X
শনিবার, ০৪ মে ২০২৪
২১ বৈশাখ ১৪৩১

তুমি কোথায়, ‍গুলশানে জঙ্গি হামলা!

জাকিয়া আহমেদ
৩০ জুন ২০১৭, ১০:৩১আপডেট : ৩০ জুন ২০১৭, ১৭:২৯



রিপোর্টার্স ডায়েরি

ভাই কইছিল, এবার ঈদে বাড়িতে আসবে, একসঙ্গে ঈদ করমু আমরা। কিন্তু ভাই আমার কই গেলো, লাশঘরে ভাইরে রাইখ্যা কোন বইন পারে ঈদ করতে?’ এভাবে আহাজারি করছিলেন গুলশান হামলায় নিহত সাইফুল চৌকিদারের বড়বোন মায়া বেগম।
হলি আর্টিজান হামলার এক বছর পর সেই ঘটনা কাভার করার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মুহূর্তেই আমার চোখের সামনে ভেসে উঠলেন মায়া বেগম আর কানে বাজলো তার সেই আহাজারি। তিনি বলছেন, ‘আমার ভাই সাইফুল জঙ্গি ছিল না, তার সঙ্গে জঙ্গিদের কোনও মিল নাই। তারা ভুল কইরা আমার ভাইরে মাইরা এখন জঙ্গি বানাইতাছে। আমাদের পরিবারকে জঙ্গি পরিবার বানাইছে, ভাইরে ফিরত পামু না, কিন্তু আমরা সরকারের কাছে এর ক্ষতিপূরণ চাই, তাদের কাছে জবাব চাই।’
জাকিয়া আহমেদ আর কেবল মায়া বেগম নন, হলি আর্টিজান রেস্টুরেন্টে জিম্মি হওয়া আলীনূরের অপেক্ষায় থাকা চাচাতো ভাই কুটুশেখ, বেকারির দারোয়ান জসিমের মেয়ে লাভলী আক্তারের বাবাকে ফিরে পাবার আকুলতা কিংবা ‘আমার মেয়ে রয়েছে ভেতরে, আমাকে আপনারা আটকাবেন না’ বলে অবিন্তা কবিরের মা রুবা আহমেদের চিৎকার অথবা ‘তাহমিদ বেঁচে আছে, ওকে ডিবি পুলিশ নিয়ে যাচ্ছে’ বলে দৌড়ে তাহমিদের বাবা ফজলে রহিম শাহরিয়ার খানের গাড়িতে ওঠা—সবই সেদিনের ভয়াল অভিজ্ঞতা; প্রতি মুহূর্তের খবর আমরা গণমাধ্যমকর্মীরা জানাচ্ছিলাম নিজ নিজ অফিসে।
সেদিন ছিল শুক্রবার। রাত সাড়ে ৯টার দিকে বাসার কাছাকাছি যেতেই মায়ের ফোন কল, ‘তুমি কোথায়, গুলশানে হামলা হয়েছে, টিভিতে দেখাচ্ছে।’ আমি বাসার কাছেই বলে তাকে আশ্বস্ত করলাম, তখনও বুঝতে পারিনি কী অপেক্ষা করছে, কী হচ্ছে গুলশানে। ঘরে ফিরেই টিভিতে দেখলাম, সেদিন টিভিতে দেখাচ্ছিল সবকিছু। 
এরপর ধীরে ধীরে সে রাতটা এমনই ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে—যা আমাদের কল্পনাতেও ছিল না। জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গিয়ে নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তা, আহত হয়েছেন পুলিশসহ অর্ধশত মানুষ। ১ জুলাই বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি ন্যাক্কারজনক দিন হিসেবেই মানুষ স্মরণ করবে।
রাতে পুরোটা সময়ই কেটেছে টিভি সেটের সামনে আর মোবাইল ফোনে বাংলা ট্রিবিউন দেখে। সব জায়গাতেই দেখছিলাম সে রাতের ভয়াবহতা।
নির্ঘুম রাত পোহালে ভোরের দিকেই অফিস থেকে ফোন, যেতে হবে স্পটে। মনে হলো যেন এমন একটা ফোনকলের অপেক্ষাতেই ছিলাম। তৈরি হয়ে সিএনজি নিয়ে ছুট দিলাম। গুলশান থেকে ডিওএইচএস বাড়িধারার প্রবেশমুখেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সিএনজি থামিয়ে দিল, বলা হলো হেঁটে যেতে হবে। নেমে হাঁটতে শুরু করতেই দেখলাম, সে সকাল ভয়ার্ত, মানুষ হাঁটছে আর কথা বলছে হামলা নিয়ে। তখনও কেউ কিছু পরিষ্কার করে জানে না, কেবল জানে লেকপাড়ের ঐ রেস্টুরেন্টে জঙ্গিরা আক্রমণ করেছে। হাঁটতে হাঁটতেই শুনতে পাচ্ছিলাম গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ।

