বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে এ পর্যন্ত এক লাখ ৮০ হাজার জনকে মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনযোগ্য বলে জানিয়েছে দেশটি। শুক্রবার (৪ এপ্রিল) থাইল্যান্ডে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার রোহিঙ্গা-বিষয়ক হাইরিপ্রেজেন্টেটিভ খলিলুর রহমানের সঙ্গে বৈঠকে বসেন মিয়ানমারের উপপ্রধানমন্ত্রী উ থান শিউ।
ঘোষণার পরই কূটনীতিক, সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক, মানবাধিকারকর্মী ও রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নেতাদের প্রশ্ন—কেন এই ভেরিফিকেশন। কোথায় যাবে এই রোহিঙ্গারা। ক্যাম্পের নেতারা বলছেন, ওপারে ক্যাম্পে রাখা হলে তারা যাবেন না। প্রত্যাবাসনের উদ্যোগের সঙ্গে তারা একমত, কিন্তু নিজের ভিটায় ফেরার ব্যবস্থা করতে হবে। ২০২৩ সালে প্রতিনিধি দলের সদস্যরা ওপারে প্রস্তুতকৃত মিয়ানমারের ক্যাম্প পরিদর্শন করে এসে বলেছিলেন—‘আমাদের কোনও আগ্রহ নেই সেই ক্যাম্পে যাওয়ার। আমাদের নিবাস আরাকানে ছিল, সেগুলোই বুঝিয়ে দিতে হবে।’
উল্লেখ্য, ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে আট লাখ রোহিঙ্গার একটি তালিকা মিয়ানমারকে দিয়েছিল বাংলাদেশ। ছয় ধাপে ওই তালিকা সরবরাহ করা হয়। আট লাখের তালিকার মধ্যে এ পর্যন্ত এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গার ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পেরেছে মিয়ানমার।
ফিরতে চায় কিন্তু কোথায়
মিয়ানমারের রাখাইন কনফ্লিক্ট নিয়ে কাজ করা ‘ইন্ডিপেন্ডেন্ট জার্নালিস্ট’ তানভীরুল মিরাজ রিপন মনে করেন—এ ধরনের সংবাদ প্রচারের আগে সতর্ক থাকা জরুরি। বাংলাদেশের যেকোনও ধরনের ‘ভুল পদক্ষেপ’ বঙ্গোপসাগরে প্রভাব ফেলবে। গত কয়েক মাসে আরাকান আর্মি আমাদের জাহাজ, জেলে, নৌকা আটকে রেখে দেওয়ার ঘটনা ঘটিয়েছে। ভেরিফিকেশনের বিষয়টি সামনে এগিয়ে নিতে চাইলে এখন মিয়ানমার সরকারের চেয়ে আরাকান আর্মির সঙ্গে এনগেজমেন্ট জরুরি। কেননা, রাখাইন অঞ্চলের কর্তৃত্ব কার্যতভাবেই মিয়ানমার জান্তার হাতে নেই। ওই ভূখণ্ডের ৯০ শতাংশ এখন আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। এমন পরিস্থিতিতে জান্তা কীভাবে এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গাকে প্রত্যাবাসন করবে? কোথায় করবে?
বালুখালী ক্যাম্প-৯-এর একজন শিক্ষক বলেন, ‘কীভাবে কেন এই ভেরিফিকেশন সেটি আমরা স্পষ্ট জানি না। তবে যতবার এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, ততবার বলেছি—আমরা ভয়ংকর অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে এ দেশে এসে আশ্রয় নিয়েছি। আমরা ফিরতে চাই। কিন্তু ফিরবো নিজ ভিটাতেই। নইলে ফিরবো না। ওপারের ক্যাম্পে না আছে আত্মসম্মান, না আছে নিরাপত্তা।’
সাত বছর ধরে চলছে ভেরিফিকেশন
শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের কার্যালয় সূত্র জানায়, এই ভেরিফিকেশন অনেক দিন ধরেই চলছে। বাংলাদেশ থেকে ৮ লাখ ২৯ হাজার ৩৬ জন রোহিঙ্গার তালিকা ২০১৮ সালেই পাঠানো হয়েছে। তখন তারা ৩৭ হাজার ৭০০ জন রোহিঙ্গা যে মিয়ানমারের বাসিন্দা, তা নিশ্চিত করেছিল। তারপর এক লাখের। আবার ২০২৩ সালে একদফা ৫০০ পরিবারের সঙ্গে সাক্ষাতের মাধ্যমে ভেরিফিকেশন হয়েছিল। সব মিলিয়ে এবার তারা এক লাখ ৮০ হাজারের ভেরিফিকেশনের কথা বলছে।
