X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

পদ্মা সেতুই এবারের ঈদে সেরা আনন্দ

রেজানুর রহমান
১০ জুলাই ২০২২, ১৩:০৫আপডেট : ১০ জুলাই ২০২২, ১৫:২৩

ছোট্ট প্রশ্ন।

এই ঈদে বড় আনন্দ কী?

সহজ উত্তর– গর্বের পদ্মা সেতু। দেশের ২১টি জেলার জীবনযাত্রা বদলে দিয়েছে পদ্মা সেতু। ঢাকা টু বরিশাল মাত্র সাড়ে ৩ ঘণ্টার পথ এখন। ঢাকা টু খুলনা ৩ ঘণ্টার পথ। এইতো কিছু দিন আগেও ঢাকা থেকে বরিশাল যাত্রায় সাত ঘণ্টারও বেশি সময় লাগতো। এখন সময় লাগে মাত্র সাড়ে ৩ ঘণ্টা। অর্থাৎ দিনে দুইবার ঢাকা টু বরিশাল আবার বরিশাল টু ঢাকা যাওয়া আসা করা যাচ্ছে। শুধু কী বরিশাল, খুলনা? শরীয়তপুর, পটুয়াখালী, ভোলা, পিরোজপুরসহ দক্ষিণবঙ্গের সব জেলার মানুষের যাতায়াত ব্যবস্থায় ছুঁ মন্তর ছুঁ অবস্থা ঘটে গেছে। জাদুকর যেমন ছুঁ মন্তর ছুঁ বলা মাত্রই কঠিন জিনিস সহজ হয়ে যায়, তেমনই পদ্মা সেতুর বেলায়ও হয়েছে। ৬ ঘণ্টার সময় ৬ মিনিটেই হচ্ছে।

আগে ফেরির জন্য বিরামহীন অপেক্ষায় থাকার পর কারও কারও বেলায় ফেরিতে পদ্মা পার হতে ৬-৭ ঘণ্টা সময় লাগতো। আর এখন পদ্মা সেতু দিয়ে মাত্র ৬ মিনিটে পদ্মা পার হওয়া যায়। সত্যিকার অর্থে এটি জাদুকেও হার মানিয়েছে। জাদু হলো হাত সাফাইয়ের খেলা, চোখের বিভ্রম। অবাস্তব। পদ্মা সেতু এখন পুরোটাই বাস্তব। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বসতভিটা টুঙ্গিপাড়া থেকে সড়ক পথে পদ্মা সেতু হয়ে মাত্র ২ ঘণ্টায় ঢাকায় গণভবনে এসে পৌঁছান। এ যেন এক অবিশ্বাস্য ঘটনা। টুঙ্গিপাড়া থেকে ঢাকায় আসতে আগে কতটা সময় পার হতো—এখন সে কথা ভাবলে বিস্ময়ের ঘোর সহজেই কাটবে না। ঢাকা থেকে শরীয়তপুর নাকি এখন মাত্র দেড় ঘণ্টার পথ। ঢাকার ভিতরে মিরপুর থেকে মতিঝিল আসতে কোনও কোনও দিন সময় লাগে ২ ঘণ্টারও বেশি। সেখানে ঢাকা থেকে শরীয়তপুর দেড় ঘণ্টায় যাওয়া যাচ্ছে। ঢাকায় ভোরে সড়ক পথে বরিশালের উদ্দেশে যাত্রা করে বরিশালে পৌঁছে সকালের নাশতা সারছেন অনেকে। ভাবলে এখন অবাক লাগে। এটা কি বাস্তবের গল্প? নাকি কল্পনায় আঁকা কোনও ছবি। যার ক্যাপশন দেওয়া আছে– এমন যদি হতো! না, এখন আর কল্পনা নয়। পদ্মা সেতু পুরোটাই বাস্তব। বাংলাদেশের গর্ব ও সক্ষমতার প্রতীক। পদ্মা সেতুর রূপকার মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আবারও জানাই অভিনন্দন ও কৃতজ্ঞতা। কারণ, পদ্মা সেতু তো একটি মাত্র সেতু নয়। একটি দেশের মান-মর্যাদা ও সক্ষমতার প্রতীক। এক অর্থে দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রার সাহস, প্রেরণাও বটে। একটি সময় আমরা কোনও উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়ার আগেই আর্থিক সংকটসহ নানা কারণে পিছিয়ে যেতাম। খেলায় না নেমেই ফলাফল জানিয়ে দেওয়া— আমরা পারবো না। পদ্মা সেতু সেই অচলায়তন ভেঙে দিয়েছে। এখন যেকোনও উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিলেই গর্বের পদ্মা সেতুর দৃষ্টান্ত অনুপ্রেরণা ও শক্তি হিসেবে সামনে এসে দাঁড়ায়। এত বড় পদ্মা সেতু নিজের টাকায় করা গেলো। কাজেই ভয়ের তো কিছু নেই।

