X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

আসুন প্লাজমা দেই, জীবন বাঁচাই পাঁচজন করোনা রোগীর

রুমিন ফারহানা
০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৮:২৫আপডেট : ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৮:২৮

রুমিন ফারহানা ‘করোনা তো চলেই গেছে, তাই প্লাজমা দেওয়ার প্রয়োজন ফুরিয়েছে’—সবাই এভাবে না ভাবলেও সরকারের কোনও নীতিনির্ধারকের চোখে আমার কলামের শিরোনামটি চোখে পড়লে এমনটা বলে ফেলতেই পারেন। চারপাশ দেখলে অবশ্য মনে হয়, করোনা এই দেশ থেকে পুরোপুরিই বিদায় নিয়েছে। নিয়েছে কি আসলেই?
গত কিছুদিন করোনা পরীক্ষা আর শনাক্তের অনুপাত ১৫ থেকে ১৮ শতাংশের মধ্যে উঠানামা করছে। তার কিছুদিন আগে এটা ২০ থেকে ২৪ শতাংশের মধ্যে ছিল। ‌এই তথ্য থেকে সরকার দাবি করতেই পারে, দেশ করোনা সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসছে। সেটা তারা করছেও। শুধু মুখে দাবি করাই নয়, সব কর্মকাণ্ড দিয়ে সরকার সেটা বুঝিয়ে দিচ্ছে। ‘স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে’ জাতীয় কথা বলা থেকেও সরকার এখন সরে এসেছে। ১ সেপ্টেম্বর সরকার আগের নিয়মে গণপরিবহন চালু করে দিয়েছে। কাগজে-কলমে দাঁড়িয়ে যাত্রী না নেওয়ার কথা বললেও মিডিয়ায় আমরা দেখেছি গাদাগাদি করে যাত্রী নেওয়া হচ্ছে এবং অন্য স্বাস্থ্যবিধি পালন করা দূরেই থাকুক, ন্যূনতম মাস্ক ব্যবহার‌ও করছে না অনেকেই।

বাংলাদেশে সংক্রমণ কি আসলেই কমে আসছে? বিশেষজ্ঞদের মতামত অনুযায়ী জনসংখ্যার অনুপাতে এই দেশে অন্তত ত্রিশ হাজার টেস্ট (নিদেনপক্ষে ২৫ হাজার) হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বেশ আগে এই সংখ্যা ২০ হাজারের কাছাকাছি গিয়েও নামতে নামতে এখন ১২/১৩ হাজার টেস্ট হচ্ছে। ২ সেপ্টেম্বর দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি দৈনিকের সংবাদ অনুযায়ী‌ দেশের করোনা নিয়ে গঠিত টেকনিক্যাল কমিটি বরাবরের মতো কিছুদিন আগেও আবার আরটি-পিসিআর টেস্ট বাড়ানো এবং অ্যান্টিজেন-অ্যান্টিবডি টেস্ট অনুমোদন দিয়ে টেস্টের সংখ্যা অনেক বাড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিল, কিন্তু সেটা রাখা হয়নি।

করোনা সংক্রমণ এখন যেই পর্যায়ে গেছে, যখন অনেক মানুষ লক্ষণ ছাড়াই এই জীবাণু বহন করছে এবং ছড়িয়ে দিচ্ছে সবার মধ্যে, তখন র‌্যাপিড টেস্টিং কিট আমাদের রোগ শনাক্তকরণে কত ভালো সাহায্য করতো সেটা বুঝাতে বিশেষজ্ঞ কিংবা চিকিৎসক হতে হয় না, সাধারণ কাণ্ডজ্ঞানই যথেষ্ট। আমি যৌক্তিকভাবেই অনুমান করি সরকার এই টেস্ট আসলে করতে দিচ্ছে না, কারণ এতে খুব দ্রুত দেশের করোনা রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাবে।‌ সেটা যদি হয়, তাহলে সরকার যে দেশের সবকিছু খুলে দিলো, এবং স্বাস্থ্যবিধি নিশ্চিতে কোথাও ন্যূনতম কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না, সেটা প্রশ্নের মুখে পড়বে। 

সরকার আসলে আস্থা রাখছে তার চিরাচরিত কৌশল ‘ডেটা ম্যানিপুলেশন’-এর ওপর। দেশের গত অর্থবছরের শেষ চার মাস করোনার প্রচণ্ড প্রভাবে পড়লেও আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি নাকি ৫.২৪ শতাংশ হয়েছে। এটা এখন এক হাসির বস্তুতে পরিণত হয়েছে। সরকার আসলে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা কমিয়ে দেখানোর চেষ্টা করছে পরিসংখ্যানগতভাবে অন্তত করোনাকে বিদায় দিয়ে দিতে।

সরকারের অবশ্য একটা আচরণ দিয়ে প্রমাণ করা যায় সরকার নিজেও খুব ভালোভাবে জানে করোনা পরিস্থিতির আদৌ উন্নতি হয়নি। করোনার ব্যাপারে এত আত্মবিশ্বাসী থাকলে তো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতো। সেটা তো দেয়নি। এমনকি এইচএসসির মতো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি পরীক্ষার ব্যাপারেও সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে পারেনি। আসলে সরকার বিপদের কথা খুব ভালোভাবেই জানে। যেহেতু মানুষের জন্য খাদ্য এবং নগদ টাকার ব্যবস্থা করবে না তাই সবাইকে ‘খেটে খেতে’ নামিয়ে দিয়েছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে যেহেতু অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের পরিমাণ তুলনামূলকভাবে কিছুটা কম, এবং সরকারি তো বটেই বেসরকারি শিক্ষকদের একটা বড় অংশের বেতনের প্রধান শেয়ার যেহেতু এমনিতেই সরকার বহন করে, তাই সরকার এই ক্ষেত্রটিকে বন্ধ রাখার সাহস রাখতে পারছে।

আসলে মোদ্দা কথা হচ্ছে আমাদের সামনে করোনার খুব বড় একটা খারাপ পরিস্থিতি আসতে যাচ্ছে। করোনাকে সবচেয়ে সফলভাবে মোকাবিলায় আলোচিত দেশগুলোর একটা দক্ষিণ কোরিয়া। সম্প্রতি খবরে এসেছে অত্যন্ত সফলভাবে করোনা মোকাবিলার পর‌ও সেখানে দ্বিতীয় ঢেউ এসেছে এবং তাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আবার বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে। একইভাবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশ যেমন ফ্রান্স স্পেনেও করোনার প্রকোপ আবার বাড়ছে এবং তারা আবারও লকডাউনের কথা ভাবছে। 

বিশেষজ্ঞরা বলছেন যেহেতু সামনে শীতকাল, তাই করোনার দ্বিতীয় ধাক্কা যদি আসে সেটা ভয়াবহ পর্যায়ে যেতে পারে। এই পরিস্থিতিতে আমাদের একটা প্রস্তুতি নিয়ে রাখা উচিত বলে আমি বিশ্বাস করি, সেটা নিয়ে কথা বলতে এতগুলো কথা বলা।

আমার নিজের করোনা হয়েছে। একমাত্র তীব্র শ্বাসকষ্ট হওয়া ছাড়া আর সব লক্ষণই আমার মধ্যে ছিল। লক্ষণ শুরু হওয়ার ১৪ দিনের মধ্যেই আমার করোনা নেগেটিভ ফলাফল আসে। আমার করোনার সময়ের পুরো জার্নিটা নিয়ে সম্ভবত সহসাই বিস্তারিত লিখবো, কিন্তু এটুকু এখন বলি, সেরে ওঠার আগেই আমার মনে হয়েছিল করোনা নেগেটিভ হয়ে যত দ্রুত সম্ভব আমি প্লাজমা ডোনেট করবো। আমরা যারা সচেতন পাঠক আছি, তারা জানি করোনা মোকাবিলায় প্লাজমা থেরাপি বেশ কিছুদিন আগেই স্বীকৃত হয়েছে।  

হাসপাতালে ভর্তি রোগীর ক্ষেত্রে বিশেষ করে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা অনেক কমে যাওয়া রোগীরা এই চিকিৎসায় উপকৃত হচ্ছেন। দেশের বিখ্যাত হেমাটোলজিস্টরা বলেছেন এই চিকিৎসায় তেমন কোনও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই।

দক্ষিণ এশিয়ায় জনসংখ্যার অনুপাতে সবচেয়ে কম আইসিইউ এবং ভেন্টিলেটরের দেশে, এবং করোনা ম্যানেজমেন্টের ক্ষেত্রে যাচ্ছেতাই রকম সরকারি ব্যর্থতার মধ্যে প্লাজমা থেরাপির মাধ্যমে রোগীদের যদি আইসিইউ পর্যন্ত যেতে না হয় তাহলে সেটাও অনেক বড় একটা প্রাপ্তি।

শুধু সেটাই না, জটিল রোগীদের ক্ষেত্রে যদি রেমডেসিভির ওষুধটি দেওয়ার প্রয়োজন হয় সেই ব্যয়‌ও অনেক রোগীর পক্ষে বহন করা সম্ভব না। সেই ব্যয়ের একটা ক্ষুদ্র ভগ্নাংশ দিয়ে প্লাজমা থেরাপির মাধ্যমে যদি রোগী ভালো হয়ে ওঠে, তবে সেটা এই দরিদ্র দেশের জন্য অনেক বড় একটা ব্যাপার। আর আমরা তো এটা এখন জানি, রেমডেসিভির রোগীকে আইসিইউতে যাওয়া বা রোগীর মৃত্যু ঠেকাতে পারে না, সেটা শুধু সুস্থ হয়ে ওঠার সময়টা কমিয়ে আনতে পারে।

প্লাজমা দিয়ে জটিল করোনা রোগীর চিকিৎসা মোটেও নতুন বিষয় নয়। মে মাসের মধ্যেই পৃথিবীর অন্তত ৬০ দেশ করোনা চিকিৎসায় প্লাজমা ব্যবহার করেছে। মার্কিন সংস্থা ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এফডিএ) কিছু দিন আগেই প্লাজমা ব্যবহারের অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু আমেরিকায় তার আগে থেকেই প্লাজমা ব্যবহৃত হচ্ছে। অনুমোদন দেওয়ার পরপরই এফডিএ‌ তাদের ওয়েবসাইটে করোনা থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা মানুষকে প্লাজমা ডোনেট করার আহ্বান জানাচ্ছে। 

নিজে প্লাজমা দিতে গিয়ে জানলাম এখন পর্যন্ত মানুষ ব্যক্তিগত উদ্যোগেই প্লাজমা সংগ্রহ করেছে। কোনও জটিল করোনা রোগীর স্বজন নিজেই কোনও করোনা থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা মানুষ খুঁজে নিয়ে প্লাজমা সংগ্রহ করেছেন। অর্থাৎ এখনও পর্যন্ত কোনও নির্দিষ্ট কাউকে না, প্রয়োজনে যে কাউকে দেওয়া যাবে এরকম চিন্তায় তেমন কেউ প্লাজমা দান করছেন না। সেই প্রেক্ষাপটে গণস্বাস্থ্য হাসপাতালের প্লাজমা ব্যাংক চমৎকার পদক্ষেপ ছিল। কিন্তু অবিশ্বাস্যভাবে সেই ব্যাংকটিকে বন্ধ করার নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। অথচ এখন উচিত ‌সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন জায়গায় দ্রুত অনেক প্লাজমা ব্যাংক স্থাপন করা।

আমি বিশ্বাস করি করোনা থেকে সেরে ওঠা প্রতিটা মানুষ যদি অন্য কোনও বড় অসুস্থতায় আক্রান্ত না থেকে থাকেন তাহলে প্লাজমা দেওয়া তাদের কর্তব্য। আমি সেই কর্তব্যটিই পালন করেছি। প্লাজমা দিতে গিয়ে জেনে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে আমার প্লাজমা দিয়ে পাঁচজন রোগীর চিকিৎসা করা যাবে। 

করোনা থেকে সুস্থ হয়ে একেকজনের প্লাজমা পাঁচজন রোগীর শুধুমাত্র জীবন বাঁচায় তা-ই নয়, এসব রোগীর হাসপাতালে, বিশেষ করে আইসিইউ-ভেন্টিলেটর থাকার অকল্পনীয় ব্যয়ের হাত থেকে এই মানুষগুলোকে রক্ষা করতে পারে।

লেখক: আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট।  জাতীয় সংসদের সংরক্ষিত আসনে বিএনপির দলীয় সংসদ সদস্য

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
টিভিতে আজকের খেলা (২৬ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৬ এপ্রিল, ২০২৪)
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি
দুর্বৃত্তের হামলায় গুরুতর আহত যুবলীগ নেতা
দুর্বৃত্তের হামলায় গুরুতর আহত যুবলীগ নেতা
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