X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গুম না আত্মগোপন: রহস্যভেদের দায়িত্ব কার?

আনিস আলমগীর
২২ জুন ২০২১, ১৩:৪১আপডেট : ২২ জুন ২০২১, ১৬:৩০

আনিস আলমগীর ২১ জুন আমার জন্মদিন ছিল। নাগরিক কোলাহল থেকে বিশেষ দিনটিতে যাতে শান্তিতে থাকি সে প্রত্যাশায় এক বন্ধু আমাকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল ঢাকা শহর থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে টাঙ্গাইলের করোটিয়ায়। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য মাখানো একটি জায়গায় আমরা উঠেছিলাম। মোবাইল নেটওয়ার্ক সেখানে মোটামুটি কার্যকর থাকলেও বেশিরভাগ সময় নেটের বাইরে থাকার চেষ্টা ছিল আমার। সময়টাকে আত্মগোপনের মতোই কাটানোর ইচ্ছা ছিল। মোবাইল ফোনের রিংটোন অফ করে রেখেছিলাম।

মাঝে মাঝে যখন ফোন হাতে নিয়েছি, অনেকের ফোন ধরতে না পারা এবং মেসেজের জবাব দিতে না পারাটা আমাকে পীড়া দিচ্ছিল। প্রকৃতি আর আধুনিকতার মিশ্রণে গড়া এত উচ্চমূল্যের একটি আবাসের সৌন্দর্য আহরণ থেকে বিরত থাকাও সম্ভব হচ্ছিল না। কিন্তু জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাতে অনবরত ফোন করা কিছু স্বজনের চেষ্টার কাছে আমাকে পরাজিত হতে হয়েছে। সেখানে অবস্থানকালে অন্তত একটি ফোন আমাকে ধরতে হয়েছে, কিছু ম্যাসেজের ত্বরিত জবাব দিতে হয়েছে। বুঝলাম, আত্মগোপন সহজ কাজ নয়।

বাড়ি ফেরার দীর্ঘপথে আমি চিন্তা করছিলাম আত্মগোপনে যাওয়া, গুম হওয়া লোকেরা তাহলে কী করে দিনের পর দিন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন সময় কাটায়! সম্প্রতি কথিত ইসলামি বক্তা রংপুরের বাসিন্দা আবু ত্ব-হা মুহাম্মদ আদনান ও তার তিন সফরসঙ্গীর নিখোঁজ হওয়ার সংবাদে সারা দেশে তোলপাড় হয়েছে। ত্ব-হার পরিবার তাকে পাওয়া যাচ্ছে না অভিযোগ করলেও আট দিন পর তার সন্ধান মিলেছে। তারা নাকি নিজেদের গোপন করার জন্য ডিজিটাল সব সংযোগ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। সেই সঙ্গে অন্য কারও সঙ্গেও সশরীরে বা অন্য কোনোভাবে কোনও যোগাযোগ রাখেনি।

এ ব্যাপারে সংবাদ সম্মেলন করে এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘জিজ্ঞাসাবাদে আবু ত্ব-হা পুলিশকে জানিয়েছেন, ১০ জুন বিকালে রাজধানীর গাবতলী থেকে স্ত্রীর মোবাইল নম্বরে কল দিয়ে সর্বশেষ কথা বলেন। এরপর মোবাইল ফোন বন্ধ করে তিন সঙ্গী মুজাহিদ, মুহিত ও গাড়িচালক আমির উদ্দিনকে নিয়ে বগুড়ায় যান। পরে মুজাহিদকে বগুড়ায় রেখে আমির উদ্দিন ও মুহিতকে সঙ্গে নিয়ে গাইবান্ধা সদর উপজেলার ত্রিমোহনীতে এক বন্ধুর বাড়িতে আত্মগোপন করেন। ১৮ জুন বিকালে রংপুর মহানগরীর মাস্টারপাড়া এলাকায় শ্বশুরবাড়িতে আসেন আবু ত্ব-হা। তার নিখোঁজ হওয়ার পেছনে কোনও গোষ্ঠী কিংবা কেউ জড়িত ছিলেন না বলে আমরা ধারণা করছি।’

এ বিষয়ে গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেন আদনানকে আশ্রয়দাতা নিশাদ নাহার। আদনানের বন্ধু সিয়ামের মা নিশাদ নাহার বলেন, ‘ত্ব-হা এখানে এসে বলে, আমাকে দুজন লোক ফলো করছে, আমরা এখানে কিছু দিন থাকবো। রংপুরে এসএসসি পর্যন্ত একসঙ্গে পড়ার কারণে আমার ছেলের সঙ্গে তার পরিচয়। এসএসসি পাসের পর তারা দু’জন দুই কলেজে পড়লেও একসঙ্গে চলাফেরা করতো। তারপর ইউনিভার্সিটিতে পড়াকালীন দু’জন একসঙ্গেই চলতো। এদিকে আমরা গাইবান্ধায় চলে আসি। এখানে আসার পর আমার ছেলের চাকরি হয়। চাকরি সূত্রে সে এখন রংপুরে থাকে। আর ত্ব-হা আমার বাসায় এর আগে অনেকবার এসেছে।’

চারদিকে তাদের নিয়ে তোলপাড়, তারপরও আপনারা কেন জানেননি, এমন প্রশ্নের জবাবে নিশাদ নাহার বলেন, ‘আসলে এটা আমি ঠিকভাবে জানতে পারিনি। কারণ, আমার বাসার টিভিটা নষ্ট। আর আত্মীয়স্বজনরা আমাকে ফোনে বলেছে ও তো নিখোঁজ। তারাও বলেছে না জানাতে। আমার ছেলেরও নিষেধ ছিল। কিন্তু পরে আমি ত্ব-হাকে বলেছি, যেহেতু মিডিয়ায় তোমাদের নিয়ে লেখালেখি হচ্ছে, তোমরা কিন্তু এবার যেতে পারো। তারপর তারা চলে গেছে।’

আমাদের একশ্রেণির লোকের ধারণা হয়েছে, কেউ নিখোঁজ হলে তার সঙ্গে রাষ্ট্রের গোয়েন্দা সংস্থার সম্পর্ক আছে। জেনে হোক বা না জেনে হোক তারা এ ধরনের সমীকরণ করে। সোশ্যাল মিডিয়ায় কেউ কেউ ইঙ্গিত করেছেন আদনানের ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে, কিন্তু দেখা যাচ্ছে ঘটনা ভিন্ন। এ ঘটনার বয়ান থেকে বোঝা যায় সিয়াম এবং তার মা যেভাবেই হোক এতে জড়িত হয়েছে এবং এ নিয়ে সারা দেশে ধূম্রজাল সৃষ্টিতে তাদেরও ভূমিকা ছিল। ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় এরমধ্যে সিয়াম তার বেসরকারি চাকরিও হারিয়েছে।

পুরো ঘটনায় কয়েকটি প্রশ্ন সামনে চলে এসেছে। আদনানকে তার মায়ের জিম্মায় আদালত ওইদিন মুক্তি দিলেও আদনান কেন মিডিয়ায় মুখ খুলছেন না। তার তো মিডিয়ায় পরিচিতি পাওয়ার খুব খায়েশ। সে কারণেই তিনি ইউটিউব চ্যানেল খুলেছেন, সিনেমার নায়ক-নায়িকা বা কবি-লেখকদের মতো আফসানুল আদনান নাম পরিবর্তন করে আবু ত্ব-হা মুহাম্মদ আদনান করেছেন। তাহলে তার কাছে হঠাৎ মিডিয়া তিতা হলো কেন!

দ্বিতীয়ত, আদনানের বিষয়ে পুলিশ যা বলছে তা যদি সত্য হয় আদনান সারা দেশের মানুষকে বিভ্রান্ত করেছেন, সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করেছেন। পুলিশ কারণে-অকারণে মানুষের বিরুদ্ধে মামলা করে, আদনানদের ব্যাপারে কোনও মামলা নেই কেন। যে কেউ তাহলে কি এসব ‘নাটক’ করার অধিকার রাখেন? পত্রিকায় এসেছে, প্রথম স্ত্রী এবং দ্বিতীয় স্ত্রীর রেষারেষি থেকে আদনান বাঁচতে চেয়েছে।

পুলিশ এ বিষয়টি খোলাসা না করে বলছে, আদনান ব্যক্তিগত কারণে এ ঘটনা ঘটিয়েছে। পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেছেন, ‘সে (আদনান) তার ব্যক্তিগত কারণটা আমাদের বলেছে। সেটা তার নিজের জীবনকে কেন্দ্র করে হতে পারে, তার পরিবারকে কেন্দ্র করেও হতে পারে। কিন্তু আইনগত কারণে তার ব্যক্তিগত কারণটা সবার সামনে বা সমাজে বা মিডিয়ায় আমরা প্রকাশ করতে পারি না।’ শুনে আমরা যে কেউ খুশি হতে পারি যে পুলিশ মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য হেফাজত করছে কিন্তু অনেকে অবাক হচ্ছেন কবে থেকে পুলিশ এই কাজ করছে, যেখানে ব্যক্তির গোপনীয়তা হরদম তাদের হাতেই লঙ্ঘিত।

সবচেয়ে জটিল প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, ত্ব-হা আদনান একা নন, নিখোঁজ অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে লোকজন সবাই কেন বোবা হয়ে যান? ৫৩ দিন নিখোঁজ থাকার পর গত বছরের ৩ মে যশোরের বেনাপোলে ভারত সীমান্তের কাছে পাওয়া সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম কাজলের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা হয়েছে। বছর তিনেক আগে সাবেক কূটনীতিক মারুফ জামান নিখোঁজ অবস্থান থেকে ফিরে আসার পর কারা তুলে নিয়েছেন, কেন নিয়েছেন কিছুই বলেননি।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে ডাক পাওয়া তানভীর আহমেদ, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক মোবাশ্বের হাসান, কল্যাণ পার্টির মহাসচিব আমিনুর রহমান, ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ রায়ও নিখোঁজ অবস্থা থেকে ফিরে কিছু বলেননি। লেখক ফরহাদ মজহারও কোনও কথা বলেননি। মুখ না খোলার জন্য তারা নিজেরা কতটা দায়ী বা তাদের ওপর রাষ্ট্রযন্ত্রের কোনও চাপ আছে কিনা সেটা স্পষ্ট নয়।

এই ধরনের ঘটনাবলি রাষ্ট্রের জন্য নিশ্চয়ই সুনাম বয়ে আনছে না। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে না। আদনান তালেবান জঙ্গিদের পক্ষ নিয়ে ডিজিটাল মিডিয়ায় প্রচার চালিয়েছে, একটি বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থার বাংলাদেশে সক্রিয় উপস্থিতি নিয়েও কথা বলেছেন দেখলাম। তার বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনেই মামলা করা যায়, তাকে সাজা দেওয়া যায়। সেটা না করে কেউ যদি তুলে নিয়ে আবার ফেরত দেয় সেটা নিয়ে প্রশ্ন আসতে পারে। সাংবাদিক কাজল, শিক্ষক মোবাশ্বের বা অন্যরা- অপরাধ করলে কেউই আইনের ঊর্ধ্বে নয়। কিন্তু আইন-বহির্ভূতভাবে তারা যদি রাষ্ট্র দ্বারা হেনস্তার শিকার হয়ে থাকে তার সুদূর প্রতিক্রিয়া শুভ নয়।

পত্রিকায় এসেছে, মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসাব অনুযায়ী গত ১৩ বছরে (২০২০ সালের আগস্ট পর্যন্ত) ৬০৪ জনের মধ্যে ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে। ৮৯ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে এবং ৫৭ জন কোনও না কোনোভাবে ফিরে এসেছেন। অন্যরা কোথায় আছেন, কেমন আছেন তার কোনও তথ্য নেই পরিবারের কাছে। এশিয়ান হিউম্যান রাইটস কমিশন (এএইচআরসি) বাংলাদেশে ২০০৯ থেকে ২০১৯ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত গুম হওয়া ৫৩২ জনের একটি তালিকা প্রকাশ করেছিল ২০১৯ সালের আগস্ট মাসে। কে কীভাবে গুম হয়েছিলেন, তারও বিস্তারিত সেখানে আছে। এ সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও কোনও তথ্য দিতে পারছে না।

এই তথ্য দেওয়া, গুম না আত্মগোপন- এই রহস্যভেদের দায়িত্ব তাহলে কার?

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট, ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।
[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দুর্বৃত্তের হামলায় গুরুতর আহত যুবলীগ নেতা
দুর্বৃত্তের হামলায় গুরুতর আহত যুবলীগ নেতা
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