আনোয়ারা বেগম (৫৯) অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা। তার স্বামী পেশায় চিকিৎসক। তাদের তিন ছেলে-মেয়ে দেশের বাইরে থাকেন এবং তারা নিজ নিজ ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত। চাকরি থেকে অবসরের পর আনোয়ারা দিনের অধিকাংশ সময় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যয় করেন। কিছুটা পারিবারিক সমস্যায় ভুগছিলেন। এ থেকে মুক্তির পথ খুঁজছিলেন।
হঠাৎ একদিন ফেসবুক স্ক্রল করার সময় তার সামনে একটি বিজ্ঞাপন আসে। বিজ্ঞাপনে দেখা যায়, দরবেশ বেশধারী এক ব্যক্তি নিজেকে সৌদি আরবের মসজিদে নববীর ইমাম পরিচয় দিয়ে বলছেন, তিনি কোরআন-হাদিসের আলোকে মানুষের সমস্যা সমাধানে কাজ করেন। স্বামী-স্ত্রীর অমিল, বিয়ে না হওয়া, বাচ্চা না হওয়া, লটারি জেতানোসহ বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করেন। বিজ্ঞাপনে দুই নারীর সাক্ষাৎকার দেখায়, যেখানে তাদের বলতে শোনা যায়, তারা এই দরবেশের কাছ থেকে তাদের সমস্যার সমাধান পেয়েছেন।
এটা দেখে আনোয়ারা বেগম তার গৃহকর্মীর সঙ্গে বিষয়টি আলোচনা করেন। ওই মেয়েটি বলে, তার গ্রামের কয়েকজনের জিন-পরীর মাধ্যমে সমস্যার সমাধান পেতে শুনেছে। এটা শুনে আনোয়ারা উৎসাহিত হন এবং বিজ্ঞাপনে দেওয়া মোবাইল নম্বরে কল করেন। সঙ্গে সঙ্গে দরবেশ সাজা ওই ব্যক্তি খুব সুন্দর করে কথা বলে তার পারিবারিক সমস্যা শুনতে চান। আনোয়ারা নিজের পারিবারিক কিছু সমস্যার কথা ওই লোকটিকে বলেন।
‘দরবেশ’ বলে, মা তোমার সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। বাবার ওপর আস্থা রাখো। আমি তোমাকে মা বলে ডাকলাম। আজ থেকে তুমি আমার মেয়ে। তবে কিছু খরচ লাগবে মা। খরচের কথা কাউকে জানানো যাবে না। যদি জানাও তবে তোমার সমস্যার সমাধান হবে না। বিপরীতে তোমার সমস্যা আরও বাড়বে এবং তোমার ছেলে-মেয়ে ও স্বামীর ক্ষতি হবে।
সে তার বিকাশ নম্বরে একটা বড় অঙ্কের টাকা পাঠাতে বলে। আনোয়ারা কথামতো বিকাশে টাকা পাঠান। এভাবে বিভিন্ন তারিখ ও সময়ে ওই লোক আনোয়ারাকে ফোন করে বিভিন্ন অজুহাতে ও ব্যক্তিগত সমস্যা সমাধানের প্রলোভন দেখিয়ে প্রায় সাত কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়। পরে একসময় আনোয়ারা বুঝতে পারেন তিনি প্রতারকের খপ্পরে পড়েছেন। প্রতিকার পাওয়ার জন্য তিনি মোহাম্মদপুর থানায় মামলা করেন। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) প্রধান অতিরিক্ত আইজিপি মোহাম্মদ আলী মিয়া বরাবর অভিযোগও করেন তিনি।
পরবর্তীতে সিআইডি প্রধানের নির্দেশে সিআইডির সাইবার পুলিশ সেন্টারের একটি টিম ভিকটিমের অভিযোগের সত্যতা যাচাই করে ওই আসামি ও তার দলবলকে শনাক্ত করে। পরবর্তীতে শনিবার (১৬ সেপ্টেম্বর) ঢাকার উত্তরা এলাকা থেকে অভিযুক্ত মো. তানজিল আহমেদ ওরফে তানজিদ হাসানকে গ্রেফতার করা করে। পরে তার দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে একই দিনে এ প্রতারক চক্রের সন্দেহভাজন মূল হোতা মো. হাসেমকে ভোলার বোরহানুদ্দিন থানা এলাকা থেকে গ্রেফতার করে সিআইডি।
