X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

আয়কর নথির যেসব বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া জরুরি

মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন
০৬ নভেম্বর ২০২৩, ১৭:৩০আপডেট : ০৬ নভেম্বর ২০২৩, ১৭:৩০

নভেম্বর মাস আসলেই করদাতাদের মধ্যে ‘আয়কর রিটার্ন’ সম্পর্কে আলোচনা শুরু হয়। যদিও রিটার্ন জমা দেওয়ার সময় শুরু হয় আয় বছরের পরবর্তী জুলাই মাস থেকে। অনেকেই চেষ্টা করেন কর বছরের প্রথম থেকে রিটার্ন জমা দিতে বা যাদের একান্ত প্রয়োজন তারা দিয়েও থাকেন।

কিন্তু অধিকাংশ করদাতাই অপেক্ষায় থাকেন নভেম্বর মাসের জন্য। আবার অনেকে নভেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহের জন্য অপেক্ষায় থাকেন। এই দুই ধরনের চিন্তার বাইরে কিছু সংখ্যক আছেন যারা সত্যিই সময়ের অভাবে শেষ মুহূর্তের জন্য অপেক্ষা করেন।

তাহলে করদাতাদের মধ্যে তিন ধরনের বৈশিষ্ট্য দেখা গেলো। এই তিন বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির বৈশিষ্ট্যের করদাতাদের অভিপ্রায় জানতে চেষ্টা করি। তাদের মধ্যে রিটার্ন জমা দেওয়ার সময়ের পার্থক্য সম্পর্কে কিছু নেতিবাচক কথা প্রচলিত আছে।

কর বছরের প্রথম দিকে রিটার্ন জমা দিতে চান না এমন করদাতাদের অভিমত বিস্তর। যেমন, বছরের শুরুতে রিটার্ন জমা দিলে আয়কর অফিস রিটার্নের বিষয়ে নানা ধরনের প্রশ্ন করেন, রিটার্ন যাচাই করেন; করদাতাকে কিছুটা বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখোমুখি করেন, যেদিন রিটার্ন জমা দেন সেদিনই প্রাপ্তি স্বীকার দিতে চান না। অনেক অফিস থেকে বলে– ‘আগামীকাল আসেন, আপনি এত টাকা আয় করেন, ট্যাক্স কম কেন?’  

কোনও অফিস থেকে করদাতাকে কিছুই বলেন না। ‘পরে আসেন’ বলে রেখে দেন, ‘পরে যোগাযোগ করে প্রাপ্তি স্বীকার নিয়েন’, ‘স্যার অফিসে আসেননি’; কাউকে কাউকে দুই-চারশ টাকা হাতে দিলে বলেন– ‘একটু বসেন, এখনই নিয়ে যান’ ইত্যাদি নেতিবাচক কথা লোকসমাজে বিরাজমান।

আবার নভেম্বর মাসে বা কর বছরের শেষের দিকে রিটার্ন জমা দেওয়া করদাতাদের ধারণা হলো– এই সময়ে কর অফিসগুলো ব্যস্ত থাকে। অযথা হয়রানি করা বা অতিরিক্ত প্রশ্ন করার সুযোগ থাকে না বা তাৎক্ষণিক যাচাই করার সুযোগ থাকে না। তাই এই জাতীয় ধারণা নিয়ে করদাতারা বছরের শেষ প্রান্তে এসে রিটার্ন জমা দিতে আগ্রহী।

অবশ্য সব কর অফিসের চিত্র এমন নয়। তবে করদাতাদের অভিযোগও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। কিছুটা সত্য। ‘নিম্নশ্রেণি’র কিছু কর্মচারী এমন আচরণ যে করেন না, তাও একেবারে বাদ দেওয়া যায় না। এই থেকে একটা উপলব্ধি করা যায়, করদাতারা যদি নির্বিঘ্নে শঙ্কাহীনভাবে, হয়রানিমুক্তভাবে কর অফিসে যেতে পারতেন, তাহলে অবশ্যই করদাতার সংখ্যা যেমন বৃদ্ধি পেতো, রাজস্ব আদায়ে কিছুটা হলেও গতি আসতো।

আসি শিরোনাম প্রসঙ্গে। আয়কর আইন ২০২৩ (২০২৩ সালের ১২ নং আইন)-এর ৩০ ধারা মোতাবেক ৭টি খাতের আয়ের ওপর কর দেওয়ার বিধান রয়েছে।

