গরু নিরাপত্তা বাহিনী অথবা গরুরক্ষী বাহিনী। এর ইংরেজি হলো—ক্যাটল সিকিউরিটি ফোর্স। হয়তো আপনারা প্রশ্ন করতে পারেন, এই বাহিনীটি কোথায় বা কোন দেশের? বাংলাদেশে এ রকম বাহিনীর কথা তো শোনা যায়নি। আসলে এই বাহিনীটির নাম দিয়েছে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস। তারা ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স বা বিএসএফ-এর নাম কৌতুক করে বলেছেন ক্যাটল সিকিউরিটি ফোর্স বা সিএসএফ। তারা কেন এ রকম নাম দিয়েছে, সেই যুক্তিটি এবার শোনা যাক।
ভারতীয় এই ইংরেজি দৈনিকের সাম্প্রতিক অনলাইন প্রতিবেদন অনুযায়ী বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফ-এর প্রধান কাজ হলো গরু চোলাচালান প্রতিরোধ করা। বিশেষ করে, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে ৯৯৫ কি. মি. সীমান্তে তাদের গরুরক্ষার তৎপরতা দেখার মতো। ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং বাংলাদেশে গরুপাচার বন্ধের ঘোষণা দেওয়ার পর তাদের দাবি ভারত থেকে বাংলাদেশে গরু চোরাচালান ৭০ ভাগ কমেছে।
২০১৪ সালের এপ্রিলে ভারতের কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে গরু পাচার বন্ধে বিএসএফকে নির্দেশনা দিয়েছিলেন। তারপর এই গরু পাচারের নিম্নগতি। এর আগে ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রতিবছর গড়ে ২০ থেকে ২২ লাখ গরু আসত। আর গত বছরে তার পরিমান দাঁড়িয়েছে মাত্র দুই থেকে আড়াই লাখ। বিএসএফ-এর এই সাফল্যে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিশ্চয়ই খুশি!
আর ভারতের দিক থেকে সীমান্ত হত্যা মানে বিএসএফ-এর হাতে বাংলাদেশি হত্যার মূল কারণ হিসেবে গরু চোরাচালানকেই দায়ী করা হতো। তাই আমরাও খুশি হতাম যদি গরু চোরাচালান কমে যাওয়ার সঙ্গে-সঙ্গে সীমান্ত হত্যাও কমে যেত। কিন্তু চিত্র পুরোপুরি উল্টো। গরু চোরাচালান কমেছে আর বেড়েছে সীমান্ত হত্যা, বাংলাদেশের নাগরিক হত্যা। বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাব অনুযায়ী গত তিন বছরের মধ্যে ২০১৫ সালে বিএসএফ-এর হাতে সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হয়েছেন।
তাদের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৩ সালে মোট ২৭ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেন বিএসএফ সদস্যরা। ২০১৪ সালে হত্যা করা হয়েছে ৩৩ জন। ২০১৫ সালে নিহত হয়েছেন ৪২ জন বাংলাদেশি। চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে তিনজন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে বিএসএফ। আর বিএসফ গত বছরে ক্রসবর্ডার ‘ক্রিমিনাল’ হত্যার যে হিসাব দিয়েছে, তাতে এই ক্রিমিনালরা হলেন গরু পাচারকারী।
২০১১ সালে বিএসএফ ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) পাচারকারী ও অবৈধপথে সীমান্ত পার হওয়া মানুষদের ক্ষেত্রে প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার না করার চুক্তি স্বাক্ষর করে। কথা ছিল, আক্রান্ত না হলে আক্রমণ করবে না বিএসএফ। আর সীমন্ত অপরাধ দমন করা হবে যৌথটহলের মাধ্যমে। এ চুক্তির পরবর্তী দুই বছর সীমান্ত হত্যা কমে এলেও এখন তা আবার বাড়ছে। রাজনাথ সিং-এর গরুরক্ষা আন্দোলন শুরুর পর বাংলাদেশের সীমান্তের মানুষের জীবন রক্ষার প্রতিশ্রুতিতে ভাটা পড়েছে।
বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের মধ্যে ৬৪টি বর্ডার আউটপোস্টের (বিওপি) গরু পাচারের জন্য ঝুকিপূর্ণ বিবেচনা করে তা রোধে তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে বিএসএফ। এসব জায়গা থেকেই ৮০ ভাগ গরু বাংলাদেশে পাচার হয় তথ্য দিয়েছেন তারা। তথ্য-উপাত্ত এবং বিএসএফ-এর তৎপরতায় এটা এখন নিশ্চিত যে ভারতের দৃষ্টিতে বাংলাদেশ ভারত ক্রসবর্ডার ক্রিমিনাল হলেন গরু পাচারকারীরা। আর তাদের হত্যা করাই ক্রসবর্ডার অপরাধ দমনের প্রধান কাজ!
