X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১
বিশ শতকের ইতালির গল্প

দ্য বাবুন।। গিওভানি আরপিনো

অনুবাদ : আলমগীর মোহাম্মদ
০৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৫:৩১আপডেট : ০৫ এপ্রিল ২০২৪, ১০:০১

হতভাগা শয়তান। এটা আসলেই হৃদয়গ্রাহী। আমাকে খুশি করার জন্য সে তার সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করে। তার মহৎ উদ্দেশ্যের কোনো শেষ নেই। আমি তাকে বকাবকি করতে অপছন্দ করি। তবে আমি যখন ক্লান্ত থাকি, কাজের ভারে পিষ্ট থাকি, সারাক্ষণ শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে দৌড়ের ওপর থাকি, কর, ব্যবসায়িক চুক্তি, বিক্রিবাট্টা, আর্থিক লেনদেনে ভাটা পড়া, আমার আইনজীবী, স্টকব্রোকার, বীমার এজেন্ট যারা যারা দাবি করে আমার কাছে কাছে টাকা পায় এবং আমি যখন পাওনাদারদের হাত থেকে পাওনা টাকা আদায় করতে ব্যর্থ হই তখন আসলে আর উপায় থাকে না।

বকাঝকা করার অল্পক্ষণ পরেই আমি অনুতপ্ত হই। তার কাছে দুঃখ প্রকাশ করি। হুইল চেয়ারের এক কোনায় গাদাগাদি হয়ে সে কাঁদতে থাকে। দুই হাতে চোখ ঢাকে। কিছুক্ষণ পর কান্নাভেজা চেহারা নিয়ে আমার দিকে একবার তাকিয়ে আবারও হেঁচকি তুলে কাঁদতে শুরু করে। তখন আমি অনুশোচনার সুরে বলি, ‘দেখো, এই বিষয়টা ভুলে যাও। আমি দুঃখিত। চলো শান্তি প্রতিষ্ঠা করি।’ সাথে সাথে আমাদের মধ্যে শান্তি নেমে আসে। সে আবারও লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে যায়। আমার কাছে দৌড়ে এসে এস্ট্রে খালি করে আবার দিয়ে যায়। আমার পত্রিকা পড়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। ধীরে ধীরে শ্বাস ফেলে। তারপর তার মনে পড়ে আমাকে এখনও কফি দেওয়া হয়নি। এবার দৌড়ে রান্নাঘরের দিকে চলে যায় সে। ধীরে ধীরে হেঁশেলে নিজের কাজের জগতে ডুবে যায়।

এ কথা আমাকে স্বীকার করতে হয়। আমার স্ত্রীদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো সে। সে আমার চতুর্থ স্ত্রী। আমার পূর্বতন তিন স্ত্রী মারা গিয়েছিল। আমার ওপর বাচ্চাকাচ্চার কোনো চাপ না রেখে। তারা প্রত্যেকেই অল্পবয়সে মারা গিয়েছিল। এটা আমার কাছে অভিশাপ মনে হয়েছিল। তৃতীয় স্ত্রীর শেষকৃত্য শেষে বন্ধুরা আমাকে প্রশ্ন করেছিল, ‘তুই তার সাথে কী করেছিস?’ তারা সন্দেহপ্রবণ আচরণ করছিল। কারণ তারা কোনোভাবেই মানতে নারাজ যে এটা সাধারণ নিউমোনিয়া ছিল। কিন্তু, এই গিলদা, আমাকে স্বীকার করতেই হবে, আমার জন্য একটা সম্পদ। সে একটা ভালো মেয়ে।  বিনয়ী ও সহযোগী মনোভাবাপূর্ণ গিলদার প্রয়োজন/চাওয়া-পাওয়ার গণ্ডি খুবই সামান্য। বছরে দুয়েকবার একটা করে অল্প দামি নেকলেস কিনে দিলেই সে খুশি হয়।

