X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

আবাসিক যখন বাণিজ্যিক!

সালেক উদ্দিন
২৯ এপ্রিল ২০১৬, ২০:১৯আপডেট : ২৯ এপ্রিল ২০১৬, ২০:১৯

সালেক উদ্দিন ঢাকা শহরে আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ব্যাপকভাবে বিস্তার লাভ করেছে এবং আবাসিক এলাকাকে বসবাসের অনুপযোগী করে তুলেছে। বিশেষ করে ঢাকার আভিজাত এলাকা ধানমণ্ডি , গুলশান, বনানী বিশেষত্ব হারিয়েছে। ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকা আর আবাসিক নেই। হয়ে গেছে স্কুলপাড়া। গুলশান যেন আরেক মতিঝিল অর্থাৎ অফিসপাড়া। আর বনানী হয়ে গেছে রেস্টুরেন্ট পাড়া। রাতের বনানীকে অনেকটা নেপালের রাতের ধূমধাড়াক্কা কাঠমান্ডুর সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে।
বলা যেতে পারে, ধানমণ্ডি-গুলশান-বনানীতে আবাসিক এলাকার রমণীয় নির্জনতা হারিয়ে গেছে কালের অতল গহ্বরে। পরিণত হয়েছে কোলাহলপূর্ণ বাণিজ্যিক রুক্ষতায়। এছাড়া পুরো ঢাকার বাণিজ্যিক পরিবেশই গিলে খেয়েছে এর আবাসিক এলাকাগুলোকে। ধানমণ্ডি সংলগ্ন লালমাটিয়া-মোহাম্মদপুরও এ প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে নেই।
লালমাটিয়া ভরপুর স্কুল, কলেজ, কোচিং সেন্টার আর ক্লিনিকে। মোহাম্মদপুরের অবস্থা আরও খারাপ। স্কুল, কলেজ, ক্লিনিক ছাড়াও দোকান, বাস স্ট্যান্ড, বাজার, মাদ্রাসা আর কোচিং সেন্টারের ভারে কুঁজো হয়ে গেছে মোহাম্মদপুর। স্কুল শুরু আর ছুটির সময় এসব এলাকায় যানজট এমনভাবে লেগে যায় যে হেঁটে যাওয়া ছাড়া আর কোনও উপায় থাকে না। মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডে গড়ে উঠেছে নতুন আবাসিক এলাকা জাপান গার্ডেন সিটি। এই আবাসিক এলাকার মধ্যেই একটি ভবনে রয়েছে ডেভলপারদের সেলস অফিস। এ ছাড়া ক্যাম্পাসেই তারা তৈরি করেছে একটি বাণিজ্যিক ভবন ‘টোকিও স্কয়ার মার্কেট’। এর চারপাশে অলিগলিতে স্থান নিয়েছে, হোটেল, চাইনিজ রেস্টুরেন্ট, সুপার শপ, শো-রুম, বাস স্ট্যান্ড, টেম্পু স্ট্যান্ড, রিকশা স্ট্যান্ড, স্কুল, কোচিং সেন্টার ইত্যাদি।
এখানেই শেষ নয়, আবাসিক এলাকার চরিত্র হননের জন্য এখানে পুরোদমে চলছে নতুন নতুন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান নির্মাণের কাজ। সব মিলিয়ে বসবাসের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে মোহাম্মদপুর এলাকা । রাজধানী ঢাকার এই সব এলাকার যে সব বাড়ি বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে তার প্রায় সবই আবাসিক শ্রেণির। আবার কিছু কিছু আবাসিক শ্রেণির হওয়া সত্ত্বেও গ্যাস –বিদ্যুৎ ও পানির সংযোগ নেওয়া হয়েছে বাণিজ্যিক শ্রেণির। প্রতিটি এলাকাতেই বহু সংখ্যক আবাসিক হিসেবে বরাদ্দ পাওয়া প্লটে গড়ে তোলা ভবন বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। তার মধ্যে রয়েছে- কোচিং সেন্টার- স্কুল –কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়। রয়েছে বাজার- হাসপাতাল। আছে হোটেল-রেস্টুরেন্ট।
যে কোনও আবাসিক এলাকা বাণিজ্যিকভাবে ব্যাপক ব্যবহারের কারণে তার আবাসিক চরিত্র হারায়। রাস্তায় সৃষ্টি হয় দুর্বিষহ যানজট। বাসস্থানে সংকট দেখা দেয় পানি- গ্যাস- বিদ্যুতের। সব মিলিয়ে অতিষ্ঠ হয়ে পড়ে জনজীবন। এই ভয়াবহ অবস্থায় ঢাকাকে রক্ষার জন্য আবাসিক এলাকা থেকে সব ধরনের বাণিজ্যিক, শিক্ষা ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নেওয়ার জন্যে সরকারি আদেশ দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী রাজউক ও সিটি করপোরেশন বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় অভিযান চালিয়ে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোর গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার কাজ চালাচ্ছিল। পরে এই কার্যক্রম ছয় মাসের জন্য বন্ধ রাখা হয় এবং এরই মধ্যে রাজধানীর আবাসিক এলাকা থেকে বাণিজ্যিক, শিক্ষা ও সেবামূলক প্রতিষ্ঠান সরিয়ে নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়। এই ছয় মাস ৪ এপ্রিল ২০১৬ থেকে গণনা করা হচ্ছে। সে অনুযায়ী আগামী ৩ অক্টোবর এই মেয়াদ শেষ হয়ে যাবে।
তারপরও কেউ যদি আবাসিক এলাকা থেকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সরিয়ে না নেয় তা হলে সরকার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। একটি জাতীয় দৈনিকের বর্ণনা থেকে যতটা তথ্য পেলাম তা হলো- এখন পর্যন্ত এ ধরনের ছয় হাজার বাড়ি চিহ্নিত করে সরকারি নোটিশ পাঠানো হয়েছে এবং আরও বাড়ি চিহ্নিত করার কাজ চলছে।

শুধু তাই নয়, মন্ত্রিসভা আবাসিক এলাকার নিম্নোক্ত দিক নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছেঃ ১. আবাসিক এলাকার বাড়ির বেসমেন্ট গাড়ি রাখা ছাড়া অন্য কোনও কাজে ব্যবহার করা যাবে না।
২. আবাসিক এলাকার সব পানশালার লাইসেন্স বাতিল করা হবে। এ এলাকায় কোনও অতিথিশালা কিংবা রেস্তোরাঁ থাকবে না।
৩. আবাসিক এলাকায় বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান চালানোর জন্য সিটি করপরেশন যে লাইসেন্স দিয়েছে, সেগুলো তারা বাতিল করবে । এসব প্রতিষ্ঠান থেকে সরকার যে মূসক নিচ্ছিল, তা আর নেয়া হবে না ।

আবাসিক এলাকা থেকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সরানো সময়ের দাবি এবং সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত। তারপরও কেউ কেউ বলতেই পারেন অথবা বলছেনও, আবাসিক এলাকায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, হাসপাতাল, বাজার, রেস্তোরাঁ তো এলাকার মানুষদের প্রয়োজনেই গড়ে উঠেছে । এগুলো তুলে দিলে এলাকাবাসী চলবে কী করে ? তাছাড়া এগুলোই বা যাবে কোথায়? হ্যাঁ, আবাসিক এলাকার মানুষের জন্যে এগুলোর প্রয়োজন রয়েছে ঠিকই। তবে সেটা বসবাসকারীর বাড়ির নাকের ডগায় নয়। এর জন্য নির্দিষ্ট জায়গা থাকা উচিৎ।
এ ব্যাপারে সরকারের চিন্তাভাবনা অতি পরিষ্কার – যারা এসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছে এগুলো সরিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব তাদেরই নিতে হবে । তাছাড়া এলাকাবাসীর এই সমস্যা বিবেচনা করে সরকার প্রতি এলাকারই কিছু কিছু রাস্তা বাণিজ্যিক এলাকা হিসাবে নির্ধারণ করে দিয়েছে । যেমন, ধানমণ্ডির ক্ষেত্রে ২৭ নম্বর ও ২ নম্বর সড়ক, সাতমসজিদ রোড ও মিরপুর রোড বাণিজ্যিক হিসাবে স্বীকৃত।