রবিবার (১৭ সেপ্টেম্বর) বিকালে সিআইডির অতিরিক্ত বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) আজাদ রহমান এসব তথ্য নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, তানজিল আহমেদ ওরফে তানজিদ হাসানকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, ওই প্রতারক চক্রের মূল হোতা মো. হাসেম। হাসেম প্রথমে বিকাশ ও রকেটের মাধ্যমে ছোট ছোট অঙ্কের টাকা নিতো। এরপর বড় অঙ্কের টাকা নেওয়ার সময় মো. তানজিল আহমেদ ওরফে তানজিদ হাসানকে আনোয়ারা বেগমের কাছে পাঠাতো। তানজিদ একসঙ্গে ৩০-৪০ লাখ টাকা নিয়ে যেত। এভাবে ধাপে ধাপে তারা ওই নারীর কাছ থেকে প্রায় সাত কোটি টাকা নেয়।
মো. হাসেমকে জিজ্ঞাসাবাদে সিআইডি জানায়, সে ২০০৫ সাল থেকে এই কাজ করছে। প্রথম দিকে সে বিভিন্ন পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলে বিজ্ঞাপন দিতো। পরে ২০১৬ সাল থেকে পত্রিকা ও টিভি চ্যানেলের পাশাপাশি সে ইউটিউব ও ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেওয়া শুরু করে। সে প্রতিমাসে ফেসবুকে চার লাখ টাকা খরচ করে বিজ্ঞাপন দিতো এবং পোস্ট বুস্ট করতো যাতে তার বিজ্ঞাপন বেশি মানুষের কাছে পৌঁছে যায়।
মূল টার্গেট স্বল্পশিক্ষিত প্রবাসীরা
সিআইডি আরও বলছে, হাসেম মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরত স্বল্পশিক্ষিত প্রবাসী বাঙালিদের টার্গেট করে সৌদি আরব, দুবাই, ওমানসহ সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়াতে দেশভিত্তিক বিজ্ঞাপন প্রচার করতো। এছাড়াও সে ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে ইতালি ও ফ্রান্সে বিজ্ঞাপন প্রচার করতো। এভাবে সে পত্রিকা, টিভি চ্যানেল, ইউটিউব ও ফেসবুকে বিজ্ঞাপন দেওয়ার মাধ্যমে অসংখ্য মানুষের সঙ্গে ‘দরবেশ বাবা’ পরিচয় দিয়ে কথা বলতো ও তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন রকম ভয়ভীতি ও প্রলোভন দেখিয়ে কৌশলে টাকা হাতিয়ে নিতো।
সিআইডি জানায়, হাসেম হিন্দি ও আরবি ভাষায় কথা বলাসহ বিভিন্ন রকম কণ্ঠে কথা বলতে পারে। সে ফ্রান্স প্রবাসী মো. ইমাম হোসেনকে (৪০) দরবেশ পরিচয় দিয়ে ১২ কোটি টাকার লটারি জিতিয়ে দেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে ১ কোটি ৫০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়। এছাড়া এক ইতালী প্রবাসীর কাছ থেকে একইভাবে লটারি ও জুয়ায় টাকা জিতিয়ে দেওয়ার কথা বলে প্রায় ৪০ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়।
সিআইডি জানায়, ফ্রান্স প্রবাসী মো. ইমাম হোসেনের পরিবার দেশের একটি প্রত্যন্ত গ্রামে বাস করে। তার স্ত্রী-সন্তানরা খেয়ে না খেয়ে অত্যন্ত কষ্টে দিনযাপন করছে। অথচ প্রবাসে তার কষ্টে উপার্জন করা টাকায় প্রতারক ‘দরবেশ বাবা’ বাড়ি-গাড়ি করে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছে। প্রবাসী মো. ইমাম হোসেন একপর্যায়ে তার বড় বোনকেও দরবেশ বাবার ভক্ত বানিয়ে ফেলে। বড় বোন তার ছেলেকে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি করার জন্য জমানো টাকা পর্যন্ত ভাইয়ের কথায় এই প্রতারকের হাতে তুলে দেয়।
সিআইডির অনুসন্ধানে জানা যায়, মধ্যপ্রাচ্যে এই প্রতারক চক্রের এরকম ২০ থেকে ২৫ জন ক্লায়েন্ট আছে, মালয়েশিয়ায় আছে ১০ থেকে ১২ জন। এরমধ্যে ৫ থেকে ৬ জন ফিক্সড ক্লায়েন্ট আছে, যারা গত ৪ থেকে ৫ বছর ধরে নিয়মিত এই প্রতারককে টাকা দিয়ে আসছে।
গ্রেফতারকৃত আসামিদের বিরুদ্ধে মোহাম্মদপুর থানায় ফৌজদারি আইনে মামলা দায়ের করা হয়েছে। মামলাটি বর্তমানে সিপিসি সিআইডিতে তদন্তাধীন রয়েছে বলে জানায় সিআইডি।