সে নিজের কাপড়চোপড় নিজে ধোয় এবং ইস্ত্রি করে। এবং প্রত্যেকদিন সে নিজেকে অবিশ্বাস্যরকম গুরুত্ব দিয়ে বেশ পরিপাটি করে সাজিয়ে তোলে। ঘরে আয়নার মতো দ্যুতি ছড়ায়। অবশ্যই সে রান্নাঘর খুব একটা ভালোভাবে সামলাতে পারে না। সে তিন বা চার পদের বেশি কিছু রান্না করতে জানে না। মানে রান্না বান্নার ক্ষেত্রে তার দক্ষতা গড়পড়তা মানের। তবে আমি আমি জানি শুরু থেকে, যখন আমি তাকে একটা সার্কাস থেকে কিনে এনেছিলাম, সে কাজের ব্যাপারে আন্তরিক ছিল।

সার্কাসের মালিক আমাকে বলেছিলেন, ‘সে সবকিছু করতে পারে। পরিচারিকার চেয়েও ভালো।’ দুর্যোগ সৃষ্টি না হলে আমি এইসময় তাকে তোমার কাছে বিক্রি করে দিতাম না।…তাকে আমরা ভালোমতো প্রশিক্ষণ দিয়েছি। সে তেমন বেশিকিছু খায় না। তেমন কিছুই না আসলে। তুমি আসলে ভালো কিছু পেতে যাচ্ছ।’ গিলদা আমার সাথে, আমার এখানে তিন বছর ধরে আছে। সে বেশ শক্তিশালী ও সমর্থ। সে নিজের পায়ের নখ থেকে চুলের বিনির ডগা পর্যন্ত অত্যন্ত সুচারুরূপে যত্ন করে। তার গা থেকে কলোন, সাবান ও ট্যালকম পাউডারের সুঘ্রাণ ছড়ায়। সে আমাকে ভালোবাসে। হয়তো একটু বাড়াবাড়ি রকমের ভালোবাসা এটা। এমন না যে সে আমাকে খুব আবেগ প্রকাশকারী হিসেবে চায়, মাঝেমধ্যে সে শুধু একটু ভালোবাসা ও যত্ন চায়। তবে সে আমার চারপাশে ভালোবাসার তীব্র আকুতি নিয়ে ঘোরাঘুরি করে। অবশ্যই ভালোবাসার এই তীব্রতা আমি কিছুটা বুঝতে পারতাম।

‘বি-বা,’ বলে সে আমাকে বারবার নিঃশ্বাস ফেলে চাপাস্বরে ডাকে। চোখ বন্ধ করে এবং কাঁপতে থাকে। এবং তারপরে আমি জানি যে আমাকে একটি নির্দিষ্ট উপায়ে তাকে ছুঁয়ে দিতে হবে, যতক্ষণ না তার কণ্ঠস্বর ধীরে ধীরে প্রায় অদৃশ্য দীর্ঘশ্বাসে পরিণত হয়। অথবা হয়তো আমি যতক্ষণ না নতি স্বীকার করি। এবং তারপর পরের তিন বা চার দিন সে পাগলের মতো ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ে।  আসবাবপত্র পলিশ কররে, কুশন ঝাড় দেয়, প্যানগুলো ঘষে, আমার সিগারেট জ্বালিয়ে দেয়, স্নানে গুনগুন করে, আমাকে উন্মত্ত করা ছোট ছোট চুম্বন ছুড়ে দেয়।

