ইরানে ইসরায়েলি হামলার উদ্দেশ্য কী? তেহরানের পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র সক্ষমতা ধ্বংস করাই ইসরায়েলের বিমান হামলার একমাত্র লক্ষ্য নয়। দেশটির এই বিস্তৃত অভিযানের লক্ষ্য হচ্ছে সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনির শাসন ভিত্তি ভেঙে দেওয়া। তার সরকারকে পতনের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাওয়া—এমনটাই জানিয়েছেন ইসরায়েলি, পশ্চিমা ও আঞ্চলিক কর্মকর্তারা।
সূত্রগুলো জানায়, ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু চান, ইরান এতটাই দুর্বল হয়ে পড়ুক যাতে তারা পারমাণবিক সমৃদ্ধকরণ চিরতরে ত্যাগ করে। ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি বন্ধ এবং অঞ্চলজুড়ে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রতি সমর্থন প্রত্যাহারে বাধ্য হয়। খামেনির সরকার কার্যত অচল হয়ে পড়ুক-এটাই চান নেতানিয়াহু।
১৯৭৯ সালের ইসলামি বিপ্লবের পর ইরানের ইসলামিক সরকার এত বড় অস্তিত্ব সংকটের মুখে পড়েনি। এমনকি ১৯৮০-৮৮ সালের ইরান-ইরাক যুদ্ধেও এইভাবে ধর্মীয় শাসনব্যবস্থা হুমকির মুখে পড়েনি। মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে উন্নত সামরিক শক্তিধর দেশ ইসরায়েল এখন ড্রোন, এফ-৩৫ জঙ্গিবিমান, মোসাদের গুপ্তহত্যা এবং সাইবার প্রযুক্তির মাধ্যমে ইরানের যেকোনও জায়গায় আঘাত হানতে সক্ষম।
সাম্প্রতিক দিনে ইসরায়েল তাদের লক্ষ্য বিস্তৃত করেছে। এর মধ্যে রয়েছে তেহরানে সরকারি প্রতিষ্ঠান—পুলিশ সদর দপ্তর এবং রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন ভবনও। নেতানিয়াহুর সরকার অন্তত দুই সপ্তাহের জন্য ব্যাপক বিমান হামলার পরিকল্পনা করছে বলে চারটি সরকারি ও কূটনৈতিক সূত্র জানিয়েছে। যদিও অভিযান কতদিন চলবে, তা নির্ভর করছে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র মজুদ এবং উৎক্ষেপণ ক্ষমতা ধ্বংসের গতি নির্ভর করে।
মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক সাবেক মার্কিন দূত ডেনিস রস মনে করেন, ইরান এখন চাপ অনুভব করছে এবং সাম্প্রতিক হামলায় খামেনির অভ্যন্তরীণ বৃত্ত ধ্বংস হওয়া, পারমাণবিক স্থাপনা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া এবং শীর্ষ নিরাপত্তা কর্মকর্তারা নিহত হওয়ার ফলে তারা আলোচনার দিকে এগোতে পারে।
ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসির সিনিয়র ফেলো রস আরও বলেন, ইসরায়েলের মূল লক্ষ্য হচ্ছে ইরানের পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি ধ্বংস করা, তবে যদি এই হামলায় সরকার পতন ঘটে, তাহলে ইসরায়েল নিশ্চয়ই দুঃখিত হবে না।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সাম্প্রতিক দিনগুলোতে আক্রমণাত্মক ভাষা ব্যবহার করলেও, যদি তেহরান বিশ্বাসযোগ্যভাবে কোনও সমঝোতার পথ দেখায়, তবে ট্রাম্প তা গ্রহণ করতে পারেন বলে রস মনে করেন।
তবে পূর্ববর্তী ছয় দফা পরমাণু আলোচনায় ইরান কোনও ছাড় দেয়নি। তাই এবার যুক্তরাষ্ট্র কঠোর নিশ্চয়তা চাইবে—যেমন চিরতরে সমৃদ্ধকরণ কর্মসূচি পরিত্যাগ না করলে যুদ্ধবিরতি অসম্ভব।
ইরানের জন্য এখন একটি গুরুত্বপূর্ণ হিসাব হচ্ছে, ৮৬ বছর বয়সী খামেনিকে যেন অসম্মানজনকভাবে সরে যেতে বাধ্য না করা হয়। দুইজন ইরানি সূত্র জানায়, যদি তাকে মর্যাদা বা বাঁচার সুযোগ না দেওয়া হয়, তবে তিনি সর্বাত্মক যুদ্ধ বেছে নিতে পারেন।
