ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা আবারও চরমে পৌঁছেছে। ইসলামাবাদের দাবি, ভারত মঙ্গলবার গভীর রাতে পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলে অন্তত ৯টি স্থানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে। এতে অন্তত ২৬ জন নিহত ও ৪৬ জন আহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে শিশুও রয়েছে।
পাকিস্তান এ হামলাকে ‘যুদ্ধ ঘোষণার শামিল’ বলে উল্লেখ করেছে। দেশটির প্রতিরক্ষা বাহিনীর দাবি, ভারতের পাঁচটি যুদ্ধবিমান ও একটি ড্রোন ভূপাতিত করা হয়েছে। ভারতের আগ্রাসনের উপযুক্ত জবাব দেওয়া হয়েছে।
ভারত অবশ্য হামলাগুলোকে ‘সন্ত্রাসবাদী অবকাঠামো ধ্বংসে প্রতিরোধমূলক অভিযান’ বলে উল্লেখ করেছে। ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গত মাসে কাশ্মীরের বৈসারান উপত্যকায় হিন্দু তীর্থযাত্রীদের ওপর হামলার প্রতিক্রিয়ায় এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যেখানে ২৬ জন প্রাণ হারান। এক ভারতীয় কর্মকর্তা দ্য গার্ডিয়ানকে বলেছেন, এই হামলার জন্য যারা দায়ী, তাদের শাস্তি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি আমরা রেখেছি।
ভারতের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় সবচেয়ে বড় হতাহতের ঘটনা ঘটেছে পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের বাহাওয়ালপুর শহরে, যেখানে একটি মসজিদে হামলায় ১৩ জন নিহত হন। নিহতদের মধ্যে দুটি তিন বছরের শিশুকন্যাও রয়েছে। পাঞ্জাবের মুরিদকে ও পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের কোটলি এলাকায়ও হামলা হয়েছে। কোটলির এক মসজিদে ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরীসহ আরও কয়েকজন নিহত হন।
ভারতীয় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বুধবার সকালে এক সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, তারা লস্কর-ই-তৈয়বা ও জইশ-ই-মুহাম্মদ সংশ্লিষ্ট ‘সন্ত্রাসী প্রশিক্ষণ শিবির’ লক্ষ্য করে অভিযান চালিয়েছে।
সেনাবাহিনীর কর্নেল সুধীর চামোলি বলেন, ‘ভারতের ওপর আরেকটি হামলার প্রস্তুতির তথ্য গোপন সংস্থা পেয়েছে। তাই এই হামলা প্রতিরোধমূলক, পরিমিত ও দায়িত্বশীল ছিল।’
অন্যদিকে, পাকিস্তান বলছে, হামলাগুলোর কোনও লক্ষ্যই সন্ত্রাসবাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল না। তাদের ভাষায়, ‘ভারতের অভিযোগ ভিত্তিহীন ও অযৌক্তিক।’
পাকিস্তানের আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ অধিদফতরের মহাপরিচালক জেনারেল আহমেদ চৌধুরি বলেন, ‘ভারতীয় বিমানবাহিনীর কোনও বিমান পাকিস্তানের আকাশসীমায় ঢোকেনি। তারা সীমান্তবর্তী এলাকা থেকেই হামলা চালায়।’
তিনি আরও জানান, ভারতীয় বিমানগুলো হামলার পরে পাকিস্তান বিমানবাহিনীর প্রতিরোধের মুখে পড়ে।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ বলেছেন, ‘ভারতের যুদ্ধ ঘোষণার জবাবে পাকিস্তান জবাব দিচ্ছে ও দেবে। পাকিস্তানি জনগণ ও সশস্ত্র বাহিনী শত্রুর মোকাবিলা করতে জানে।’
বুধবার সকালে পাকিস্তানে জাতীয় নিরাপত্তা কমিটির জরুরি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে। হামলার কিছুক্ষণ পরই ভারতীয় নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের কুপওয়ারা জেলায় সীমান্ত রেখা বরাবর গোলাগুলি শুরু হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী জানায়, এই গোলাগুলিতে তাদের সাতজন বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং পাঁচজন আহত হয়েছে। পাকিস্তান দাবি করেছে, তাদের দিকেও পাঁচ বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে, যাদের মধ্যে একটি শিশুও রয়েছে। পাশাপাশি, কাশ্মীরের পাম্পোর এলাকার উইয়ান গ্রামে একটি ভারতীয় বিমান বিধ্বস্ত হয়।
২৫ বছর বয়সী স্থানীয় বাসিন্দা আদনান আহমদ বলেন, রাত ১টা ৪০ মিনিটে একটা বিকট শব্দ শুনি। জানালা দিয়ে দেখি একটি বিমানে আগুন ধরে নেমে আসছে। কিছুক্ষণ পরে সেটি গাছের ওপর আছড়ে পড়ে। সেখান থেকে এক ঘণ্টা ধরে বিস্ফোরণের শব্দ হচ্ছিল। এ ঘটনায় বিমানের পাইলট নিরাপদে বেরিয়ে আসেন এবং তাকে স্থানীয় সেনা হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে।
ভারতের অভ্যন্তরে এই হামলাগুলোর ব্যাপক প্রশংসা হচ্ছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্কর বলেন, বিশ্বকে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের নীতি নিতে হবে। প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাজনাথ সিং এক্সে লিখেছেন, ‘ভারত মাতার বিজয়’। কংগ্রেস দলের সভাপতি মল্লিকার্জুন খাড়গে বলেন, ‘ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাহস ও সংকল্পের জন্য আমরা গর্বিত।’
এই ঘটনার পর একাধিক আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্স পাকিস্তান ও উত্তর ভারতের বিভিন্ন রুটে ফ্লাইট বাতিল করেছে। ভারতের জনসংযোগমাধ্যম জানায়, শ্রীনগরসহ বেশ কিছু বিমানবন্দর বেসামরিক চলাচলের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। সব সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে সক্রিয় রাখা হয়েছে।
জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের মুখপাত্র বলেছেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে সংঘর্ষে বিশ্ব আরেকটি যুদ্ধের ঝুঁকি নিতে পারে না। আমরা সর্বোচ্চ সামরিক সংযমের আহ্বান জানাচ্ছি।
ওয়াশিংটনের স্টিমসন সেন্টারের দক্ষিণ এশিয়া বিশ্লেষক আসফান্দিয়ার মির বলেন, ‘২০১৬ ও ২০১৯ সালের মতো সীমিত হামলার চেয়ে এবার ভারতের পদক্ষেপ আরও বিস্তৃত এবং জোরালো। তারা একাধিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালিয়েছে এবং পাকিস্তানের মূল ভূখণ্ডে ঢুকেছে, যা আগের হামলাগুলোর তুলনায় বড় ধরনের পরিবর্তন।’ এই পরিস্থিতিতে দুই দেশের মধ্যে নতুন করে সর্বাত্মক যুদ্ধ বেধে যাওয়ার আশঙ্কা বিশেষজ্ঞরা উড়িয়ে দিচ্ছেন না।
সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান, নিউ ইয়র্ক টাইমস