X
শনিবার, ০৪ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১

আনু মুহাম্মদের আঙুল কাটায় দায় কার?

শাকিল রিয়াজ
২২ এপ্রিল ২০২৪, ১৫:৫৬আপডেট : ২২ এপ্রিল ২০২৪, ১৭:০৫

উন্নত-উন্নয়নশীল দেশগুলোতে চলন্ত ট্রেনের দরজা-জানালা বন্ধ থাকে। শুধু স্টেশনে থামলেই দরজা খোলা হয়। ট্রেনের চালক ছাড়া আর কেউ খুলতে পারেন না বন্ধ দরজা। স্টেশনে ট্রেন থামলে যেদিকে প্ল্যাটফর্ম শুধু সেদিকের দরজাগুলো খোলার জন্য বাটনে চাপ দেন চালক। আমাদের দেশে এই ব্যবস্থা নেই। কারণ মানুষের জীবনের দাম এ দেশে সবচেয়ে কম। এটি নিঃসন্দেহে রাষ্ট্রীয় অবজ্ঞা। মানুষের জীবনকে ঝুঁকিপূর্ণ করার জন্য এই অবজ্ঞার বিরুদ্ধে মামলা করা যায়। অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ রেলের অবজ্ঞা ও অব্যবস্থাপনার বলি হলেন। তার শুধু পায়ের আঙুল কাটা পড়েছে। বহু মানুষের জীবন কাটা পড়ার খবর পাই নিয়মিত।

ক্রসিংয়ে ট্রেন বহুক্ষণ থেমে থাকলে, বাসা-বাড়ি-কর্মস্থল আশপাশে হলে আর সর্বোপরি দরজা খোলা থাকলে নেমে যেতে কে না চাইবে? আমিও চাইতাম। মূল সমস্যা, চলন্ত ট্রেনের দরজা খুলে রাখা।

যে দেশে হাত উঠালেই মধ্য রাস্তায় বাস থামিয়ে যাত্রী তোলা হয়, ট্রেন স্লো করা হয়, খেয়া থেকে চলন্ত লঞ্চে যাত্রী ওঠানামা করানো হয়, সে দেশে হঠাৎ করেই “নামতে গেলো কেন” বড় হয়ে গেলো!

গত বছরের ঘটনা। উত্তরার যেখানে থামার কথা সেখানে না থামিয়ে শুধু “হালকা” করেছিল বাসটি। চলন্ত সেই বাস থেকে নামতে গিয়ে প্রাণ হারান আমার চাচাতো ভাই।

এ বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে দেশে গেলে জমি সংক্রান্ত এক কাজে সাভার যেতে হয়েছিল। শ্যামলী থেকে ছোট ভাই মাহিনকে নিয়ে বাসে উঠেছিলাম। দেশে গিয়ে এই একবারই বাসে ওঠার সাহস করেছিলাম। যত্রতত্র বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানো হচ্ছিল। আমার আলাপের বিষয় অবশ্য এটা নয়, কারণ এমনটাই চলে আসছে। এটাই রীতি। আমাদের নামার সময় যে ভয়াবহ কাণ্ডটি ড্রাইভার করলেন তা ভাবলে এখনও আঁতকে উঠি। যেসব জায়গায় স্ট্যান্ড নেই সেসব জায়গায় থেমে থেমে যাত্রী ওঠালেও আমাদের গন্তব্য সাভার থানা রোড বাসস্ট্যান্ডে বাস থামলো না। স্ট্যান্ডে বাস থামার জন্য আঞ্চলিক লেনে বাস না ঢুকিয়ে দূরপাল্লার যানবাহনের জন্য বরাদ্দকৃত মাঝখানের লেনে বাস “হালকা” করা হলো আমাদের নামার জন্য। আগে অভ্যাস ছিল, দীর্ঘ অনভ্যাসে চলন্ত বাস থেকে নামতে গিয়ে পড়তে পড়তে উঠে দাঁড়ালাম। কোথায় নামলাম বুঝতে পেরেছি নামার পর। হাইওয়েতে আমরা দাঁড়ানো। সামনে বিপজ্জনকভাবে বাস-ট্রাকগুলো ছুটে যাচ্ছে। পেছনে উঁচু রোড ডিভাইডার। এই ডিভাইডার পার হয়ে আঞ্চলিক দুটি লেন ক্রস করে অতঃপর রাস্তার কিনারে যেতে হবে। ডিভাইডারগুলো আমাদের মাথার চেয়েও উঁচু। এমন ডিভাইডার রাখার কারণ হিসেবে জানলাম দূরপাল্লার বাসগুলো যেন আঞ্চলিক সার্ভিস লেনে না ঢুকে সরাসরি গন্তব্যে যেতে পারে। এছাড়াও যাত্রীরা যাতে আঞ্চলিক লেন ও দূরপাল্লার লেনের মধ্যে যাতায়াত করতে না পারে সেটাও উঁচু ডিভাইডার বসানোর কারণ।

শুনলাম, এই রোডের আগে-পিছে এক কিলোমিটারের মধ্যে কোথাও খোলা নেই যেখান দিয়ে আমরা লেন বদল করে রাস্তার অন্য পাশে যেতে পারবো। কিংকর্তব্যবিমূঢ় ও ভীতবিহ্বল হয়ে ডিভাইডার সেঁটে দাঁড়িয়ে থাকলাম। মাহিন জিজ্ঞাসা করলো, ডিভাইডার টপকে যেতে পারবো কিনা। ভয় আড়াল করে বললাম, চেষ্টা করি। চেষ্টায় কাজ হয়নি। অপারগতা ঢাকতে জিন্সের প্যান্টের ওপর দোষ চাপালাম। আমাকে দাঁড় করিয়ে রেখে মাহিন একটা কোণাভাঙা ডিভাইডারের সন্ধান পেলো। কয়েকবারের চেষ্টায় সেই ভাঙা কোণায় পা রেখে ডিভাইডারের ওপরে উঠলাম বটে কিন্তু আঞ্চলিক লেনে নামার জায়গা নেই। ডিভাইডার ঘেঁষে বাসের লাইন। লাফ দিয়ে নামতে হবে বলে জায়গাও বেশি লাগবে। আর লাফ দিয়েই তো স্থির থাকা যায় না, গতিজড়তা বলে একটা কথা আছে তো! লাফ দিয়ে কয়েক কদম সামনে দৌড়াতে হয়। সেই সুবর্ণ সুযোগের জন্য মিনিট দশেক অপেক্ষা করতে হয়েছিল।

কেন বাস ড্রাইভার আমাদের স্ট্যান্ডে না থামিয়ে ডিভাইডার ঘেরা মহাসড়কে চলন্ত অবস্থায় নামিয়ে দিলো তার কারণ স্থানীয়দের জিজ্ঞেস করে জেনেছি। কারণটি হচ্ছে “সিরিয়াল”। রাস্তায় থেমে থেমে যাত্রী ওঠানোর কোনও এক ফাঁকে পেছনের সিরিয়ালের বাস আগে চলে যায়। আগের বাস আঞ্চলিক লেনে ঢুকে পড়ায় আমাদের বাসটি সিরিয়াল ঠিক রাখার জন্য হাইওয়ে ধরে টান দেয়। এমনটা নাকি নিয়মিতই হচ্ছে। মাসখানেক আগে একটা ভিডিও ভাইরাল হয়েছিল। পরে নিউজও হয়। দেখা গেছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ অংশে মই দিয়ে ডিভাইডার পার হচ্ছেন যাত্রীরা। বিনিময়ে ৫ টাকা প্রদান করতে হচ্ছে যাতায়াতকারী যাত্রীদের। ওইখানে দূরপাল্লার যানবাহনগুলো শিমরাইল মোড়ের যাত্রীদের নামিয়ে দিতো। কী অবাক করা কাণ্ড!

এই বয়ানের মাধ্যমে আমি যেটা বুঝাতে চাচ্ছি তা হচ্ছে সেই পুরনো কথাই, মানুষের জীবনের দাম সবচেয়ে কম। আমার জীবনের কথা ভাবা হয়নি। ভাবা হয়েছে যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা করিয়ে বেশি মুনাফা অর্জনের কথা, ভাবা হয়েছে অন্যায়ভাবে সিরিয়ালে ফিরে আসার কথা, ভাবা হয়েছে আগে যাওয়ার জন্য বাস না থামিয়ে চলন্ত বাস থেকে মহাসড়কের ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় আমাকে নামিয়ে দেওয়ার কথা। যোগাযোগ ব্যবস্থায় উন্নয়নের অনেক মেগা প্রজেক্ট দৃশ্যমান। কিন্তু এসবের কি দাম যখন এই যোগাযোগের আঙ্গিনায়ই কর্তৃপক্ষের অজ্ঞতা, উদাসীনতা ও খামখেয়ালিতে মানুষের জীবন খসে পড়ে?

