X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘প্রশাসন থেকে পুলিশের লোক সবাই ইলিশ কিনছেন’

আরিফুল ইসলাম রিগান, কুড়িগ্রাম
১৮ অক্টোবর ২০২২, ১৭:৩০আপডেট : ১৮ অক্টোবর ২০২২, ১৭:৩০

‘উপস্থিত ইলিশ নাই। মাছ ছিল প্রায় ৩০ থেকে ৩৫ কেজির মতো। বেচি হয়া গেইছে। আইজ সকালে থানায় দিছি ৫ কেজি। মণ্ডলের হাটের এক এনজিও ম্যানেজার রাইতে নিয়া গেইছে ২০ কেজি। সন্ধ্যায় মাছ হইলে দিতে পারবো।’ মঙ্গলবার সকালে কুড়িগ্রামের উলিপুরের এক ইলিশ বিক্রেতার কাছে ক্রেতা সেজে ইলিশ কিনতে চাইলে এভাবেই ইলিশের চাহিদার কথা জানান তিনি। তার ভাষ্য, ‘প্রশাসন থেকে পুলিশের লোক, সবাই ইলিশ কিনছেন।’

জেলেদের কাছ থেকে ইলিশ সংগ্রহ করে বিক্রি করা এই মাছ ব্যবসায়ী বলেন, ‘নদীতে ইলিশ জেলে আছে। সাহেবের আলগার (উলিপুরের সীমান্তবর্তী ইউনিয়ন) দিকে মাছের আমদানি বেশি। ওইদিকে মাছ বেশি যায়।’

পুলিশ-প্রশাসনের লোকদের কাছে মাছ বিক্রি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘সেদিন এসিল্যান্ড স্যার আসছিলেন। দুই-একটা মাছ দিতে বলছিলেন। আমি বলছি, “স্যার ঘরত তালা লাগাইছেন, মাছ দেই কোটাই থাকি।” তিনি বলছেন, “আরে একদিন দাবড়ে যাই (অভিযান), ১৫ দিনই মারেন।” পরে তার গাড়ির ড্রাইভার মাছ নিয়া গেছে।’

মাছের দাম নেওয়া প্রসঙ্গে এই ব্যবসায়ী বলেন, ‘আমি জীবনে কাহো ফাও মাছ খাওয়াই না।’

ইলিশের প্রধান প্রজনন মৌসুম নির্ধারণ করে গত ৭ অক্টোবর থেকে দেশের নদ-নদীতে  ইলিশসহ সব ধরনের মাছ শিকার নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। নির্বিঘ্নে মা ইলিশকে ডিম ছাড়ার সুযোগ দিতে আগামী ২৮ অক্টোবর পর্যন্ত দেশব্যাপী ইলিশ আহরণ, বিপণন, বহন, কেনাবেচা, বিনিময় ও মজুত নিষিদ্ধ করা হয়েছে। কুড়িগ্রামের ৬ উপজেলার (সদর, নাগেশ্বরী, উলিপুর, চিলমারী, রৌমারী ও রাজিবপুর) নদ-নদী ইলিশ জোনের আওতাভুক্ত। উপকূলীয় অঞ্চলে ইলিশ শিকার বন্ধ থাকলে তখন জেলার নদ-নদীতে কিছু ইলিশের দেখা মেলে। মাছ শিকার থেকে বিরত থাকতে জেলার তালিকাভুক্ত প্রায় সাড়ে ৭ হাজার দুস্থ জেলেকে ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় খাদ্য সহায়তা দিয়েছে সরকার।

মৎস্য অভয়াশ্রম সাইন বোর্ডের পেছনের এই ঘরটিসহ অনন্তপুর বাজার এলাকার একাধিক ঘর ইলিশ বিক্রির আড়ত হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে মাছ শিকার করছেন কারা

উলিপুরের ব্রহ্মপুত্র নদে ইলিশ শিকার করেন এমন একজন জেলে বলেন, ‘মাছ কম ধরা পড়তাছে। সারাদিন মিলি ৫-৭ কেজি মাছ মেলে। প্রতিটির ওজন ৯০০ গ্রাম থেকে ১ কেজি ১০০ গ্রাম। কাইল থাকি পানি কমি যাওয়ায় আইজ একটু মাছ কম। বিকালে হয়তো আরও পাওয়া যাইবে।’ আকার ভেদে প্রতিটি কেজি ইলিশ ৯০০ থেকে ১১০০ টাকায় বিক্রি করছেন বলে জানান ওই জেলে।

মাছ কিনতে চাইলে হাতিয়া ইউনিয়নের আরেক ইলিশ বিক্রেতা শ্যামল বলেন, ‘মাছ আছে। ৭-৮ কেজি দেওয়া যাবে। বিকালে আসলে ১০ কেজিও দেওয়া যাবে।’

উলিপুর উপজেলার হাতিয়া ইউনিয়নের পুরাতন অনন্তপুর বাজার ঘুরে আসা এক মৌসুমি ইলিশ ব্যবসায়ী ব্রহ্মপুত্র নদে ইলিশ শিকার ও বিক্রি নিয়ে বলেন, ‘নদীতে পেশাদার জেলে কম। যাদের টাকা আছে তারা নৌকা আর জাল কিনে দৈনিক পারিশ্রমিক হারে লোক নিয়োগ করে ইলিশ শিকার করছে। সেই ইলিশ ঘাটের কাছে বাজারে এনে ফ্রিজে রেখে বিক্রি চলছে। সকাল-সন্ধ্যা ইলিশে ভরপুর ব্রহ্মপুত্রের ঘাট।’

