ছোটকাল থেকে আমাদের শেখানো হয়– ‘পড়ার সময় পড়া, খেলার সময় খেলা’। খেলাধুলা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী। ক্লাস সিক্সের সবচেয়ে দুষ্টু ছেলে বল্টু তার শিক্ষককে বললো– ‘স্যার আমি কিন্তু প্রতিদিন ফুটবল, ক্রিকেট আর টেনিস খেলি!’
স্যার অবাক হয়ে বললেন– ‘ভালো কিন্তু খেলা শুরু আর শেষ হয় কখন?’
বল্টু উত্তর দিলো– ‘স্যার খেলা শুরুর নির্দিষ্ট কোনও সময় নেই! মা কিংবা বাবার মোবাইল যেটা আগে হাতে পাই সেটা নিয়ে খেলা শুরু করি। শেষ হয় যখন চার্জ চলে যায়!’
খেলারাম যতই বলুক খেলা হবে, চার্জ চলে গেলে আর খেলা যায় না। খেলা আর যৌবন সমার্থক। গানে আছে– যৌবন জোয়ার একবার আসে রে.. চলে গেলে আর আসে না।
একদা বিশ্বকাপ ফুটবলে হাঙ্গেরি এবং উরুগুয়ের ব্যাপক প্রভাব ছিল। বলা যায়, এখন তাদের সেই আগের চার্জ নেই। রাশিয়া কখনও ফুটবল বিশ্বকাপ জেতেনি। ব্যঙ্গ করে বলা হতো ব্রাজিল যখন আইস হকি খেলা শুরু করবে, রাশিয়া তখন বিশ্বকাপ ফুটবলে চ্যাম্পিয়ন হলেও হতে পারে।
২০২২-এর বিশ্বকাপে ইতালি ছিল না আর ২০২৩-এর ক্রিকেট বিশ্বকাপে একসময়ের চ্যাম্পিয়ন ওয়েস্ট ইন্ডিজ বাছাই পর্ব থেকে বাদ পড়ে যায়। খুব ভালো খেললেও আপনি যে বিশ্বকাপ জিতবেন এমন কোনও কথা নেই। সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ গোলরক্ষক ধরা হয় সোভিয়েত রাশিয়ার লেভ ইয়াসিনকে। জার্মানির অলিভার কানও কম যান না। তারা কেউ বিশ্বকাপ জেতেননি। বিশ্বকাপ জিততে পারেননি ব্রাজিলের জিকো, ইতালির পাওলো মালদিনি, জর্জ বেস্ট কিংবা ফ্রান্সের মিশেল প্লাটিনির মতো বিশ্বখ্যাত ফুটবলাররা। খেলারামের ‘খেলা হবে’র হুংকার কখনও সখনও হুংকার হয়েই থাকে। কিছু থাকে ব্যর্থতা থেকে উদ্ভূত কৌতুক বা বেদনার স্মৃতি হয়ে। যেমন–
এক ছেলে বাংলাদেশ ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডে রিং দিয়েছে। এরপরের কথোপকথন–
– হ্যালো সাকিব আল হাসান কি দলের সাথে আছেন নাকি ফিতা কাটতে গেছেন?
– ফিতা কাটা বা বিজ্ঞাপন করতে কোথাও যায়নি। সে ভারত থেকে ঢাকার মিরপুরে গিয়ে একা একা প্র্যাকটিস করছে।
– কেন? বাংলাদেশ দলের কোচ নেই?
টেলিফোন রেখে দেওয়া হলো। দুই দিন পরে আবারও রিং দিয়েছে ওই ছেলে।
– হ্যালো ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ড? সাকিব আল হাসান আছেন?
– জি-না, সে এখন ইডেন গার্ডেনে ব্যাট করছে!
– দয়া করে কলটা কাটবেন না। আশরাফুলের মতো সে এখনই আউট হবে। তখন না হয় তাকে একটু ডেকে দেবেন।
খেলায় ধারাবাহিক ব্যর্থতা কিংবা পরাজয় বাজে পরিণতি ডেকে আনতে পারে। আসলে যেকোনও খেলার ফলাফলই আসল। গানের কথায় আছে– উইনার্স টেক ইট অল। অনেকটা এমন– বিজয়ীর হাত ধরে হাঁটে/ পৃথিবীর সব সুখ হাসি/ তুনাবী তোমার জন্য শুধু পরাজিত হতে ভালোবাসি।
গানে বা কবিতায় যেমনই বলা হোক, দিন শেষে জয়টাই আসল। ইতিহাসে যেমন বীরদের কথা লেখা থাকে ঠিক তেমনি পরাজিত মানুষের কোনও বন্ধু থাকে না। ক্রিকেট মাঠে ২২ গজের পিচে ২২ জন খেলোয়াড় আর তিন জন কোচ থাকলেও গ্যালারিজুড়ে থাকা দর্শকরা কোচ বনে যান। রাজনীতির খেলাতেও তা-ই। রাজনীতিবিদরা যতই খেলুক, দেশজুড়ে জনগণ হয়ে যায় কোচ কিংবা বুদ্ধিজীবী। তাই জমে ওঠে জনগণের ধাঁধাঁ খেলা।
যেমন-
এক. পৃথিবীতে বহুদিন ধরে কোন খেলা চলছে?
– যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা। একদিকে নিরন্ন মানুষ আরেক দিকে এটম/এ কি খেলা চলছে হরদম...
