ইসরায়েল গাজার উত্তর ও দক্ষিণে ব্যাপক স্থল অভিযান শুরু করেছে। রবিবার ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, তারা বিস্তৃত স্থল তৎপরতা চালাচ্ছে এবং নতুন সামরিক অভিযান শুরু করেছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, শনিবার রাতভর ইসরায়েলি বিমান হামলায় কমপক্ষে ১৩০ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ খবর জানিয়েছে।
স্থল অভিযান শুরু হলো এমন এক সময়ে, যখন কাতারে ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে পরোক্ষ শান্তি আলোচনা কার্যত ফলপ্রসূ হয়নি বলে দুই পক্ষের সূত্র জানিয়েছে।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কার্যালয় জানায়, আলোচনায় যুদ্ধবিরতি, জিম্মি বিনিময় এবং হামাসের শীর্ষ নেতাদের নির্বাসনের বিনিময়ে যুদ্ধ বন্ধের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হয়েছে। তবে হামাস আগে থেকেই এসব শর্ত প্রত্যাখ্যান করে আসছে।
এক শীর্ষ ইসরায়েলি কর্মকর্তা রবিবার জানান, আলোচনায় এখন পর্যন্ত কোনও অগ্রগতি হয়নি।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী জানায়, গত এক সপ্তাহে তারা গাজায় ৬৭০টির বেশি হামাস টার্গেটে বোমা হামলা চালিয়েছে। এই হামলার মাধ্যমে ‘গিডিয়নের রথ’ নামে নতুন স্থল অভিযানকে সমর্থন দেওয়া হয়েছে, যার লক্ষ্য হচ্ছে গাজার নির্দিষ্ট অংশে ‘কৌশলগত নিয়ন্ত্রণ’ প্রতিষ্ঠা। সেনাবাহিনী দাবি করেছে, এই অভিযানে তারা ডজনখানেক হামাস যোদ্ধাকে হত্যা করেছে।
এদিকে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, কেবল গত সপ্তাহেই ৪৬৪ জন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। শনিবার রাতের ১৩০ জন নিহতের সংখ্যা এই হিসাবে রাখা হয়নি।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র খালিল আল-দেকরান বলেছেন, রাতভর ইসরায়েলি হামলায় অনেক পরিবার পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে, বেঁচে নেই কেউ।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় আরও জানায়, ইসরায়েলের চলমান অভিযানে এখন পর্যন্ত ৫৩ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন এবং প্রায় ২৩ লাখ মানুষই বাস্তুচ্যুত হয়েছেন।
ইসরায়েল মার্চ মাস থেকে গাজায় খাদ্য, ওষুধ ও জ্বালানির প্রবেশ বন্ধ রেখেছে, যাতে করে হামাসকে জিম্মিদের মুক্তি দিতে চাপ প্রয়োগ করা যায়। সামরিক মহলের বরাতে জানানো হয়েছে, পুরো গাজা ভূখণ্ড দখলে নেওয়ার পরিকল্পনাও অনুমোদিত হয়েছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিশেষজ্ঞরা গাজায় দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
গাজার স্বাস্থ্য খাত কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। ইসরায়েলি অবরোধ এবং টানা হামলার ফলে অধিকাংশ হাসপাতালই কার্যক্ষমতার বাইরে। রবিবার গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, উত্তর গাজার অন্যতম বৃহৎ হাসপাতাল ইন্দোনেশীয় হাসপাতাল ইসরায়েলি হামলার কারণে সেবা কার্যক্রম বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী দাবি করেছে, তারা সন্ত্রাসী অবকাঠামো লক্ষ্য করে হামলা চালাচ্ছে, যার মধ্যে ওই হাসপাতালের পাশের এলাকাও রয়েছে।
শিফা হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, শনিবার রাতে ৪০টি মৃতদেহ এবং অসংখ্য আহত ব্যক্তিকে আনা হয়েছে। রক্ত সংকট দেখা দেওয়ায় তারা রক্তদানের আহ্বান জানিয়েছে।
ফিলিস্তিনি জরুরি সেবা বিভাগ জানায়, তাদের ৭৫ শতাংশ অ্যাম্বুলেন্স জ্বালানির অভাবে অচল হয়ে পড়েছে। ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সব গাড়ি থেমে যেতে পারে বলে তারা সতর্ক করেছে।
কাতারে চলমান আলোচনা নিয়ে এক হামাস কর্মকর্তা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেছেন, ইসরায়েলের অবস্থান অপরিবর্তিত। তারা কেবল জিম্মিদের মুক্তি চায় কিন্তু যুদ্ধ বন্ধে কোনও প্রতিশ্রুতি দিতে চায় না।
হামাসের পক্ষ থেকে এখন যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তা হলো—সব ইসরায়েলি জিম্মির মুক্তির বিনিময়ে যুদ্ধ বন্ধ, সেনা প্রত্যাহার, অবরোধ প্রত্যাহার এবং ফিলিস্তিনি বন্দিদের মুক্তি।
কয়েকটি ইসরায়েলি ও আরব সংবাদমাধ্যমে জানানো হয়েছে, হামাস নেতা মোহাম্মদ সিনওয়ার হয়তো নিহত হয়েছেন। তবে হামাস এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানায়নি। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ও কোনও মন্তব্য করেনি।
গাজার মেডিক্যাল সূত্র জানায়, মোহাম্মদ সিনওয়ারের ভাই বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক জাকারিয়া আল-সিনওয়ারকে মৃত ভেবে মর্গে পাঠানো হলেও পরে দেখা গেছে তিনি জীবিত আছেন, তবে তারা অবস্থা আশঙ্কাজনক।
যুদ্ধ শেষ না হওয়ায় ইসরায়েলে ক্ষোভ বাড়ছে। এক জিম্মির মা আইনাভ জানগাউকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখেছেন, সরকার রাজনৈতিক স্বার্থে যুদ্ধ থামাতে চাচ্ছে না। আমাদের সন্তানদের ফিরিয়ে আনুন!
শনিবার রাতে ইসরায়েলের এক বিমান হামলা দক্ষিণ গাজার খান ইউনুসে এক আশ্রয়কেন্দ্রকে লক্ষ্য করে চালানো হয়। এতে নারী ও শিশুসহ বহু মানুষ নিহত হন এবং অনেক তাঁবুতে আগুন ধরে যায়।