রিকশাচালক বাবার খোঁজে বাড্ডা নতুন বাজার এলাকায় যায় শিশু ইমন। হঠাৎ একটি গুলি এসে বাঁ পা ভেদ করে বেরিয়ে যায়, আরেকটি গুলি তার ডান পায়ের হাড়ে আটকে থাকে। লোকজন তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায় হাসপাতালে। গত ৭ আগস্ট অস্ত্রোপচারে ডান পায়ের গুলি বের করা হয়। কিন্তু ইমনের পঙ্গুত্ববরণের আশঙ্কা করছেন চিকিৎসকরা। ইমন বর্তমানে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বার্ন ইউনিট ভবনের গ্রিন ইউনিটের ৭ নম্বর শয্যায় চিকিৎসাধীন।
সরেজমিনে ঢামেক হাসপাতালে বার্ন ভবনে দেখা যায়, কোটা আন্দোলনে সৃষ্ট সহিংসতায় আহত রোগীদের মধ্যে এখনও এই হাসপাতালে ১৪৪ জন চিকিৎসাধীন রয়েছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই গুলিবিদ্ধ। গ্রিন ইউনিটের বারান্দায় রেখে চিকিৎসা চলছে ইমনের।
গত মাসের ১৯ জুলাই (শুক্রবার) কোটা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের ত্রিমুখী ব্যাপক সংঘর্ষ চলছিল। এদিন সকাল ১০টার দিকে ১২ বছর বয়সী শিশু ইমন তার রিকশাচালক বাবার খোঁজে বাড্ডা নতুন বাজার এলাকায় যায়। সংঘর্ষের মধ্যে দিগ্বিদিক ছোটাছুটির এক পর্যায়ে ইমনের দুই পায়ে দুটি গুলি লাগে। এরপর আর কিছু বলতে পারে না সে।
শিশু ইমন পরিবারের সঙ্গে উত্তর বাড্ডার নূরেরচালা এলাকায় ভাড়া থাকে। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে ইমন দ্বিতীয়। তাদের গ্রামের বাড়ি কিশোরগঞ্জের করিমগঞ্জ। বাড্ডা এলাকায় দ্য ফিউচার স্টার হাই স্কুলের তৃতীয় শ্রেণির ছাত্র ইমন।
ঘটনা সম্পর্কে জানতে চাইলে ইমনের বাবা মো. সুমন বলেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ঘটনার দিন (১৯ জুলাই) সকালে জীবিকার তাড়নায় তিনি রিকশা নিয়ে বের হন। সকাল থেকে ব্যাপক সংঘর্ষ চলায় তার দ্বিতীয় সন্তান ইমন বাবাকে খুঁজতে বাড্ডা নতুন বাজার যায়। সেখানে ব্যাপক সংঘর্ষের মধ্যে ইমনের দুপায়ে দুটি গুলি লাগে। এরপর মানুষ ইমনকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসেন। বর্তমানে তার বাঁ পা ভালো থাকলেও ডান পায়ের হাড় ভেঙে যাওয়ায় চিকিৎসকরা রড লাগিয়ে রেখেছেন।
তিনি আরও জানান, চিকিৎসকরা জানিয়েছেন ইমনের একটি পা পঙ্গু হয়ে যেতে পারে। তার পাঁচটি সন্তানই ছোট। তিনি রিকশা চালিয়ে সংসার চালান। এখন ইমনের চিকিৎসা কীভাবে চালাবেন, এই পাঁচ সন্তান নিয়ে কী করবেন, কোথায় যাবেন, কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিলেন এসব কথা।
ইমনের মতো গুলিবিদ্ধ আরও অনেকে ঢামেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। হাসপাতালের পুরাতন ভবনের ১০০ নম্বর ওয়ার্ডের ৩৭ নম্বর শয্যায় চিকিৎসাধীন হাবিবুর ইসলাম (১৬)। তিনি আগুলিয়ায় কাজী নজরুল মডেল স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্র।
গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের দিন বিকালে ইপিজেড এলাকায় পুলিশের গুলিতে আহত হয়। তার বাঁ পায়ের ঊরু দিয়ে একটি গুলি মেরুদণ্ডের হাড়ে আটকে থাকে। গত ১১ আগস্ট ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে অস্ত্রোপচারে হাবিবুরের মেরুদণ্ডের হাড় থেকে গুলি বের করা হয়। তবে সে আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না বলে জানিয়েছেন চিকিৎসক।
হাবিবুরের বাবা বাশিরুল ইসলাম একজন পোশাকশ্রমিক। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে সে দ্বিতীয়। তার বড় ভাই আসাদুল ইসলাম বলেন, আমার ভাই আজীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে গেলো। তার মেরুদণ্ডের একটি হাড় ভেঙে গেলো। ডাক্তার বলেছে, সে আরও সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।
