আমাদের কোনও উৎসব নেই, আনন্দ নেই। আমাদের জীবনে কোনোদিন মনে হয় উৎসব ফিরেও আসবে না। স্ত্রী, মেয়ে, ভাইয়ের স্ত্রী, নাতনিদের হারিয়ে আমাদের দুটি পরিবার নিঃস্ব হয়ে গেছে। আমার আর কিছু ভালো লাগছে না। সংসারে কেন এত কষ্ট থাকবে, তাও শুধু আমাদের জন্য। এভাবেই আক্ষেপ নিয়ে কথাগুলো বলছিলেন বোদা উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের আরাজী শিকারপুর বটতলী গ্রামের বাসিন্দা হেমন্ত রায়।
গত রবিবার (২৫ সেপ্টেম্বর) দুপুরে পঞ্চগড় জেলার মাড়েয়া উপজেলার আউলিয়ার ঘাট এলাকায় করতোয়া নদীতে হিন্দু ধর্মাবলম্বী পুণ্যার্থীদের বহনকারী নৌকাডুবির ঘটনা ঘটে। ওই ঘটনায় হেমন্ত রায় স্ত্রী-কন্যাসহ পাঁচ স্বজনকে হারিয়েছেন। এদের মধ্যে চার জনের লাশ মিললেও এখন পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছে হেমন্তের নাতনি জয়া।
জানা যায়, জেলার বোদা উপজেলার মাড়েয়া বামনহাট ইউনিয়নের আরাজী শিকারপুর বটতলী গ্রামের বাসিন্দা বেংঠু রাম। তার দুই ছেলে হেমন্ত রায় ও বাসুদেব রায়। হেমন্ত রায়ের স্ত্রী কবিতা রানি। কবিতার তিন মেয়ে আলো, অর্পিতা ও শ্যামলী রানি এবং আলো রানির দুই মেয়ে জয়া ও জ্যোতি। আর হেমন্তের ভাই বাসুদেব রায়ের স্ত্রী রূপালি রানি ও তার মেয়ে নন্দিনী নৌকায় করে মহালয়ার অনুষ্ঠানে যাচ্ছিলেন।
নৌকাডুবিতে এই দুই পরিবারের পাঁচ জন তলিয়ে যান। এদের মধ্যে হেমন্তের স্ত্রী কবিতা রানি, মেয়ে শ্যামলী রানি, ভাই বাসুদেবের স্ত্রী রূপালি রানি ও নাতনি জ্যোতির মরদেহ উদ্ধার হয়েছে। তবে আরেক নাতনি জয়ার মরদেহ এখনও পাওয়া যায়নি।
নৌকাডুবির ঘটনায় বেঁচে যান হেমন্ত রায়ের দুই মেয়ে আলো ও অর্পিতা। সরেজমিন দেখা গেছে, নৌকাডুবি থেকে বেঁচে ফেরা অর্পিতা শুধুই কান্নাকাটি করছে। প্রতিবেশীদের গলা জড়িয়ে ধরে শুধুই মা কবিতা রানিকে ফিরিয়ে দেওয়ার আবদার করছে। কান্না করতে করতেই মূর্ছা যাচ্ছে সে।
একটু ধাতস্ত হলে অর্পিতা বলে, যে পাশে নৌকা ডুবেছে আমরা সে পাশেই ছিলাম। নৌকা পানিতে তলিয়ে যাওয়ার পর আমাদের ওপরে সবাই চেপে বসে। তখন আমরা দু’বোন জানপ্রাণ দিয়ে উপরে ওঠার চেষ্টা করি। একসময় আমি আলাদা হয়ে যাই। পানির গভীর দিয়ে সাঁতরে একটি নৌকার পাশে আসি। নৌকার লোকজন আমাকে তুলে এনে নদীর পাড়ে রেখে যায়। একপর্যায়ে আমি জ্ঞান হারাই। পরে আমার বড় বোন আলো আমাকে ডেকে তুলে। পরে দুজনে মিলে মাসহ সবাইকে খুঁজতে থাকি। বিষয়টি একজনের মোবাইল ফোন দিয়ে বাবাকে জানাই। পরে সেখান থেকে আমরা দু’বোন বাড়ি ফিরে আসি। পরের দিন মায়ের লাশ খুঁজে পাই।
এদিকে স্ত্রীকে হারিয়ে নির্বাক হেমন্তের ভাই বাসুদেব। তিনি বলেন, মেয়ে নন্দিনী ফিরে এলেও স্ত্রীকে হারিয়েছি। এখন আর আমার কিছুই ভালো লাগে না। সবই যেন শূন্য হয়ে গেছে।
হেমন্ত রায় বলেন, বদেশ্বরী মন্দিরে মহালয়ার অনুষ্ঠানে গিয়ে নৌকাডুবিতে সবকিছু হারিয়েছি। স্ত্রী, ভাইয়ের স্ত্রী, মেয়ে ও দুই নাতনিকে হারিয়েছি। আমি কিছু বলার ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। এখন আমাদের আর কোনও উৎসব নেই।