গরু চোরাচালানের যারা রিং লিডার, তারা কিন্তু মারা পড়ছেন না। যারা গরুর ক্যারিয়ার বা রাখাল তারাই মারা পড়ছেন। ভারতের এই গরু কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের নয়। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশ থেকে গরু আনা হয় পশ্চিমবঙ্গে। এ সব গরু আসে ৪ শ থেকে ৫ শ কি.মি দূর থেকে। তাহলে প্রশ্ন—মূল জায়গা থেকে গরু আসা বন্ধ হয় না কেন? ভারতে যারা গরুপাচারের সঙ্গে জড়িত, তাদের ব্যাপারে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয় না কেন?
ভারতের মানবাধিকার নেতা কীরিটি রায়ের সঙ্গে এ নিয়ে আমার বেশ কয়েকবার টেলিফোনে কথা হয়েছে। তিনি মনে করেন, গরুপাচার একটি অজুহাত মাত্র। আসলে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে যারা ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী হিসেবে কাজ করেন, তারা বাংলাদেশি নাগরিকদের শত্রু রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করেন। তাই তারা কোনওরকম বিবেচনা না করেই সরাসরি গুলি করেন। কিশোরী ফেলানী তো কোনও পাচারকারী ছিলনা। তারপরও কেন তাকে গুলি করা হলো? কেন লাশ ঝুলে থাকল কাঁটাতারের বেড়ায়?
কিরিটি রায়ের এই কথার প্রমাণ পাওয়া যাবে, আরেকটি পরিসংখ্যানে। আর তা হলো—তিন বছরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসফ-এর হাতে মোট ১০২ বাংলাদেশি নিহত হলেও একই সময়ে পাকিস্তান-ভারত সীমান্তে বিএসএফ-এর হাতে পাকিস্তানি নিহত হয়েছেন মাত্র ৪৬জন। নিহত পাকিস্তানি নগারিকদের বড় একটি অংশ সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য। বাংলাদেশের নিহত নাগরিকরা সবাই নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ।
পাকিস্তানকে ভারত শত্রু রাষ্ট্র হিসেবে বিবেচনা করে। আর বাংলাদেশকে বন্ধু রাষ্ট্র। এই কি তার নমুনা?
ভারতের কিছু বিএসফ কর্মকর্তা এখন বলছেন, অস্ত্র, জাল টাকা, মাদকপাচার এবং সীমান্ত ভিত্তিক জঙ্গি তৎপরতা বন্ধে তারা কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারছেন না। কারণ তাদের কেন্দ্রের নির্দেশে এখন গরুপাচার রোধ এবং পাচারকারীদের( রাখাল) দমনেই ব্যস্ত থাকতে হয়। তারা বলেন, আমাদের তো এখন কৌতুক করে বলা হয় ক্যাটল সিকিউরিটি ফোর্স বা সিএসএফ। তাই নানা ধরনের সীমান্ত অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে। সেদিকে আমাদের খেয়াল রাখার সময় নেই।’ আর ভারতীয় সংবাদ মাধ্যমই জানাচ্ছে, এই সুযোগে বিএসএফ-এর কিছু অসাধু সদস্য ফুলে ফেপে উঠছে অবৈধ কাজকারবারে সহযোগিতা করে।।
আশঙ্কা করা হচ্ছে, সীমান্তে এই হত্যাকাণ্ড বন্ধ না হলে সীমান্তভিত্তিক জঙ্গি কার্যক্রম বাড়তে পারে। আর তা বাংলাদেশ-ভারত দুই দেশের জন্যই ক্ষতিকর হতে পারে। গরু রক্ষায় ভারতের এই অতি মনোযোগ শেষ পর্যন্ত বুমেরাং হয়ে যেতে পারে। মানুষ-রক্ষায় মনোযোগী না হলে হিতে বিপরীত হতে পারে।
বাংলাদেশকে তো ভারত মোটামুটি খাঁচাবন্দি করে ফেলেছে। বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে ৪ হাজার ৯৬ কি.মি. সীমান্তের ৩ হাজার ৪০৬ কি.মি. এলাকায় এরইমধ্যে ভারত তিন মিটার উচ্চতার কাঁটাতারের বেড়া দিয়েছে। আর কতটুকুই বা বাকি আছে। এরপরও বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতের কিসের এত ভয়? কেন কাশ্মীর সীমান্তে দায়িত্ব পালনকারী অবাঙালি বিএসএফ সদস্যদের বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে নিয়োগ দেওয়া হয়। এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা জরুরি।
লেখক: সাংবাদিক
ইমেইল:[email protected]