সাইফুল ইসলাম চৌকিদার এরইমধ্যে ইউনাইটেড হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনে পেয়ে যাই কুটু শেখকে, ভাই আলীনূর হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁর সামনের ক্লিনিক লেক ভিউতে কাজ করছেন। সাংবাদিক পরিচয় পেয়েই জানালেন ভাইকে ছাড়া বাড়ি যাবেন না। বলেন, গত রাত ১১ টার দিকে শেষ কথা হয়েছে মোবাইল ফোনে। আলীনূর তখন তাকে বলেছিলেন, ‘আটকা আছি, গোলাগুলি চলছে, কথা বলা সম্ভব না, রাইখা দিলাম।’ এরপর আর কোনও যোগাযোগ হয়নি বলে জানান কুটু শেখ। ইউনাইটেড হাসপাতালের জরুরি বিভাগের সামনের রাস্তায় তখন গণমাধ্যম কর্মীদের ভিড়, ভিড় আটকে পড়াদের স্বজনদের। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নির্দিষ্ট এলাকা আটকে দিয়েছে, সেখানে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ। এরইমাঝে দেখা হয় মায়া বেগম আর ময়না বেগমের সঙ্গে। আগের রাতে টেলিভিশনে হামলার খবর শুনেই ভাইকে ফোন করেন, কিন্তু যোগাযোগ না হওয়াতে পরদিন ভোরেই শরীয়তপুর থেকে রওনা দিয়ে হাজির হয়েছেন এখানে। সবাইকে ফোনে থাকা ভাইয়ের ছবি দেখাচ্ছেন আর কাঁদছেন। এরইমধ্যে ৭টা ৫৫ মিনিট পর্যন্ত একটানা গুলি ও সাউন্ড গ্রেনেডের শব্দ শোনা যায়। তিন মিনিট পর ৭টা ৫৮ ও ৮টা ৯মিনিটে গুলির শব্দ শোনা যায়। ৮টা ১২ মিনিটে আবারও বিকট শব্দ শোনা যায়। গোলাগুলি চলে ৮টা ২০ মিনিট পর্যন্ত। এরপর থেকেই শান্ত ছিল ঘটনাস্থল। এসব খবরই অফিসে প্রতিমুহূর্তে জানিয়েছি, আমরা সেদিন যারা ওখানে ছিলাম। 

সাইফুল ইসলামের স্ত্রী সোনিয়া আখতার ও দুই সন্তান তবে এরইমধ্যে কয়েকবার এলিগ্যান্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান রুবা আহমেদ কর্ডন করে রাখা জায়গার মধ্যেও চলে গিয়েছেন, চিৎকার করে বলছিলেন, ‘আমার মেয়ে রয়েছে ভেতরে, আমাকে আপনারা আটকাবেন না।’ কিন্তু স্বজনরা তাকে ধরে নিয়ে আসে, গাড়িতে করে যখন তাকে নিয়ে যাওয়া হয় তখনও তার চোখ খোঁজে মেয়ে অবিন্তাকে।
সেদিনের খবরগুলো ছিল আমাদের দুই থেকে তিন লাইন করে, কিন্তু এসব টুকরো খবরই গুলশান হামলার ব্যাপারে জানান দিচ্ছিল সবকিছু।
আর একটি কথা বলতে চাই, সেদিন আশেপাশের প্রতিটি ভবনের বাসিন্দারা সাহায্য করেছেন গণমাধ্যমকর্মীদের। ফোন চার্জে দেওয়া, পানি খাওয়ানো, টয়লেটে যাওয়ার সুবিধা সবই পেয়েছি আমরা তাদের কাছ থেকে।
সকাল এগারটা চল্লিশ মিনিটে গুলশানের হলি আর্টিজান বেকারির কম্পাউন্ডের ভেতরে সিআইডির ক্রাইম সিন ভ্যান প্রবেশ করেছে।
হঠাৎ করেই চিৎকার শোনা যায় আফতাব বহুমুখী ফার্মের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শাহরিয়ার খানের। দৌড়াচ্ছেন তিনি, ফোনে কাউকে বলছেন, তাহমিদ বেঁচে আছে, পুলিশ তাকে নিয়ে যাচ্ছে ডিবি কার্যালয়ে, আমিও সেখানেই যাচ্ছি। তার পাশে থেকেই শোনা গেল তিনি ফোনে কাউকে বলছেন, ‘কাঁদছো কেন, ছেলেতো বেঁচে আছে।’

