যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যপ্রাচ্যে চার দিনের সফর শুধু বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র ও প্রযুক্তি চুক্তিতে সীমাবদ্ধ ছিল না—এ সফর মধ্যপ্রাচ্যে এক নতুন কূটনৈতিক বিন্যাসের জন্ম দিয়েছে, যার ফলে ইসরায়েল ক্রমেই একঘরে হয়ে পড়ছে। এই সফরের মাধ্যমে স্পষ্ট হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্র মধ্যপ্রাচ্যে এক নতুন বাস্তবতা মেনে নিচ্ছে, যেখানে সৌদি নেতৃত্বাধীন সুন্নি শক্তিগুলোই এখন মূল ভূমিকায়, আর ইসরায়েল চাইলেই আর কূটনীতির নিয়ন্ত্রক থাকতে পারছে না। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ খবর জানিয়েছে।
রিয়াদে সিরিয়ার ইসলামপন্থি নেতা আহমেদ আল-শারার সঙ্গে ট্রাম্পের করমর্দনের দৃশ্যটি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর একাকিত্বের প্রতীক হয়ে উঠেছে। আল-শারাকে ইসরায়েল একসময় স্যুট পরা আল-কায়েদা সন্ত্রাসী হিসেবে অভিহিত করেছিল।
রিয়াদে বৈঠকের পর ট্রাম্প সাংবাদিকদের বলেন, তিনি একজন প্রকৃত নেতা। তার মধ্যে সম্ভাবনা আছে।
সৌদি আরবের মধ্যস্থতায় এ বৈঠক সম্পন্ন হয়, যেখানে অস্ত্র, ব্যবসা ও প্রযুক্তির বিভিন্ন চুক্তি হয় যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরবের মধ্যে।
সৌদি আরব, কাতার ও সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করে ট্রাম্প এক নতুন মধ্যপ্রাচ্য বিন্যাস প্রতিষ্ঠা করেছেন। যেখানে ইরান নেতৃত্বাধীন ‘প্রতিরোধ অক্ষ’ দুর্বল হয়েছে আর ইসরায়েল হারিয়েছে তার ঐতিহ্যগত কূটনৈতিক গুরুত্ব। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন অঞ্চলভিত্তিক তিনটি ও পশ্চিমা দুটি সূত্র।
গাজায় যুদ্ধবিরতিতে ব্যর্থ হওয়া এবং ইরান ইস্যুতে মার্কিন অবস্থানের বিরোধিতা করার কারণে নেতানিয়াহুর প্রতি হোয়াইট হাউজের অসন্তোষ বাড়ছে বলে জানিয়েছেন সাবেক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড শেঙ্কার। তিনি বলেন, এই প্রশাসন অনেক বেশি লেনদেন নির্ভর এবং নেতানিয়াহু এখন কিছুই দিচ্ছেন না।
ইসরায়েলের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ঐতিহ্যগত সমর্থন একেবারে বন্ধ হচ্ছে না। তবে সূত্রগুলো বলছে, ট্রাম্প প্রশাসন নেতানিয়াহুকে জানাতে চাচ্ছে যে মার্কিন স্বার্থকে আটকে রাখলে সমর্থনও সীমিত হতে পারে।
হোয়াইট হাউজের জাতীয় নিরাপত্তা কাউন্সিলের মুখপাত্র জেমস হিউইট বলেছেন, ইসরায়েলের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক অটুট এবং গাজায় অবশিষ্ট জিম্মিদের মুক্ত করতে, ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনে বাধা দিতে এবং আঞ্চলিক নিরাপত্তা জোরদারে দুই দেশ একযোগে কাজ করছে।
তবে গোপনে ট্রাম্প প্রশাসনের অনেকেই নেতানিয়াহুর প্রতি বিরক্ত। একদিকে গাজায় যুদ্ধবিরতিতে অনীহা, অন্যদিকে ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক আলোচনার বিরোধিতা—এই দুটি ইস্যুতে ওয়াশিংটনের সঙ্গে তেলআবিবের দূরত্ব বাড়ছে।
নির্বাচনি প্রচারে ট্রাম্প গাজায় যুদ্ধবিরতি ও জিম্মি মুক্তির অঙ্গীকার করেছিলেন। কিন্তু তিনি প্রেসিডেন্ট পদে ফিরে আসার পরও নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতিতে সাড়া না দিয়ে বরং অভিযান আরও জোরদার করেছেন।
