X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

সহিংস সাম্প্রদায়িক ভাবনায় ত্রস্ত দেশ

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা
১৭ ডিসেম্বর ২০১৫, ১১:৫০আপডেট : ১৭ ডিসেম্বর ২০১৫, ১১:৫৫

Ishtiaque Rezaভয় নয়, সাহসকে সঙ্গে নিয়ে দেশ জয় করতে হয়। জাতিকে সেই সাহসী আর সৃজনশীল নেতৃত্ব দেয় রাজনীতিকরা। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখি কী এক অসীম সাহসিকতায় দেশকে স্বাধীন করেছে এদেশের মানুষ আর কী এক আসাধারণ রাজনৈতিক নেতৃত্ব সেই সাহসের প্রেরণা দিয়েছিল। নেতৃত্বের পুরোভাগে ছিলেন বঙ্গবন্ধু আর তার সহযোদ্ধারা। আজ এদেশের মানুষ গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করছে মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের, যুদ্ধে নির্যাতিত মানুষদের। স্মরণ করছে মানুষের আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার তথা স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে সফল নেতৃত্বদানকারী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে।

খেতাব পাওয়া আমাদের বিদেশি বন্ধুদের অন্যতম ১৯৭১-এ ব্রিটিশ টেলিগ্রাফ পত্রিকার সাংবাদিক সায়মন ড্রিং। পরবর্তী জীবনে আমার সহকর্মী। কথায় কথায় একবার মুক্তিযুদ্ধের কথা বিস্তারিত আলোচনা হয়েছিল তার সঙ্গে। বলেছিল, যদি ত্যাগ হয় স্বাধীনতার জন্য কোনও রাষ্ট্রের দেওয়া মূল্য, তবে বাংলাদশের মানুষ তার চেয়ে বেশিই দিয়েছে। তো সেই মানুষ আজ অংক করছে নিজেকে নিয়ে, দেশকে নিয়ে।

সদ্য স্বাধীন দেশের নেতৃত্বের মানুষকে সমৃদ্ধি দেওয়ার বিষয়ে অঙ্গীকারের অভাব ছিল না। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে বাংলাদেশকে দীর্ঘ সময় আবারো পাকিস্তান বানাবার চেষ্টা হয়েছে, এখনো সেই চেষ্টা অব্যাহত আছে। কিন্তু তবুও মানুষ এগিয়েছে, দেশকে নিয়েই এগিয়েছে।

তাই জাতি যখন ৪৫তম বিজয় দিবসে আনন্দে ভাসছে, তখন একই সঙ্গে হিসেব মিলিয়ে দেখছে স্বাধীনতার মূল স্বপ্নের সঙ্গে এখন কতটুকু মিলছে তার পথ চলা। একটি উদার অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন হোঁচট খেয়েছে বঙ্গবন্ধু হত্যার সঙ্গে সঙ্গেই।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ শুরু হলে দেখা গেল এর প্রতি ব্যাপক মানুষের সমর্থন আছে। কিন্তু বিপরীত চিত্রটাও ভয়ংকর। বড় একটি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ আছে এই বিচার প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে। আর তার বিরোধিতার ধরনটা চরম সহিংস ও সাম্প্রদায়িক।

বিজয়ের এমন আনন্দক্ষণে আমাদের আশঙ্কায় রাখে মন্দির, শিয়া মসজিদ, গীর্জা আর সংখ্যালঘু ধর্মীয় নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের ওপর একের পর এক হামলা। বুঝতে পারি একটি সহিংস, জিঘাংসাভরা ধর্মীয় উগ্র গোষ্ঠী তীর্যকভাবে তাকিয়ে আছে আমাদের দিকে।  

এই রাষ্ট্র দেশের সব মানুষের। 'প্রজাতন্ত্র' কথাটি যখন এই অর্থে ব্যবহৃত হয়, তখন আসলে বলার চেষ্টা হয় যে, এর মধ্যে সকলের অধিকার ও দায়িত্ব প্রতিষ্ঠার যে অঙ্গীকার, সেটা গণতন্ত্রের অধিকারের চেয়ে অনেকখানি বড়। শ্রেণি, গোষ্ঠী, সম্প্রদায়, সমাজ, সব কিছুর ঊর্ধ্বে ব্যক্তির সেই অধিকার। এমন একটি সংবিধানও আমরা রচনা করেছিলাম স্বাধীনতার পরপরই যাতে দাবি করা হয়েছিল রাষ্ট্র সব নাগরিককে সমান করে দেখবে, এবং সব নাগরিক রাষ্ট্রকে সমান করে কাছে পাবে। আমাদের সংবিধান-প্রণেতারা যে বিধ্বংসী দ্বন্দ্বদীর্ণতা ও হিংসাত্মক ঘটনাপ্রবাহের মধ্যেও এই কথাটা ভাবতে পেরেছিলেন, সেটা সহজ ব্যাপার ছিল না। কিন্তু আমরা দেখলাম এদেশেই সামরিক স্বৈরাচার এক রাষ্ট্রধর্ম করে বিভেদের রেখা স্থায়ী করে গেছে। নাগরিকদের একটি অংশকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা দিয়ে বাকিদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে ফেললো রাতারাতি।

