X
মঙ্গলবার, ১৯ মার্চ ২০২৪
৫ চৈত্র ১৪৩০

কোভিড-১৯ ও বাংলাদেশের ‘রহস্যময়’ প্রত্যাবর্তন

ডা. মালিহা মান্নান আহমেদ
২০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৪:১০আপডেট : ২০ সেপ্টেম্বর ২০২১, ১৬:২৫

ডা. মালিহা মান্নান আহমেদ কোভিড-১৯ সামাল দেওয়া নিয়ে আমরা যতটা না ভয় পেয়েছিলাম, বাংলাদেশ তারচেয়ে বেশ ভালোভাবেই এটি নিয়ন্ত্রণ করতে পেরেছে। মোটামুটি একটা বড় জনগোষ্ঠী টিকার আওতায় না আসা পর্যন্ত নতুন ভ্যারিয়েন্ট ও ব্রেকথ্রু কেইস (টিকা দেওয়ার পরও আক্রান্ত হওয়া)-এর বিরুদ্ধে আমাদের লড়াইটা চলবে। তবে এখন পর্যন্ত গত ১৯ মাসে আমরা যেহেতু তৃতীয় ঢেউ ও তৃতীয় লকডাউনের ধাক্কা সামলে উঠতে পেরেছি সেটার সাপেক্ষে এখন একটি পর্যালোচনামূলক গবেষণা করা জরুরি। কী কী পদক্ষেপ নেওয়ার কারণে আমরা একটি মানবিক ও অর্থনৈতিক বিপর্যয় এড়াতে পেরেছি, সেটা বুঝতে পারলে আমরা আমাদের সক্ষমতা সম্পর্কে বুঝতে পারবো। ‘কোভিড ১৯ ইন সাউথ এশিয়া’ শীর্ষক ব্রাউন ইউনিভার্সিটির একটি প্যানেল আলোচনায় পর্যবেক্ষণটি উপস্থাপন করেছিলেন ভারতীয় প্রতিনিধি বরখা দত্ত ও শ্রীলঙ্কা থেকে আসা ড. পি. সারাভানামুত্তু।

এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের ১৫ লাখ ৪০ হাজার কোভিড আক্রান্তের ৯৭ দশমিক ২ শতাংশই সেরে উঠেছে। আমাদের মৃত্যুর হারও এখন ১ দশমিক ৭৬ ভাগে রয়েছে। নিঃসন্দেহে আক্রান্তের আসল সংখ্যাটা আরও বেশি হবে— সেটা হতে পারে পরীক্ষার সংখ্যা কম ছিল কিংবা অনেকেই উপসর্গহীন ছিলেন। তার মানে, আমাদের সত্যিকার মৃত্যুর হারও আরও কম?

এমনটা হতে পারে, আবার না-ও পারে। কেননা, কোভিডের মতো উপসর্গ নিয়েও অনেকের মৃত্যু হয়েছে। যেমন, সাতক্ষীরার কথা বলা যায়। সেখানে একপর্যায়ে কোভিডের মতো উপসর্গ নিয়ে ৪৪৬ জনের মৃত্যুর খবর বলা হয়েছিল। কিন্তু পরে দেখা গেলো তাদের মধ্যে কোভিড-১৯ ছিল ৮০ জনের।

ভবিষ্যতের রেফারেন্সের খাতিরে এমন শ্রেণি করে হিসাব রাখলেই ভালো হতো- কোভিড সন্দেহে মৃত্যু, নিশ্চিত কোভিড, লং-কোভিড ও কোভিড-পরবর্তী জটিলতায় মৃত্যু। যাবতীয় বিতর্কের পরও ২০২০ সালে বাংলাদেশের মোট মৃত্যুর হার ছিল ৫.৫৪১। যার মানে হলো প্রতি হাজারে সাড়ে পাঁচ জন মারা গিয়েছিল। ২০১৯ সালেও সংখ্যাটা ছিল ৫.৫৪৫ জন। প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশে এ সংখ্যাটা ছিল সন্তোষজনক।

ঠিক কোন জিনিসটা এখানে কাজে এসেছে? ২০২০ সালে সবার জন্য এটুআই-তে কাজ করার সুবাদে আমি একটা বিষয় জানি যে আমাদের কোভিড সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগুলো অন্য দেশের মহামারি নিয়ন্ত্রণের সফল কৌশল, লোকজনের চলাফেরা, সম্পদের স্মার্ট ব্যবহার ও বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে নেওয়া বিজ্ঞানসম্মত মতামতের ওপর ভিত্তি করেই নেওয়া। এটা সরকার, বেসরকারি খাত ও উন্নয়ন সংস্থাগুলোর এমন এক সমন্বিত প্রচেষ্টা, যা প্রতিটি সময়ই পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দিতে সহায়তা করেছে। তেমনই কিছু সিদ্ধান্তের কথা এখানে বলবো। আর এসব তথ্য থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়ভারটা আপাতত পাঠকের হাতেই ছেড়ে দিচ্ছি।

তিনটি ঢেউ ও তিনটি লকডাউন

এ নিয়ে কোনও বিতর্কের অবকাশ নেই যে লকডাউনই সংক্রমণের চেইনটা ভাঙতে পেরেছিল। যেসব নিয়ম বেঁধে দেওয়া হয়েছিল, সেগুলো অন্য সব দেশের সঙ্গে ছিল সঙ্গতিপূর্ণ—জনসমাগমে নিষেধাজ্ঞা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস, কারখানা বন্ধ রাখা, জেলার ভেতর ও আন্তজেলার পরিবহন বন্ধ রাখা, ফ্লাইট বাতিল করা ইত্যাদি।

বিদেশ ফেরত আক্রান্তদের কারণে সৃষ্ট প্রথম ঢেউয়ের সময় পজিটিভ টেস্টের হার ছিল গড়পড়তায় ২৩ শতাংশ। আর সাধারণ লকডাউন তখনই তুলে দেওয়া হয়েছিল, যখন ছোটখাটো অনেক নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়ন করতে কোভিডের হটস্পটগুলোর ম্যাপিং করা সম্ভব হয়েছিল। ওই সময়কার তুলনামূলক ভালো তিনটি মাসের বলয়টা ভেঙে গিয়েছিল ২০২১ সালের মার্চে—বেটা ভ্যারিয়েন্টের আগমনে। ওই সময় যখন আবার শনাক্তের হার ১৮ শতাংশর কাছাকাছি চলে এলো তখনই আরোপ করা হলো দ্বিতীয় লকডাউন। এরপর খুব তাড়াতাড়িই সীমান্ত এলাকাগুলোতে ডেলটা ভ্যারিয়েন্ট ছড়িয়ে পড়লে তৃতীয়বারের মতো লকডাউন দেওয়া হয়। তখন রাজশাহী, খুলনা ও রংপুর বিভাগের ১৫টি ‘রেড জোন’ জেলা থেকে ঢাকাকে রক্ষা করাই ছিল বড় লক্ষ্য।

তৃতীয় লকডাউনের ৪২ দিনেই ৪ লাখ ৬৫ হাজার ১৮৩ নতুন শনাক্ত হয়, যখন কিনা ২০২০ সালের প্রথম ছয় মাসে শনাক্ত ছিল ৩ লাখ ১৩ হাজার। এ সংখ্যা ও ২৮-৩১ শতাংশ শনাক্তের হার—দুটোই ইয়েল ইউনিভার্সিটির প্রতিবেদনের সঙ্গে মিলে যায়, যাতে বলা হয়েছিল অনিয়ন্ত্রিত পরিবেশে ডেলটায় আক্রান্ত এক ব্যক্তি গড়ে সাড়ে তিন থেকে চার জনকে আক্রান্ত করছে। আগের সার্স কভ-২ ভ্যারিয়েন্টের ক্ষেত্রে সংখ্যাটা ছিল ২ দশমিক ৫ জন।

স্বাস্থ্যসেবার সক্ষমতা বেড়েছে

২০২০ সালের এপ্রিলে যেখানে গোটা দেশের জন্য ঢাকায় মাত্র ৫টি টেস্ট সেন্টার ছিল, সেখানে এখন দেশজুড়ে আছে ৮০০টি। মোট পরীক্ষা কেন্দ্রের মধ্যে ৯০ শতাংশই এখন আরটি-পিসিআর। আর ১৪০টি আরটি-পিসিআরের মধ্যে ৮৬টি পরীক্ষা কেন্দ্র পরিচালিত হচ্ছে বেসরকারিভাবে। ৫৪৫টি র‌্যাপিড অ্যান্টিজেন ও ৫১টি জিন এক্সপার্ট টেস্ট সেন্টারে বিনামূল্যে পরীক্ষার সুযোগ দিয়েছে সরকার। সরকারি কেন্দ্রগুলোতে আরটি-পিসিআর পরীক্ষায় লাগছে জনপ্রতি ১০০ টাকা, দরিদ্রদের জন্য তা আবার বিনামূল্যে। বেসরকারি কেন্দ্রগুলোতে খরচ হচ্ছে ৩০০০-৪৫০০ টাকা পর্যন্ত। গত বছরেই আমদানি করা আরটি-পিসিআর টেস্ট কিটের দাম ৩০০০ থেকে কমে ৮০০ টাকায় দাঁড়িয়েছে। এখন পর্যন্ত মোট ৯৪ লাখ পরীক্ষা করা হয়েছে, যার ৭৪ শতাংশই হয়েছে সরকারি কেন্দ্রগুলোতে। এখন দিনে পরীক্ষা করার সক্ষমতা ৫৫ হাজারের কাছাকাছি। অথচ, মহামারির একদম শুরুর দিকে আইইডিসিআর দিনে মাত্র ৩৩ জনের কোভিড পরীক্ষা করতে পারতো।

২০২০ সালের এপ্রিলে আমাদের কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতাল ছিল মাত্র ৯টি। এখন ১০০টি সরকারি ও ৩৯টি বেসরকারি হাসপাতাল কোভিড ১৯ রোগীদের সেবা দিচ্ছে। ২০২০ সালের জুনে ২১৮টি সরকারি আইসিইউ বেডের মধ্যে মাত্র ৬৯টি ঠিকঠাক কাজ করতো। দেশজুড়ে তখন এর মোট সংখ্যা ছিল ৩৮১। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে কোভিড ডেডিকেটেড জেনারেল বেড বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৭ হাজারে, আইসিইউ হয়েছে ১৩২১টি ও এইচডিইউ বেড হয়েছে ৮৫৬টি।

আর ঢাকা যেহেতু দারুণভাবে ঘনবসতিপূর্ণ এবং মোট শনাক্তের ৫৪ শতাংশ ও মোট মৃত্যুর ৪৩ শতাংশই এখানে। আর তাই মোট হাসপাতালের ৪৪ শতাংশই আছে ঢাকায়। কোভিড আক্রান্তদের জন্য হাইফ্লো অক্সিজেন সরবরাহের বিষয়টি শুরু থেকেই জানতে পারি আমরা, আর তাই সেই অনুযায়ী একটি কৌশল গ্রহণ করা হয় ২০২০ সালের জুনে। যে কৌশলের আওতায় কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোর সেন্ট্রাল পাইপলাইনে নিরবচ্ছিন্ন অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করতে তরল অক্সিজেনের ট্যাংক স্থাপন করা হয়। সেন্ট্রাল অক্সিজেন ট্যাংক, অক্সিজেন সিলিন্ডার ও অক্সিজেন কনসেনট্রেটর থেকে অক্সিজেন সরবরাহে হাসপাতালগুলোও তাদের সক্ষমতা বাড়িয়েছে। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন বাড়িয়ে সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে সরবরাহ করা হয়েছে পিপিই।

আমাদের স্বাস্থ্যসেবার ব্যয়ের বেশিরভাগটা পকেট থেকেই যায়। আর প্রাইভেট হাসপাতালগুলোতে কোভিড রোগীর চিকিৎসায় দিনে ৩৭ হাজার থেকে শুরু করে ৬৮,৫০০ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। এ পরিমাণ খরচ ও সরকারি হাসপাতালের বেডগুলোর সংখ্যা—এ দুটো বিষয়ই সরকারি হাসপাতালে মৃত্যুর হার (মোট মৃত্যুর ৮৪ শতাংশ) বেশি হওয়ার কারণটা ব্যাখ্যা করতে পারে।

আমাদের ওষুধ শিল্পও এ কৃতিত্বের দাবিদার। দরকারি ওষুধপত্রের ৯৮ শতাংশই এসেছে এ শিল্প থেকে। শুধু টোসিলিজুমাব (অ্যাকটেমরা) ছাড়া। যে ইমিউনোমডিউলেটরটি ব্যবহৃত হয়েছিল সাইটোকাইন স্টর্ম কমানোর জন্য। এর বাইরে কোভিড ১৯ সংক্রমণের যাবতীয় ওষুধই তৈরি করা হয়েছিল দেশে। এমনকি সরকার যাতে ভ্যাকসিন সংরক্ষণ করতে পারে সেজন্য প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের সংরক্ষণ ফ্যাসিলিটিও বাড়িয়েছিল।

সরকারের যত প্রণোদনা প্যাকেজ

গত ১৯ মাসে আমাদের প্রধানমন্ত্রী মোট ১ লাখ ৩১ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করেছেন। ৭২ হাজার ৭৫০ টাকার প্রথম প্রণোদনা প্যাকেজটি ঘোষণা করা হয়েছিল ২০২০ সালের এপ্রিলে এবং ১ লাখ ২১ হাজার ৩৫৩ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা হয়েছিল ২০২০ সালের নভেম্বরে। এটি আমাদের জিডিপির ৪.৩ শতাংশ এবং এর ৭০ ভাগই বিতরণ হয়েছে ২০২১ সালের এপ্রিলের মধ্যে।

সর্বশেষ ৩২০০ কোটি টাকার প্রণোদনা ঘোষণা করা হয় ২০২১ সালের জুলাইয়ে। এর লক্ষ্য ছিল সরকারি ব্যয়ের মাধ্যমে লোকজনের কাজের সংস্থান, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, স্বল্পসুদে ঋণ দেওয়ার মাধ্যমে শিল্পকারখানাকে টিকিয়ে রাখার ব্যবস্থা করা। পাশাপাশি বিচ্ছিন্ন নানা খাতে কর্মরত দরিদ্র জনগোষ্ঠীকে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীতে নিয়ে আসতে খাদ্য সহায়তা, নগদ অর্থ ও আবাসনের মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানো হয়েছে।

একনজরে বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক এর প্রণোদনা প্যাকেজ

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও এনজিও খাত

মহামারি ঠেকাতে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউএসএইড যৌথভাবে ৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার দিয়েছে বাংলাদেশকে। যুক্তরাজ্য, বিশ্বব্যাংক ও আরও কিছু দেশও বেশ ভালো অঙ্কের সহায়তা দিয়েছিল। স্থানীয় এনজিওগুলোকে এ ক্ষেত্রে নেতৃত্বে দিয়েছিল ব্র্যাক। এক লাখ মানুষকে নগদ ভর্তুকি দিয়ে সহায়তা করেছে সংস্থাটি। স্বাস্থ্যসেবা খাতে তাদের ৫০ হাজার নারীকর্মী কোভিড দূরীকরণ তথ্য শিক্ষা দিয়েছিলেন প্রায় ৪৭ লাখ মানুষকে। বাংলাদেশের জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিভিন্ন গবেষণাতেও তারা ভূমিকা রেখেছেন।

করপোরেট প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও মানবিক সাহায্য সংস্থা; প্রত্যেকেই কমিউনিটির প্রতি যার যার দায়িত্ব পালনে এগিয়ে এসেছিলেন। সবচেয়ে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর হাতে ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া ও খাবারের রেশন নিশ্চিত করেছেন স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধি ও স্থানীয় প্রশাসন।

এই সময়ে আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ১০৬ কর্মকর্তাকে হারিয়েছি। হারিয়েছি কোভিড-১৯ ফ্রন্টলাইনে ডিউটিরত ১৮৬ ডাক্তারকে। সংসদের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ সদস্য অর্থাৎ প্রায় ১০০ সংসদ সদস্য আক্রান্ত হয়েছিলেন কোভিডে এবং দুঃখজনক যে তাদের চার জনকেও আমরা হারিয়েছি।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার

আমাদের ১১ কোটি মোবাইল ফোন ব্যবহারকারী আছে। এদের মধ্যে ১০ কোটি ৭০ লাখের ইন্টারনেট সংযোগ আছে এবং মোবাইল ব্যবহারকারীদের ৪০ শতাংশেরই আছে স্মার্টফোন। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার করে সরকারি ও বেসরকারি খাত লকডাউনে টিকে থাকার জন্য সবচেয়ে কার্যকরভাবে চালু করেছে ই-কমার্স, ই-হেলথ, ই-ব্যাংকিং, ই-গভর্ন্যান্স ও ই-এডুকেশন। আরও অনেক কিছুর মধ্যে মহামারির সময়টাতে আইসিটির সবচেয়ে বড় সেবাটা ছিল ‘সুরক্ষা’ পোর্টালের মাধ্যমে ভ্যাকসিন রেজিস্ট্রেশন, করোনা হেলপলাইন ৩৩৩, ভার্চুয়াল কোর্ট সিস্টেম (মাইকোর্ট), টেলিহেলথ সেবা ও ডিজিটাল ক্লাসরুম। নিরবচ্ছিন্ন নেটওয়ার্ক সুবিধাসম্পন্ন অনলাইন অফিস পরিচালনা, মুদিপণ্য কেনা, খাবারের অর্ডার ও ডেলিভারি অ্যাপ, মোবাইল ব্যাংকিং, অনলাইন ফার্মেসি, বিল পরিশোধ, টেলিমেডিসিন ও বিনোদন পরিচালনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর অনুমোদন পেয়েছিল আইসিটির বিজনেস কনটিনিউইটি প্ল্যান।

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার

ভ্যাকসিন সংগ্রহ ও ভ্যাকসিন প্রকল্প

এফডিএ, ইইউ এবং ডব্লিউএইচও কর্তৃক জরুরি অনুমোদনপ্রাপ্ত ভ্যাকসিনগুলোর অনুমোদন দিয়ে নাগরিকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে বাংলাদেশ এবং প্রায় ১১ কোটি ৭৮ লাখ ৫৬ হাজার মানুষ (জনসংখ্যার ৮০%) বিনামূল্যে টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে।

এই অঞ্চলের মধ্যে বাংলাদেশই সিরাম ইনস্টিটিউট অব ইন্ডিয়ার সঙ্গে ২০২০ সালের নভেম্বরের প্রথম দিকে ভ্যাকসিন চুক্তি করে প্রশংসিত হয়েছিল। তবে ফেব্রুয়ারিতে এ যাত্রার সফল সূচনা হলেও দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারত ভ্যাকসিন রফতানি বন্ধ ঘোষণা করলে এপ্রিল থেকে জুন পর্যন্ত একটি বিপর্যকর পরিস্থিতি তৈরি হয়।

এদিকে ধাপে ধাপে ৬ কোটি ভ্যাকসিনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে কোভ্যাক্স। আর এর আওতায় যুক্তরাষ্ট্র প্রদান করেছে ৬৫ লাখ ফাইজার ও ৫৫ লাখ মডার্নার টিকা। জাপান দিয়েছে ৩০ লাখেরও বেশি অ্যাস্ট্রাজেনেকা, চীন দিয়েছে ৩৪ লাখ সিনোফার্ম ভ্যাকসিন।

বাংলাদেশ এখন বেশিরভাগ টিকা সিনোফার্ম থেকে কিনে স্থানীয়ভাবে প্যাকেটজাত করার প্রস্তাব দিয়েছে।

টিকাদান কার্যক্রমটাকে সহজ করেছে সুরক্ষা অ্যাপ, যা নিবন্ধনের পাশাপাশি টিকার সনদও দিচ্ছে।

সৌদি আরব ও কুয়েতগামী প্রবাসীদের জন্য ফাইজার ও মডার্নার টিকা দিয়ে অযাচিত কোয়ারেন্টিনের খরচ কমাতে সরকার যে কৌশল নিয়েছে সেটাও কিন্তু প্রশংসার দাবি রাখে। স্কুল খোলার এই সময়টাতে ১২-১৮ বছর বয়সীদের ফাইজার ও মডার্নার টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। এখন পর্যন্ত মোট জনগোষ্ঠীর ১২ শতাংশ টিকার আওতায় এসেছে। ১৮ শতাংশ পেয়েছে এক ডোজ করে টিকা।

পরিস্থিতির উন্নয়নে আরও যা ভূমিকা রেখেছে

  • সরকারের ‘নো মাস্ক নো সার্ভিস’ নীতি ও প্রতিটি ফোন কলে মাস্কের ব্যবহার নিয়ে নিরবচ্ছিন্ন প্রচার।
  • গত চার দশকে গড়ে ওঠা ইপিআই প্রোগ্রাম, যা কিনা কোভিড-১৯ টিকা কার্যক্রমের ভিত গড়ে দিয়েছিল। আগস্ট ও সেপ্টেম্বরের ছয় দিনের গণটিকা কার্যক্রমে মোট ৫০ লাখ মানুষ পরিপূর্ণভাবে ভ্যাকসিনের আওতায় এসেছিল।
  • জনসংখ্যা সমঘনত্ব ও সমজাতীয়তার কারণে যোগাযোগটা হয়েছিল সহজ। আবার বিভিন্ন সম্প্রদায় ও ধর্মীয় নেতারাও সচেতনতা ছড়াতে অংশ নিয়েছিলেন।
  • ২০২০ সালে রেকর্ড পরিমাণ ১৯ দশমিক ৮ বিলিয়ন ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল। একই বছর জিডিপির প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৫ শতাংশ।
  • একটি গবেষণায় স্বাস্থ্যসেবা বিশেষজ্ঞদের দাবির পক্ষে জোরালো প্রমাণ মিলেছে যে, ৬০-৭০ শতাংশ মানুষের শরীরে হয়তো ইতোমধ্যে কোভিড-১৯ অ্যান্ডিবডি তৈরি হয়েছে।
  • যুব সমাজের একটি বড় অংশও এখানে বড় ভূমিকা রেখেছে বলা যায়। জাতির গঠনে এই যুব সমাজের উৎপাদনমুখী ব্যবহার গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিতে পারে।
  • ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে নিরাপত্তা বেষ্টনীতে রাখতে পারা।

আর্থসামাজিক প্রভাব

অনেক সূচকের মধ্যে কোনোটিতে কাঙ্ক্ষিত অর্জন আসতে দশকেরও বেশি সময় লাগলেও মহামারিতে এগুলো বেশ বড় ধাক্কা খেয়েছিল-

  • ২০২১ সালে বাংলাদেশে ‘নতুন দরিদ্র’ হয়েছে ২ কোটি ৪৫ লাখ।
  • নারীদের মধ্যে বেকারত্বের উচ্চহার চলমান আছে। গত বছরেই চাকরি হারিয়েছিল প্রায় ১০ লাখ গার্মেন্ট কর্মী।
  • ৫৩টি জেলার ৬৫ হাজার নারী ও শিশুর ওপর গবেষণা করে দেখা গেছে, এদের ৩০ শতাংশই মহামারিকালে প্রথমবারের মতো পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে।
  • স্কুল বন্ধ হওয়া, বেকারত্ব ও দরিদ্রদের ঋণের বোঝা বেড়ে যাওয়ার কারণে বাল্যবিয়ে বেড়েছে কয়েকগুণ।
  • তালিকাভুক্ত প্রায় আট হাজার যৌনকর্মী হয়েছে আশ্রয়হীন।
  • ১৮ মাস স্কুল বন্ধ থাকায় শিক্ষায় ক্ষতি হয়েছে অনেক। এ সময়ে বন্ধ হয়ে গেছে প্রায় ১৫ হাজার বেসরকারি কিন্ডার গার্টেন স্কুল।
  • অভিভাবকের আয় কমে যাওয়ার কারণে ৪০ শতাংশ শিশু অপুষ্টির শিকার হয়েছে।
  • আগের চেয়ে কম হলেও এখনও কোভিড সম্পর্কিত মানসিক অবসাদ কেটে যায়নি।

আমাদের বিজয়, এরপর কী?

এ যুদ্ধে আমাদের বড় জয়টা হলো কোভিডে আমরা যাদেরই হারিয়েছি, আমাদের স্বেচ্ছাসেবী মানবিক সংস্থাগুলোর সুবাদে প্রত্যেকেই সম্মানজনক একটি শেষকৃত্য পেয়েছেন। আমাদের কোনও গণকবর খুঁড়তে হয়নি। এছাড়া, সরকারি, বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও উন্নয়ন সংস্থাগুলো একজোট হয়ে খাদ্য নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক কার্যক্রম চলমান রেখে বেকারত্ব দূর করা, শিল্পগুলোকে বাঁচিয়ে রেখে জিডিপি ধরে রাখা এবং সংক্রমণের চেইন ভেঙে ভারতের মতো ভয়ানক পরিস্থিতির হাত থেকে বাঁচিয়েছে দেশকে। যখন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে এসব উপাত্ত দেখানোর সুযোগ আমি পেয়েছিলাম তখন বিশেষজ্ঞ মডারেটররা কিন্তু বাংলাদেশের এসব সংখ্যাতত্ত্বের প্রতি মনোযোগী ছিলেন। তারা এও বুঝতে পেরেছিলেন যে ইসরায়েল বা যুক্তরাষ্ট্রের মতো মহামারিতে লাগাম দেওয়ার নেপথ্যে টিকার ভূমিকা ছিল না। এটা সম্ভব হয়েছিল আমাদের সুযোগ্য নেতৃত্বের কারণে, কৌশলের কারণে। এ পরিস্থিতি থেকে নিজেদের আরও শক্তিশালীরূপে বেরিয়ে আসতে আমরা ছিলাম দৃঢ় প্রত্যয়ী। তাই আশা করি, এসব তথ্য-উপাত্ত নিজেদের সক্ষমতার ওপর আমাদের আত্মবিশ্বাস আরও জোরালো করবে। আর হ্যাঁ, এখনও মাস্ক পরতে ভুল করবেন না।

লেখক: অর্গানিকেয়ার-এর প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী পরিচালক। এমবিবিএস, এমবিএ ও হেলথ কেয়ার লিডারশিপ-এ স্নাতকোত্তর।

 

/এফএ/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জবি শিক্ষার্থী মীমের অভিযোগের বিষয়ে যা বললেন ডিবি হারুন
জবি শিক্ষার্থী মীমের অভিযোগের বিষয়ে যা বললেন ডিবি হারুন
মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির ব্যাপারে যা বললেন আ.লীগ সাধারণ সম্পাদক
মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির ব্যাপারে যা বললেন আ.লীগ সাধারণ সম্পাদক
গানের শহরে খালিদ খালিদ কান্না...
গানের শহরে খালিদ খালিদ কান্না...
হলমার্ক দুর্নীতি মামলা: কারাদণ্ডের আদেশ শুনে পালিয়ে গেলেন আসামি
হলমার্ক দুর্নীতি মামলা: কারাদণ্ডের আদেশ শুনে পালিয়ে গেলেন আসামি
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