যেমন– ১) বেতন খাতের আয়, ২) ভাড়া হতে আয়, ৩)  কৃষি খাতের আয়, ৪) ব্যবসা খাতের আয়, ৫) মূলধনী আয়, ৬) আর্থিক পরিসম্পদ খাতের আয় ও ৭) অন্যান্য খাতের উৎস হতে আয়।

করদাতাগণ এই খাতগুলো থেকে অর্জিত আয় করসীমা অতিক্রম করলে কর দিতে হয়, রিটার্ন প্রস্তুত ও জমা দিতে হয়, দিতে হয় সংশ্লিষ্ট নানা তথ্যাদি। এই ক্ষেত্রে যাদের প্রথম রিটার্ন তাদেরকেও বেশ সতর্কতার সঙ্গে রিটার্ন জমা দিতে হয়। অনেকের মধ্যে ধারণা আছে সব সম্পদ ও দায় রিটার্নে দেখালে ঝামেলা হতে পারে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে না দেখালেই ঝামেলা পড়তে হয়!

সকল শ্রেণির করদাতার রিটার্ন ফরম প্রস্তুতের সময় নির্বিঘ্নে বর্ণিত বিষয়গুলোর প্রতি বিশেষ সতর্কতার অবলম্বন করা জরুরি।

যেমন: সম্পদের স্বচ্ছ বিবরণ– আপনার ব্যক্তিগত আয়, ব্যাংকে গচ্ছিত টাকা, সঞ্চয়পত্র, শেয়ার, ডিবেঞ্চার এবং অন্যান্য স্থাবর সম্পদের বিবরণ আয়কর রিটার্ন দাখিলের সময় সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরুন। আপনি যদি নিজের সম্পত্তির বিবরণ স্বচ্ছতার সাথে আয়কর নথিতে তুলে না ধরেন তাহলে অনেক বড় ধরনের ভুল করবেন। কোনও সম্পদের বিবরণ রিটার্নে প্রদর্শন না করলে, আপনার শ্রমের টাকায় কেনা হলেও তা অপ্রদর্শিত সম্পদ হিসেবে গণ্য হবে এবং সেটি বৈধতা হারাবে। এমনকি আপনি আইনত জটিলতায়ও পড়তে পারেন।

যথাযথ দলিলাদি দাখিল: আপনারা জানেন যখন আয়কর রিটার্ন দাখিল করা হয় তখন তার সাথে কিছু প্রমাণ এবং কাগজপত্র দিতে হয়। যেমন: চাকরিজীবী হলে বেতন এবং সুযোগ-সুবিধার বিবরণ, ব্যাংকে টাকা জমা থাকলে সুদ/মুনাফা পাওয়া টাকার সার্টিফিকেট; সঞ্চয়পত্র ক্রয় করা থাকলে ৩০ জুন তারিখের প্রত্যয়নপত্র, সম্পত্তি ক্রয় থাকলে দলিলাদি; দান থাকলে প্রমাণপত্র ইত্যাদি। আয়, ব্যয়, সম্পদ ও দায়ের ক্ষেত্রে যথাযথ দলিল দাখিল করা আবশ্যক। নতুবা তথ্যের অভাবে অতিরিক্ত করদায় সৃষ্টি হতে পারে।

সঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করে রিটার্ন ফরম পূরণ: আপনি চাইলে নিজে রিটার্ন ফর্ম পূরণ করে জমা দিতে পারেন অথবা একজন অভিজ্ঞ আয়কর আইনজীবীর পরামর্শ নিতে পারেন। তবে আইনজীবীর কাছে আপনার সকল তথ্য সঠিকভাবে দেবেন। কোনও তথ্য গোপন করলে বা সঠিক তথ্যের অভাবে আপনার রিটার্ন যথাযথভাবে প্রস্তুত করা না হলে আপনি আইনি জটিলতায় পড়তে পারেন।

প্রথমবার রিটার্নের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকা: যারা প্রথমবার রিটার্ন জমা দিচ্ছেন তারা ফরম পূরণের ক্ষেত্রে সতর্ক থাকুন। সম্পদের বিবরণ দাখিলের ক্ষেত্রে স্বচ্ছ থাকুন। কোনও কিছু লুকানোর চেষ্টা করবেন না। অনেকে মনে করেন, প্রথমবার সব সম্পত্তির বিবরণ না দিয়ে ধাপে-ধাপে প্রতিবছর সেগুলো দেখাবেন। কিন্তু এটি একটি ভুল ধারণা। বিষয়টি যদি আয়কর কর্তৃপক্ষের নজরে আসে তাহলে আপনি আইনি জটিলতায় পড়তে পারেন। কারণ, আপনার কর নথি পাঁচ থেকে সাত বছরের মধ্যে কোনও ফাইল অডিট হতে পারে। সেক্ষেত্রে গরমিল