সাইফুলের বোন মায়া বেগম এরই মাঝে সন্তান কোলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বের হয়ে আসেন সন্তান কোলে এক দম্পতি। মো. নজরুল ইসলাম নামের ঐ বাবা বলেন, ‘সামনের লেকভিউ ক্লিনিকে গতকাল রাতে তাদের প্রথম সন্তানের জন্ম হয়। একের পর এক গুলিতে জানালার গ্লাস ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ভেতরে গিয়ে বেঁধেছে, পুরো রুম তাদের গ্লাসের গুড়িতে ভর্তি। ভাবেননি তারা বেঁচে ফিরবেন।’ নজরুল ইসলাম বলেন, সদ্য জন্মানো সন্তানকে নিয়ে তারা খাটের নিচে লুকিয়ে ছিলেন। নজরুল ইসলামের ভাষায়, ‘গতরাতে যুদ্ধ হয়েছে। সন্তানকে নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারবেন সে আশাই ছেড়ে দিয়েছিলাম।’ 
চোখের সামনে দিয়ে বেলা ১২টা ১০ মিনিটে নিহতদের লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সগুলো বের হয়ে যায়। এর আগে অ্যাম্বুলেন্সে করে আহতদের নিয়ে যাওয়া হয় হাসপাতালে।
কেবল হামলার পরদিনই নয়, গুলশান হামলার রেশ ছিল আরও বেশ কিছুদিন। সিএমএইচে পাঁচ জঙ্গিসহ নিহতদের ময়নাতদন্তও কাভার করেছি। জেনেছি, নারীদের প্রতি বেশি নৃশংস ছিল হামলাকারীরা।’
এই জঙ্গি হামলায় তাহমিদ বেঁচে থাকার খবরে তার বাবার উচ্ছ্বাস যেমন একদিকে দেখেছি, তেমনি দেখেছি অবিন্তা কবিরের মায়ের চোখে ওড়না চেপে কান্নার দৃশ্য—জেনেছি একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে নীরব হয়ে গেছেন তিনি; দেখেছি মোবাইলে ভাইয়ের ছবি হাতে মায়া বেগমের কান্না—জেনেছি যে ঈদ তাদের একসঙ্গে করার কথা ছিল সেটি আর কোনওদিনই হয়নি, কখনোই আর ভাইকে নিয়ে ঈদ করা হবে না মায়া বেগমের।

/টিএন/
আরও পড়ুন:


হলি আর্টিজান এখন

 

 

 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
নৌকার টিকিট পেলেন নায়েব আলী
ঝিনাইদহ-১ আসনের উপনির্বাচননৌকার টিকিট পেলেন নায়েব আলী
‘কাপ্তাই লেকের হারানো যৌবন ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগ নেওয়া হবে’
‘কাপ্তাই লেকের হারানো যৌবন ফিরিয়ে আনতে উদ্যোগ নেওয়া হবে’
রাশিয়ার ‘ওয়ান্টেড’ তালিকায় জেলেনস্কি
রাশিয়ার ‘ওয়ান্টেড’ তালিকায় জেলেনস্কি
সম্পূর্ণ দুর্ভিক্ষের কবলে উত্তর গাজা: ডব্লিউএফপি প্রধান
সম্পূর্ণ দুর্ভিক্ষের কবলে উত্তর গাজা: ডব্লিউএফপি প্রধান
সর্বাধিক পঠিত
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
জাল দলিলে ৫০ কোটি টাকা ব্যাংক ঋণ!
মিল্টনের আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিতদের এখন কী হবে
মিল্টনের আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রিতদের এখন কী হবে
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
রবিবার থেকে স্কুল-কলেজ খোলা, শনিবারও চলবে ক্লাস
বিসিএসে সফলতায় এগিয়ে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা
বিসিএসে সফলতায় এগিয়ে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা
চট্টগ্রামে যান চলাচলের জন্য প্রস্তুত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে
চট্টগ্রামে যান চলাচলের জন্য প্রস্তুত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে