থ্যালাসেমিয়া বংশগত রক্তস্বল্পতাজনিত একটি রোগ। এ রোগ বাবা-মায়ের কাছ থেকে সন্তানের মাঝে আসে। বেশিরভাগ রোগী রক্তস্বল্পতায় ভোগেন। প্রতি ২ সপ্তাহ পরপর তাদের নিয়মিত রক্ত নিতে হয়। আবার কারও কারও ক্ষেত্রে কিছুই দরকার হয় না। আরেক দল আছেন, এ দুইয়ের মাঝামাঝি। তাদের মাঝে মাঝে রক্ত দিতে হয়। কিন্তু চাইলেই সবাই সময় মতো রক্ত নিতে পারেন না। অনেক সময় রক্ত পাওয়া যায় না। কেনার মতো নগদ অর্থ থাকে না। তখন স্বেচ্ছায় রক্তদাতাদের দয়ার ওপর ভরসা করতে হয়। রক্ত না পেলে রোগী ও স্বজনদের শুরু হয় ছোটাছুটি, কখনও কখনও বুকফাটা আর্তনাদ।
আড়াই বছরের মুহাম্মদ বিন এহসান। বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান। ৫ মাস বয়সের সময় ওর খুব জ্বর হলো, তখন চিকিৎসকের কাছে নিয়ে গেলে ধরা পড়ে সে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত।
আরও পড়ুন: একমুঠো ভাতের জন্য আদালতে মা
থ্যালাথেসিময়ায় আক্রান্ত এক শিশুর বাবা-মায়ের যুদ্ধের কথা শুনতে চাইলে মা মিপা বলেন, এ যুদ্ধে আমরা এখন অভ্যস্ত হয়ে গেছি। শুধু চাই, এই সমস্যা আরও কেউ ফেস করুক। আমরা আমাদের মতো করে সর্বাত্মক চেষ্টা করছি ওকে বাঁচিয়ে রাখার। প্রতিমাসে রক্ত দিতে হয়। সরকারি কোনও পৃষ্ঠপোষকতা নেই বিষয়টাতে, জনসচেতনতাও নেই। গর্ভবতী নারীদের কোনও কাউন্সিলিং করেন না চিকিৎসকরা। এতে থ্যালাসেমিয়ার রোগী দিনে দিনে বাড়ছে। এমন দিন হয়তো আসবে, রোগী বাড়তে থাকবে আর তাদের জন্য ব্লাড বাইরে থেকে ইমপোর্ট করা লাগবে।
মিপা বলেন, সবচেয়ে বড় ভোগান্তি হচ্ছে আমার ছেলেটার। এখন রক্ত দেওয়ার সময়ে নিজেই হাতটা বাড়িয়ে দেয়। বলে, এই হাতে দিও না আমাকে, ব্যথা দিও না, আস্তে দাও।
এদিকে, ২২ বছরের সুমির জন্মের চার মাস পর ধরা পড়ে তিনি থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত। তখন থেকে রক্ত দিতে হচ্ছে। সুমি বলেন, আমার শরীরে রক্ত জন্মায় না। যে কারণে প্রতিমাসে চারব্যাগ রক্ত নিতে হয় আমাকে।ছোট থেকে বড় হচ্ছি, আর রক্ত নেওয়ার পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন: আ. লীগের ওপর ‘ক্ষুব্ধ’ ১৪ দলের শরিকরা
প্রতিমাসে কিভাবে এই চারব্যাগ রক্ত জোগাড় করেন—জানতে চাইলে সুমি বলেন, এখন আমার এমন অবস্থা হয়েছে যে, রক্ত দেওয়ার তারিখ ওভার হয়ে যায়, কিন্তু রক্ত নিতে পারি না। কারণ, রক্ত পাই না, প্রতিমাসে চারব্যাগ রক্ত পাওয়া খুব কঠিন কাজ। আর রক্ত ঠিক সময়ে দিতে না পারলে নানারকম শারীরিক সমস্যায় ভুগি। সব কিছু মিলিয়ে ঠিক সময়ে রক্ত পাওয়াটা আমাদের জন্য খুব জরুরি।
বিটা থ্যালাসিমিয়া মেজর রোগীদের ক্ষেত্রে সাধারণত ২ থেকে ৪ সপ্তাহ পর পর রক্ত দিতে হয়।
ঢাকা শিশু হাসপাতালের এক গবেষণা থেকে জানা যায়, প্রতিবছর সারাদেশে প্রায় ৭ হাজার শিশু জন্ম নিচ্ছে থ্যালাসেমিয়া মেজর ও ই-বিটা থ্যালাসেমিয়া নিয়ে। দেশে এই রোগে আক্রান্ত রয়েছে ৩ লাখেরও বেশি শিশু, যাদের প্রতি ২ থেকে ৪ সপ্তাহ পরপর রক্ত নিতে হয়। এক হিসেবে দেখা গেছে, দেশে সংগৃহীত রক্তের ৬০ ভাগেই ব্যয় হয় থ্যালাসেমিয়া রোগীদের চিকিৎসায়। প্রতি ব্যাগ রক্তের সঙ্গে জমা হচ্ছে ২০০ মিলিগ্রাম আয়রন, এই আয়রন ধীরে ধীরে লিভার প্যানক্রিয়াসের প্রতিটি কোষ ধ্বংস করে দেয়। আর তাতে হয় নানাবিধ অসুখ।
