X
বুধবার, ০১ মে ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

ব্রেক্সিট: অবাক হওয়ার কী আছে!

আনিস আলমগীর
২৮ জুন ২০১৬, ১৬:০০আপডেট : ২৮ জুন ২০১৬, ১৬:০৫

Anis Alamgir২৩ জুনের গণভোটে ব্রিটেনের ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনেককে দেখছি স্তম্ভিত। অনেকে ব্রিটেনের এই সিদ্ধান্তকে কটাক্ষ করছেন। এমনকি মার্কিন মিডিয়া ‘হাবা’ খেতাবটি মার্কিনিদের পরিবর্তে এখন ব্রিটিশদের অধিকারে চলে গেছে বলে মন্তব্য করেছে। ঘটনা যে এমন হবে তাতে আশ্চর্য হওয়ার মতো কিছু ছিল কি? যারা আশ্চর্য হচ্ছেন তারা বোধ হয় ব্রিটেনের বিগত সাধারণ নির্বাচনটি খেয়াল করেননি। খেয়াল করেননি, ইউরোপে অবস্থান হলেও মূলভূখণ্ডের সঙ্গে ব্রিটেনের বিরোধের ঐতিহাসিক বিষয়টি।
২০১৫ সালের সাধারণ নির্বাচনে জেতার পর ক্যামেরন-এর পক্ষে ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকা না থাকার প্রশ্নে গণভোটের আয়োজন করা ভিন্ন অন্য কোনও পথ খোলা ছিল না। ২০১৫ সালের নির্বাচনে কনজারভেটিভ দল নির্বাচনে জিতবে আর ক্যামেরন পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হবেন সে রকম কোনও অবস্থা ছিল বলে অনেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মনে করতেন না। কিন্তু ক্যামেরন নির্বাচনি প্রচারে এই বিষয়টি পরিষ্কার করেছিলেন যে তিনি যদি পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হন তবে তিনি গণ-ভোটের আয়োজন করে ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকা না থাকার বিষয়ে পরিষ্কার সিদ্ধান্ত নেবেন। অনেকে বলে থাকেন ক্যামেরন- এর এই প্রচারণাই তাকে ব্রিটেনের গত সাধারণ নির্বাচনে বিজয়ী হতে সাহায্য করেছিল।
এবারের গণভোটে লেবার পার্টির ৯০% এমপি ইউরোপীয় ইউনিয়নে থাকার ব্যাপারে প্রচারণা চালিয়েছিল। তাদের একজন এমপি প্রচারণা চালানোর সময় বিরুদ্ধবাদীদের হতে ছুরিকাহত হয়ে নিহত হয়েছেন। ইউনিয়নে থাকার প্রশ্নে লেবার পার্টিতে ব্যাপক কোনও দ্বিমত ছিল না, তবে ভোটের পরে ক্যামেরন-এর মতো পার্টি প্রধান জেরেমি করবিন পদত্যাগ করুক এমন চাপ আসছে দলের অভ্যন্তর থেকে। মিডিয়ার খবর হচ্ছে, তার ওপর চাপ বাড়াতে লেবার পার্টির শ্যাডো ক্যাবিনেটের অর্ধেক নেতা পদত্যাগ করতে পারেন। জেরেমি করবিন দলের নেতা হিলারি বেনকে বরখাস্ত করেছেন। সব কিছু মিলিয়ে লেবার পার্টির নেতা জেরেমি করবিন অনাস্থা ভোটের মুখোমুখি হতে চলেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

লেবার অনেকটা ঐক্যবদ্ধ থাকলেও ব্রেক্সিট ভোটের প্রচারণার সময় দেখা গেছে যে কনজারভেটিভ পার্টিতে কোনও ঐক্যমত্য ছিল না। এমন কী ক্যামেরনের মন্ত্রিসভার মাঝেও দ্বিধাবিভক্তি ছিল। অনেক শক্তিশালী মন্ত্রী ও নেতা ক্যামেরনের বিরুদ্ধে ইউরোপীয় ইউনিয়নে না থাকার পক্ষে শক্তিশালী প্রচারণা চালিয়েছেন।

এতো গেল অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। ঐতিহাসিক বিষয় হচ্ছে-- ব্রিটেন ইউরোপ মহাদেশের রাষ্ট্র হলেও মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন একটা দ্বীপ রাষ্ট্র। ইউরোপ মূলভূখণ্ডের প্রতি ব্রিটেনের কোনও আকর্ষণ কখনও ছিল না। মূলভূখণ্ডে ফ্রান্স ও রাশিয়া উপনিবেশ স্থাপন করলেও ব্রিটেন কখনও কোনও উপনিবেশ স্থাপন করেনি। মূল ভূখণ্ডের রাষ্ট্রগুলোও তাদেরকে ‘ফিশারম্যান অব ইউরোপ’ বলে বিদ্রুপ করতো। কিন্তু ইউরোপের আধুনিক সভ্যতার গোড়াপত্তন হয়েছিল ব্রিটেনের হাতে। শিল্প বিপ্লবও ব্রিটেনের সন্তান। চতুর্থদশ শতাব্দী থেকে নৌশক্তিতে ব্রিটেন দুনিয়ার সেরা নৌশক্তি ছিল।

ফ্রান্স কখনও ব্রিটেনের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রেখে চলার চেষ্টা করেনি। নেপোলিয়নের সময় ব্রিটেনের গতিরোধ করে দাঁড়াবার জন্য ফ্রান্স ব্রিটেনের বিরুদ্ধে মহাদেশীয় অবরোধ পর্যন্ত প্রতিষ্ঠা করেছিল। তখন ইউরোপের মূল ভূখণ্ডের সব রাষ্ট্রই ব্রিটেনের বিরুদ্ধে নেপোলিয়ানকে সাহায্য করেছিল। মূলভূখণ্ডের সঙ্গে তাই ব্রিটেনের বিরোধ এক ঐতিহাসিক বিষয়। ফ্রান্সের নোপালিয়ান ওয়াটার লুর যুদ্ধে ব্রিটেনের হাতে পরাজিত হয়ে সেন্ট হেলানায় বন্দী জীবন-যাপনের সময় মারা গিয়েছিলেন। নেপেলিয়ানকে নাকি ব্রিটেন খাদ্যে ফরমালিন বিষ-মিশিয়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছিলেন। ব্রিটেনের মানুষ এসব কিছুই বিস্মত হননি। নিজেদের গৌরবময় ইতিহাস সংরক্ষণে ব্রিটেনের লোক খুবই যত্নবান।

ইউরোপিয়ান ইকোনমিক কমিউনিটি ১৯৯৩ সালে মাসট্রিখট চুক্তির সম্পাদনের মধ্য দিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন গঠন করে। পূর্বে ইউরোপিয়ান ইকোনমিক কমিউনিটি শুধু অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতো। ১৯৯৩ সালে ইকোনমিক কমিউনিটি যখন ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে তখন তার কর্মকাণ্ডের পরিধিও ব্যাপক হয়। অনেক বিষয় ইউনিয়নের হাতে চলে যায়। ইউনিয়ন মুদ্রা ব্যবস্থা চালু করে পার্লামেন্ট প্রতিষ্ঠা করে এবং অভিন্ন বাণিজ্য আইন ও কার্যকর করেছিল। এ বিষয় গণভোটের মাধ্যমে ব্রিটেনের মানুষের কোনও সম্মতি কখনও নেওয়া হয়নি। ব্রিটেনের লোক তাদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ব্রিটেনের বাইরে কোথাও সমর্পণ করে তার অধীনে চলতে অভ্যস্ত নয়।

সুতরাং ধরে নেওয়া যায় যে ব্রিটেনের মানুষ এ ব্যবস্থার অধীনে স্বস্তিতে ছিল না। গণভোটের ফলাফলে তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। উত্তর আয়্যারল্যান্ডে হোক, স্কটল্যান্ডের হোক, ওয়েলসের হোক বা ব্রিটেনের হোক- কোনও বয়স্ক লোকই ইউনিয়নে থাকার পক্ষে ছিল না। তুলনামূলকভাবে যুবকেরাই থাকার পক্ষে ছিল। ব্রিটেনের মানুষ সবচেয়ে বেশি বিরক্তিবোধ করেছে অভিবাসন নিয়ে। মূলভূখণ্ড থেকে যেসব অভিবাসী আসছে তাদের সঙ্গে ব্রিটেনের মানুষের মানসিকতা কোনওভাবেই খাপ-খাচ্ছিল না। অথচ অভিবাসী হিসাবে পাকিস্তান, ভারত, বাংলাদেশ থেকে আসা অভিবাসীদের সঙ্গে তাদের কোনও বিরোধ নেই। দিনে দিনে অভিবাসীর আগমন বেড়ে যাওয়ায় ব্রিটেনে চাকরি, সরকারি পরিসেবার ওপর চাপ সৃষ্টি হয়েছিল, সে কারণে মানুষের মনে ক্ষোভেরও সৃষ্টি হয়েছিল।

অনেক বিশ্লেষক বলেছেন- অভিবাসনের কারণে সৃষ্ট বিরক্তিকর পরিস্থিতির চাপে ব্রিটেনবাসী ইউনিয়ন ত্যাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। অনেকে বলেছেন ক্যামেরন, প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জন মেজর, টনি ব্লেয়ার যে বার বার বলেছেন ইউনিয়ন পরিত্যাগ করলে ব্রিটেনের পুনরায় মন্দার সম্মুখীন হবে, ব্যবসায় মন্দা দেখা দেবে, ব্রিটেন দেউনিয়া হয়ে যাবে ইত্যাদি-- তারা এতো বেশি-বেশি বলেছেন যে ভোটারদের মাঝে তার বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়েছে। প্রধান প্রধান ব্যক্তিদের মুখ দিয়ে এসব ভীতিকর ভাষার কথা বলা ভোটারেরা মোটেই পছন্দ করেননি। শেষ পর্যন্ত ভোটারেরা সব পরিণতি কবুল করে নিয়ে ইউনিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পক্ষেই ভোট দিলেন।

ইউনিয়ন ছাড়ার পক্ষে নেতৃত্ব দিয়েছেন সাবেক  লন্ডন শহরের মেয়র রবিস জনসন, বিচারমন্ত্রী মাইকেল গোভ, চ্যান্সেলর জর্জ অসবনও, স্টিফেন ক্র্যাব, তেরাসা মে প্রমুখ। ইউনিয়ন ছেড়ে আসার পরে জাতিকে সুন্দরভাবে নেতৃত্ব প্রদানের জন্য তারা এখন সলা-পরামর্শ আরম্ভ করে দিয়েছেন এবং সংঘবদ্ধ হচ্ছেন। তারা দৃঢ়ভাবে বলছেন যে আপাতত যে দুর্যোগ আসবে তা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। এখনও পর্যন্ত তারা অটুট মনোভাব দেখাচ্ছেন। ক্যামরন পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন। কিন্তু বলেছেন আগামী অক্টোবর মাসে কনজারভেটিভ দলের জাতীয় কনভেনশনে যিনি নেতা নির্বাচিত হন তিনি তার কাছে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেবেন।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিশ্বের বৃহৎ একটা অর্থনীতির জোট। এটা ক্ষতিগ্রস্ত হলে প্রত্যেক দেশের অর্থনীতিই কম-বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হতো। এখন যতটুকু বোঝা যায় ব্রিটেনের ইউনিয়ন ত্যাগের ফলে ইউনিয়নের অর্থনীতি আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ব্যাপক কোনও ধ্বসের সম্মুখীন হবে না। তুরস্ক ইউনিয়নের সদস্য হওয়ার জন্য বহুদিন থেকে চেষ্টা করে আসছে। ব্রিটেনের ইউনিয়ন ত্যাগের কারণে হয়তো তুরস্কের সদস্য পদ পাওয়ার বিষয়টা ত্বরান্বিত হবে।

অনেক বিশ্লেষক বলছেন, যুক্তরাজ্য ভেঙে যাবে। স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়াল্যান্ডও এবার যুক্তরাজ্য থেকে বের হয়ে যাবে। স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়্যারল্যান্ড কখনও যুক্তরাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল না। ব্রিটেনের রাজা তার রাজ্যের সীমানা বড়ানোর জন্য স্কটল্যান্ডকে জোর করে ব্রিটেনের অন্তর্ভুক্ত করে ছিলেন। ব্রিটেনের রাজা একই উদ্যোগ নিয়ে ছিলেন আয়ারল্যান্ড- এর ব্যাপারেও। দীর্ঘ সাত শত বছর ব্রিটেনের সঙ্গে যুদ্ধ করেছিল আয়ারল্যান্ড-এর মানুষ। আইরিশ রিভোলিউশনারি আর্মি কখনও ব্রিটেনের কাছে মাথানত করেনি কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা উত্তর আয়ারল্যান্ডকে তাদের সঙ্গে ব্রিটেনের কবলমুক্ত করতে পারেনি। উত্তর আয়ারল্যান্ডের ছয় কাউন্টির মাঝে লন্ডনডেরি সহ বহু কাউন্টিতে ইংল্যান্ডের লোক এসে বসতি করায় মিশ্র জনগোষ্ঠী সৃষ্টি হয়েছে।

ব্রিটেন বহু কলোনিকে স্বাধীনতা দিয়ে মুক্ত করে দিয়েছে। ভারত, আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া সবইতো তার কলোনি ছিল। শেষ পর্যন্ত যদি স্কটল্যান্ড ও আয়ারল্যান্ডকেও ছাড়তে হয় তবে ব্রিটেন দ্বিধা করবে বলে মনে হয় না। ২০১৪ সালে স্কটল্যান্ডে একবার গণভোট হয়েছে তারা ব্রিটেনের সঙ্গে থাকবে না স্বাধীন হয়ে যাবে। কিন্তু ব্রিটেনের সঙ্গে থাকার পক্ষে ভোট বেশি হওয়ায় ২০১৪ সালে তারা স্বাধীন হতে পারেনি। এখন তারা পুনরায় গণভোটের দাবি তুলেছে। কোনও এক সময় হয়তো গণভোট হবে। গণভোটে জিতলে স্কটল্যান্ড নিশ্চয়ই তাদের স্বাধীনতা পাবে। স্কটল্যান্ডে যারা স্বাধীনতা চাচ্ছেন তারা বলেছেন তারা স্বাধীন হলেও রানী অভিন্ন থাকবেন।তিন/চার শত বছর সহ-অবস্থানের পর বিচ্ছিন্ন হওয়াও কঠিন ব্যাপার। স্কটল্যান্ড ও উত্তর আয়ারল্যান্ড বিচ্ছিন্ন হলে ইংল্যান্ড ও ওয়েলস পুর্বাবস্থায় ফিরে যাবে।

ওসমানিয়া খেলাফতের মূল ভূখণ্ড হচ্ছে তুরস্ক। তুরস্ক তার সব কলোনি হারিয়ে তার আদি ভূখণ্ডে নিজ অস্তিত্ব বজায় রেখেছে। ইংল্যান্ডেরও একই অবস্থা হবে। এতে ইংরেজ জাতির অনুতপ্ত হওয়ারতো কিছুই থাকবে না। মনে হয় তারা অনুতপ্তও হবে না। অধিপত্যের দিন শেষ এখন, যে যার জায়গায় থাকবে। পৃথককে বলপূর্বক এক করলে তারাই একদিন বলপূর্বক বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ইংরেজ জাতির অভিজ্ঞতার ভাণ্ডারে তার বহু নজির রয়েছে। সুতরাং অভিজ্ঞতায় ঝানু এ পুরানো কলোনিয়াল পাওয়ার কখনও আর ভুল করবে না। ব্রেক্সিট ফলাফল বিলুপ্ত হওয়া থেকে রক্ষা করেছে ইংরেজ জাতিকে।

লেখক: সাংবাদিক ও শিক্ষক

[email protected]

আরও পড়তে পারেন: ব্রেক্সিটের পর ইইউ নেতাদের মুখোমুখি হচ্ছেন ক্যামেরন

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ঢাকা সাব এডিটরস কাউন্সিলের সভাপতি অনিক, সম্পাদক জাওহার
ঢাকা সাব এডিটরস কাউন্সিলের সভাপতি অনিক, সম্পাদক জাওহার
মুম্বাইকে হারিয়ে পয়েন্ট টেবিলের তিনে লখনউ
মুম্বাইকে হারিয়ে পয়েন্ট টেবিলের তিনে লখনউ
তপ্ত রোদেও থামে না তাদের কাজ
আজ মহান মে দিবসতপ্ত রোদেও থামে না তাদের কাজ
মদ ছেড়ে বললেন, ‘মাইলফলক’
মদ ছেড়ে বললেন, ‘মাইলফলক’
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