পাওয়া গেলে বড় অঙ্কের জরিমানা হতে পারে। ‘ধরুন, কারও তিন কোটি টাকা আছে বা দুটি গাড়ি আছে বা কৃষি জমি আছে বা একাধিক ফ্ল্যাট আছে বা এমন কিছু সম্পত্তি আছে আপনি ছাড়া অন্যরা জানে না। এই সম্পত্তিগুলো রিটার্ন দাখিলের সময় দেখালেন না। যদি আয়কর অফিসের তদন্তের মাধ্যমে এটি বেরিয়ে আসে, তাহলে করনথি সংক্রান্ত মামলায় সহজে পার পাওয়া যাবে না। এই ক্ষেত্রে বড় ধরনের জরিমানায় পড়তে হতে পারে।

আয়-ব্যয়ের সঙ্গতিপূর্ণ রিটার্ন দাখিল: আয়কর রিটার্ন দাখিলের সময় আপনি আয় যেমন দেখাবেন, তেমনি ব্যয়ও দেখাবেন। আয়ের সাথে ব্যয়ের সামঞ্জস্য থাকাটা জরুরি। আপনার জীবনযাত্রার ব্যয়, আয়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হলে সন্দেহ তৈরি হবে এবং অতিরিক্ত কর পরিশোধ করার ঝুঁকি তৈরি হবে।

নিয়মিত আয়ের বাইরে কৃষি আয় এড়িয়ে না যাওয়া: অনেকের নিয়মিত আয়ের বাইরে পৈতৃক সম্পত্তি বা গ্রামের কৃষি জমি থেকে কৃষি আয় থাকে। এরূপ আয় থাকলে সেটি সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরতে হবে। আপনার যদি কৃষি জমি থেকে শস্য, বা গাছ বিক্রি বা মৎস্য উৎপাদন বা অন্যান্য কোনও আয় থাকে, সেখান থেকে উৎপাদন খরচ বাদ দিয়ে বাকি টাকার ওপর কর দিতে হবে। আর আপনার যদি শুধু কৃষিই একমাত্র আয়ের উৎস হয়, তাহলে নিয়মিত কর রেয়াত ছাড়াও ২ লাখ টাকা অতিরিক্ত কর ছাড় পাবেন।

নিয়মিত আয়ের বাইরে বাড়ি ভাড়া থেকে আয়: অনেকে নিয়মিত আয়ের খাত ছাড়া বাড়ি বা ফ্ল্যাট বা খালি ভূমি ভাড়া দিয়ে আয় করে থাকেন। তাহলে সেটি আয়কর রিটার্নে অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে। সেক্ষেত্রে যে অংশটি আপনি ভাড়া দিয়েছেন, সেটির আয়তন কত তা উল্লেখ করতে হবে। মনে রাখবেন আইন মোতাবেক ভাড়া বাবদ প্রতিমাসে ২৫ হাজার টাকার বেশি আয় হলে বাড়ির মালিককে সেটি ব্যাংক হিসাবে জমা রাখতে হবে। সেটি না করলে জরিমানা করার বিধান রয়েছে।

মূলত আয়কর রিটার্ন এখন প্রতিটি নাগরিকের একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল। যেনতেনভাবে এই দলিল প্রস্তুত করা বা আয়কর অফিসে জমা দেওয়ার মানসিকতা থেকে বের হয়ে আসতে হবে। আপনার জানামতো সব তথ্য আয়কর নথিতে যথাযথভাবে উপস্থাপন করুন। এতে আপনি একজন সম্মানিত করদাতা হিসেবে আইনি সুরক্ষা পাবেন।

লেখক: কর আইনজীবী
[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ, খুলনা-মোংলায় শুরু হচ্ছে ট্রেন চলাচল
পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষ, খুলনা-মোংলায় শুরু হচ্ছে ট্রেন চলাচল
টিভিতে আজকের খেলা (২ মে, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২ মে, ২০২৪)
ঘরের মাঠে পিএসজিকে হারিয়ে এগিয়ে থাকলো ডর্টমুন্ড
চ্যাম্পিয়নস লিগ সেমিফাইনালঘরের মাঠে পিএসজিকে হারিয়ে এগিয়ে থাকলো ডর্টমুন্ড
ইজিবাইক ছিনতাইয়ের সময় স্থানীয়দের পিটুনিতে একজনের মৃত্যু
ইজিবাইক ছিনতাইয়ের সময় স্থানীয়দের পিটুনিতে একজনের মৃত্যু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