মুহাম্মদের মা মিপা এ প্রতিবেদককে বলেন, একটু মায়া করে লিখেন আপা, সবাই যেন ব্লাড ডোনেট করে। আমরা রক্তের জন্য হাহাকার করি, কত মানুষ এই দেশে! সবাই যদি এই রোগীদের জন্য এগিয়ে আসেন, তাহলে আমাদের সন্তানেরা, আমরা বাঁচতে পারি। টাকা-পয়সা কিচ্ছু চাই না, এক ব্যাগ করে রক্ত চাই শুধু।
আরও পড়ুন: যেভাবেই হোক একটা পরিচয় মা’দের দাঁড় করাতে হবে
কোয়ান্টাম থেকে মানুষ রক্ত আনে, কিন্তু তারাতো ফ্রি দেয় না।ওরাতো ফ্রি কালেক্ট করে রক্ত, তারাতো এই রোগীদের জন্য ফ্রিতে দিতে পারে, ফ্রি দেয় না। সবাইতো আর কিনে দিতেও পারে না। নিজের বাচ্চাকে নিয়ে বসে থাকি, আর চোখের সামনে দেখি, রক্ত পাচ্ছে না দরকারের সময়, কেঁদে বুক ভাসাচ্ছে।
এদিকে, ১ বছরের আয়মানের মা কাজী জয়নাব বলেন, প্রতি মাসে আমাকে কুমিল্লা থেকে ঢাকায় এসে মেয়েকে রক্ত দিতে হয়। অনেক সময় ডোনার পাওয়ার জন্য ভোগান্তিতে পড়তে হয়। সব সময়ই চিন্তায় থাকতে হয়, ঠিক সময়ে ডোনার পাওয়া যাবে কি না। অনেক সময় দেখা যায়, ডোনার কনফার্ম হলেও শেষ পর্যন্ত রক্ত দিতে আসেন না। তখন নতুন করে ডোনার খুঁজতে হয়। কিন্তু নির্দিষ্ট সময়ের ভেতরে রক্ত দিতে না পারলে আমার মেয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ে। প্রতিমাসে কুমিল্লা থেকে নতুন ডোনার খোঁজা বেশ কষ্টকর। এ কারণে চাই, সবাই যদি আরেকটু বেশি মানবিক হয়ে স্বেচ্ছায় রক্ত দিতেন, তাহলে আমাদের সন্তানেরা বেঁচে যেত।
বাংলাদেশে রক্ত দানের বিষয়টি আগের চেয়ে অনেক বাড়লেও এখনও মাত্র ৩০ শতাংশ মানুষ স্বেচ্ছায় রক্ত দেন। আর বাকিরা আত্মীয় স্বজনের প্রয়োজনে বা চাপের মুখে রক্ত দেন। ফলে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের যে পরিমাণ রক্ত দরকার হয় তাতে অভিভাবকরা চাপের মুখে পড়ে যান বলেন, বাংলাদেশ থ্যালাসেমিয়া ফাউন্ডেশনের মহাসচিব মো. আব্দুর রহিম। আর বারবার অনুরোধ করায় রক্ত দাতারাও এক সময় বিরক্ত হয়। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের জন্য রক্ত সংগ্রহ করা একটি বড় অসুবিধা। ঠিক সময়ে যদি রক্ত না পান, তখন রোগীরা ভোগান্তিতে পড়ে।তাই স্বেচ্ছায় রক্তদান আমাদের এই রোগীগুলোকে একটু বাঁচাতে পারে মনে করে সবার স্বেচ্ছায় রক্ত দেওয়া উচিত বলেন তিনি।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের রক্ত পরিসঞ্চালন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মাসুমা রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্তদের রক্তের রেডসেল দরকার হয়। আর একজন সুস্থ মানুষের রেড সেলগুলো ৮০ থেকে ১২০ দিনের মধ্যে ভেঙে যায়, কেউ যদি রক্ত নাও দেন, তবু সেটা শরীরে থাকছে না। আর তিনি যদি এই রক্তটা দান করেন, তাহলে একজন থ্যালাসেমিয়ার রোগী বেঁচে যান। তাই প্রতিটি সুস্থ মানুষের কাছে আবেদন, তারা যেন স্বেচ্ছায় রক্ত দেন। এই সব রোগীর পাশে দাঁড়ান।
/এমএনএইচ/ আপ- এপিএইচ/