মঙ্গলবার ট্রাম্প সোশ্যাল মিডিয়ায় ইরানের ‘নির্বিচার আত্মসমর্পণ’ দাবি করেন। জবাবে খামেনি টেলিভিশনে বলেন, যদি যুক্তরাষ্ট্র ইরানে সামরিক হস্তক্ষেপ করে, তাহলে এর প্রতিক্রিয়া হবে অপরিবর্তনীয় ধ্বংস।’
সম্প্রতি নেতানিয়াহু সরাসরি শাসন পরিবর্তনের কথা বলেছেন এবং ইরানিদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন, ‘মুক্তির দিন আসছে।’
আঞ্চলিক সরকারগুলো শঙ্কিত, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে ইরান সম্পূর্ণ বিশৃঙ্খলায় নিমজ্জিত হতে পারে অথবা সংঘাত ছড়িয়ে পড়তে পারে পুরো অঞ্চলে।
এছাড়া পর্দার আড়াল থেকে প্রক্সি যুদ্ধ চালানোর যে কৌশল ইরান দীর্ঘদিন ধরে ব্যবহার করে আসছিল, তা ইসরায়েলি অভিযানে ভেঙে পড়েছে—বিশেষ করে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের ইসরায়েল আক্রমণের পর।
গাজায় হামাস ধ্বংস হয়েছে, লেবাননে হিজবুল্লাহ পরাজিত, সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদ বিদ্রোহীদের হাতে ক্ষমতা হারিয়েছেন আর ইয়েমেনে হুথিরা প্রতিরক্ষামূলক অবস্থানে চলে গেছে।
তেহরানের মিত্র হিসেবে পরিচিত রাশিয়া ও চীন কার্যত নিষ্ক্রিয় রয়েছে। পশ্চিমা শক্তিগুলো এখন ইরানের আঞ্চলিক প্রভাব এবং পারমাণবিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা নির্মূল করতেই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। যদিও সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত প্রকাশ্যে ইসরায়েলের হামলার নিন্দা করেছে। তবে বিশ্লেষকদের মতে, এই শিয়া প্রতিদ্বন্দ্বীর দুর্বলতা এসব সুন্নি উপসাগরীয় দেশ গোপনে স্বাগত জানাতে পারে। বিশেষত ইরান-সমর্থিত গোষ্ঠীগুলো অতীতে উপসাগরের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোতে হামলা চালিয়েছে।
এছাড়া ইরানের সামরিক বিকল্প খুবই সীমিত। ইসরায়েল কার্যত ইরানের আকাশ নিয়ন্ত্রণ করছে, তাদের বিমান প্রতিরক্ষা ধ্বংস হয়ে গেছে। ইরানের অধিকাংশ ক্ষেপণাস্ত্র মজুদ ধ্বংস হয়েছে। প্রায় ৪০০টির মতো ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হলেও সেগুলোর বেশিরভাগ ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় ধ্বংস হয়েছে।
তবে ইরানের বিরোধী গোষ্ঠী বিভক্ত, এবং রেভল্যুশনারি গার্ড (আইআরজিসি) ও তাদের আড়াই লাখ সদস্যবিশিষ্ট বেসিজ বাহিনীর মধ্যে বিভাজনের কোনও লক্ষণ নেই, ফলে সরকার পতনের সম্ভাবনা এখনও ক্ষীণ।
তেহরানের রাস্তায় বড় কোনও বিক্ষোভ দেখা যায়নি। অনেক ইরানি বরং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ। স্থল আক্রমণ বা অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ছাড়া সরকার পতনের সম্ভাবনা দুরাশা বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
তবে আঞ্চলিক পর্যবেক্ষকরা সতর্ক করে বলছেন, আসল ক্ষমতা এখন খামেনির পুত্র মুজতবা ও আইআরজিসির হাতে। তারা এখনও শাসনব্যবস্থার মূল ভিত্তি। ফলে লাখো শিয়াদের ধর্মীয় নেতা খামেনিকে হত্যা করলে বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে।
তবে যদি সংঘাত আরও বাড়ে এবং খামেনির সরকার পতন ঘটে, আঞ্চলিক নেতারা শঙ্কা প্রকাশ করছেন—এর ফলে গণতন্ত্র নয় বরং বিশৃঙ্খলা তৈরি হতে পারে।
ইরানে সংখ্যালঘু আরব, কুর্দি, আজারি, বালুচি, বাহাই ও খ্রিষ্টান জনগোষ্ঠীগুলো তখন আলাদা শক্তি হিসেবে মাথাচাড়া দিতে পারে।
মিডল ইস্ট ইনস্টিটিউটের ইরান প্রোগ্রামের পরিচালক অ্যালেক্স ভাতানকা বলেন, তেহরানে সরকারের পতনের অভিঘাত ইরানের সীমান্তেই থেমে থাকবে না। একটি অস্থিতিশীল ইরান, আজারবাইজান থেকে পাকিস্তান পর্যন্ত অস্থিরতা ছড়িয়ে দিতে পারে।
সূত্র: রয়টার্স