ওই ব্যবসায়ী বলেন, ‘এ বছর নদে ভালোই ইলিশ মিলছে। তবে পেশাদার জেলের চেয়ে চুক্তিতে মাছ শিকার করা জেলের সংখ্যাই বেশি। তাদের নিজেদের কোনও জাল কিংবা নৌকা নেই। স্থানীয় কয়েকজন মহাজন তাদের দিয়ে ইলিশ শিকার করাচ্ছেন। তারা ফোনে অর্ডার নিয়ে মাছ বিক্রি করেন।’

মাছ কিনছেন কারা? এমন প্রশ্নে এই মৌসুমি ব্যবসায়ী বলেন, ‘প্রশাসনের লোক থেকে শুরু করে পুলিশ, সাংবাদিক এবং সামর্থ্যবান অনেকেই ইলিশ কিনছেন। যারা সারাবছর ইলিশ খান তারাই ব্রহ্মপুত্রের ইলিশের ক্রেতা। তাদের যুক্তি হলো, বছরে একবার ব্রহ্মপুত্রে ইলিশ মেলে। মাছ তো মারাই হয়। আমরা না কিনলে কেউ না কেউ তো কিনবে।’

এদিকে, দিনভর ইলিশ শিকার করে উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের মোল্লারহাট বাজারে ধুমছে বিক্রি করছেন জেলে ও স্থানীয় ইলিশ ব্যবসায়ীরা। প্রতি সন্ধ্যায় অন্তত ২ থেকে ৪ মণ ইলিশ বিক্রি হচ্ছে এই হাটে। বেশির ভাগ ক্রেতাই শহর থেকে যাওয়া লোকজন। স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে এমন তথ্য জানা গেছে।

ব্রহ্মপুত্রে ইলিশ শিকারের জন্য যাচ্ছেন এক জেলে পুলিশ-প্রশাসনের বক্তব্য

পুলিশের ইলিশ কেনার বিষয়ে উলিপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শেখ আশরাফুজ্জামান বলেন, ‘কোন অফিসার কিনেছেন তা আমার জানা নেই। আমাকে জানালে আমি অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো। থানার কথা বলে নিচ্ছেন নাকি ব্যক্তিগতভাবে কিনছেন সেটাও দেখতে হবে। একজন অফিসার যদি মাত্র ২২ দিন ইলিশ মাছের লোভ সামলাতে না পারেন তাহলে কেমন করে হবে? বিষয়টি আমাকে জানানোর জন্য ধন্যবাদ। আমি সবাইকে জানিয়ে দিচ্ছি যেন কোনও অফিসার ইলিশ না কেনেন।’

উপজেলার সহকারী কমিশনার (এসি ল্যান্ড) কাজী মাহমুদুর রহমান ব্রহ্মপুত্র এলাকায় অভিযানে যাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমি যোগদানের পর এমন অভিযানে যাইনি। আমার গাড়িচালকের যে নাম বলেছেন সে নামে আমার কোনও গাড়ি চালক নেই। ইলিশ কেনার অভিযোগ ভিত্তিহীন।’

তবে ব্র্হ্মপুত্রের জেলেদের বরাতে উলিপুরের এক মাছ ব্যবসায়ীর দাবি, ‘ব্রহ্মপুত্রে শিকার করা মাছের প্রথম শ্রেণির গ্রাহক হলেন উপজেলা প্রশাসনের লোকজন, পুলিশ, প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সাংবাদিকরা।’

মৎস্য বিভাগ কী বলছে

উলিপুর উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা মো. তারিফুর রহমান সরকার বলেন, ‘অভিযান চলছে। আমরা নৌ পুলিশ নিয়ে অভিযান করেছি। মোবাইল কোর্ট সহ আরও অভিযান চলবে।’

তবে অভিযানের সীমাবদ্ধতার কথা জানিয়েছেন জেলা মৎস্য কর্মকর্তা (ডিএফও) কালিপদ রায়। তিনি বলেন, ‘ঢাল নাই তলোয়ার নাই অবস্থা। আমাদের নিজস্ব নৌকা বা স্পিডবোট নেই। জনবলও সংকট। তারপরও নদীতে অভিযান চলছে। মোবাইল কোর্টের জন্য জেলা প্রশাসনে রিকুইজিশন দেওয়া হয়েছে। অনুমোদন পেলে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হবে। অভিযান বাড়ানোর ব্যবস্থা করছি।’

/এমএএ/
সম্পর্কিত
ধরা পড়ছে ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ, জেলেপল্লীতে ঈদের আমেজ
পুকুরের পানিতে ধরা পড়লো ১০ কেজি ইলিশ
১১ থেকে ১৭ মার্চ জাটকা সংরক্ষণ সপ্তাহ
সর্বশেষ খবর
স্ত্রীকে নিয়ে ঘুমিয়ে ছেলে, রান্নাঘরে পুড়ে মারা গেলেন মা
স্ত্রীকে নিয়ে ঘুমিয়ে ছেলে, রান্নাঘরে পুড়ে মারা গেলেন মা
২৫ দিনেও গ্রেফতার হয়নি কেউ, পুলিশ বলছে সিসিটিভির ফুটেজ পায়নি
কুমিল্লা শিক্ষা প্রকৌশল কার্যালয়ে ঠিকাদারকে মারধর২৫ দিনেও গ্রেফতার হয়নি কেউ, পুলিশ বলছে সিসিটিভির ফুটেজ পায়নি
উপজেলা নির্বাচন: অংশ নিতে পারবেন না পৌর এলাকার ভোটার এবং প্রার্থীরা
উপজেলা নির্বাচন: অংশ নিতে পারবেন না পৌর এলাকার ভোটার এবং প্রার্থীরা
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ভোট শুরু
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ভোট শুরু
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