রাজধানীর ডেমরায় আইডিয়াল ল্যাবরেটরি মডেল কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র মো. সজীব (১৯)। বাবা মো. মহসীন ডেকোরেটরের কাজ করেন। থাকেন ডেমরার কোনাপাড়া এলাকায়। তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে সজীব দ্বিতীয়। গত ৫ আগস্ট বিকাল ৫টার দিকে যাত্রবাড়ী থানার সামনে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। বাঁ হাতের গোড়ালিতে গুলি লাগায় হাত অকেজো হয়ে পড়ে।
সজীবের মা আনোয়ারা বলেন, আমরা গরিব মানুষ। এখন ছেলে চিকিৎসা করাবো কীভাবে আর সংসারই বা চালাবো কীভাবে? গত ১৫ দিন ধরে ছেলের বাবা হাসপাতালে থাকে ছেলের পাশে। কাজকাম সব বন্ধ। আমাগো তো টাকা-পয়সা নাই।
রিকশাচালক শহিদুল ইসলামের (৪০) গ্রামের বাড়ি পাবনা সদরের বাংলাবাজার এলাকায়। তার তিন মেয়ে ও এক ছেলে। পরিবার গ্রামের রেখে শহিদুল ঢাকায় রায়ের বাজার এলাকা থেকে রিকশা চালাতেন। গত ৫ আগস্ট থেকে বিভিন্ন জায়গায় হামলা-ভাঙচুর ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এমন অবস্থায় সেদিন রাত ৮টার দিকে নিউমার্কেট এলাকা থেকে শহিদুল রায়ের বাজার এলাকায় যাচ্ছিল। ধানমন্ডি দুই নম্বর সড়কের ইয়োলো শপিংমলে আগুন জ্বলছিল। সেখান দিয়ে যাওয়ার সময় বিদ্যুতের একটি ক্যাবল তার রিকশা ও শরীরে পড়ে। এরপর তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। দুদিন পর জ্ঞান ফিরলে তিনি নিজেকে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে দেখতে পান। তার শরীরের ৭০ শতাংশ পুড়ে যায়। বর্তমানে তিনি গ্রিন ইউনিটের বারান্দায় ২২ নম্বর শয্যায় চিকিৎসাধীন।
হাসপাতালে কথা হয় শহিদুলের স্ত্রী রোজিনার সঙ্গে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ঘটনার পর থেকে আমরা তার (শহিদুল) কোনও খোঁজ পাচ্ছিলাম না। দুই দিন পর হাসপাতাল থেকে একজন ফোন করে জানান আমার স্বামী হাসপাতালে ভর্তি। আমরা গরিব মানুষ। কামাই করলে ভাত জোটে, নইলে না খাইয়া থাকতে হয়। এখন আমরা কী করবো?
কোটা ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গত ১৬ জুলাই থেকে রাজধানীরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে পুলিশ ও আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের ত্রিমুখী ব্যাপক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে অন্তত এক হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে কয়েক হাজার মানুষ। যাদের বেশির ভাগই গুলিবিদ্ধ। আহতদের ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালসহ দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। এখনও সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসা নিচ্ছে হাজারেরও বেশি আহত মানুষ।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. আসাদুজ্জামান জানিয়েছেন, আন্দোলনে সহিংসতায় আহত হয়ে ঢামেক হাসপাতালে ২ হাজার ২০০ জন চিকিৎসা নিয়েছে। তাদের মধ্যে ৭৮৬ জনকে ভর্তি করা হয়েছিল। এখনও ১৪৪ জন আহত হয়ে ভর্তি আছে। এর মধ্যে আইসিইউতে থাকা ৭ জনের মধ্যে ৩ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।
এ ছাড়া হাসপাতালে এ পর্যন্ত ১৬৫ জন মারা গেছে। এর মধ্যে ৭৬ জনকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। বাকিরা চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় বলে জানান তিনি।