দুই. দেশজুড়ে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির যে খেলা চলছে তাতে জিতবে কে?
– যে-ই জিতুক, হারবে জনগণ।
তিন. জনগণ আসলে কে?
– দূর্বা ঘাস। আনন্দ নিয়ে এক হাতি যখন আরেক হাতির সাথে রমণ করে তখন যেমন দূর্বাঘাস পিষ্ট হয়, এক হাতি যখন আরেক হাতির সাথে মারামারি করে তখনও দূর্বাঘাস পিষ্ট হয়। জন্মই তাদের আজন্ম পাপ।
চার. সবচেয়ে বড় মিথ্যা কী?
– জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস। আসল ক্ষমতার উৎস টাকা এবং বন্দুক।
পাঁচ. আমেরিকার ‘স্যাংকশন’ আসলে কী?
– বিএনপির কাছে ক্ষমতায় যাওয়ার আশাবাদ। যদিও একসময় তাদের দেয়াল লিখন ছিল এমন– বিদেশে আমাদের বন্ধু আছে প্রভু নেই। আর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের কাছে ‘স্যাংকশন’ হচ্ছে ‘বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে নগ্ন হস্তক্ষেপ’ এবং ‘উন্নয়নে বাধা দেওয়ার পদক্ষেপ।’
যদিও তাদের কাছে রাশিয়া বন্ধু, চীন বন্ধু কিংবা ভারত বন্ধুদের হাতছানি আছে। ‘স্যাংকশন’ খেলাটা কেবল শুরু হয়েছে, কীভাবে শেষ হয়, কে জেতে আর কে হারে তা এখন পর্যন্ত নির্ণীত নয়।
ছয়. বাজারে এখন কোন পাত্ররা দাপিয়ে খেলছে?
– ডিম, আলু আর পেঁয়াজের আড়তদারের ছেলেরা। খেলা এখন বাজারে, খেলা এখন রাস্তাঘাটে আর স্যাংকশনে।
সাত. রাজনীতির খেলায় জনগণের করণীয় কী?
– বিধাতার কাছে দুই হাত তুলে পানাহ চাওয়া। আগামী পাঁচ বছর যাদের দ্বারাই আমরা ‘খেলিত’ হই, খানিক ভালো থাকি যেন।
লেখাটা শুরু হয়েছিল খেলা নিয়ে। দুঃখ এই যে খেলা, ধর্ম কিংবা বাণিজ্য কোনও কিছুই রাজনীতির বাইরে না। জয়-পরাজয় সেখানে এক বড় নিয়ামক। বহু আগে কবি হেলাল হাফিজ লিখেছিলেন– ‘ভুল রমণী ভালোবাসার/ ভুল নেতাদের জনসভার/ তাসের খেলায় দুইটি জোকার নষ্ট হবার কষ্ট আছে/ কষ্ট নেবে কষ্ট?’
সাধারণ মানুষ কষ্টে থাকে। সামান্য একটু ভালো থাকার জন্য তারা কতটা বিসর্জন দেবে? খোলাবাজার থেকে চাল কিনতে না পারলে তাদের লাইনে দাঁড়াতে হয় টিসিবির ট্রাকের পেছনে। পেঁয়াজ আর কাঁচা মরিচ ডলে ভাত খাবার উপায় নেই। দাম বেড়েছে অনেক। আলু ভর্তাও এখন দামি খাবার। গরিবের প্রোটিন ডিমও নাগালের বাইরে। জনগণের সাথে সিন্ডিকেট করে যারা দ্রব্যমূল্য নিয়ে খেলছে তারা থেকে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর কোনও খেলাতেই যেন সুখ নেই। এমনকি ফুটবল বা ক্রিকেট খেলা দেখেও আনন্দ নেই তাদের। পরাজয় আর কত ভালো লাগে? তাই নিচের কৌতুকটা খেয়াল করুন–
এক দম্পতির বিবাহ বিচ্ছেদ হয়েছে। দম্পতির একমাত্র ছেলের কাছে বিচারক জানতে চাইলেন–
– বাবু তুমি কি বাবার সাথে থাকবে?
– না। বাবা শুধু পেটায়।
– তাহলে নিশ্চয়ই মা’র সাথে থাকবে?
– না। সুযোগ পেলে মাও আমাকে পেটায়।
– তাহলে তুমি কার সাথে থাকবে?
– আমাকে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের কাছে পাঠান। ওরা ভালো। সুযোগ পেলেও ওরা পেটাতে পারে না!
হৃদয়ভাঙা পরাজয় শেষে হাতছানি দেবে নতুন খেলা। জয়ের আশায় আবার মাঠে নামবে খেলোয়াড়রা। রাজনীতি আর রাস্তার খেলাও চলবে। খেলা থামবে না। খেলারাম হুংকার দিতে থাকবে ‘খেলা হবে’। সাধারণরা খেলায় অংশ নিক আর না নিক, তারা চায় তাদের পেট ভরা থাক। তাদের জন্য নিবেদিত কবিতা–
মাথা কিনে নেয়া ধনীদের খেলা
কেউ নিতে চায় মাথা কেটে!
বিপ্লব মেনে রাষ্ট্র কী আসে
গরিবের ঘরে হেঁটে?
ধর্ম আর রাজনীতি বাড়ে সর্বহারার পেটে...
লেখক: রম্যলেখক