X
বুধবার, ০১ মে ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

ক্রীড়ায় নতুন মন্ত্রী নাজমুল হাসান পাপন, পরিবর্তন কি আসবে?

তানজীম আহমেদ
১৮ জানুয়ারি ২০২৪, ১৬:৩৭আপডেট : ১৮ জানুয়ারি ২০২৪, ১৮:৩১

গুঞ্জন ছিল নাজমুল হাসান পাপন হয়তো স্বাস্থ্য কিংবা অন্য মন্ত্রণালয় পেতে যাচ্ছেন। তবে সরাসরি ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাবেন, তা অনেকেই ধারণা করতে পারেননি। বিসিবি সভাপতির দেশের ক্রীড়ার প্রধান চালিকাশক্তি হয়ে নিয়োগ পাওয়াটা বড় চমক ছিল।

১৯৯০ সালের পর এই প্রথম যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে পূর্ণ মন্ত্রীর স্থান হয়েছে। এবং তা নাজমুল হাসান পাপনের মাধ্যমে! এর অর্থ পরিষ্কার, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগের চেয়ে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়কে বেগবান ও উজ্জ্বল দেখতে চাইছেন। এর জন্য ক্রীড়ামনস্ক বিসিবি সভাপতিকে বড়সড় দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে। এতে নাজমুল হাসান পাপনের কাজের পরিধি তো বেড়েছেই; পাশাপাশি পাহাড়সম চ্যালেঞ্জ জয়ের বিষয়টি সামনে এসে দাঁড় করিয়েছে।

দেশের ক্রীড়া ইতিহাসে এই প্রথম তিনি ক্রিকেট বোর্ডে টানা ১০ বছর দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি মন্ত্রণালয়ের কর্তা হয়ে কাজ শুরু করছেন। এর আগে যারাই ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ে এসেছেন, তাদের ক্রীড়াঙ্গনে সেভাবে অভিজ্ঞতা ছিল না বললেই চলে। এবার বুঝি আগের সব রেকর্ড ছাপিয়ে নতুন কিছু করার চেষ্টা।

তবে যতটা সহজ মনে হচ্ছে, বাস্তবে কি তাই? বড় প্রতিকূলতা হলো ক্রিকেট বোর্ড নিজেদের অর্থে যে কোনও বড়সড় সিদ্ধান্ত নিতে পারে। প্রায় ৯০০ কোটি টাকার তহবিল নিয়ে বসে আছে দেশের সবচেয়ে ধনী ফেডারেশন। তাই পাপন কিংবা সংশ্লিষ্ট যে কাউকে কাজ করতে হলে অর্থের কথা চিন্তা করতে হয় না। কিন্তু ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ঠিক বিপরীত।

এখানে ৫০টির ওপরে ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশন রয়েছে। রয়েছে যুব মন্ত্রণালয়। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ ছাড়াও রয়েছে ক্রীড়া পরিদফতর, বিকেএসপি ও বঙ্গবন্ধু ক্রীড়াসেবী ফাউন্ডেশন। পুরো বাংলাদেশের যুব ও ক্রীড়া খাতে বাজেট শুনলে হয়তো আপনি ভ্রু কুচকাবেন।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের বাজেট ধরা হয়েছিল ১ হাজার ৩০৯ কোটি ৮৬ লাখ টাকা। এর মধ্যে উন্নয়ন খাতে ৩৮২ কোটি ৪৮ লাখ এবং পরিচালন খাতে ৯২৭ কোটি টাকা ব্যয় ধরা হয়েছে। নতুন অর্থবছরে পরিচালন ব্যয় প্রায় ৮০ কোটি টাকা বাড়লেও উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ কমেছে প্রায় ৪০৫ কোটি টাকা।

আর ক্রীড়া উন্নয়নে গতবার বাজেট ছিল ৩২ কোটি ৯৭ লাখ টাকা। এ খাতে নতুন বাজেটে ৩৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য গতবার বরাদ্দ ছিল ৩০ কোটি ২০ লাখ টাকা। এবার তা বেড়ে ৩২ কোটি ৫১ লাখ টাকা হয়েছে।

এই অর্থ দিয়ে সারা বছর দেশের যুব ও ক্রীড়া ‘উন্নয়ন’ হয়ে থাকে। যেখানে একেকটি ফেডারেশন সারা বছরের জন্য বরাদ্দ পেয়ে থাকে ১০ থেকে ২২ লাখ টাকা পর্যন্ত। এছাড়া দেশের বাইরে টুর্নামেন্টে অংশ নেওয়ার জন্য মাঝে মধ্যে কিছু অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হয়। আর বড়সড় গেমস আয়োজন করতে হলে তখন অনেক কষ্টে অর্থ বরাদ্দ পাওয়া যায়।

ইচ্ছা করলেও ফেডারেশনগুলো সারা বছর দেশি-বিদেশি কোচের অধীনে ট্রেনিং কিংবা নিয়মিত আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সুযোগ কম। তখন জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কাছে ধরনা দিয়েও অনেক সময় বিফল মনোরথে ফিরতে হয়।

যে কারণে দেশের খেলাধুলায় সাফল্যের হার সেভাবে কমই। ক্রিকেট তরতর করে একটা জায়গায় স্থান করে নিলেও বাকি খেলাগুলো সেভাবে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। মাঝে মধ্যে সাফল্যের হাসি দেখা যায়। মিরপুরের স্বাস্থ্যবান বাজেটের ক্রিকেট বোর্ড চালিয়ে আসা সভাপতি নাজমুল হাসান পাপনের সামনে গুলিস্তানকেন্দ্রিক রুগ্ন ফেডারেশনগুলো দেখভাল করা কঠিন চ্যালেঞ্জ।

শুধুই কি অর্থ সমস্যা? তা কিন্তু নয়। রয়েছে অবকাঠামোগত বাধা। স্বাধীনতার ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও দেশে ক্রীড়া কমপ্লেক্স গড়ে ওঠেনি। এক জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের পুরাতন জিমনেসিয়ামে খেলা চালিয়ে নিতে প্রায়ই ফেডারেশনগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্বের উপক্রম হয়। ক্রীড়াবিদরা জানেন না তাদের নির্দিষ্ট করে খেলা কিংবা প্রশিক্ষণের জায়গা কোথায়!

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের টাওয়ার হয়েছে। বলা হয়েছিল, সেখানে অনেক ফেডারেশনের জায়গা হবে। কিন্তু আদতে দেখা গেছে ক্রীড়া পরিষদের অফিস ছাড়াও সেখানে বাণিজ্যিকভাবে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। কোনও ফেডারেশনেরই সেখানে জায়গা হয়নি!

এছাড়া ক্রীড়া পরিষদের অফিসে গেলে আপনি অবকাঠামো উন্নয়নের গল্প বেশি শুনতে পাবেন। সেখানে ক্রীড়া বা ক্রীড়াবিদদের এগিয়ে নেওয়ার চর্চা কমই হয়।

রাজধানীতে মাঠের তীব্র অভাব। ঢাকার বাইরেও মাঠের পরিচর্যা কতটুকু হয় তাও ভাবার বিষয়। অতীতে ফুটবল, হকি, অ্যাথলেটিকস, শুটিং, কাবাডি কিংবা অন্য জনপ্রিয় খেলাগুলো থেকে পদক কিংবা সাফল্য আসার রেকর্ড আছে। সময়ের পরিক্রমায় তা কিছুটা হলেও ফিকে হয়েছে।

অনেক ফেডারেশনে যোগ্য সংগঠকের পাশাপাশি অনেকের মাঝে সুদূরপ্রসারী দৃষ্টির অভাব রয়েছে। যে কারণে দেশের খেলাধুলায় সাফল্যের হার কমছে।

এত সমস্যার ভিড়ে নাজমুল হাসান পাপন দায়িত্ব পেয়েছেন। তাই চ্যালেঞ্জটা বেশ বড়। বর্তমান বিশ্বে খেলাধুলার সাফল্যের মাধ্যমে দেশের ভাবমূর্তি অনেকটাই উজ্জ্বল হয়ে থাকে। এক পার্শ্ববর্তী ভারতের দিকে তাকালে দেখা যাবে ক্রিকেট প্রধান দেশ হয়ে তারা বেশ কয়েক বছর আগে থেকে ফুটবল, হকি, কাবাডি, কুস্তি, শুটিং, ব্যাডমিন্টন কিংবা দাবার পাশাপাশি অন্য খেলার উন্নয়নে বেশ জোর দিয়েছে। যার কারণে অলিম্পিক কিংবা এশিয়ান গেমসে তাদের পদক প্রাপ্তিও চোখে পড়ার মতো।

তাই দেশের ক্রীড়াঙ্গনের চেহারা পাল্টে দিতে হলে নতুন মন্ত্রী নাজমুল হাসান পাপনকে অনেক সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রচণ্ড ক্রীড়াবান্ধব। তাই তিনি যদি চান নতুন করে কিছু করবেন, সেক্ষেত্রে জননেত্রীর সহযোগিতা অবশ্যই পারেন।

দেশের ক্রীড়ানীতি কী হবে? আমরা দেশের ক্রীড়াঙ্গনকে ৫ বছর কিংবা এরপরে কোথায় দেখতে চাই, তা নির্ধারণ করে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ রয়েছে। এসএ, এশিয়ান কিংবা অলিম্পিক গেমস আমাদের লক্ষ্য হবে কিনা তা এখনই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময়।

যদিও পাপন প্রথম দিন দায়িত্ব নিয়েই জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে ফুলবৃষ্টিতে ভিজেছেন। সংগঠকদের শুভেচ্ছায় সিক্ত হতে দেখা গেছে তাকে। তবে সেখানে অভিজ্ঞ সংগঠকের মতো শুরুতে ছক্কা হাঁকিয়ে সবার উদ্দেশে ইতিবাচক বার্তা দিয়েছেন। সংবাদমাধ্যমের কাছে তার মনোভাব বুঝিয়ে দিয়েছেন। খেলার উন্নয়ন করতে হলে অর্থ প্রয়োজন। সেটার বন্দোবস্ত করে অন্তত তিন বছর সময় বেঁধে দিতে চান তিনি।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি ফেডারেশন কর্মকর্তাদের বলেছেন, ‘আমাকে প্রথমে সব ফেডারেশনের সঙ্গে আলাদাভাবে বসতে হবে। তাদের কথা শুনতে হবে। সব খেলা তো আর আন্তর্জাতিক পর্যায়ে যাবে না। এমন অনেক ফেডারেশন আছে, যারা ইতোমধ্যে ভালো। তবে যাদের আর্থিক সমস্যা আছে, তারা আমার সঙ্গে বসে আমাকে একটা লক্ষ্য দেবে, বাজেট দেবে। আমি তিন বছর সময় দেবো যেন তাদের অগ্রগতি দেখতে পাই।’

তিন বছরের মধ্যে কিছু করতে না পারলে অন্য ব্যবস্থা নেবেন তিনি। তার সরাসরি কথা, ‘তারা আমাকে পাঁচ-সাত-দশ বছরের লক্ষ্যমাত্রা দিতেই পারে। তাই বলে আমি এত সময় দেওয়ার পক্ষে না। তিন বছর পর যদি দেখি তারা ভালো করছে, লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে, তাহলে সামনের দিকে ভাববো। লক্ষ্যপূরণ করতে না পারলেও যে অর্থ দেওয়া বন্ধ হবে তেমনটি নয়। তখন যারা উন্নতির দিকে যাচ্ছে সেদিকে বাড়তি নজর দেবো।’

জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ সাধারণত স্টেডিয়ামের অবকাঠামো নির্মাণে ব্যস্ত থাকে। এটা জেনেই হয়তো নতুন চেয়ারম্যান স্টেডিয়াম নির্মাণের চেয়ে মাঠকে বেশি প্রাধান্য দিচ্ছেন, ‘ব্যক্তিগতভাবে আমি মনে করি, স্টেডিয়াম তো রয়েছে। কিন্তু মাঠ কোথায়? মাঠ না থাকলে মানুষ খেলবে কোথায়? তাই আমার কাছে স্টেডিয়ামের চেয়ে মাঠ বেশি প্রয়োজন।’

আবার কথার পিঠে কথা থাকে। ক্রীড়ামনস্ক একজন সংগঠক ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব নিয়ে নিজের মনোভাব পরিষ্কার করেছেন।

গত ১০ বছর ধরে বিসিবির দায়িত্বে থেকে নাজমুল হাসান পাপন কী করতে পেরেছেন? সর্বশেষ বিশ্বকাপ ক্রিকেটে দল গঠন নিয়ে নানান বিতর্ক হয়েছিল। যেকোনও সিরিজে নির্বাচকদের চেয়ে নিজের পছন্দকে বেশি গুরুত্ব দেওয়ার গুঞ্জন তো রয়েছেই। এ নিয়ে নিজেই সংবাদমাধ্যমের কাছে ব্যাখ্যা দিতেন।

শুধু তাই নয়। ক্রিকেট কাঠামো বদলে ফেলা কিংবা গতিশীল ভূমিকায় রাখার জন্য তার নিবেদন কতটুকু ছিল, এ নিয়ে প্রশ্ন থাকতেই পারে। বয়সভিত্তিক দলগুলো আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সাফল্য পেলেও সিনিয়রদের আসরে সাকিব-তামিমরা এখনও কোনও ট্রফি পাননি। অন্দরমহলে কান পাতলে শোনা যায়, বিসিবি সভাপতি যা করবেন তা-ই সই। সেখানে অন্য কারও কথা বলার সুযোগ থাকে না বলে অভিযোগ আছে।

দেশের ঘরোয়া ক্রিকেটে কোনও গতি নেই। প্রথম শ্রেণির খেলাতেও বড়সড় পরিবর্তন নেই। তার সময়ে সাকিব-তামিমরা ধর্মঘট ডেকেছিল। এছাড়া অন্য অনেক ‘বিতর্কিত’ বিষয় তো রয়েছে।

সবকিছু ছাপিয়ে এখন নাজমুল হাসান পাপন ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। যেখানে নিজেকেই বিভিন্ন খেলাতে প্রকারান্তরে তৈরি করতে হবে ভবিষ্যতে সাকিব কিংবা তামিমের মতো খেলোয়াড়। পাপনের হাত ধরে সামনের দিকে সাফল্য আসবে কিনা, কিংবা দেশের ক্রীড়াঙ্গনের খোলনলচে বদলে দেওয়ার সুযোগটা লুফে নিতে পারবেন কিনা তা সময় বলে দেবে। আপাতত তার শুরুটা আশা জাগানিয়া। নিশ্চয়ই  প্রথমবার পূর্ণ মন্ত্রী হয়ে ইতিবাচক কিছুই করবেন, সেই প্রত্যাশায় ক্রীড়াঙ্গনের সবাই।

লেখক: সিনিয়র রিপোর্টার, বাংলা ট্রিবিউন

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
তপ্ত রোদেও থামে না তাদের কাজ
আজ মহান মে দিবসতপ্ত রোদেও থামে না তাদের কাজ
মদ ছেড়ে বললেন, ‘মাইলফলক’
মদ ছেড়ে বললেন, ‘মাইলফলক’
প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন বৃহস্পতিবার
প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলন বৃহস্পতিবার
১০৩ চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ ১৭৭ জনের প্রার্থিতা প্রত্যাহার
উপজেলা পরিষদ নির্বাচন১০৩ চেয়ারম্যান প্রার্থীসহ ১৭৭ জনের প্রার্থিতা প্রত্যাহার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