পদ্মা সেতু শুধু জাতীয় পর্যায়ের উন্নয়ন প্রকল্পের ক্ষেত্রেই নয় স্থানীয় পর্যায়ের উন্নয়নের পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায়ের উন্নয়ন যাত্রায়ও সাহস ও প্রেরণার উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই তো কিছু দিন আগেও স্থানীয় পর্যায়ে কিছু করতে গেলে সম্ভব কী সম্ভব না? এই বিতর্কই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিতো। এখন কোনও বিতর্কের সুযোগ নেই। পদ্মা সেতুই সকল প্রেরণার উৎস। এত বড় পদ্মা সেতু যখন নিজেদের টাকায় করতে পেরেছি তখন স্বপ্ন যত কঠিনই হোক তা বাস্তবে রূপ দেওয়া সম্ভব।

ব্যক্তি পর্যায়েও এমন পজিটিভ ধারণা সম্প্রসারিত হচ্ছে। আবুল কালাম একজন বেকার যুবক। বেকারত্বের হতাশা তাকে প্রায় কাবু করে ফেলেছিল। কিন্তু পদ্মা সেতু চালু হওয়ায় আবুল কালাম নিজেকে বদলে ফেলেছেন। প্রসঙ্গক্রমে বললেন, নিজের ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রচণ্ড হতাশ ছিলাম। একদিন পদ্মার পাড়ে গিয়ে দাঁড়ালাম। সেতুটিকে দেখলাম। ৬ ঘণ্টার পথ ৬ মিনিটেই কাবার। তখনই মনে হলো মানুষ চেষ্টা করলে কী না হয়? বেকারত্ব ঘুচানোর নতুন সংগ্রাম শুরু করেছি। পদ্মা সেতুই আমার আত্মবিশ্বাস ও প্রেরণা।

পদ্মা সেতু শুধু কি একজন বেকার যুবকের প্রেরণা? না, তা নয়। পদ্মা সেতু দক্ষিণ বঙ্গের ২১টি জেলার মানুষের পাশাপাশি গোটা দেশের মানুষের মাঝে আস্থা ও বিশ্বাসের ভিত্তিভূমি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে তো বটেই, পর্যটনের ক্ষেত্রেও পদ্মা সেতু বিরাট সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। আগে ঈদের ছুটি কাটাতে মানুষ ছুটতো কক্সবাজারের দিকে। এবার মানুষ ছুটছে পটুয়াখালীর কুয়াকাটার দিকে। খোঁজ নিয়ে জানলাম, কুয়াকাটার হোটেল, মোটেল ইতোমধ্যে পর্যটকদের ভিড়ে মুখর হয়ে উঠেছে। কোথাও সিট খালি নেই। এই ঈদে নতুন আনন্দে জেগে উঠবে অপরূপ সমুদ্র সৈকত— আমাদের কুয়াকাটা।

দক্ষিণ বঙ্গের বিভিন্ন জেলার মানুষ যাদের সাথেই দেখা— তাদের মুখেই হাসির ঝিলিক দেখি। সবাই খুব খুশি। সবার অভিন্ন মন্তব্য- এবারের ঈদের শ্রেষ্ঠ আনন্দ হবে পদ্মা সেতু। দক্ষিণের বিভিন্ন জেলার মানুষ ঢাকায় যারা বসবাস করেন তাদের অনেকে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ঢাকায় ঈদের নামাজ পড়ে সড়ক পথে গ্রামের বাড়ির উদ্দেশে রওনা দেবেন। এখন তো আর ফেরির ঝামেলা নেই। যখন খুশি তখনই চলো গ্রামের বাড়ি। আহা! কী আনন্দ, কী আনন্দ।

আনন্দের এই শুভ সময়ে কয়েকটা জরুরি কথা বলতে চাই। আমার কথাগুলো পড়ে অনেকেই হয়তো বলবেন, আরে ভাই আমি তো এই কথাগুলো জানি। এগুলো তো নতুন কোনও কথা নয়। বহুবার শুনেছি। হ্যাঁ, আপনি, আমি কথাগুলো বহুবার শুনেছি। সবই জানি। কিন্তু মানি কয়জন? এই যে এত বড় পদ্মা সেতু হলো; দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা নতুন করে স্বাধীনতা পেলো; তাই বলে আমরা কি যা খুশি তাই করবো? নিজের টাকায় পদ্মা সেতু। কাজেই আমি এখানে উঠে গাড়ি পাশে রেখে সেলফি তুলবো, টিকটক ভিডিও বানাবো, হাডুডু খেলবো, ক্রিকেট প্র্যাকটিস করবো। মিউজিক ভিডিও বানাবো, প্রচণ্ড বেগে বাতাসের চেয়ে দ্রুত গতিতে যানবাহন চালাবো। তাই কী হয়? নিজের টাকা বলে যা খুশি তাই করবো? নিশ্চয়ই না। কথায় আছে স্বাধীনতা অর্জন করা যেমন কঠিন রক্ষা করা তার চেয়েও কঠিন। পদ্মা সেতুর ক্ষেত্রেও কথাটি প্রযোজ্য। সেতুটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে কঠোর নীতিমালা অনুসরণ করা জরুরি। কিন্তু আমরা অনেকে নিয়ম মানতে চাই না। বিশেষ করে যারা নিয়ম তৈরি করে তাদের মধ্যেই অনেকের ক্ষেত্রে নিয়ম ভঙ্গ করার প্রবণতা দেখা যায়। ভাবটা এমন আমি তো নিয়ম তৈরি করেছি। আমাকেও মানতে হবে? হ্যাঁ, আপনি নিয়ম প্রণয়ন করেছেন বলেই আপনাকেই সবার আগে নিয়ম মানতে হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এক্ষেত্রেও অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছেন। তিনি তো দেশের প্রধানমন্ত্রী। দেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী ব্যক্তি। পদ্মা সেতু পারাপারের সময় তিনি তো টোল নাও দিতে পারতেন। অথচ তিনি নিজ হাতে পদ্মা সেতুতে টোল দিয়েছেন। তিনি জানিয়ে দিয়েছেন— নিয়ম সবার কাছেই সমান।

বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রা এমন একটা উচ্চ আসনে পৌঁছে গেছে যে এখন দরকার নিয়মকে গুরুত্ব দেওয়া। যেখানে যে নিয়ম সেটা সকলকেই জানতে হবে, মানতেও হবে। নিয়ম জানলাম কিন্তু মানলাম না তাহলে কাজের কাজ কিছুই হবে না। আমি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, আমার গাড়িতে সরকারি স্টিকার আছে। আমাকেও কি টোল দিতে হবে? আমি ক্ষমতাসীন দলের বড় নেতা, অথবা আমি দেশের একজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আমার কথায় সাধারণ মানুষ ওঠে-বসে। আমি তো এক অর্থে দেবতা। আমাকেও নিয়ম মানতে হবে? আমাকেও টোল দিতে হবে?— এই ধরনের মানসিকতা যারা পোষণ করেন তাদের একটা মানসিক বদল প্রয়োজন।