এই অজ্ঞতা ও উদাসীনতার কারণে নির্মম মৃত্যুর শিকার হয়েছিল আমার কাজিন। মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে এসেছি আমি ও মাহিন। এমন আরও লক্ষ-হাজার ঘটনা ঘটেছে, ঘটে চলেছে যেগুলোর বেশিরভাগই দুর্ঘটনা নয়। দুর্ঘটনা হঠাৎ করেই ঘটে এবং তাকেই দুর্ঘটনা বলে, যা যথাযথ ও কার্যকর একটি ব্যবস্থাপনায় সাধারণত ঘটে। চেনাজানা ও চিহ্নিত ঝুঁকিগুলোকে জিইয়ে রাখা একটি অব্যবস্থাপনার পরিবেশে, সিস্টেমের ত্রুটির কারণে মানুষ বিপর্যয়ে পতিত হলে সেটা দুর্ঘটনা নয়, বরং ঘটনা। কর্তৃপক্ষের ইন্ধনে ঘটে এসব ঘটনা, হত্যাকাণ্ড। উদাহরণ দিয়ে বলি। যদি একটি ট্রেনের দরজা চলন্ত অবস্থায় অটোলকের ব্যবস্থা থাকে এবং কোনও অজ্ঞাত কারণে চলতি পথে হঠাৎ দরজা খুলে যায় এবং এই কারণে কেউ পড়ে গিয়ে আহত-নিহত হয় তবে সেটা দুর্ঘটনা। কিন্তু সিস্টেমই যখন চলন্ত অবস্থায় বাস-ট্রেনের দরোজা-জানালা খুলে রাখা, চলন্ত অবস্থায় যাত্রী ওঠানো-নামানো, ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় যাত্রীদের নামতে বাধ্য করানো—এবং এসব কারণে যাত্রীরা বিপর্যয়ের শিকার হলে তা কিছুতেই দুর্ঘটনা নয়, বরং সরকার ও কর্তৃপক্ষ আয়োজিত-প্রযোজিত ঘটনা। মৃত্যু হলে হত্যাকাণ্ড। কেননা এসব চিহ্নিত ঝুঁকির বিপরীতে কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

দুর্ঘটনায় মৃত্যু ও হত্যাকাণ্ডের পার্থক্য বোঝাটা জরুরি। বুঝতে হবে কোনটা আগুন লাগা আর কোনটা আগুন লাগিয়ে দেওয়া।

অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের ট্রেন থেকে এভাবে নামাটা সিভিক সেন্স অনুসারে ঠিক না বেঠিক সেই আলাপের চেয়েও বড় আলাপ হলো রেল কর্তৃপক্ষ এভাবেই নামার ব্যবস্থা করে রেখেছে। এই নির্মম ঘটনাটির দায়ভার  শতভাগ রেল কর্তৃপক্ষের।

ধরা যাক, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের সিভিক সেন্স ওই মুহূর্তে কাজ করেনি। কিন্তু আমার বেলা? যে মৃত্যুকূপে আমি বুঝে ওঠার আগেই আমাকে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল সেখানে সিভিক সেন্স কীভাবে খাটানো যেত?

একটা দিয়ে অন্যটা ধামাচাপা না দিয়ে আসল জায়গায় হাত দিন। ঝুঁকি চিহ্নিত করুন। সেগুলো সমাধানে মনোযোগী হন। আমাদের সৌভাগ্য আমরা অল্পের জন্য আনু মুহাম্মদের মতো শোষণ, বৈষম্য, নিপীড়ন, মৌলবাদ ও আধিপত্যবিরোধী লড়াইয়ের একজন সক্রিয় ও সরব কমরেডকে হারাইনি। 

লেখক: কবি, সাংবাদিক, বিশ্লেষক। সুইডেন প্রবাসী।

 

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ছেলের মৃত্যুর ৪ দিনের মাথায় চলে গেলেন বাবা, গ্রামজুড়ে শোকের ছায়া
ছেলের মৃত্যুর ৪ দিনের মাথায় চলে গেলেন বাবা, গ্রামজুড়ে শোকের ছায়া
গাজা ও ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে কাজ করতে চায় বাংলাদেশ: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
গাজা ও ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে কাজ করতে চায় বাংলাদেশ: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
অনেক নার্ভাস ছিলেন সাইফউদ্দিন
অনেক নার্ভাস ছিলেন সাইফউদ্দিন
বকশিবাজার মোড়ে বাসের ধাক্কায় পথচারী নিহত
বকশিবাজার মোড়ে বাসের ধাক্কায় পথচারী নিহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