গাজায় ১৯ মাসের সংঘাতে মৃতের সংখ্যা ৫২ হাজার ৯০০ ছাড়িয়েছে বলে স্থানীয় স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা জানিয়েছেন। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত তুলেছে। এর পাশাপাশি দুর্নীতির মামলায় নিজ দেশে নেতানিয়াহুর বিচার চলছে।
ট্রাম্পের এ সফর ছিল এমন এক সময়ে, যখন নেতানিয়াহু সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টায় প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছেন। রিয়াদ স্পষ্ট জানিয়েছে—যুদ্ধ বন্ধ এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার স্পষ্ট রোডম্যাপ ছাড়া ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক হবে না।
নতুন আঞ্চলিক ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু এখন রিয়াদ, দোহা ও আবুধাবি। তারা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে উন্নত অস্ত্র, চিপস এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি চায়। ট্রাম্প প্রশাসনও এই চাহিদাকে সুযোগে পরিণত করেছে।
সফরের দ্বিতীয় পর্যায়ে কাতারে ট্রাম্পকে অভিজাত ৭৪৭ বিমান, রাজকীয় আতিথেয়তা ও একটি ব্যতিক্রমী রাজসভায় স্বাগত জানানো হয়। সেখানে ট্রাম্প বলেন, কাতার ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্ত করতে সাহায্য করছে।
তবে কাতার যে হামাসকে সহায়তা দেয়—তা নিয়ে ইসরায়েলে ক্ষোভ বাড়ছে। তেলআবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশ্লেষক ইউয়েল গুজানস্কি বলেন, অনেকে বোঝেন না কাতার এখন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ—সেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় সামরিক ঘাঁটি আছে।
হোয়াইট হাউজ জানিয়েছে, সফরে ট্রাম্প দুই ট্রিলিয়ন ডলারের বেশি বিনিয়োগ প্রতিশ্রুতি পেয়েছেন—এর মধ্যে রয়েছে বোয়িংয়ের বিমান চুক্তি, প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বিক্রি, ডেটা ও প্রযুক্তি বিনিময় চুক্তি। রিয়াদে ১৪২ বিলিয়ন ডলারের অস্ত্র চুক্তি হয়েছে, যা ইসরায়েলের আকাশ প্রতিরক্ষা আধিপত্যে হুমকি হিসেবে দেখা হচ্ছে।
ট্রাম্প সৌদি আরবকে পারমাণবিক শক্তিতে রূপান্তরের একটি চুক্তিও করছেন, যা ইসরায়েলে উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠছে।
সৌদি চাপে ট্রাম্প হঠাৎ সিরিয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। শারার সরকার সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল-আসাদকে হটিয়ে ক্ষমতায় আসে মাত্র কয়েক মাস আগে। হোয়াইট হাউজ একসময় শারার মাথার জন্য ১ কোটি ডলার পুরস্কার ঘোষণা করেছিল।
হুথিদের সঙ্গে ইয়েমেনে যুদ্ধবিরতি ও ইরানের সঙ্গে পারমাণবিক আলোচনা শুরুর মধ্য দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তাদের পূর্বাঞ্চলীয় কৌশল পুনর্বিন্যাস করছে—যার ফলে ইসরায়েল নিজেকে অনেকটাই ছিটকে পড়া হিসেবে দেখছে।
নেতানিয়াহুর সরকার ট্রাম্পের সফর নিয়ে প্রকাশ্যে কোনও প্রতিক্রিয়া জানায়নি। তবে ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম ও বিরোধী রাজনীতিবিদরা এই সফরকে ইসরায়েলের জন্য হুঁশিয়ারি হিসেবে দেখছেন।
সাবেক প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যে মৌলিক পরিবর্তন ঘটছে, আমাদের শত্রুরা শক্তিশালী হচ্ছে, আর নেতানিয়াহু ও তার দল নির্বিকার, নিষ্ক্রিয়, যেন তারা অস্তিত্বহীন।