X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১
পর্ব—ছয়

কুসতুনতুনিয়ায় কয়েকদিন

মুহম্মদ মুহসিন
১৫ জুলাই ২০২২, ০০:০০আপডেট : ১৫ জুলাই ২০২২, ০০:০০

পূর্ব প্রকাশের পর

জুমার নামাজের পরে খাওয়া দাওয়া শেষ করে গিয়ে দেখি মসজিদে প্রবেশের জন্য টুরিস্টদের বিশাল লাইন। লাইনে দাঁড়িয়ে ১৫-২০ মিনিটের চেষ্টায় ঢুকতে পারলাম ব্লু মসজিদের ভিতরে। মসজিদের তখন সংস্কার কাজ চলছিল। ফলে ভিতরের মূল নামাজের জায়গায় কিছু অংশই শুধু টুরিস্টদের জন্য উন্মুক্ত ছিল। অন্যান্য ঐতিহাসিক মসজিদের মতো এখানেও মিহরাবের কাছাকাছি কিছু জায়গা মুসল্লিদের জন্য নির্দিষ্ট, অর্থাৎ ওখানে টুরিস্ট ঢুকবে না। আমি সেখানে গিয়ে দুরাকাত নামাজ পড়ে এই ঐতিহাসিক মসজিদের দর্শন সম্পন্ন করে নেমে আসলাম আবার সুলতান আহমেদ স্কয়ারে। সুলতান আহমেদ স্কয়ারে আরো যে সব ঐতিহাসিক নিদর্শন রয়েছে সেগুলোর মধ্যে সুলতান আহমেদ মাদ্রাসা অন্যতম। এটিও ব্লু মস্কের কমপ্লেক্সের অংশ, অর্থাৎ সুলতান আহমেদের নির্দেশনায় নির্মিত। ২৪ কক্ষ বিশিষ্ট এই মাদ্রাসার নান্দনিক আঙ্গিকও অতুলনীয়। ১৯২৪ সাল পর্যন্ত তিনশো বছরের অধিককাল এ মাদ্রাসায় হাদিসের উচ্চতর অধ্যয়ন ও গবেষণা পরিচালিত হয়েছে। ১৯২৪ সালের কামাল পাশার প্রবর্তিত শিক্ষানীতি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে এ মাদ্রাসার কার্যক্রম নিষিদ্ধ হয়। তবে শুনলাম বর্তমান সরকার মাদ্রাসাটি পুনরায় হাদিস অধ্যয়নের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। আমরা যখন দেখলাম তখন ব্লু মস্কের সাথে সাথেই এই মাদ্রাসার সংস্কারের কাজও চলছিল। ফলে ভিতরে প্রবেশের আর সুযোগ হয়নি। সুলতান আহমেদ স্কয়ারের আরো ঐতিহাসিক স্থান এবং সন্নিহিত তোপকাপি মিউজিয়াম পরিদর্শনের পরিকল্পনা পরের দিনের জন্য রেখে এবার আমরা ঠিক করলাম বসফরাস ট্যুরে বের হব।