আগেই বলেছি, আবাসিক এলাকা থেকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সরানো সময়ের দাবি এবং সরকারের সঠিক সিদ্ধান্ত । প্রশ্ন হচ্ছে এটা কতটা বাস্তবায়িত হবে?

প্রশ্নটি মনে আসার যথেষ্ট কারণও রয়েছে। এর আগে ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত অস্বাস্থ্যকর ট্যানারি ঢাকার অদূরে সাভারে স্থানান্তরের বিষয়টিও ছিল সময়ের দাবি এবং এই দাবির পক্ষে সরকারি সিদ্ধান্ত সর্ব মহলে প্রশংসিত হয়েছিল। বার বার নির্দেশের পরও মালিকরা ট্যানারি সাভারে স্থানান্তর না করায় সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী মহোদয় ট্যানারি স্থানান্তরের জন্য নির্ধারিত সময় বেঁধে আল্টিমেটাম দিয়ে দিলেন । বেঁধে দেওয়া সময় পার হওয়ার পরও ট্যানারির মালিকরা ট্যানারি স্থানান্তর করলেন না। মাননীয় মন্ত্রী মহোদয়ও চুপ মেরে গেলেন। এখন আর এ ব্যাপারে তিনি কিছু বলেন না। আশা করছি, আবাসিক এলাকা থেকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সরানোর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের বিষয়টি সে রকম হবে না ।

এ প্রসঙ্গে যে কথাটি না বললেই নয় তা হলো- রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে যে কোনও সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে সরকার নিশ্চয়ই বহুবার ভেবে দেখে যে সিদ্ধান্তটি সঠিক কিনা, জনগণের কল্যাণের জন্য কিনা। সঠিকতার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পরই সরকারি সিদ্ধান্ত আসে। জনগণের কল্যাণের জন্য গৃহীত সেই সিদ্ধান্ত সরকার যখন বাস্তবায়ন করতে পারে তখনই জনসাধারণ সরকারের প্রতি আস্থাশীল হয় এবং সরকারের জনপ্রিয়তা বহুলাংশে বেড়ে যায় । ঠিক একই ভাবে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে সরকার যখন ব্যর্থ হয়, তখন জনসাধারণ আর সরকারকে ক্ষমা করে না ।

আবাসিক এলাকা থেকে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান সরানোর বিষয়ে সরকার যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, আমরা মনে করছি সিদ্ধান্তটি সঠিক এবং আর সব আশাবাদী মানুষদের মতোই আশা করছি, সিদ্ধান্তটি যথাসময়ে বাস্তবায়িত হবে ট্যানারি স্থানান্তরের জন্য নির্ধারিত সময় বেঁধে ল্টিমেটামের মতো হবে না ।

লেখক: কথাসাহিত্যিক ও কলামিস্ট

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
রাজশাহীতে তীব্র গরমে মরছে মুরগি, আতঙ্কে খামারিরা
রাজশাহীতে তীব্র গরমে মরছে মুরগি, আতঙ্কে খামারিরা
বাকি না দেওয়ায় দোকানিকে ছুরিকাঘাতে হত্যার অভিযোগ
বাকি না দেওয়ায় দোকানিকে ছুরিকাঘাতে হত্যার অভিযোগ
যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চার কর্মকর্তা নিহত
যুক্তরাষ্ট্রে বন্দুক হামলায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চার কর্মকর্তা নিহত
ঢাকা কর কমিশনারের কার্যালয়ে চাকরির সুযোগ
ঢাকা কর কমিশনারের কার্যালয়ে চাকরির সুযোগ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