মিয়ানমার সরকার নাকি আরাকান আর্মির সঙ্গে আলোচনা হওয়া জরুরি প্রশ্নে শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মিজানুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আরও অনেক স্টেক আছে, প্রত্যেকের সঙ্গেই আলাপ এগিয়ে নেওয়ার বিষয় আছে।’ প্রত্যাবাসন বিষয়ে কতটা আশাবাদী প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমার কার্যালয় ও কাজের সঙ্গেই প্রত্যাবাসন শব্দটি আছে, ফলে আমি এই বিষয়ে আশা রেখেই কাজ করি। এর কোনও বিকল্প নেই।’
এর আগে ২০২৩ সালের ১৫ মার্চ বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের জন্য তৈরি তালিকা যাচাই-বাছাই করতে মিয়ানমারের একটি টেকনিক্যাল দল আসে। ২২ সদস্যবিশিষ্ট দলটি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সমাজ বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী অং মিয়োর নেতৃত্বে অভিবাসন ও জনসংখ্যা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা টেকনাফে আসেন এবং প্রত্যাবাসনের তালিকায় থাকা বেশ কিছু রোহিঙ্গা পরিবারের সাক্ষাৎকার নিয়েছেন। এই উদ্দেশ্যে টেকনাফের হ্নীলা ইউনিয়নের লেদা-নয়াপাড়া ক্যাম্পে বসবাসকারী ৭০ জন রোহিঙ্গাকে টেকনাফ স্থলবন্দরের ভেতরে রেস্ট হাউজের সামনে তৈরি করা প্যান্ডেলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মিয়ানমার দলের সদস্যরা রোহিঙ্গাদের নাম, পরিচয়, ঠিকানা, পেশা ইত্যাদি বিষয়ে তথ্য নেন।
এদিকে ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়ার সমালোচনা করে মানবাধিকারকর্মী রেজাউর রহমান লেনিন বলেন, ‘বিমসটেকের মধ্য দিয়ে আমরা জানতে পারলাম এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গার ভেরিফিকেশনের তালিকা করেছে মিয়ানমার সরকার। এক্ষেত্রে এই প্রথম এ প্রক্রিয়ার কথা জানতে পারলাম। নিঃসন্দেহে এই সরকার এই কূটনৈতিক অবস্থান ও প্রক্রিয়া জানানোর কারণে ক্রেডিট পেতে পারেন। কিন্তু একইসঙ্গে কী প্রক্রিয়ায় মিয়ানমার সরকার এক লাখ ৮০ হাজার রোহিঙ্গা ভেরিফিকেশন করেছে এবং এই প্রক্রিয়াটি কী ও কেমন ছিল, কোন আলোচনার ভিত্তিতে হয়েছে, সেই জায়গাগুলো স্পষ্ট নয়। এর আগেও ২০১৮/১৯ ও ২০২৩ সালে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে এ ধরনের বিভিন্ন প্রকার ভেরিফিকেশনের কথা বলা হয়েছিল এবং সেসব ভেরিফিকেশন সবগুলোই ত্রুটিপূর্ণ ছিল। এই ত্রুটিপূর্ণ থাকার পরেও সেই আলোচনাগুলো রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বিশ্বাস অর্জন করতে পারেনি। কেননা দেখা গেছে, একই পরিবারের দুজনকে ভেরিফিকেশন করেছে, বাকি তিন জন বাদ পড়েছে। সন্তানকে করেছে তো বাবা-মা তার মধ্যে নেই। আরেকটি প্রশ্ন করা দরকার—এই ভেরিফিকেশন কী উদ্দেশ্যে কাজে লাগবে। তাদের ফিরিয়ে নিতে কাজে লাগবে, নাকি তারা আসলে ওইসব ক্যাম্পে তাদের নিজ বাসভূমিতে ফিরে যেতে পারবে, মর্যাদাপূর্ণ একটা প্রত্যাবাসন হবে, নাকি অন্য কোনও কাজে ব্যবহার হবে। এটা আমাদের কাছে যেমন স্পষ্ট না, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর কাছেও না। কারণ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী এ ধরনের ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া, নিজ দেশে ফেরার বিষয়ে আলাপ এগিয়ে নিতে কোনও ধরনের অংশগ্রহণমূলক অবস্থায় নেই। এ ধরনের প্রক্রিয়া যেটাতে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর নিজেদের অংশগ্রহণ নাই, তা অবশ্যই একটা ত্রুটিপূর্ণ ভেরিফিকেশন প্রক্রিয়া।