আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর গুম, অপহরণ, নির্যাতন ও প্রতিহিংসামূলক মিথ্যা মামলার ঘটনায় পুলিশের সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) ইশতিয়াক আহমেদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইন অনুযায়ী তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে।
বুধবার (৩০ এপ্রিল) আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালে প্রসিকিউশন বরাবর অভিযোগ দেন গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক মো. রাশেদ খান।
অভিযোগে ঘটনার তারিখ ও সময় ২০১৮ সালের ১ জুলাই ডিএমপি সাইবার ক্রাইম ইউনিট, তৎকালিন এডিসি ইসতিয়াকের কক্ষ বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
অভিযোগে রাশেদ খান জানান, গণঅভ্যুত্থান চলাকালে ড্রোন দিয়ে নজরদারি, মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার করা সিটিটিসির সাবেক অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) ইশতিয়াক আহমদ পুলিশ নামধারী একজন সন্ত্রাসী। কোটা সংস্কার আন্দোলন-২০১৮ চলাকালীন সময়ে শেখ হাসিনাকে কটুক্তির মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলায় গ্রেফতারের পর তার দ্বারা আমি নির্মম ও নিষ্ঠুর নির্যাতনের শিকার হয়েছি। ২০১৮ সালের ১ জুলাই আমাকে ডিবি পুলিশ গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের সময় আমি আক্রান্ত হই। এ সময় ডিএমপিতে নিয়ে যাওয়ার পর পা দিয়ে রক্ত ঝরার কারণে আমাকে পুলিশ হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসা করানো হয়। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে ডিএমপির সাইবার ক্রাইম ইউনিটে নিয়ে যাওয়ার পরপরই এডিসি ইশতিয়াক আহমদ আমাকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করে। মা-বাপ তুলে গালিগালাজ করে আর বলতে থাকে, আমার চোরের মতো চেহারা, আমি শেখ হাসিনাকে গালি দিয়েছি। এরপর চেয়ার থেকে উঠে এসে বুট জুতা দিয়ে আমার অন্ডকোষে লাথি মারে, আমি চিৎকার করে উঠলে, সে আমাকে চড়-থাপ্পড়, লাথি-ঘুষি মারতে থাকে। আমি দিশেহারা হয়ে বারবার তার পা জড়িয়ে ধরতে যাই। এরপর সে আমার হাতে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে দিতে বলে, মুখে গামছা ঢুকিয়ে মুখ বাধার নির্দেশনা দেয় একজন পুলিশকে, যাতে চিৎকার করতে না পারি। এরপর আমার হাত ও মুখ বেধে ফ্লোরে ফেলে পুলিশের মোটা লাঠি দিয়ে একটানা নির্যাতন করে। এ সময় আমার আঙল ফেটে ফ্লোরে রক্ত পড়ে এবং পুরো শরীর থেঁতলে যায়। আমি কয়েকবার জ্ঞান হারাই। তখন আর কিছুই বুঝতে পারছিলাম না।
রাশেদ খান বলেন, আমার স্বাভাবিক সেন্স ছিল না। মনে হচ্ছিল, আমি মারা যাচ্ছি। দুনিয়ার কোনও চিন্তা আমার মধ্যে ছিল না। মনে হচ্ছিল, আমি জাহান্নামে আছি। একটা পর্যায়ে এই ইশতিয়াক আহমদ ক্লান্ত হওয়ার পরে আমাকে মারা বন্ধ করে। কিন্তু আমি আর দাঁড়াতে পারছিলাম না। যতোবার দাঁড়াতে যাই, ততোবার পড়ে যাই। আর পড়ে গেলেই চেয়ার থেকে বারবার উঠে এসে সে আমাকে লাথি-ঘুষি মারতে থাকে। পুরোদমে ক্লান্ত হওয়ার আগে সে কোনোভাবেই অত্যাচার বন্ধ করে না। আমার সামনেই ফ্লোরে পড়ে থাকা রক্ত তারা টিস্যু দিয়ে মুছে ফেলে। এতো অত্যাচারের পরেও আমাকে কোন চিকিৎসা দেওয়া হয়নি।
অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, আমি চিকিৎসার অনেক আকুতি করেও কোনও চিকিৎসা পায়নি। আমাকে মাত্র কয়েকটি ব্যথার ট্যাবলেট দেয় তারা। সে সময়কার অত্যাচারের কারণে রিমান্ডে ও কারাগারে থাকাকালীন সময়ে ঘুমাতে পারিনি। আমার পুরো মাংসপেশি শক্ত হয়ে যায়। জেল থেকে বের হওয়ার পর চিকিৎসা নেওয়ার সুযোগ পেয়েছি। তবে আমি আজও সুস্থ হতে পারিনি। ওই নির্যাতনের পর থেকে, প্রায়ই আমার পেশার লো হয়ে যায়, শরীর নিস্তেজ হয়ে পড়ে। এখনও পা-হাত ও শরীরের ব্যথায় ঠিকমতো ঘুমাতে পারি না, ঘুমের মধ্যে আঁতকে উঠি। জেল থেকে বের হওয়ার পর দীর্ঘদিন আমি ঘুমের মধ্যেই চিৎকার করে উঠতাম। ইশতিয়াক আহমেদ আমার মতো অসংখ্য মানুষকে নির্যাতন করেছে।
রাশেদ খান বলেন, যেহেতু ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই পুনরায় ২০২৪ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থান। সে ২০১৮ সাল থেকে ২৪ সাল পর্যন্ত ষড়যন্ত্রের সঙ্গে লিপ্ত। আমি একজন ভুক্তভোগী হিসেবে মানুষরূপী এই হায়েনার উপযুক্ত শান্তির দাবি করছি।
রাশেদ তার অভিযোগে আরও বলেন, গণমাধ্যমের তথ্যমতে, এই অপরাধী পুলিশ কর্মকর্তা জুলাই গণঅভ্যুত্থান চলাকালে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় ড্রোন ব্যবহার করে নজরদারি ও ভিডিও ধারণ করেন। পরবর্তী সময়ে তথ্য গোপন করার উদ্দেশ্য সেই ভিডিও তিনি মুছে ফেলেন। সুতরাং তার সর্বোচ্চ শাস্তি না হলে শহীদের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করা হবে। আমি তার সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।
অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার সময় আরও ছিলেন– বাংলাদেশ আইনজীবী অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট এসএম নূরে এরশাদ সিদ্দিকী, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট মো. খালিদ হোসেন, সুপ্রিম কোর্ট শাখার সদস্য সচিব ড. শোয়েব মাহমুদ, ঢাকা বারের আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট মো. মোমিনুল ইসলাম, সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট হাবিবুর রহমান, সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট মেহেদী হাসান, যুগ্ম আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট নার্গিস পারভীন, সুপ্রিম কোর্ট শাখার যুগ্ম সদস্য সচিব অ্যাড. সাজেদুল ইসলাম রুবেল প্রমুখ।