সত্যি কথা বলতে কী, গর্বের পদ্মা সেতু এক নতুন বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে। পদ্মা সেতুকে ঘিরে উভয় পারের রাস্তাঘাট, অন্যান্য স্থাপনা এতটাই ঝলমলে সাজানো গোছানো যে পুরো দেশটাকে এমন অপরূপ দেখার ইচ্ছে জাগছে। আমরা যদি আজ থেকে নিজেদের প্রতিটি কাজে সৎ থাকার চেষ্টা করি, নিয়ম মেনে চলি, যার যা দায়িত্ব সততা ও বিশ্বাসের সাথে লালন ও পালন করার চেষ্টা করি তাহলে পদ্মা পারের সাজানো মিনি বাংলাদেশের মতো পুরো দেশটাই নতুনভাবে জেগে উঠবে। হ্যাঁ, ইচ্ছা করলেই আমরা তা পারবো। এ জন্য প্রয়োজন নিয়ম এবং নিয়মকে গুরুত্ব দেওয়া, শ্রদ্ধা জানানো। পৃথিবীর যে দেশগুলো উন্নত হয়েছে সেই দেশগুলোর প্রধান প্রাণশক্তি হলো নিয়ম। দশটা মানে ৯টা ৫৯ মিনিট। জাপানের রাজধানী টোকিও থেকে একবার কোবে শহরে যাচ্ছিলাম ট্রেনযোগে। বুলেট ট্রেন। প্রচণ্ড গতিতে ছুটছে। হঠাৎ ট্রেনের শব্দযন্ত্রে জাপানি ভাষায় একই কথা বারবার উচ্চারিত হচ্ছিল। বুঝতে না পেরে ট্রেনের অ্যাটেনডেন্টকে জিজ্ঞেস করলাম– ঘটনা কী? কোনও সমস্যা? অ্যাটেনডেন্ট মুখে হাসি ছড়িয়ে বললেন, ট্রেনটি কোবে শহরে পৌঁছাতে ৫ মিনিট দেরি করবে। তাই যাত্রীদের কাছে ক্ষমা চাইছে ট্রেনচালক।

সেদিন বিস্মিত হয়েছিলাম। ট্রেন পাঁচ মিনিট লেট। এটা কোনও ঘটনা যে ক্ষমা চাইতে হবে? হ্যাঁ, এটাই ঘটনা। এটাই নিয়ম। জাপানিরা নিয়ম মানে বলেই বিশ্বে এতটা উন্নত করতে পেরেছে নিজেদের।

আর আমাদের দেশে নিয়ম ভাঙাই যেন নিয়ম। যে যত নিয়ম ভাঙতে পারে সে তত ক্ষমতাধর ব্যক্তি। তাকে কিছু বলা যাবে না। বললে হয়তো হিতে বিপরীত হতে পারে।

এই যে আশঙ্কা তা দূর হওয়া প্রয়োজন। নিয়ম রক্ষার কাজে যারা জড়িত থাকবেন তাদের নিরাপত্তা বিধান এবং তাদের প্রতি যথার্থ শ্রদ্ধা প্রদর্শনের পরিবেশ নিশ্চিত করা জরুরি।

পদ্মা সেতুই এবারের ঈদে নতুন আনন্দ হয়ে উঠেছে। পদ্মা সেতু প্রমাণ করেছে— নিয়ম মানলে কঠিন স্বপ্নও বাস্তবে রূপ দেওয়া সম্ভব। কাজেই আসুন নিয়ম পালনের ব্যাপারে সকলে আরও সচেতন হয়ে উঠি। নিয়ম পালনের অঙ্গীকারই হোক এবারের ঈদ আনন্দের সেরা অর্জন। শুভ কামনা সবার জন্য। ঈদ মোবারক।

লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক- আনন্দ আলো।

/এমএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
ইসরায়েলে প্রতিশোধমূলক রকেট হামলা হিজবুল্লাহর
ইসরায়েলে প্রতিশোধমূলক রকেট হামলা হিজবুল্লাহর
হুন্ডির মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকা পাচার, গ্রেফতার ৫
হুন্ডির মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকা পাচার, গ্রেফতার ৫
ন্যাটোর কোনও দেশ আক্রমণের পরিকল্পনা নেই রাশিয়ার: পুতিন
ন্যাটোর কোনও দেশ আক্রমণের পরিকল্পনা নেই রাশিয়ার: পুতিন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