X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ফেসবুক লাইভে ডা. সংযুক্তা সাহার ‘অনৈতিক’ অবস্থান

উদিসা ইসলাম
২১ জুন ২০২৩, ২২:০৩আপডেট : ২১ জুন ২০২৩, ২২:২৭

মাহবুবা রহমান আঁখি ও তার নবজাতক সন্তানের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে চিকিৎসক সংযুক্তা সাহার বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ উঠেছে। সংযুক্তা সাহার দাবি—তিনি সেদিন দেশে ছিলেন না এবং এই অপারেশনের বিষয়ে তার কিছু জানা ছিল না।  প্রশ্ন জাগে, তাহলে  মা ও সন্তানের মৃত্যুর ঘটনায় ডা. সংযুক্তার সম্পৃক্ততা কতখানি? প্রয়াত আঁখি ও তার স্বজনরা বলছেন, তার (ডা. সংযুক্তা সাহা) তত্ত্বাবধানে অর্ধ-ডজনের বেশি চিকিৎসক যেমন প্রেসক্রিপশন লেখেন ও রোগী দেখেন, তেমনি তারা অপারেশনও করে থাকেন। গ্রেফতার দুই চিকিৎসক ডা. শাহজাদী ও ডা. মুনার জবানবন্দি অনুযায়ী, ডা. সংযুক্তা সাহা হাসপাতালে উপস্থিত না থাকলেও তার নামে রোগী ভর্তির নির্দেশ তিনিই দিয়ে রেখেছিলেন। তার রোগী দেখা, রোগী ভর্তি ও অপারেশনের এই ধরনটি হাসপাতাল কর্তৃপক্ষও জানতেন।

এদিকে ডা. সংযুক্তা সাহার বিভিন্ন রোগী ও তাদের স্বজনদের অভিযোগ—ফেসবুক লাইভে এসে রোগীর অতি ব্যক্তিগত বিষয়ও পাবলিক করেন এই চিকিৎসক। কার ‘দুটি বাচ্চা’ নষ্ট হওয়ার পরে, কার জরায়ুতে সমস্যা থাকার পরে, কার শারীরিক কোন জটিলতায় বাচ্চা হচ্ছিল না—সব পাবলিক করে তিনি আহ্বান জানাতে থাকেন, তার কাছে চিকিৎসা নেওয়ার। তার ফেসবুক লাইভের প্রধান আহ্বান ‘নরমাল ডেলিভারি’। এসবই একজন চিকিৎসকের জায়গা থেকে ‘অনৈতিক’ বলে মন্তব্য করেছেন জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকরা।

সংযুক্তা সাহার বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলেন ‘ফুডআপ্পি’ নামের এই ভ্লগার

ডা. সংযুক্তা সাহা গত ২ জুন ফেসবুক পেজে এক লাইভে এসে উল্টো বাচ্চা কীভাবে তিনি নরমাল ডেলিভারি করান—সেটির বর্ণনা দেওয়ার সময় নবজাতকের ভিডিও দেখান। তিনি রোগী ও স্বজনদের বারবার বলতে থাকেন, ‘ভিউয়ারদের অভিজ্ঞতা বলেন’। এ সময় তার পরনে হাসপাতালের পোশাক ছিল। এই লাইভে তিনি দাবি করেন কীভাবে তিনি রোগীদের প্রতি যত্নশীল। যদিও ডা. সংযুক্তা সাহাকে দেখাতে গিয়ে তার কাছে পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেননি, এমন অনেক অভিযোগ পাওয়া যায় রোগীদের কাছ থেকে।

রোগীর প্রসব পরবর্তী ক্ষতি পোষান যেভাবে

২০২২ সালের নভেম্বরে ডা. সংযুক্তা সাহার কাছে সন্তান ডেলিভারি হয়েছিল মিরপুরের এক নারীর। তার স্বামীর দেওয়া ভিডিও বক্তব্যে জানা যায়, ফেসবুকে সংযুক্তা সাহার নরমাল ডেলিভারির বিজ্ঞাপন দেখে স্ত্রীকে নিয়ে তিনি সেন্ট্রাল হাসপাতালে আসেন। ভর্তি হওয়ার প্রায় ১৫ ঘণ্টা পরে তার স্ত্রী বাচ্চা প্রসব করেন। পরের দিন তাকে ৮০ হাজার টাকা বিল ধরিয়ে দেওয়া হয়। কেন এত বিল, এটা জিজ্ঞাসা করতেই সংযুক্তা সাহা বলেন, ‘বিরিয়ানি খেয়ে সাদা ভাতের বিল দেওয়া যায় না।’ সেটা তো গেলো। এর কিছু দিন পর ওই নারীর জরায়ুর মুখে নানা জটিলতা দেখা দেয়। পরবর্তী সময়ে ডা. সংযুক্তা সাহা ভুল স্বীকার করে ওই নারীকে বিনামূল্যে চিকিৎসা করলেও এখনও সেই সমস্যা রয়ে গেছে। মিরপুরের এই নারীর স্বামী অভিযোগ করে বলেন, সংযুক্তা সাহা রোগীর কোনও প্রাইভেসি রাখতে জানেন না। সবাই স্বেচ্ছায় যে তার ভিডিওতে আসেন, এমন না। উনি ভিডিও বিজ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে রোগী ধরেন, ডেলিভারির পরে আবার ভিডিও করে সেটা ভাইরাল করেন।

চাইলেও তার দেখা মেলে না, সহকারীরাই ভরসা

সাংবাদিক নওরীন আখতার তার অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সিরিয়াল নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে মাত্র ৩০ সেকেন্ডের জন্য সংযুক্তার চেম্বারে ঢুকেও কথা বলার সুযোগ হয়নি তার। সহকারীর কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে ফিরতে হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমি কনসিভ করার পরে ডা. সংযুক্তা সাহা সম্পর্কে নানা জনের কাছে শুনে প্রথমে তার কাছেই গেলাম। আমার জীবনের অন্যতম ভয়ংকর অভিজ্ঞতা ছিল সেটা। চেম্বারে হাজার হাজার মানুষ। শত শত সিরিয়াল, গরম ও অস্বস্তি। আমার শরীর তুলনামূলক ভালো—তাও আমার নাভিশ্বাস উঠে যাচ্ছিল। সেখানে লাস্ট ট্রাইমিস্টারের অনেক রোগী ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে অপেক্ষা করছেন। চেম্বারে ঢুকলাম যখন, তখন আমার সঙ্গে আরও কয়েকজন ঢুকলো। সেখানে আমি সবচেয়ে কম কমপ্লিকেশনের রোগী। আমার সঙ্গে কথা বলার কোনোই প্রয়োজন বোধ করলেন না সংযুক্তা সাহা। তার অ্যাসিস্ট্যান্ট বিল নিলেন, তিনিই একটা ফাইল ধরিয়ে দিলেন। সেখানে কখন কী খাবার খেতে হবে, এমন একটা নির্দেশিকা প্রিন্ট আকারে। আর কী টেস্ট করতে হবে সেটাও লেখা। ৩০ সেকেন্ড ছিলাম তার চেম্বারে, তাও দাঁড়িয়ে। বসার জায়গা ছিল না।’

সংযুক্তা সাহার কাছে স্ত্রীর চিকিৎসা করাতে গিয়ে নেতিবাচক অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন এই ব্যক্তি রোগীদের অনুমতি না নিয়ে ভিডিওর অভিযোগ

ডা. সংযুক্তা সাহা যে রোগীর প্রাইভেসি রাখেন না, তার আরেকটি অভিযোগ পাওয়া যায় বিখ্যাত ভ্লগার ‘ফুডআপ্পি’র পোস্টে। তিনি জানান, কীভাবে একটার পর একটা কক্ষে পাঠানোর পর ফাইনালি যখন সংযুক্তা সাহার কক্ষে প্রবেশ করেন তিনি, সেখানে দেখতে পান অনেক জুনিয়র ডাক্তার বসা। একটি রুমের মধ্যেই তারা একাধিক রোগী দেখছেন, কথা শুনছেন, ব্যায়াম শেখাচ্ছেন।

বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের কোড অব প্রফেশনাল কনডাক্ট, এটিকেট অ্যান্ড এথিকসে বলা আছে—রোগীকে শনাক্ত করতে পারে, এমন বিষয়াদির ক্ষেত্রে প্রাইভেসি ও গোপনীয়তার নিয়ম মেনে সুরক্ষা নিশ্চিত করা উচিত। সেখানে এই চিকিৎসক কোনোভাবেই অন্যের অনুমতি নেওয়া যে প্রয়োজন, সেটাও মনে করেন না বলে রোগীদের স্বজনদের অভিযোগ। তারা বলছেন, দূরদূরান্ত থেকে বাচ্চা জন্ম দিতে মায়েরা আসেন, প্রসবের পর ইমোশনাল থাকেন বলে চিকিৎসকের ভিডিওতে কথা বলেন। তারা অনেকে জানেনও না যে এটা লাইভ হচ্ছে না কোথায় আপলোড হচ্ছে।

বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ)-এর সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ডা. রশিদ-ই মাহবুব মনে করেন, ফেসবুকে এ ধরনের বিজ্ঞাপন দেওয়া ভীষণভাবে অনৈতিক। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিএমডিসি’র এসব বিষয় মনিটরিংয়ে রাখা উচিত। একজন চিকিৎসক তিনি যে বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সেটি জানাতে পারেন। তার চেম্বারের বাইরে ডিগ্রি ও ডিপ্লোমা প্রদর্শনের সুযোগ আছে। এখন বিশ্বজুড়ে ফেসবুকে তার অভিজ্ঞতাও তুলে ধরার রেওয়াজ দেখা যায়। কিন্তু লাইভ করে নরমাল ডেলিভারির প্রলোভন দেখানো তার কাজ না।

ডা. সংযুক্তা সাহার ফেসবুক লাইভের স্ক্রিন শট প্রবীণ এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, ‘রোগীর প্রাইভেসি রক্ষা করা চিকিৎসকের কর্তব্য। এটা তো মার্কেটিং না। এমনকি তিনি নরমাল ডেলিভারির যে বিজ্ঞাপন দিচ্ছেন, সেটিও একজন চিকিৎসকের কাজ না। চিকিৎসক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বুঝবেন যে কোনভাবে প্রসব করানো সম্ভব হবে। যেকোনোভাবে নরমাল করানোর কাজ তো ধাই মায়ের, চিকিৎসকের না।’

চিকিৎসকরা নিজেদের বিশেষত্ব, প্রাজ্ঞতা প্রচার করতে কতটুকু পারেন প্রশ্নে স্বাধীনতা চিকিৎসক পরিষদের নেতা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) বেসিক সায়েন্স অ্যান্ড প্যারা ক্লিনিক্যাল সায়েন্স অনুষদের সাবেক ডিন অধ্যাপক ডা. ইকবাল আর্সলান বলেন, ‘চিকিৎসকরা যেকোনও ধরনের আত্মপ্রচারণা থেকে বিরত থাকবেন, এটাই কাম্য। তাদের পারদর্শিতা, তাদের দক্ষতা—এসব কতটুকু ডিসপ্লে করতে পারবেন, তার নির্দিষ্ট সীমারেখার বাইরে যাওয়া অনৈতিক।’ রোগীদের রোগ ও চিকিৎসা বিষয়ে লাইভে জানানো প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘যেকোনও রোগীর পরিচিতি, চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য কোনোভাবেই পাবলিক করা উচিত না। এটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হওয়া উচিত।’

আরও পড়ুন:

আঁখির হাসপাতালে ভর্তির ‘তথ্য জানতেন’ ডা. সংযুক্তা সাহা

সরেজমিন সেন্ট্রাল হাসপাতাল: সেবার নামে অরাজকতা চলে যেখানে

কী ঘটেছিল অপারেশন থিয়েটারে, যেসব প্রশ্নের জবাব মিলছে না

সেন্ট্রাল হাসপাতালকে দুষছেন ডা. সংযুক্তা

আঁখির মৃত্যুর ঘটনায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি

সেন্ট্রাল হাসপাতালে সব ধরনের অপারেশন বন্ধের নির্দেশ 

সেন্ট্রাল হাসপাতালের দুই চিকিৎসক কারাগারে

নবজাতকের মৃত্যু: সেন্ট্রাল হাসপাতালের দুই চিকিৎসকের দায় স্বীকার

ডা. সংযুক্তা সাহার কারণেই আজ এই অবস্থা: সেন্ট্রাল হাসপাতাল

সেবার নামে অরাজকতা চলে যেখানে

ফেসবুক ব্যবহার করে ‘রোগী ডাকতে’ না করলো সেন্ট্রাল হাসপাতাল

ল্যাবএইডের বিল দিতে হবে সেন্ট্রাল হাসপাতালকে

/এপিএইচ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
গরমে বেড়েছে স্বাস্থ্যঝুঁকি, রংপুর হাসপাতালে পাঁচ দিনে ২২ জনের মৃত্যু
চিকিৎসা সুরক্ষা আইন জরুরি‘শো মাস্ট গো অন’
চিকিৎসক ছাড়াই রক্ত ট্রান্সফিউশনের সময় হাজির ম্যাজিস্ট্রেট
সর্বশেষ খবর
জেসি অনভিজ্ঞ বলেই আপত্তি ছিল মোহামেডান-প্রাইম ব্যাংকের
জেসি অনভিজ্ঞ বলেই আপত্তি ছিল মোহামেডান-প্রাইম ব্যাংকের
যাত্রাবাড়ীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
যাত্রাবাড়ীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
শেখ জামালের জন্মদিন আজ
শেখ জামালের জন্মদিন আজ
জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস আজ
জাতীয় আইনগত সহায়তা দিবস আজ
সর্বাধিক পঠিত
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
তাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
প্রাক-প্রাথমিক বন্ধই থাকছেতাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু