X
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪
২৩ বৈশাখ ১৪৩১

নিরানন্দময় শিক্ষা ব্যবস্থায় আনন্দময় ফল!

রাশেদা রওনক খান
১২ মে ২০১৬, ১৯:১৬আপডেট : ১২ মে ২০১৬, ১৯:৩২

রাশেদা রওনক খান টেলিভিশনে এসএসসি পরীক্ষার ফল প্রকাশের খবর দেখছিলাম। শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বসিত-আনন্দিত হৈ-চৈ বলে দিচ্ছে, আজ তাদের জীবনের একটি বহুল কাঙ্ক্ষিত একটি দিন! মনে মনে ভাবি, আহা! প্রতিদিন যদি বাচ্চাগুলো এমন এক হাজার ভাগের একভাগ খুশি মনে দিন কাটাত! আমাদের শিক্ষাব্যবস্থায় অভিভাবক-শিক্ষকরা এই আনন্দময় দিনটির আশায় আশায় সারাবছর কোমলমতি এই বাচ্চাদের ওপর চালান এক ধরনের মানসিক নির্যাতন। একটি শিশু যখন প্রথম স্কুলে ভর্তি হয়, সেদিন হতেই এই নির্যাতন শুরু হয়।
অনেক কৃতজ্ঞতা জানাই প্রধানমন্ত্রীকে। তিনি অন্তত এই কোমলমতি শিশুদের ভর্তি যুদ্ধ হতে বাঁচিয়ে দিয়েছেন। নয়তো এই মানসিক নিপীড়ন শুরু হতো সেই হাঁটিহাঁটি পা-পা হতেই! শুধু মানসিক নিপীড়নই নয়, ব্যাগ ভর্তি বইয়ের চাপে নুয়ে যাওয়া এই বাচ্চাদের এক ধরনের শারীরিক নিপীড়নের মধ্য দিয়েও যেতে হচ্ছে দিনকে দিন!
নিপীড়ন এখানেই শেষ নয়, বরং শুরু! আজকাল অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানই টর্চার সেল হয়ে উঠেছে। একটি পত্রিকার প্রথম পাতায় 'মধ্যযুগীয়' একটি শিরোনামে সেদিন চোখ আটকে গেল। কী ভয়ঙ্কর সে ছবি, দেখলেই গা শিহরে ওঠে! লোহার শিকলে বাঁধা একটি বাচ্চা; যার আরেক প্রান্তে ১ কেজি ওজনের কাঠ। মাদ্রাসা থেকে বাধ্যতামূলক পাঠ মুখস্ত করার প্রতি অনিচ্ছা পোষণকারী এই আবুজারকে কেন তার বাবা বাধ্য করলেন এই নির্মম চাপের মধ্যে তীব্র যন্ত্রণা সহ্য করতে, তা আমার জানা নেই। প্রায় একই ঘটনা ঘটেছে শিশু আরিফুর রহমান শুভ্রর সঙ্গে। বাবা-মাকে দেখার আকুতি নিয়ে শিক্ষকের কাছে গিয়েছিল ১২ বছরের শুভ। তাকে তো ছুটি দেওয়া হয়ইনি, বরং লুকিয়ে বাড়ি যাওয়ার চেষ্টার 'অপরাধে',  শিক্ষক আশরাফুল ইসলাম তাকে ধরে নিয়ে ক্রিকেটের ব্যাট-স্টাম্প দিয়ে পিটিয়ে ক্ষতবিক্ষত করেন। শুভ এখনও ফেনী সদর হাসপাতালের বিছানায় যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে।

আরও পড়তে পারেন: ‘রহস্যজনক’ নিখোঁজের মামলার তদন্তেও রহস্য!
যদিও প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর থেকে ৬ বছর আগে একটি নির্দেশনা পাঠানো সত্ত্বেও দেশের ৫০ শতাংশ স্কুলে শিক্ষার্থীদের ওপর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন অব্যাহত রয়েছে। ২০১১ সালে হাইকোর্টের রায়ে এই ধরনের শাস্তি দেওয়াকে আইন ও সংবিধানবিরোধী বলা হলেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি।
কিছুদিন আগেও এই এসএসসি পরীক্ষা চলার সময় শিক্ষক নাসিমা আক্তারের নির্যাতনের শিকার হয়ে মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে কিশোরগঞ্জ গার্লস হাইস্কুলের এক ছাত্রী। আরেক শিক্ষকের পিটুনিতে আহত হয়ে প্রায় এক সপ্তাহ হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে হয়েছে ফরিদপুরের মধুখালী বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র আরাফাত অথিকে।
উদয়ন স্কুল এর অষ্টম শ্রেণির নাদিমকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করেছেন শিক্ষক জাওশেদ আলম কিছুদিন আগে। বিদ্যালয়টির অধ্যক্ষ দাবি করছেন, নাদিম ওই শিক্ষককে 'সিএনজি' বলে সম্বোধন করেছিল! শিক্ষক জাওশেদ আলমের কীর্তি এবং অধ্যক্ষের বক্তব্য শুনলে মনে হয়, তারা জীবনে শৈশব-কৈশোর পার করে আসেননি! কী আশ্চর্য! আমরা তো প্রত্যেকেই ছোটবেলায় এই ধরনের কত নাম ব্যবহার করেছি শিক্ষকদের নিয়ে। শৈশব-কৈশোরেই যদি এ ধরনের দুষ্টুমী না করে, তবে তাদের কাছে আমার প্রশ্ন, বয়সকালে 'বুড়িয়ে যাওয়া মানুষ' এই ধরনের দুষ্টুমি করবে? শুধু শিক্ষকই নয়, ৪০ শতাংশ অভিভাবকেরও এমন ধারণা যে, 'মার না দিলে বাচ্চা মানুষ হবে না!' এই 'মানুষ' হওয়ার বিষয়টি আসলে কী? এই 'মানুষ' হওয়ার প্রক্রিয়া কি কেবল স্কুলের মুখস্ত বিদ্যা নির্ভর পড়ালেখা শেখা? এই মুখস্তবিদ্যা সর্বস্ব শৈশব-কৈশোর আমাদের  আসলে কতটা 'মানুষ' করতে পারছে বা পারবে?

আরও পড়তে পারেন: রাজশাহীর 'পীর' হত্যা: প্রতিবাদের শ্রেণিচরিত্র

শিক্ষকদের এই পাশবিক আচরণ দেখে ডা. লুৎফুর রহমানের সেই কথাটি খুব মনে পড়ছে—‘কেবল বহুসংখ্যক লোককে অক্ষরজ্ঞান বিশিষ্ট করলেই তাদের মানুষ করা হলো না। মানুষের মাঝে পাশবিক স্বভাব আছে এবং ঐশ্বরিক গুণও আছে। শিক্ষকের কাজ তার ঐশ্বরিক গুণকে ফুটিয়ে তোলার  মধ্য দিয়ে এই লেজ-শিংবিহীন পশুকে মানুষ করা।’  আমার তো সন্দেহ হচ্ছে, এ সব ক্ষেত্রে কে কাকে এই পাশবিক মনোবৃত্তি দমন করতে শিক্ষা দেবে! শিক্ষক নিজেই যিনি শেখেননি কিভাবে পাশবিক স্বভাব দমন করতে হয়, তিনি  কী করে শিক্ষা দেবেন তার ছাত্রকে? 

এভাবে পেটানোর পেছনে কারণ দেখানো হয়েছে, তারা পড়ালেখায় মনযোগী নয়, দুষ্ট ও বেয়াড়া। এই বয়সের একটু 'দুষ্টমি', 'বেয়াড়াপনা', 'পাগলামোপনা'কে এতটা 'অমানবিক' ও 'পাশবিক'ভাবে নিয়ন্ত্রণ করলে তাদের শৈশব-কৈশোরের 'স্বাভাবিকতা'কেই তো নষ্ট করে দেওয়া হয়। তাহলে তাদের কাছ থেকে আর 'স্বাভাবিক' আচরণ আমরা আশা করব কিভাবে? 

স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার বৈচিত্র্যময় বাল্যকাল থাকা সত্ত্বেও মুখস্ত বিদ্যার ভয়ানক সংস্কৃতিকে ব্যঙ্গ করতে ছাড়েননি! সন্ধ্যাবেলায় মুখস্ত করার সংস্কৃতি সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘তখনও ইংরেজি শব্দের বানান আর মানে মুখস্ত’র বুক-ধড়াস সন্ধ্যাবেলা ঘাড়ে চেপে বসেনি’।

শিশুকাল থেকেই বিচিত্র সব অভিজ্ঞতার মধ্যদিয়ে বড় হয়েছেন রবীন্দ্রনাথ, তাইতো  নিজের জীবন সাহিত্যে এগিয়ে যেতে পেরেছেন সৃষ্টির সত্যতায়। তারপরও মনের গহীনে একটা দুঃখবোধ হতে শৈশবের 'নিরানন্দময়' পাঠ্য কার্যক্রমকে 'আনন্দময়' করার কথা বলতেন। তিনি বলতে এজন্য যে, ‘আমাদের শিক্ষার সহিত আনন্দ নাই। কেবল যাহা কিছু নিতান্ত আবশ্যক, তাহাই কণ্ঠস্থ করিতেছি। তেমন করিয়া কোনওমতে কাজ চলে মাত্র, কিন্তু মনের বিকাশ হয় না।’ শৈশব যদি বৈচিত্র্যময়ই না হয়, যদি কেবল পড়া আর পড়া নিয়েই থাকে, তাহলে এই 'একঘেয়ে', 'নিরানন্দময়' জীবনে কোনও বৈচিত্র্যই থাকল না এবং এই 'একঘেয়ে' জীবন তো মানুষের নয়, বরং 'রোবট' এর হতে পারে! শুধু পুথিগত বিদ্যা নয়, জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত থেকে যে অভিজ্ঞতা, তাই বরং জীবনের সবচেয়ে বড় অর্জন!

পাশ্চাত্যে গিয়ে বুঝলাম, বঙ্গদেশের মতো  শৈশব হতে তাদের পাঠ্য কার্যক্রম অত 'নিরানন্দময়' নয়, বরং খুবই 'আনন্দময়', যার স্বপ্ন দেখতেন রবীন্দ্রনাথ। তবে এটাও ঠিক পাশ্চাত্যের শৈশবকালীন লেখাপড়া যতটা সহজ-সুন্দর, ততটাই কঠিন এবং গড়ল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা! একে তো কঠিন পাঠ্য কার্যক্রম, তার মাঝে নিজের আয় করা অর্থে পড়ালেখার খরচ জোগানো -দুটা  মিলে যার পর নেই কষ্ট শিক্ষার্থীদের। ফলে অনেক শিক্ষার্থীই কলেজ না পেরুতেই শিক্ষা গ্রহণের পাঠ চুকিয়ে চাকরি জীবনে প্রবেশ করে। আমাদের সমাজের মতো 'কাজ' এর 'ধরন-ধারণ' নিয়ে যেহেতু ওদের 'নাক উঁচু' ভাব নেই, তাই যেকোনও চাকরি/কাজ তারা করতে দ্বিধা করে না। পড়ালেখা ভালো না লাগলেও করতেই হবে, কিংবা গিলতে হবে, এই প্রবণতা  তাদের মাঝে  আমাদের চেয়ে তুলনামূলকভাবে কম। যদি আমরা বিশ্ব-বিখ্যাত মানুষজনের জীবনী পড়ি, তাহলে সহজেই এর প্রমাণ মেলে। 
স্টিভ জবস-এর কথা বলি, যাকে পারসোনাল কম্পিউটার বিপ্লবের পথিকৃৎ বলা হয়, তিনি কলেজ ছেড়ে দিয়েছিলেন। যেই ফেসবুক নিয়ে এখন আমাদের দিনের গুরুত্বপূর্ণ সময় কেটে যায়, সেই ফেসবুক স্রষ্টা মার্ক জুকারবার্গও ছেড়েছিলেন হার্ভার্ড-এর পড়া-শোনা! টুইটার-এর কো-ফাউন্ডার ইভান উইলিয়ামস, ভার্জিন গ্রুপের ফাউন্ডার রিচার্ড ব্রানসনও ছিলেন স্কুল পালানোর দলে। 

শেষ করব হার্ভাড ছেড়ে চলে আসা বিল গেটস-এর কথা দিয়ে। তার দুটি কথা যদি অভিভাবকরা একটু মনে রাখতেন, হয়তো সন্তানদের ওপর গাদা গাদা বই পড়া আর স্কুল-কোচিংয়ের পরীক্ষায় ভালো ফল করার জন্য চাপ কম দিতেন। গেটস একবার বলেছিলেন, ‘আমি পরীক্ষার বেশ কয়েকটি বিষয়ে ফেল করি, এবং আমার বন্ধু সবগুলোতেই পাস করে ভালো ফল নিয়ে শিক্ষাজীবন সফলভাবে শেষ করেছে, যা আমি করিনি। এখন আমার সেই বন্ধু মাইক্রোসফটে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরি করে। আমি এই মাইক্রোসফট-এর  মালিক। 

এবার পরীক্ষায় যাদের ফল খুব ভালো হয়েছে, যাদের হয়নি—উভয়কেই অনেক অনেক অভিনন্দন! মনে রাখতে হবে যে, এই ফলই জীবনের চূড়ান্ত কোনও সাফল্য নয়, আরও অনেক দূর যেতে হবে, জীবনে কেবল একাডেমিক ফলই সাফল্যের মাপকাঠি নয়, বরং মানবিকতা বোধসম্পন্ন মানুষ হওয়াই হোক আমাদের  শিক্ষা ব্যবস্থার প্রধানতম লক্ষ্য। 

লেখক: শিক্ষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মিল্টনের আশ্রমের দায়িত্ব পেলো শামসুল হক ফাউন্ডেশন
মিল্টনের আশ্রমের দায়িত্ব পেলো শামসুল হক ফাউন্ডেশন
চাসিভ ইয়ার ঘিরে হাজার হাজার সেনা জড়ো করছে রাশিয়া
চাসিভ ইয়ার ঘিরে হাজার হাজার সেনা জড়ো করছে রাশিয়া
ওপারের গোলার বিকট শব্দে কেঁপে উঠছে টেকনাফ
ওপারের গোলার বিকট শব্দে কেঁপে উঠছে টেকনাফ
নিজ বুদ্ধিমত্তায় যেভাবে অপহরণকারীদের কাছ থেকে পালিয়ে এলো স্কুলছাত্র
নিজ বুদ্ধিমত্তায় যেভাবে অপহরণকারীদের কাছ থেকে পালিয়ে এলো স্কুলছাত্র
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