সরকার পতনের এক দফা দাবিতে বিএনপি ও যুগপৎ আন্দোলনে যুক্ত বিরোধী দলগুলোর সর্বাত্মক অবরোধ কর্মসূচির সপ্তম দফা শুরু হবে রবিবার (২৬ নভেম্বর)। ৪৮ ঘণ্টার ওই অবরোধের পর আবারও একই কর্মসূচি আসার সম্ভাবনা রয়েছে। এসব কর্মসূচি মাঠপর্যায়ের সাধারণ নেতাকর্মী ও যুগপতে যুক্ত দলগুলোর নেতারা পালন করলেও মূল নেতৃত্বে থাকা বিএনপির নেতাদের পাওয়া যাচ্ছে না।
দলে সামনে থেকে সক্রিয় থাকা বেশিরভাগ নেতা কারাগারে থাকলেও বিএনপির বাকি নেতারা নিজেদের আড়াল করে রেখেছেন। স্থায়ী কমিটির সদস্য থেকে শুরু করে কেন্দ্রীয় কমিটির বেশিরভাগ নেতা এই তালিকায় রয়েছেন। ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ দলের ষষ্ঠ কাউন্সিলের পর দুই দফায় ৬০০ জনের বেশি সদস্যের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করে বিএনপি। সেই সদস্যদের সংখ্যা কমে এখন ৫০২ জনে দাঁড়িয়েছে। বাকি ৯৮ জনের মধ্যে বেশিরভাগই মারা গেছেন। আবার কেউ কেউ বহিষ্কৃত হয়েছে, কেউবা দল থেকে পদত্যাগ করেছেন।
বিএনপির মিডিয়া সেলের সদস্য শায়রুল কবির খান জানান, খালেদা জিয়া, তারেক রহমানসহ ১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটির সদস্যের মধ্যে মারা গেছেন— তরিকুল ইসলাম, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, এম কে আনোয়ার, ব্রিগেডিয়ার জেনারেল অব. হান্নান শাহ। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় আছেন ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস ও আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী কারাগারে রয়েছেন।
দলের অভ্যন্তরে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ব্যারিস্টার জমির উদ্দিন সরকার, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ড. আবদুল মঈন খান, নজরুল ইসলাম খান, সেলিমা রহমান বাইরে থাকলেও ২৮ অক্টোবরের পর তারা দলীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেননি। ভার্চুয়াল বৈঠকে অংশগ্রহণ করলেও প্রকাশ্যে তাদের কাউকে দেখা যায়নি। স্থায়ী কমিটির অন্যতম সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন নীরব অবস্থায় রয়েছেন। বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপে তিনি জানান, তিনি এখনও পুরোপুরি সুস্থ নন। এছাড়া দেশের বাইরে থেকে সক্রিয় থাকলেও সহসাই দেশে ফেরার সম্ভাবনা নেই ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও সালাহউদ্দিন আহমেদের।
বিএনপির দায়িত্বশীলরা বলছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে যখন শীর্ষ নেতৃত্বকে এখান থেকে (দেশ থেকে) সহযোগিতা করার কথা, সেখানে সিনিয়র নেতারা প্রায় নেই বললে চলে। এক্ষেত্রে উভয়পক্ষের অবদান রাখার সুযোগ আছে বলে মনে করেন অনেকে।
কেন্দ্রীয় কমিটির একাধিক দায়িত্বশীল উল্লেখ করেন, মহাসচিবসহ দেশে থাকা নেতৃত্বের প্রায় সবাই জেলে। সেদিক থেকে স্থায়ী কমিটির বাকি সদস্যদের যে সক্রিয়তা দরকার ছিল, তার কোনও রেশ দলে পড়েনি। উপরন্তু, দলের স্থায়ী কমিটির বাইরে বাকি সিনিয়র নেতারাও দৃশ্যে নেই। দলের ৩৫ জন ভাইস চেয়ারম্যানের মধ্যে মারা গেছেন ৯ জন, কারাগারে আছেন ৫ জন, ৩ জন বিদেশে, ৩ জন পদত্যাগ করেছেন এবং বহিষ্কৃত হয়েছেন একজন। ভাইস চেয়ারম্যান পদধারী বাকি নেতাদের ২৮ অক্টোবরের পর আর দেখা যায়নি।
উপদেষ্টা কাউন্সিলের ৭৫ জন সদস্যদের মধ্যে মারা গেছেন ১৯ জন, ৩ জন কারাগারে ও একজন বহিষ্কৃত। বাকি সদস্যদের উপস্থিতি প্রায় নেই বললেই চলে, বলে উল্লেখ করেছে দলীয় সূত্র। ৮ জন যুগ্ম মহাসচিবের মধ্যে ৪ জন কারাগারে আছেন। ১০ জন সাংগঠনিক সম্পাদকের মধ্যে তিন জন বর্তমানে কারাগারে রয়েছেন।
বিএনপির নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, দলটির সামনে সম্ভাবনা রয়েছে। সেই সম্ভাবনা কাজে লাগানোর মতো পদক্ষেপ নেই। নেতারা যারা আছেন তারা নিজেরা পলাতক। সেক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ না করা গেলে স্রোতের সঙ্গে যেতে হবে (নির্বাচনে) বলে মনে করে সূত্রটি। রাজপথে সারা দেশের কর্মীরা ২৪ ঘণ্টা সক্রিয় থাকলেও নেতা না থাকায় তাদের মধ্যে হতাশা সৃষ্টি হয়েছে। এই হতাশা ছুঁয়েছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্বকেও। সাংগঠনিকভাবে আলাপে তৃণমূলের বেশ কয়েকজন নেতা বিষয়টি তার (শীর্ষ নেতৃত্ব) কাছে তুলে ধরেছেন।
জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ব্যাপারটা হচ্ছে, অনেকে কারাগারে রয়েছেন। বাইরে আছেন কিছু। তারা ভেতর থেকেই কাজ করছেন। বিভিন্নভাবে নেতাকর্মীরা তাদের সঙ্গে আছেন।’
দলের একাধিক নেতা জানান, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জের মুখে রয়েছে বিএনপি। উপযুক্ত নেতৃত্ব ছাড়া এই চ্যালেঞ্জ পার হওয়া যাবে না। তারা জানান, চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে অন্যতম— সারা দেশে নির্বাচনপন্থি নেতাদের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আদায়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে ভারসাম্যমূলক কৌশল অন্যতম।
তারা বলেন, ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগেও জাতিসংঘের মধ্যস্ততায় যে সংলাপ হয়েছিল, যদিও উভয় দলের সিনিয়র নেতাদের ব্যর্থতার কারণে তা সাফল্যের মুখ দেখেনি। এরপর ২০১৮ সালে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট গঠনে বিএনপির সিনিয়র নেতারা অবদান রাখেন। যদিও পরবর্তী সময়ে ফ্রন্টের কার্যক্রম থেকে সরে আসেন ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ।
দলের নির্ভরযোগ্য একজন দায়িত্বশীল জানান, গত বছরের ১০ ডিসেম্বরের কর্মসূচি ও চলতি বছরের ২৯ জুলাই ‘ঢাকার প্রবেশমুখে অবস্থান’ কর্মসূচি নির্ধারণে স্থায়ী কমিটিতে কোনও আলোচনা হয়নি। এছাড়া সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনে জামায়াতকে বাইরে রেখে কর্মসূচি সমন্বিত হলেও গত জুন মাসে এসে ঘনিষ্ঠতা শুরু হয় উভয়পক্ষের।
সূত্রের দাবি, স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য বিগত একবছর ধরে শক্তিশালী ‘রোল প্লে’ করছেন। এর রেশ পড়েছে চলমান কর্মসূচিতেও। আর এ কারণে দলের উদার গণতন্ত্রপন্থি অংশের নেতারা এখন অনেকটাই কোণঠাসা।
জানা গেছে, ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিদের সঙ্গে দলের দ্বিতীয় সারির নেতাদের দিয়ে যোগাযোগ রক্ষা করা হলেও রাজনৈতিক লক্ষ্য অর্জনে সিনিয়র নেতাদের সক্রিয়তা এখন সময়ের দাবি।
বিএনপি নেতা সেলিমা রহমান অবশ্য দাবি করেন, ‘আমাদের অনেকের সঙ্গে অনেকের যোগাযোগ আছে। নেতাদের শারীরিক অনুপস্থিতি কোনও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে না।’
সেলিমা রহমান বলেন, ‘আমাদের তৃণমূল দেখিয়েছেন আন্দোলন কী। একজন গ্রেফতার হলে অন্যজন নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তারা কোনও অভিযোগও করছেন না।’
শুক্রবার (২৪ নভেম্বর) বাংলা ট্রিবিউনকে বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির একজন নেতা বলেন, ‘তারেক রহমানের নির্দেশেই কেন্দ্রীয় নেতারা নিরাপদে অবস্থান করছেন। এটা দলীয় সিদ্ধান্ত।’
স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, স্বাভাবিক কর্মসূচিতে ফেরার চিন্তা-ভাবনা শুরু হয়েছে। তবে যেভাবে কর্মসূচি চলমান আছে, সেভাবে ধারাবাহিক হবে না।