অথবা সে সাহস সঞ্চয় করে আমাকে স্বাস্থ্য পরিচর্যার কাজে মনোযোগী হয়। আমার চুলগুলো ব্যাক ব্রাশ করে। আমাকে পরিচর্যার এই কাজটা সে অত্যন্ত আনন্দের সাথে করে। সে যখন আমার চুলে ব্রাশ চালায় আমি আমার ত্বক এবং শার্টের কলারের মাঝখানে একটা সুড়সুড়ি অনুভব করি। যার নিঃশ্বাসের উষ্ণতা অনুভব করি। এবং এর কিছুক্ষণ পরপর আলতো চুমুর ছোঁয়া। সে যখন এই কাজটা চালিয়ে যায় তখন আমি ‘লক্ষ্মী আমার!’ বলে পত্রিকা পড়া চালিয়ে যাই। আমার এই ভক্তিপূর্ণ সম্বোধনে সে খুশি হয়ে খুশি মনে চুল আঁচড়ানো চালিয়ে যায়। এই বাবুন গিলদা ও আমার সাবেক তিন স্ত্রীর মধ্যে যেকোনো তুলনা আসলে অরুচিকর হবে। এবং যখনই আমি আগের তিনজনকে স্মরণ করি, মনে মনে আমি তাদেরকে তিন ডাইনি বা পেত্নী হিসেবে সম্বোধন করি। তারা সবসময় টাকা, সম্পত্তি এবং কথাবার্তার পেছনে লালায়িত ছিল। আমি মোটামুটি ঘরে থাকতে গিয়ে ক্লান্ত হয়ে, সিনেমা বা ক্যাফেতে গিয়ে অথবা হাঁটাহাঁটি করতে গিয়েও বিরক্ত হয়ে ফিরতাম। খরচাপাতির ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে কোনো বাছবিচার ছিল না। এবং মাঝেমধ্যে আমার বেড়াতে আসা বন্ধুদের সাথে অপ্রত্যাশিতরকমের ঘনিষ্ঠতায় লিপ্ত হতো তারা।  

এসবের কোনো দোষ গিলদার ছিল না। তার সীমাবদ্ধতা আছে বটে, তবে সে আমার জন্য বোঝা নয়। সে সবসময় এটা সেটা চায় না, মুখে মুখে কথা ফিরিয়ে দেয় না, সে তর্ক করে না, এবং সে মনগড়া কোনো আচরণ করে না। বা হেঁয়ালি করে না। ঘর এবং অল্প ভালোবাসাই তার কাছে সবকিছু। এটাই আমার মতো একজন পুরুষকে স্থির এবং মনোযোগী হতে যথেষ্ট সহায়তা করেছে। আমার কাজের গতি বা ভারসাম্য ধরে রাখাতে সহায়তা করেছে। অবশ্যই, গিলদা ও আমার মধ্যে টুকটাক কিছু বিষয়ে বিতর্কও আছে। তবে সেসব যতটুকু না বিরোধপূর্ণ, ততটুকুই স্বাভাবিক। মানবিক। যেমন ধরেন : গিলদা একটা মোহের মধ্যে আছে। আমি জানি না সে কীভাবে বা কেন অন্তত আমার কাছাকাছি লম্বা হতে হবে এটা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকে। সে সবসময় এ ধরনের মোহে গ্রস্ত থাকে। প্রায়সময় সে আমাকে হাত ধরে টান দিয়ে আয়নার কাছে নিয়ে যায় এবং পাশাপাশি দাঁড়িয়ে যাচাই করে সে কতটুকু লম্বা হতে পেরেছে। আমার শার্টের প্রান্ত ধরে প্রাণপণ চেষ্টা করে সে পাশে দাঁড়িয়ে যখন আবিষ্কার করে যে বড়জোর সে আমার কোমর পর্যন্ত পৌঁছুতে পেরেছে তখন তার দুচোখ বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ত। অথবা মাথা নাড়তে নাড়তে সে একটা উচ্চতা মাপার ফিতা এনে আমার হাতে দিয়ে দেয়ালের সাথে দাঁড়িয়ে তার উচ্চতা মাপতে দিত। যেমনটা আপনারা বাচ্চাদের সাথে করে থাকেন।

কিন্তু দেয়ালে মাপের চিহ্ন বরাবরই একই জায়গায় রয়ে যায়। এবং গত তিন বছরে দাগটা একটুও ওপরে ওঠেনি। দাগটির দিকে গিলদা তাকিয়ে চোখের জল মুছে নেয়। এ ধরনের পরিস্থিতেতে তাকে শান্ত করার জন্য অত্যন্ত ন্যাকা সুরে আমি তাকে বলতাম, ‘বী-বা?’ যাতে সে আমাকে ভুল না বোঝে। জবাবে সে মাথা নাড়ত। অবশ্যই আমি জানি না এটা সে লম্বা হতে না পারার হতাশা থেকে করত কি না। আমি বলতে বাধ্য হতাম, বী…বা আমি আসলে তোমার সাথে মজা করছিলাম। রাতে ঘুমোতে যাওয়ার কিছুক্ষণ আগে, সময় করে তাকে একটা ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিতে হতো। আমি যেহেতু নীদ্রাহীনতায় ভুগতাম, সে এটা নিয়েও কিছুটা উদ্বিগ্ন থাকত। এমনও হতো মাঝেমধ্যে সে আমার কার্যকলাপ দেখে দেখে প্রায় বিনিদ্র রাত কাটিয়ে দিত। আমি না ঘুমোনো পর্যন্ত জেগে থাকার অভ্যাসটা সে রপ্ত করে নিয়েছিল। এই অপ্রয়োজনীয় বিষয় এড়ানোর লক্ষ্যে আমি তাকে দুয়েকটা ঘুমের ওষুধ খাইয়ে দিয়ে নিজেও দুয়েকটা খেয়ে নিতাম। যদিও আমি জানতাম ঘুমের এসব ওষুধ আমার ওপর আজকাল কোনো প্রভাবই ফেলতে পারছে না। এবং তার পাশে শুয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিনিদ্র কাটিয়ে দিতাম পাশে শোয়া তার ঘুমের আওয়াজ শুনে শুনে।

সে নাক ডাকে না। যদিও সে কিছুক্ষণ পরপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। আমার কোনো ধারণা নেই সে কি স্বপ্ন দেখে কি না। লোকে বলে কুকুরের স্বপ্ন দেখার সামর্থ্য আছে। তাইলে কেন বাবুনের মতো প্রজাতির বিকাশ বা উদ্ভব ঘটেনি? সে জন্মেছিল জিম্মাদারি অবস্থায়, সেই হতদরিদ্র ব্যর্থ সার্কাসের মধ্যে। তাই তার মনে আফ্রিকা নিয়ে কোনো স্মৃতি নেই। আফ্রিকার বনভূমি বা হাতি নিয়ে তার কোনো স্মৃতি নেই। সে যদি স্বপ্ন দেখে থাকে, তাহলে এটা সেই সার্কাসকেই স্বপ্নে দেখে। সার্কাসে তারা তাকে দিয়ে যেসব কাজকর্ম করাত সেসবই দেখে হয়তো। যেমন, বুড়ি দাদির কাপড় বোনার দৃশ্য, একজন ক্লাউনের স্খলিত হওয়া, একজন নাবিকের সাইকেল চালানো, একজন পরিচারিকার টেবিলে পরিবেশন… অথবা, খুব সম্ভবত সে তার কোনো প্রেমের কথা স্বপ্নে দেখে, অথবা আমাকে স্বপ্নে দেখা ইত্যাদি। এই অনুমানের কারণ হলো প্রায় রাতেই সে হাত বাড়িয়ে ঘুমের মধ্যে আমাকে খোঁজে। হালকা একটা ছোঁয়াতে সে খুবই আপ্লুত হয়। আমি তার মাংসল আঙুলের ডগা ছোঁয়ার অনুভূতি উপভোগ করি। মাঝেমধ্যে তাকে হাত বুলিয়ে শান্ত করে ঘুম পাড়াতে গিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখিয়ে ফেলি যদিও। রাতে আমি প্রায়ই অনুভব করি সে কত ছোট। সে যদি আরেকটু লম্বা হতো, তবে সবকিছু আরও ভালোভাবে হতে পারত!

অন্ধকারে প্রায়ই তার নিঃশ্বাসের শব্দ শুনতাম। গ্রীষ্মকালীন একটা ছোট ব্লাউজ পরা তার ছোটখাটো শরীরটা দেখে আমি অনেক সময় আঁতকে উঠতাম। গত বছর একটা বড় দোকান থেকে আমি একই রকম একটা ব্লাউজ কিনেছিলাম। ভান করছিলাম যেন আমার বড় মেয়ের জন্য কিনছিলাম। তারপর অবশ্যই সে একই মাপের আরও তিনটা ব্লাউজ বানিয়েছিল। ভিন্ন ভিন্ন রঙের এই ছোট টুকরো কাপড় গায়ে জড়িয়ে যখন সে রাতে ঘুমের জন্য ফ্রেশ হয়ে যেত আমি রীতিমতো মুগ্ধ হতাম। অবশ্যই আমার নিদ্রাহীনতাকে অবশ্যই এসব চিন্তাকে বিষিয়ে তোলে। কয়েক রাত ধরে আসলে আমি আশা করছিলাম গিলদা আসলে আরেকটু লম্বা হলে ভালো হতো। গিলদার এই স্বল্প দীর্ঘ শরীরের চিন্তা আমাকে ব্যথিত করত। আমি অবশ্যই পরক্ষণে নিজেকে প্রমাদ দিতে চাইতাম এই বলে যে তুমি একটা নির্বোধ আসলে। নিজেকে আরও বলতে চাইতাম, তোমার জীবন যথার্থ রথে আছে। এসব মিটার সেন্টিমিটারের ভাবনায় নিজেকে বিষিয়ে তুলো না। 

এবং, তুমি কীভাবে জানো যে সে কী ভাবছে? কীভাবে তুমি নিশ্চিত হলে যে স্বপ্নে সে তোমার চেয়ে যোগ্য ও দক্ষ, এবং নিজের মনমতো গড়নের কোনো বাবুনের কথা ভাবছে না? এইসব বেসামাল চিন্তাভাবনাগুলো আমি সহজে এড়াতে পারতাম না। এবং এমন সব মুহূর্তে আমার পাশে শুয়ে থাকা ছোটখাটো গড়নের সেই মানুষটাকে আমি হাতে ছুঁয়ে দেখতেও আমার ভয় হতো। অবশ্যই, কোনোমতে আমি এসব বাজে চিন্তা থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে নিতে পেরেছিলাম এক পর্যায়ে।

আমি অভিশপ্ত। কীভাবে একজন মানুষ তার নির্বুদ্ধিতা ও পাগলামোর কারণে নিজের ভাগ্যে যা কিছু সুন্দর এবং ভালো আছে তাকে মাড়িয়ে অহেতুক বাজে ভাবনায় বিভোর হয়ে থাকে? অথবা এটা কী এমন যে আমার অভিশাপ নির্দিষ্ট কোনো নক্ষত্রের গতিবিধির সাথে পরিবর্তিত হয়? তারা কি এমন যে আমাকে সুখে শান্তিতে দেখলেই ভুল কোনো পদক্ষেপ নিতে আমাকে উদ্বুদ্ধ করে?

সংক্ষেপে বলি : গতকাল আমি চিড়িয়াখানায় গিয়েছিলাম। দীর্ঘ একটা শীতের শেষে এটা ছিল প্রথম রোদ্রোজ্জ্বল রোববার। আমি একা যেতে চাইনি। তাই গিলদা আমাকে সঙ্গ দিয়েছিল। সে কিছুটা অনিচ্ছুক ছিল কারণ ঘর ছেড়ে সে বাইরে যেতে চায় না। কারণ সে মানুষের ওপর বেশ বীতশ্রদ্ধ। বিশেষ করে কুকুরকে সে খুব ভয় পেত। তার পরেও আমি যখন জোর করছিলাম সে সুন্দর একটা স্কার্ট পরে আমার সাথে হাত ধরে বের হলো। চিড়িয়াখানায় অনেক বাচ্চাকাচ্চা এসেছিল। সবাই প্রাণীদের মুভমেন্ট এবং উপস্থিতির প্রতি এতই ব্যস্ত ছিল আমার সাথে গিলদাকে দেখে তারা বিস্মিত হতে ভুলে গিয়েছিল। 

নদীর ধারে বাতাস ধীরে ধীরে দমকা তালে বইতে শুরু করেছে। চিড়িয়াখানাটি নদীর পাশেই তৈরি করা। বাতাসের একেকটা ঝাপটা ছুরির ফলার মতো বিঁধছে আমাদের গায়ে। গিলদা অস্বস্তি বোধ করতে শুরু করছিল এবং সে আমাকে এক প্রকার টেনে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। বানরশালার সামনে এসে সে আর দাঁড়াতে চাইছিল না। অবশ্যই নোংরা, অদ্ভুত এবং ঝগড়াটে বানরগুলো দেখে সে বিবমিষা বোধ করছিল। এসব ঘটেছিল যখন আমরা কিম্ভুতকিমাকার একটা গরিলার খোয়াড়ের পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। গরিলাস্টা ছিল আসলে বিরল প্রজাতির ভূতুড়ে কিছুর সৌজন্য বা কার্বন কপি। খোয়াড়ের ভেতর এটা অনেকটা কার্পেটের মতো গাদাগাদি করে বসে ছিল। যখন এটা আমাদের দিকে ঘুরে দাঁড়াল তখন বুঝতে পারলাম সে আসলে পুরুষ গরিলা ছিল না। কোলে একটা বাচ্চা তার। সে কমপক্ষে এক মিটার আশি সেন্টিমিটার লম্বা ছিল। অথবা তার চেয়ে একটু বেশি। বিশাল অদ্ভুত আকারের জন্তু। আমি গিলদাকে আমার পিঠের ওপর তুলে নিয়েছিলাম যাতে সে এই অদ্ভূতুড়ে প্রাণীটাকে ভালোমতো দেখতে পায়।

হঠাত বুঝতে পারলাম গিলদা কাঁপছিল। যেন গায়ে তার বুনো জ্বর এসেছে। সে আমাকে দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরল। মনে হচ্ছিল সে ভয়ে কাপছে। আমি তাকে কানে কানে বললাম, ‘লক্ষ্মীটি আমার!’  দেখছ না গরিলাটা কত সুন্দর। একটা বিশাল দৈত্যের মতো এটা। তুমি তার সাথে আমাকে ‘বী- বা’ করতে দেবে? আমি আমার গলার পাশে তার নখের আঁচড় অনুভব করলাম। তারপর একটা গভীর কাঁপুনি যেটা তাকে পুরোটা ঝাঁকিয়ে দিয়েছে। আমরা ঘরে ফেরার পর সে বাথরুমে নিজেকে অনেকক্ষণ আটকে রেখেছিল। আমি তাকে আকুলভাবে কাঁদতে শুনেছি সেখানে। অবশ্যই এ নিয়ে আমি তাকে কিছু বলিনি। ডাকিনিও। কারণ আগের তিনজন স্ত্রীর সাথে সংসার করার অভিজ্ঞতা থেকে আমি বলতে পারি নারীর চোখের জলের জবাবে নীরবতা কত বড় একটা নিরাময়। বেরিয়ে এসে সে আমাকে রাতের খাবার বেড়ে দিল। একটা নিঃশ্বাসও না ফেলে। সে আমার সবগুলো ফরমায়েশ পালন করল। তবে নিয়মিত যে উচ্ছ্বাস নিয়ে সে কাজগুলো করত সেটা অনুপস্থিত ছিল।

রাতের খাবার শেষে সে তাড়তাড়ি বিছানায় চলে গেল। যখন আমি টেলিভিশন দেখার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ঠিক তখনই খেয়াল করলাম সে পুরো এক পাতা ঘুমের বড়ি গিলে নিয়েছে। মুখ দিয়ে তার হালকা চালে নিঃশ্বাস নেওয়ার শব্দ শুনতে পাচ্ছিলাম। খানিক পর খেয়াল করলাম তার মুখ দিয়ে শাঁ শাঁ করে নিঃশ্বাস বের হতে শুরু করেছে। আমি রেডক্রসে ফোন করলাম সাথে সাথে। কেউ একজন এখানে শীঘ্রই চলে আসবেন। হয়তো তারা আমার হাত থেকে তাকে বাঁচাতে পারবে। আমার মাথায় ঝিম ধরেছে। হাত ঘামছে। আমি পাশে দাঁড়িয়ে তাকে দেখছি। অপেক্ষা করছি দরজায় বেল বাজার শব্দের জন্য। হ্যাঁ, তারা হয়তো তাকে বাঁচাতে পারবে। কিন্তু তারপর কী হবে? সে কি আবারও আমার গিলদা হবে, গতকালের মতো, সবসময়ের মতো ভালো আচরণ করবে? নাকি আমাকে সন্দেহ করবে এবং আমার প্রতি ঘৃণা বোধ করবে? যেমনটা আমার আগের স্ত্রীদের বেলায় ঘটেছিল। সে কি  কোনো ধরনের প্রতিশোধ নিতে চাইবে?

তবে এই নারীরা আমার কাছে আসলে কী চায়? তারা কি আমার চেষ্টার গুরুত্ব বোঝে না। যেটা আমি করে যাই জীবনকে টেনে নিয়ে যেতে, শান্তি ধরে রাখতে। আচ্ছা, এখন যদি আমাকে একা রেখে যাওয়া হয়, যদি গিলদা মারা যায়, তখন আমি আসলে কিছু কি করতে পারব? যখন আমি আসলে কারও ওপর কর্তৃত্ব ফলাতে পারব না!


গিওভানি আরপিনো (১৯২৭-৮৭)

একটা সাক্ষাৎকারে আরপিনো বলেছিলেন, এক জীবনে একজন সত্যিকার লেখকের উচিত কমপক্ষে একশটি গল্প লেখা। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় অবশ্যই তার চেয়ে দ্বিগুণ গল্প লিখেছেন। আরপিনো শিক্ষাজীবনে মাঝারি মানের ছাত্র ছিলেন। তার বাবা সেনাবাহিনীতে কর্নেল হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বাবাই তাকে তুরিনে আইন পড়ার জন্য চাপ দিয়েছিলেন। আইন থেকে তিনি সাহিত্যে মাইগ্রেট করেন এবং ছোট একটা কবিতার বই লিখে বসেন ছাত্রকালে। বয়স বাড়ার সাথে তিনি কবিতার পাশাপাশি গদ্য লেখায়ও মনোযোগী হন। পঁচিশ বছর বয়সে তাঁর প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয়। 'দ্য শ্যাডো অব দি হিলস' সহ তিনি মোট পনেরোটি উপন্যাস লেখেন। 'দ্য শ্যাডো অব দি হিলস' ১৯৬৪ সালে স্ট্রেগা পুরস্কার লাভ করে। বাণিজ্যিকভাবে আরপিনোর সবচেয়ে সফল সাহিত্যকর্ম হল 'সেন্ট অব আ ওম্যান'। আরপিনো স্ক্রীড়া সাংবাদিক হিসেবে ১৯৭২ সালে মিউনিকে অনুষ্ঠিত অলিম্পিক গেমস কাভার করেন। আর্ট ও ফটোগ্রাফি নিয়ে বিশদ লেখালেখির পাশাপাশি তিনি শিশুদের জন্য এক ডজনেরও বেশি গ্রন্থ রচনা করেন।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সৈকতে জনসমুদ্র!
চিড়িয়াখানায় মানুষের ঢল
জঞ্জালের নগরে প্রাণ ভরানো সবুজের খোঁজে...
সর্বশেষ খবর
দুর্নীতির অভিযোগে ইসলামপুর পৌর মেয়র বরখাস্ত
দুর্নীতির অভিযোগে ইসলামপুর পৌর মেয়র বরখাস্ত
মাটি কাটার সময় ‘গরমে অসুস্থ হয়ে’ নারী শ্রমিকের মৃত্যু
মাটি কাটার সময় ‘গরমে অসুস্থ হয়ে’ নারী শ্রমিকের মৃত্যু
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
সাকিবের সঙ্গে উপজেলা নির্বাচনের দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর সাক্ষাৎ
স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
কান উৎসব ২০২৪স্বর্ণপামে ৯ বিচারক: সর্বকনিষ্ঠ আদিবাসী লিলি, আছেন বন্ডকন্যাও
সর্বাধিক পঠিত
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
আজ কি বৃষ্টি হবে?
আজ কি বৃষ্টি হবে?
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে সরকার
খোলা সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে সরকার