আমাদের বিশ্বাস ছিল ধর্মে, কিন্তু তার চেয়ে বেশি ছিল মানবিকতায়। মানুষকে ধর্ম দিয়ে বিচার করার যে হীন সংস্কৃতি পাকিস্তানিরা আমাদের শিখিয়েছিল তা আমরা প্রত্যাখ্যান করেছিলাম ১৯৭১-এ। এমন বিশ্বাসের ওপর ভর করে যে দেশ তৈরি হলো সেদেশের অসহিষ্ণুতার এমন সংস্কৃতি সেদেশের সংখ্যালঘুরাই আবার ১৯৭৫ থেকে শুধু দেশ ছাড়ছে।

আমাদের বিবাদ-বিসংবাদ-বৈষম্য চিরদিনের জন্য হয়তো কোনদিনই দূর করতে পারতাম না। কিন্তু সবাইকে জায়গা দেওয়ার চেষ্টাটা ছিল। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার প্রচেষ্টা হয়তো ত্রুটিহীন ছিল না, কিন্তু ইচ্ছাশক্তির কোথাও ধর্ম আর শ্রেণি বৈষম্য চেয়েছিলেন তা বলা যাবে না। কিন্তু একটি উদার অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের যে ভাবনা ছিল আমাদের তার খোলনলচে পাল্টে নতুন এক ভিন্ন ভাবনার বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে জঙ্গিমহল, সাথে রাজনৈতিক সমর্থন পাচ্ছে বড় দল আর জো। আর তা দেখে তীব্র আশঙ্কা হয় সবদিক থেকে। এই ভাবনার একটিই রং, একটিই নাম, একটিই পথ তা হলো একটিই ধর্ম থাকবে, তার নাম ব্যবহার করে যা পারো করে নাও।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক আর সামাজিক অগ্রগিত আজ বিশ্ব দরবারে সমাদৃত। অর্থনীতির উন্নয়নেই সবার উন্নয়ন। উন্নয়ন মানে তো মন মানসিকতার উন্নতিও। কিন্তু তা কি হয়েছে আজ? একশ্রেণির শিক্ষিত জনগোষ্ঠীও যেভাবে সংখ্যালঘু বিদ্বেষী মনোভাব নিয়ে থাকেন, তাতে ধর্মনিরপেক্ষতার ভাবনা মুখ থুবড়ে পড়ে। সংখ্যাগুরু দর্শনের জোয়ার সংখ্যালঘু মানুষদের রাষ্ট্রের প্রাত্যহিক পরিসর থেকে দূরে সরিয়ে দেয়ার যে ষড়যন্ত্র বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল তার ভিত বড় মজবুত হয়ে গেছে আজ। এরা ঐক্যবদ্ধ কী করে মুক্তবুদ্ধির মানুষের কলম থামিয়ে দেওয়া যায়, কী করে তালেবানি সহিংসতা ছড়িয়ে দেওয়া যায়, কী করে আতঙ্ক তৈরি করে সমাজের নিরীহ সংখ্যালঘু মানুষকে অনধিকারী নাগরিক বানিয়ে দেওয়া যায়।

মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগের অনুভূতিই আমাদের প্রগাঢ়তম অনুভূতি। এই বাংলাদেশ তাদের যারা এতটুকুও সাম্প্রদায়িক উচ্চারণ করে না। সংখ্যাগুরু-তন্ত্রের ভয়ঙ্কর থাবা থেকে বাঁচার জিয়নকাঠিটা আছে যারা এখন ক্ষমতায় তাদের সুশাসনের হাতে। এবার বিজয় দিবস আমাদের নতুন করে আত্মজিজ্ঞাসার সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। স্বাধীনতার জন্য আমাদের আত্মত্যাগের পেছনে যে স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা ছিল, তার কোথাওতো ছিল না এমন সহিংসত সাম্প্রদায়িক ভাবনা। তাহলে হোক আরেক মহাঐক্য, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার এমন দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির মখোমুখি যখন হয়েছি তার মোকাবেলা হোক রাজনৈতিক ভাবেই।

 

লেখক: পরিচালক বার্তা, একাত্তর টেলিভিশন

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব। বাংলা ট্রিবিউন-এর সম্পাদকীয় নীতি/মতের সঙ্গে লেখকের মতামতের অমিল থাকতেই পারে। তাই এখানে প্রকাশিত লেখার জন্য বাংলা ট্রিবিউন কর্তৃপক্ষ লেখকের কলামের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে আইনগত বা অন্য কোনও ধরনের কোনও দায় নেবে না।

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
ভারতের নিখিলের হ্যাটট্রিকে ঊষার বড় জয়
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
বাংলাদেশে আইসিটির ভবিষ্যৎ কেন হুমকির মুখে?  
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
মস্কোতে কনসার্টে হামলা: ৯ সন্দেহভাজনকে আটক করলো তাজিকিস্তান
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
চট্টগ্রামে জুতার কারখানায় আগুন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