X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

এখনই সময় নতুন উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করার

সাইফুর রহমান
২৭ জানুয়ারি ২০২১, ১৮:৪১আপডেট : ২৭ জানুয়ারি ২০২১, ১৮:৪১

সাইফুর রহমান
ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন আর স্বপ্ন নয়, অনেকটা বাস্তব রূপ লাভ করেছে। দৈনন্দিনের কাঁচাবাজার থেকে শুরু করে, অনলাইন ব্যাংকিং, রাইড শেয়ারিং সার্ভিসসহ প্রায় সবকিছুই চলে এসেছে একেবারেই সাধারণ মানুষের হাতের মুঠোয়। এছাড়া ইন্টারনেট সংযোগের সহজলভ্যতার সুবাদে ফ্রিল্যান্সিংয়ের সুযোগ বেড়েছে বহুগুণ। সেই সুযোগ কাজেও লাগাচ্ছে দেশের তরুণ প্রজন্ম। পাশাপাশি বিপথগামী হচ্ছে অনেকেই।

এই সপ্তাহেরই একটি সংবাদ নজরে পড়েছে। মাত্র ১৬ বছর বয়সী এক স্কুলছাত্র প্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে একটি ব্যাংক ডাকাতি করার চেষ্টা চালিয়েছে। বিভিন্ন সংবাদপত্রে তা বেশ ফলাও করে প্রকাশ হওয়ার পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেখা গেছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। অনেকেই বেশ ‘গর্ব’বোধ করেছেন এই কিশোরকে নিয়ে, এমনটিও দেখা গেছে। না, এখানে গর্বের কিছু নেই। এ ঘটনায় আমাদের সঠিক মূল্যবোধ এবং নৈতিকতা শিক্ষা দেওয়ার ক্ষেত্রে চরম ব্যর্থতা প্রকাশ পায়। মেধা থাকলে তার সদ্ব্যবহার না করলে তাকে বাহবা দেওয়ার কিছু নেই। একজন মেধাবী মানুষের চোখে পড়ার কথা সমাজের দুর্বলতা, মেধা কাজে লাগিয়ে চেষ্টা করার কথা সেই দুর্বলতা মোচনের। কাউকে ঠকানো কিংবা চুরির মানসিকতা কখনোই বাহবা পাওয়ার যোগ্য নয়। হোক উক্ত ব্যক্তি চরমমাত্রার মেধাবী।

ফিরে আসি মূল প্রসঙ্গে। আমাদের দেশে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে হাতে হাতে পৌঁছে গেছে ইন্টারনেট। গ্রামের কৃষক এখন নিজেই জেনে নিতে পারছেন কোন সার ব্যবহার করা উচিত কোন সময়ে। সুফলও পাচ্ছেন তাতে। এমন হাজারো উদাহরণ দেওয়া যাবে বর্তমান বাংলাদেশে ইন্টারনেটের ব্যবহারের। তবে একটি বিষয় সবার অলক্ষে থেকে যাচ্ছে। তা হলো ব্যবহারকারীর সংখ্যা বৃদ্ধিই সবকিছু নয়। এতে করে ভোক্তা বৃদ্ধি পায়, উদ্যোক্তা নয়। উদাহরণ হিসেবে যদি ইউটিউবকে ধরে নিই, তবে বলা যায় তাতে ভিডিও দেখেন না এমন ব্যক্তি বাংলাদেশে খুঁজে পাওয়া প্রায় অসম্ভব। যার কাছে একটি স্মার্টফোন আছে, সেই জানে ইউটিউবের নাম। এ থেকে বোঝা যায়, ইউটিউব নামক পণ্যের সেবার ভোক্তা বেড়েছে দেশে, কিন্তু এমন কিংবা নতুন কোনও সেবা অথবা পণ্য বাজারে আনতে পারিনি আমরা। হ্যাঁ, তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে অনেক সেবা সহজলভ্য হয়েছে। শুধু সেবার বাইরে নতুন উদ্ভাবনের দিকে কি ঝুঁকেছে এ দেশের প্রযুক্তিবিদরা? যদি দশটি প্রতিষ্ঠানের নামের তালিকা করতে বলা হয় যারা একেবারেই নতুন কিছু নিয়ে কাজ করছেন, সে তালিকা কি পূর্ণ হবে?

ব্যক্তিগত আগ্রহ থেকে দেশের প্রযুক্তি খাতে কেমন কাজ হচ্ছে তা সম্পর্কে কিছুটা জানার চেষ্টা করেছি। একসময় দেশে কাজ করেছি, এরপর লম্বা সময় দেশের বাইরে অনেক বড় প্ল্যাটফর্মে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে প্রায়ই ইচ্ছে জাগে নিজের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে দেশের জন্য কিছু করার। সে ইচ্ছেকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করে যে বিষয়গুলো সামনে এসেছে তার ওপর ভিত্তি করে কিছু সমস্যা চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছি।

প্রথম সমস্যা যা আমার ধারণা হয়েছে, দেশে নতুন আইডিয়ার পেছনে বিনিয়োগ করার মানসিকতা এখনও তৈরি হয়নি আমাদের বিনিয়োগকারীদের। সবাই তাৎক্ষণিক লাভের পেছনে দৌড়ানোর এক নেশায় মত্ত। দীর্ঘ সময় বিনিয়োগ করে কয়েক বছর পর লাভের মুখ দেখা কিংবা বিশ্বদরবারে নতুন ব্র্যান্ড হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার ইচ্ছে নেই বললেই চলে।

দ্বিতীয় সমস্যা, নতুন ধারণা বাস্তবে রূপ দেওয়ার ধৈর্য তৈরি হয়নি সফটওয়্যার কোম্পানিগুলোর মালিক পক্ষের। তারা দেশের বাইরে কিংবা ভেতরের তৈরি বাজারে যতটা আগ্রহী, নতুন করে বাজার তৈরি করে নেওয়ায় ততটা আগ্রহী নন। যে কয়টা প্রতিষ্ঠানের কর্ণধারের সঙ্গে আলাপ হয়েছে তাদের মাঝে দেখা গেছে অন্যের কাজ করে অর্থ উপার্জনেই বেশি আগ্রহী। বেশিরভাগে কথা, কাজ নিয়ে আসুন, আমরা করে দেবো।

তৃতীয় সমস্যা, তরুণরা নতুন কিছু করার ক্ষেত্রে কম আগ্রহী। অবশ্যই আমাদের বেশ কিছু তরুণ ইতোমধ্যে নিজেদের মেধার স্বাক্ষর রেখেছে বিশ্বদরবারে। তবে সেগুলো খুব বেশি আলোর মুখ দেখেনি পরবর্তীতে। হয় দেশের বাইরে ভালো প্রস্তাব পেয়ে দেশান্তরী হয়েছে, নইলে দেশে বসেই ফ্রিল্যান্সিং করছে। নিজেদের ‘ড্রিম প্রজেক্ট’ বলে তেমন কিছুর আভাস পাওয়া যায় না তাদের সাথে কথা বলে। অথবা, ইতোমধ্যে বাজারে রয়েছে অনুরূপ কিছু করে মিডিয়ায় বেশ বাহবা কামিয়ে তাতেই সন্তুষ্ট থাকছে। অথচ, এই তরুণদের বেশিরভাগেরই জানার সুযোগ রয়েছে বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে কতটা বড় পরিসরে কাজ হচ্ছে। এমনকি আমাদের পাশের দেশ ভারতে বিশ্বের প্রায় সব বৃহৎ প্রতিষ্ঠানগুলোর গবেষণা এবং ডেভেলপমেন্ট সেন্টার রয়েছে।

প্রথম ও দ্বিতীয় সমস্যার সমাধান আমার সঠিক জানা নেই। ব্যবসায়ীদের কীভাবে নতুন উদ্ভাবনী কাজের প্রতি উৎসাহিত করা যায় সেটা অর্থনীতিবিদরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে তৃতীয় সমস্যার আংশিক সমাধান আমার জানা আছে।

খুব সহজ একটি পথ হলো, তরুণদের উদ্ভাবনী কাজে আগ্রহী করে তোলার পরিবেশ সৃষ্টি করা। অনেকভাবে তা করা যেতে পারে। একটি পথ অনুসরণ করা যেতে পারে আমাদের প্রতিবেশী দেশ থেকেই। ভারতের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় ইউরোপ-আমেরিকার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে চুক্তিবদ্ধ আছে। পুরো প্রোগ্রামের একটি নির্দিষ্ট সময় কিছু কোর্স ভারতের শিক্ষার্থীরা ইউরোপ-আমেরিকার সেসব বিশ্ববিদ্যালয়ে করার সুযোগ পেয়ে থাকে। এমন কোর্স করতে যাওয়া সহপাঠীদের সাথে আলাপ করে আমার ধারণা হয়েছে, তারা যে সময়টা ওইসব দেশে কাটিয়ে আসে সে সময় উন্নত বিশ্বের কাজগুলো সম্পর্কে বেশ ভালো ধারণা পেয়ে যান। এতে তাদের ভেতর আগ্রহ জন্মায় সেই উচ্চতার কাজ করার, কিংবা নিজেরা তেমন কিছু করার। আমার একাধিক ভারতীয় সহপাঠী নিজ দেশে ফিরে হয় নিজেরাই নতুন কিছু করেছেন, নয়তো বিশ্বের প্রথম সারির প্রতিষ্ঠানে খুব ভালো অবস্থানে যোগ দিয়েছেন। এই আগ্রহ তৈরিতে ভূমিকা রাখতে হবে দেশের নীতিনির্ধারকসহ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর।

এছাড়া, মেধাবী তরুণ প্রযুক্তিবিদদের সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে নতুন উদ্ভাবনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়নের। সেটা সরকার সরাসরি করতে পারে, কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি কিছু নিয়ম বেঁধে দিতে পারে। যেমন, বাৎসরিক বিনিয়োগের একটি নির্দিষ্ট অংশ উদ্ভাবনী কাজে বিনিয়োগ করতে হবে। এতে তরুণ প্রজন্মের ভেতর যেমন আগ্রহ তৈরি হবে তেমনি উদ্ভাবনী কাজে আগ্রহী বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোও বাংলাদেশে বিনিয়োগে ইচ্ছুক হবে। অন্তত, নিজেদের স্বার্থেই প্রতিযোগিতার লক্ষ্যে হলেও তাদের নজর কাড়বে বাংলাদেশি মেধাবী তরুণরা। এবং সবচেয়ে বড় লাভ হবে দেশের। এতে মেধাপাচার রোধ হবে অনেকটাই।

খুব সহজ কিছু পদক্ষেপ বদলে দিতে পারে দেশের প্রযুক্তি খাতকে। অনেক বড় পরিবর্তন এনে দিতে পারে, খুলে যেতে পারে অপার সম্ভাবনার দুয়ার। প্রশ্ন থেকে যায়, এই সদিচ্ছা আছে তো এই খাতের কর্তৃপক্ষ তথা বিনিয়োগকারীদের?


লেখক: সফটওয়্যার আর্কিটেক্ট, ভলভো গ্রুপ কানেক্টেড সলিউশন, গোথেনবার্গ, সুইডেন।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দুর্বৃত্তের হামলায় গুরুতর আহত যুবলীগ নেতা
দুর্বৃত্তের হামলায় গুরুতর আহত যুবলীগ নেতা
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