এ উদ্দেশে সুলতান আহমেদ স্কয়ার ত্যাগ করে আমাদের গন্তব্য এমিনোনু। সেখান থেকে আমরা উঠব বসফরাস প্রণালি ট্যুরের বোটে। যে জায়গা থেকে আমরা উঠব সেটি অবশ্য বসফরাস প্রণালির তীরে না, বরং বসফরাস থেকে উঠে আসা গোল্ডেন হর্ন নদীর তীরে অবস্থিত। এমিনোনুতে বোটের জেটিতে পৌঁছে গোল্ডেন হর্নের পানির দিকে তাকিয়ে আমার আর লুসির সে এক অবাক বিস্ময়! কয়েক হাজার বছরের পুরনো একটি মেগাসিটির পাশের ছোট্ট একটি নদীর জল এত স্বচ্ছ আর এত পরিষ্কার হতে পারে! এই শহরের দেড় কোটি মানুষের এক মাসের প্রস্রাব জমা হলে এই গোল্ডেন হর্ন নদীর পানির চেয়ে প্রস্্রাবের আয়তন বড় হয়ে যাওয়ার কথা। অথচ সেই রকম একটি শহরের বর্জ্য এসে এই দুই আড়াই হাজার বছরেও এই পানির এতটুকু ক্ষতি করতে পারল না। আর, হায়রে বাংলাদেশ! নদীমাতৃক বাংলাদেশের বুড়িগঙ্গা ঢাকা শহরের বর্জ্য গিলে গিলে আজ কোন জায়গায় পৌছেছে! লঞ্চের কেবিনে দরজা দিয়ে ঘুমিয়ে থাকি। আর সেই লঞ্চ বুড়িগঙ্গা ঢোকারও পাঁচ দশ কিলোমিটার আগে থেকেই কেবিনের মধ্যে নদীর পচা পানির এমন গন্ধ ঢুকে যায় যে, কেবিনের মধ্যে কম্বল টেনে নাক ঢাকতে হয়। এই হলো ঢাকা শহরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। সেই দেশের মানুষ এসে হাজার হাজার বছরের পুরনো এক শহরের পাশে ছোট্ট একটি নদীর পানি এত স্বচ্ছ ও টলটলে দেখলে বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে যাবে—সে তো খুবই স্বাভাবিক।

এই বিস্ময় চোখেমুখে নিয়েই উঠলাম বোটে। বোট চলল নদীর উত্তর পাশ ধরে। নদীর পাড় অসাধারণ দৃষ্টিনন্দন। কোথাও একটু কোনো আবর্জনা নেই। একটি প্লাস্টিকের বোতল বা একটি পলিথিনের ব্যাগ কোথাও ভাসছে না। নদীর দুপাশ যেন কোনো পার্কের সাজানো লেকের পাড়। নদী থেকে শহেরর মসজিদগুলোর এত মিনার চোখে পড়ছিল মনে হচ্ছিল পুরো ইস্তাম্বুল এক মসজিদ আর মিনারের শহর। বোট বসফরাস প্রণালিতে প্রবেশ করল। বসফরাস পৃথিবীর এমন এক প্রণালি যার ভিতরে সার্বক্ষণিক চলতে থাকে দুটি বিপরীত জলস্রোতে। বসফরাসের উত্তর মাথায় হলো কৃষ্ণসাগর আর দক্ষিণ মাথায় হলো মর্মর সাগর। কৃষ্ণসাগরের পানির উপরিভাগ মর্মর সাগরের পানির চেয়ে সাড়ে নয় ফুট উঁচু। সেকারণে বসফরাসের উপরের পানি সব সময় উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত হয়। কিন্তু নিচের পানি বয় উল্টোদিকে অর্থাৎ দক্ষিণ থেকে উত্তরে। কারণ, কৃষ্ণসাগরের পানির লবণাক্ততা বেশি। লবণাক্ততা বেশি বিধায় অভিস্রবন অনুযায়ী কম লবণাক্ততার পানি বেশি লবণাক্ত পানির দিকে আকৃষ্ট হয় আর সেই টানে বসফরাসের নিচের স্রোতে চলে দক্ষিণ থেকে উত্তরের দিকে। সবই আল্লাহর কুদরত। ছোটবেলায় আখ নিয়ে ধাঁধা শুনতাম—‘আল্লাহর কুদরত, লাঠি ভরা শরবত’। আর এখন দেখছি—‘আল্লাহর কুদরত, এক নদীর দুই স্রোতে’।

বসফরাসে প্রবেশ করে বোট উত্তর দিকে মোড় নিতেই চোখে পড়ল নদীর উপর একটি দোতলা ঘর। জয়নালকে জিজ্ঞেস করে জানলাম ওটিই হলো মেডেনস টাওয়ার (Maiden’s Tower)। অনেক পৌরাণিক কাহিনি জড়িয়ে আছে পানির উপরের এই ছোট্ট দোতলা ঘরটি নিয়ে। এর আরেক নাম লিয়েন্ডার টাওয়ার। দুই নামে দুই কাহিনি। মেডেনস টাওয়ার নামের সাথে জড়িয়ে আছে এক রাজা আর রাজকুমারীর কাহিনি। বসফরাসের পাড়ের এক রাজার ছোট মেয়ে সম্পর্কে এক জ্যোতিষী ভবিষ্যদ্বাণী করেছিল যে এই কন্যা ১৮ বছর বয়সের মধ্যে সাপের কাপড়ে মারা যাবে। এই ভবিষ্যদ্বাণী শুনে রাজা তাকে সাপের নাগাল থেকে বাইরে লালন পালনের প্রয়াসে বসফরাসের মাঝে ঘর বানিয়েছিলেন। এখানেই রাজা তার মেয়েকে থাকতে দিলেন। প্রতিদিন রাজা এসে তার মেয়েকে দেখে যেতেন। ১৮তম জন্মদিনে রাজা তার মেয়ের জন্য এক ঝুড়ি ভিনদেশি ফল নিয়ে মেয়েকে দেখতে এলেন। সেই ঝুড়িতেই ফলের তলে লুকিয়ে ছিল এক ছোট্ট সাপ। মেয়ে অনেক আনন্দে ঝুড়ি থেকে ফল বের করতে গেল এবং সাপের দংশনে বাবার কোলেই মৃত্যুবরণ করল। সেই থেকে এর নাম হলো মেডেনস টাওয়ার।

এই টাওয়ারের নাম লিয়েন্ডার টাওয়ার হওয়ার পিছনে রয়েছে অন্য এক মিথ। এই মিথের গল্প অনুযায়ী রাজকন্যা হেরোর প্রাসাদ ছিল বসফরাসের পশ্চিমপাড়ে। জিউসের ঔরসজাত রাজকন্যা হেরোর রূপের ঔজ্জ্বল্যে পাগল হলো পূর্বপাড়ের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজার পুত্র লিয়েন্ডার। যৌবনের স্বাভাবিক স্রোতে সে প্রেম দ্রুত পরিণত হলো মাদকতাময় প্রণয়ে। হেরোর বাবা টের পেয়ে প্রহরীদেরকে কঠোর নির্দেশ দিলেন লিয়েন্ডার যাতে রাজপুরির কোনো গেট দিয়ে প্রবেশ করতে না পারে। কিন্তু লিয়েন্ডার জীবন বাজি রাখল তার দয়িতার কাছে পৌঁছতে। লিয়েন্ডার হেরোকে বলল তার শয়নকক্ষের জানালা বরাবর একটি বাতি জ্বালিয়ে রাখতে। রাতে বাতি দেখে সেই বরাবর বসফরাস সাঁতরে পার হয়ে লিয়েন্ডার গাছের লতা বেয়ে পৌঁছে যাবে হেরোর শয়নকক্ষে। কথামতো প্রতিরাতে বসফরাস সাঁতরে পার হয়ে চলতে থাকল লিয়েন্ডারের অভিসার। এক ঝড়ো শীতের রাতে লিয়েন্ডার বাতি দেখে শুরু করল তার সাঁতার। কিন্তু কিছুক্ষণে ঝড়ে নিভে গেল সেবাতি। লিয়েন্ডার পথ হারিয়ে সাঁতরাতে সাঁতরাতে প্রাণ হারিয়ে পড়ে রইল বসফরাসে পাড়ে। সেই দৃশ্য দেখে প্রেমিকা হেরো তার রাজপ্রাসাদ থেকে প্রেমিকের দেহ বরাবর লাফিয়ে পড়ে প্রাণ হারাল। তাদের প্রেমের স্মৃতি অমর রাখতে নির্মিত হয় এই টাওয়ার।

এই দুই গল্পই নিছক মিথ। বিশেষ করে হেরো-লিয়েন্ডার মিথটি বসফরাসের সাথে সংশ্লিষ্টই নয়, বরং সংশ্লিষ্ট হলো দার্দানালিস প্রণালির সাথে। ফলে লিয়েন্ডার টাওয়ার নামটি একেবারেই উটকোভাবে জুড়ে দেওয়া হয়েছে এই টাওয়ারের সাথে। এই টাওয়ার একেবারেই এক ঐতিহাসিক স্থাপনা মোটেই পৌরাণিক নয়। কাইজিকাস যুদ্ধে জিতে ৪১০ খ্রিষ্ট-পূর্বাব্দে এথেন্সীয়রা কৃষ্ণসাগর থেকে আসা তৎকালীন জাহাজ বা বাণিজ্যতরির শুল্ক আদায়ের জন্য এখানে প্রথম একটি কাস্টমস হাউজ নির্মাণ করে। পরবর্তীতে ১১১০ খ্রিষ্টাব্দে বায়জান্টাইন সম্রাট সেই স্থানে একটি কাঠের টাওয়ার নির্মাণ করেন লোহার চেইন টানিয়ে বসফরাসে চলাচলকারী জাহাজ নিয়ন্ত্রণের জন্য। অটোম্যান সাম্রাজ্যের সময় এটি একটি ওয়াচ টাওয়ার হিসেব ব্যবহৃত হতো। ১৫০৯ সালের ভূমিকম্পে এটি বিধ্বস্ত হয়। ১৭২১ সালে এটি পুনর্নির্মিত হয় সমুদ্রের বাতিঘর হিসেবে ব্যবহারের জন্য। ১৯৯৮ সালে এটি পুননিংর্মিত হয় ‘দি ওয়ার্ল্ড ইজ নট ইনাফ’ ছবির শুটিংয়ের জন্য। বর্তমানে এটিকে রেস্তোরাঁ ও ক্যাফেতে রূপান্তর করা হয়েছে। বর্তমানে এর তুর্কি নাম কিজ কুলেসি (Kiz Kulesi)। নিচতলায় রেস্টুরেন্ট আর উপরের তলায় ক্যাফে। আমরা অবশ্য ক্যাফে বা রেস্টুরেন্ট কোনোটিতেই যাইনি। শুধু বোটের ডেকে দাঁড়িয়ে দেখেছি আর এর ইতিহাস স্মরণ করেছি।

বোট চলতে চলতে কিছুক্ষণেই পৌঁছে গেল ১৫ জুলাই মারটারস ব্রিজের (15 July Martyrs Bridge) নিকট। এটিই বসফরাসের ওপর এশিয়া ও ইউরোপের সংযুক্তকারী প্রথম ব্রিজ। এটি ১৯৭৩ সালে নির্মিত হয়। এটি সম্পূর্ণ একটি ঝুলন্ত ব্রিজ। অবশ্য ঝুলন্ত ছাড়া বসফরাসের ওপর ব্রিজ নির্মাণ সম্ভব নয়, কারণ, বসফরাসের ওপর পিলার নির্মাণ করলে মাত্র আধা কিলোমিটার বা পৌনে এক কিলোমিটার প্রশস্ত এই প্রণালি দিয়ে ২৪ ঘণ্টা চলমান হাজার হাজার বাণিজ্য জাহাজ পুরান ঢাকার কেয়ামত পর্যন্ত কায়েমি জ্যামের মতো আটকে যাবে। বসফরাসের ওপর ব্রিজ নির্মাণ এ কারণেই শতাব্দীর পর শতাব্দী আটকে ছিল। অবশ্য ১৫০১ সালে সুলতান দ্বিতীয় বায়জিদ মোনালিসার জনক লেওনার্দো দা ভিঞ্চিকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন গোল্ডেন হর্নের ওপরে একটি ব্রিজ নির্মাণের জন্য। কিন্তু সুলতানের মনে ছিল ঐ নকশা অনুসরণ করে তিনি বসফরাসের ওপর ব্রিজ নির্মাণ করবেন। ভিঞ্চি একটি নকশা এঁকেও পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু সুলতানের চাটুকাররা ভিঞ্চির ডিজাইনে অনেক ত্রুটি দেখিয়ে সুলতানকে এই পরিকল্পনা থেকে নিরস্ত করেন। তিন বছর পরে একই আমন্ত্রণ জানানো হয় স্থপতিগুরু মাইকেল অ্যাঞ্জেলোকে। মাইকেল অ্যাঞ্জেলোও চমৎকার একটি ডিজাইন পাঠিয়েছিলেন। সুলতান সে ডিজাইন পছন্দও করেছিলেন। কিন্তু পোপ দ্বিতীয় জুলিয়াস মাইকেল অ্যাঞ্জেলোকে নির্দেশ পাঠান মুসলমানদের কোনো নির্মাণে অংশ না নিতে। এভাবেই ভেস্তে যায় বসফরাস বা গোল্ডেন হর্নের ওপর ব্রিজ নির্মাণের আদি প্রচেষ্টাগুলো। তবে স্থায়ী ব্রিজ নির্মাণ করা না গেলেও পারস্য সম্রাট দারিউস থেকে শুরু করে অটোম্যান সম্রাট সুলতান মুহাম্মদ পর্যন্ত অনেকেই নৌকার পর নৌকা লাগিয়ে ভাসমান ব্রিজ বানিয়ে বারবার তাদের হাতিঘোড়া এই বসফরাস পার করিয়েছে। এ ঘটনা ইতিহাসে অজস্র বার ঘটেছে।

এখন অবশ্য বসফরাসসের ওপর অন্তত তিনটি ব্রিজ রয়েছে। ১৫ জুলাই মারটারস ব্রিজ, ফাতিহ সুলতান মুহাম্মাদ ব্রিজ ও ইয়াজুজু সুলতান সেলিম ব্রিজ। ১৫ জুলাই মারটারস ব্রিজ বা ১৫ জুলাই শহিদ ব্রিজের পূর্ব নাম অবশ্য ছিল শুধুই বসফরাজ ব্রিজ। ২০১৬ সালের ১৫ জুলাই রজব তাইয়েব এরদোয়ানের বিরুদ্ধে সংঘটিত ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের শহিদদের স্মরণে পরবর্তীতে এই ব্রিজের এই নতুন নামকরণ করা হয়। কিছুক্ষণেই আমাদের বোট ৬ লেনের সেই বিশাল ব্রিজের নিচ দিয়ে আরো কিছুদূর অগ্রসর হলো। তারপর শুরু হলো ফিরতিযাত্রা। ফিরতি যাত্রায় দেখলাম নদীর পাড়ে অনেক হোটেল ও প্রমোদ ভবন গড়ে উঠেছে বসফরাস ও গোল্ডেন হর্নের তীরজুড়ে। আমাদের অবশ্য কোনোটিতেই যাওয়া হয়নি। ফিরে এলাম এমিনোনু।

এবারের গন্তব্য এমিনোনু স্পাইস মার্কেট। এটিকে মিশরী বাজার বা ইজিপশিয়ান স্পাইস মার্কেটও বলা হয়। এমিনোনু বোট পন্টুনের একদম লাগোয়া। বাজারে ঢোকার আগে নামাজ পড়লাম রুস্তম পাশা মসজিদে। ইস্তাম্বুলের রাস্তাঘাট মাঠময়দান মানেই যে শতশত বছরের স্থাপত্য ঐতিহ্যের নিদর্শন তা ইস্তাম্বুল শহরের যেকোনো জায়গায় হাঁটতে গিয়ে পদে পদে অনুভবযোগ্য। সামনে যে মসজিদ পড়বে সেটিতেই মাগরিবের নামাজ পড়ব এমন এরাদায় এ মসজিদটিতে পা দিতেই দেখি সেটি দুনিয়াবিখ্যাত স্থপতি মিমার সিনানের এক অমর কীর্তি। মিমার সিনানের সাথে আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের জনতার একটু আত্মীয়তার ইতিহাসও রয়েছে। আমাদের তাজমহলের স্থপতি ঈসা মুহম্মদ এফেন্দি (উস্তাদ ঈসা খা) ছিলেন মিমার সিনানের ভ্রাতুষ্পুত্র ও তাঁর কৃতী ছাত্রদের একজন। কোনো ভ্রমণ গাইডের এলেম ছাড়াই হাঁটতে হাঁটতে মিমার সিনানের এমন কীর্তিময় স্থাপত্যে পা রেখে বুঝলাম ইস্তাম্বুলে ভ্রমণ গাইড পড়ে ঐতিহ্যের নিদর্শন খোঁজার কোনো দরকার নেই। খালি রাস্তায় হাঁটতে থাকলেই যে ভবনে আর যে স্থাপত্যে পা পড়বে তাহাই বলতে থাকবে শত শত বছরের ঐতিহ্যের গল্প। রুস্তম পাশার নামের এ মসজিদ নির্মিত হয়েছিল সেই মাইকেল অ্যাঞ্জেলোর আমলে ১৫৬৪ সালে শেক্সপিয়ারের জন্মের বছর। রুস্তম পাশা ছিলেন মহান তুর্কি সুলতান সোলায়মানের উজির বা প্রধান মন্ত্রী। রুস্তুম পাশার শাশুড়ি ছিলেন সুলতানের বিখ্যাত বেগম হুররম সুলতান। এতসব ঐতিহ্যের গল্প ইস্তাম্বুলের পথেঘাটে মাঠেময়দানে এত অজস্রভাবে ছড়িয়ে রয়েছে যে, সেসব গল্প কারো পক্ষেই সব শোনা বা বলা কল্পনাতীত।

হুররম সুলতানের জামাইর মসজিদে আমরা জামাই-বউ নামাজ শেষ করে ঢুকলাম মিশরি মসলার বাজারে। ঢুকতেই চোখে পড়ল বড় করে লেখা ‘স্থাপিত-১৬৬৪’। আটোম্যান সাম্রাজ্যের সময় মিশর থেকে প্রাপ্ত কর দিয়ে এই বাজারের নির্মাণ সম্পন্ন হয়েছিল বলে এর নাম হয়েছিল মিশরি বাজার বা ইজিপশিয়ান মার্কেট। এই বাজারের পাশে নয়া মসজিদ নামে একটি মসজিদ নির্মিত হয়েছিল অনেকটা একই সময়ে। এর নির্মাতা ছিলেন সুলতান তৃতীয় মুহাম্মদের মা সাফিয়া সুলতান। এটিই ছিল ইস্তাম্বুলের কোনো নারী কর্তৃক নির্মিত প্রথম মসজিদ। এই মসজিদের পরিচালনার ব্যয় নির্বাহ হতো মিশরি বাজার থেকে প্রাপ্ত খাজনা দ্বারা। মিশরি মসলাবাজার ইস্তাম্বুলের দ্বিতীয় বৃহত্তম ক্লাসিক বাজার। খিলানযুক্ত গলির দুপাশে সারিসারি দোকান এবং এমন খিলানের অনেকগুলো গলি। পুরো বাজার গম্বুজে ঢাকা ছাদে আবৃত। এর স্থপতি ছিলেন প্রথমে কাসিম আগা (১৫৭০-১৬৫৯) ও পরে মুস্তফা আগা। ঐতিহাসিক উক্ত নির্মাণে ৮৫টি দোকান ছিল যা বর্তমানে সংখ্যায় আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। চলবে

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
কেমন চলছে ভারতের লোকসভার দ্বিতীয় দফার ভোট?
কেমন চলছে ভারতের লোকসভার দ্বিতীয় দফার ভোট?
সাফের আগে চাইনিজ তাইপের বিপক্ষে সাবিনাদের ম্যাচ
সাফের আগে চাইনিজ তাইপের বিপক্ষে সাবিনাদের ম্যাচ
কানের ধ্রুপদি বিভাগে শ্যাম বেনেগালের ‘মন্থন’
কানের ধ্রুপদি বিভাগে শ্যাম বেনেগালের ‘মন্থন’
থাইল্যান্ডের রাজা-রানির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সৌজন্য সাক্ষাৎ
থাইল্যান্ডের রাজা-রানির সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর সৌজন্য সাক্ষাৎ
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