জয়ার লাশের জন্য আলোর আহাজারি
পঞ্চগড় সদর উপজেলার কামাত কাজলদীঘি ইউনিয়নের ঘাটিয়ার পাড়া গ্রামের ধীরেন্দ্রনাথ রায়ের স্ত্রী ও হেমন্তের রায়ের মেয়ে আলো রানি সাঁতরে নদীর পাড়ে উঠলেও হারিয়ে ফেলেন তার দুই মেয়ে জয়া ও জ্যোতিকে। ঘটনার দিনই ছোট মেয়ে জ্যোতির লাশ মেলে। তবে এখনও খোঁজ মেলেনি জয়ার। নৌকাডুবির ঘটনায় এখনও যে তিন জন নিখোঁজ রয়েছেন তাদের মধ্যে একজন জয়া।
জ্যোতি আর জয়ার মামা নীলকুমার রায় বলেন, জয়ার লাশের জন্য ঘটনার দিন থেকে আউলিয়ার ঘাটসহ বিভিন্ন এলাকায় খুঁজেছি। কিন্তু বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত জয়ার লাশ পাওয়া যায়নি। প্রতিদিন সকালে আসি আর রাতে বিফল মনোরথে বাড়ি ফিরে ডাই। ভগ্নিপতি আর বোনকে সান্ত্বনা দেওয়ার ভাষা নেই। তার বাড়িতে কেউ গেলে গলা জড়িয়ে ধরে শুধু বলে ‘আমার জয়ার লাশ কই, জয়ার লাশ এনে দাও’।
শোকে কাতর বোদা ও দেবীগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম
নৌকাডুবির ঘটনায় কেউ হারিয়েছে বাবা, কেউ মা, কেউ ভাই কেউ বোন। এসব পরিবারে থামছে না আহাজারি। ঘটনার কথা মনে হলেই হাউমাউ করে কেঁদে উঠছেন স্বজনরা। সমবেদনা জানাতে আসা প্রতিবেশীরাও বাকরুদ্ধ। এ অবস্থাতেই গ্রামে গ্রামে চলছে মৃতদের শ্রাদ্ধ ও পিণ্ডদান অনুষ্ঠান। স্বাভাবিক মৃত্যু হলে ১২-১৩ দিনের মধ্যে এসব আচার-অনুষ্ঠান পালনের কথা। তবে অস্বাভাবিক মৃত্যুর কারণে ৩-৪ দিনের মধ্যে অনুষ্ঠান করতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন স্বজনরা।
এদিকে নৌকাডুবির ঘটনায় বুধবার সন্ধ্যা পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৬৯। অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট দীপঙ্কর কুমার রায় এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, এ পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা ৬৯। আর নিখোঁজ রয়েছেন তিন জন। এরমধ্যে রয়েছে বোদা উপজেলার ৪৬ জন, দেবীগঞ্জ উপজেলায় ১৭, আটোয়ারী উপজেলার দুই, পঞ্চগড় সদর উপজেলার এক ও ঠাকুরগাঁও সদর উপজেলার তিন জন। মৃতদের মধ্যে পুরুষ ১৮ জন, নারী ৩০ এবং ২১ শিশু রয়েছে।
তিনি আরও জানান, বুধবার রাত পর্যন্ত দেবীগঞ্জ উপজেলার শালডাঙ্গা ইউনিয়নের ছত্রশিকারপুর হাতিডুবা গ্রামের মদন চন্দ্রের ছেলে ভুপেন ওরফে পানিয়া, বোদা উপজেলার সাকোয়া ইউনিয়নের ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের খগেন্দ্রনাথের ছেলে সুরেন ও পঞ্চগড় সদর উপজেলার ঘাটিয়ারপাড়া গ্রামের ধীরেন্দ্রনাথের মেয়ে জয়া রানি নিখোঁজ রয়েছেন।
আরও পড়ুন:
বিয়ের দেড় মাসেই হিমালয়-বন্যার চির বিচ্ছেদএকসঙ্গে এত লাশ কখনও দেখেনি মাড়েয়া গ্রামের মানুষ
ঘরে ১০ মাস বয়সী সন্তান, আঙিনায় স্বামীর লাশ
করতোয়ার পাড় থেকে শ্মশান ঘাট, লাশ আর লাশ
‘মায়ের পর বাবাও ফিরলেন, তবে লাশ হয়ে’
যে কারণে করতোয়ায় ভয়াবহ নৌকাডুবি