X
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪
২৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাঙালি মুসলমানের সংখ্যাগুরুত্ব নিয়ে বাড়াবাড়ি

মাসুদা ভাট্টি
৩১ অক্টোবর ২০১৬, ১২:০৫আপডেট : ৩১ অক্টোবর ২০১৬, ১২:১৯

মাসুদা ভাট্টি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গতরাতে যা কিছু ঘটেছে তা এদেশে নতুন কোনও ঘটনা নয়, বরং বিস্মৃতপ্রায় অতীত থেকে এরকম ঘটনা আমাদের চলমান বর্তমান। কাল যখন বাংলাদেশের ক্রিকেট দল ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে টেস্ট ম্যাচে ঐতিহাসিক বিজয় অর্জন করেছে, সোশ্যাল মিডিয়া ভরে গেছে ব্যক্তির উচ্ছ্বাসে, ঠিক তখনই ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় নাসিরনগরে একের পর হিন্দু মন্দির ভাঙা হচ্ছে, লুটপাট চলেছে সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে। কারণটা কী? কারণটা হলো, এক হিন্দু যুবকের ফেসবুক পাতায় একটি ছবি আপলোড করা হয়েছে, যেখানে হিন্দুদের দেবতা শিবকে কাবা ঘরের ওপর বসানো হয়েছে। কিছুক্ষণের ভেতরেই সেই ছেলেটি তারই পাতায় পোস্ট দিয়ে বলেছে যে, এরকম কোনও ছবি সে আপলোড করেনি বা তার সেরকম সাহসও নেই।
এলাকার সংখ্যাগুরু মুসলিম জনগোষ্ঠীর কাছে করজোড়ে ক্ষমা চেয়ে সে বলেছে যে, কেউ শত্রুতাবশত এলাকায় দাঙ্গা সৃষ্টির জন্য তার ফেসবুক পাতায় এরকম একটি ছবি প্রকাশ করেছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা? একটি ছবি প্রকাশিত হওয়ায় এলাকার মুসলিম জনগোষ্ঠীর ধর্ম এমন আঘাত পেয়েছে যে তারাতো আর বসে থাকতে পারে না, তাই না? তারাও রামদা, ছুরি, চাপাতি, মুগুর যা কিছু হাতের কাছে পেয়েছে তাই নিয়েই নেমে গেছে ‘হিন্দু শিকারে’। আগেই বলেছি বাংলাদেশে এ দৃশ্য নতুন কিছু নয়, অতি পুরোনো ও কোটি কোটি বার ঘটে যাওয়া ঘটনার একটি মাত্র। তাই হয়তো এ নিয়ে দেশের প্রথম সারির দৈনিক পত্রিকাগুলো কোনও বিস্তারিত রিপোর্টও করেনি। ক্রিকেট-এর বিজয় নিয়ে প্রথম পাতাতো বটেই ভেতরেও পাতা-দেড়েক জায়গা খরচ করা হয়েছে, কিন্তু কাল রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হিন্দু জনগোষ্ঠীর যে ভয়াবহ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে তা নিয়ে একটি অক্ষরও লেখার সুযোগ হয়নি আমাদের। এর কারণ হয়তো যে, এটাইতো ঘটার কথা ছিল বা এটাই স্বাভাবিক ঘটনা, এর আবার রিপোর্ট করার প্রয়োজন আছে নাকি?
সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম উন্মুক্ত হওয়ার আগে এদেশে হিন্দু নির্যাতন ও নিগ্রহ ঘটতো কোনও কারণ ছাড়াই, কিন্তু এই যোগাযোগ মাধ্যম উন্মুক্ত হওয়ার ফলে হিন্দুদের ওপর আক্রমণ করার জন্য প্রতিনিয়তই কিছু ছবি কিংবা বক্তব্য আপলোড করলেই চলে। তাতেই জিহাদি জোশ চলে আসে সংখ্যাগুরু মুসলমান সম্প্রদায়ের ভেতর। তারা ধর্মের নামে তখন নারায়ে তাকবির বলে ঝাঁপিয়ে পড়ে হিন্দুদের ওপর। এতে সব দিয়েই আক্রমণকারীর লাভ। প্রথমত- তার ধর্মের কারণেই পরকালে  সে অনন্ত শান্তিতে বসবাস করার সুযোগ লাভ করবে। দ্বিতীয়ত- আক্রান্ত হিন্দুবাড়িটি থেকে যদি একটি লোটাও লুট করে আনা যায় তাহলে সেটিও অত্যন্ত কাজের কাজ হবে ইহজগতের জন্য। আর এরকম আঘাত পেতে পেতে যদি এলাকা থেকে হিন্দুরা চিরতরেই উধাও হয়ে যায় (যেমনটি গোটা বাংলাদেশ থেকেই উধাও হয়ে গেছে বা ক্রমশ যাচ্ছে) তাহলে সর্বশেষ তার জমিজমা বা বাড়িটিও যদি দখলে এসে যায় তাহলেতো আর কথাই নেই, আগামী কয়েক পুরুষ বসে বসে খাওয়া যাবে।

বাঙালি মুসলমানের মধ্যে এই প্রকারের চিন্তা সবসময় ঘুরপাক খায় এবং সে কারণেই নির্বাচন হলেও হিন্দুরা মার খায়, নির্বাচন না হলেও হিন্দুরা আক্রান্ত হয়; বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় এলেও হিন্দুদের রক্ষা নেই, আওয়ামী লীগ ক্ষমতা পেলেও হিন্দুরা বাঁচতে পারে না। দেশের সুশীল সমাজ রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে যতটা সোচ্চার, যতটা তাদের বন রক্ষায় আহাযারি ঠিক ততটা দেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের রক্ষায় গা নেই। কেনই বা হবে? এদের রক্ষায়তো আর ফান্ড পাওয়া যাবে না, তাই না? কিংবা কে জানে, গত চল্লিশ বছরে এদেশের সংখ্যাগুরু মুসলমানের মন ও আচরণে যে বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে তা থেকে হয়তো এই সুশীলকূলও মুক্ত নয়, তাই তারাও হয়তো মনে করে যে, এদেশ থেকে হিন্দুরা শেষ হলেই ভালো, ছেলেমেয়ে নিয়ে জমিজমা দখল করে বেশ আয়েশ করেই বেঁচে থাকা যাবে!

লক্ষ্য করে দেখবেন, কাল রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। গত শতকের শুরু থেকেই (এর আগে উপমহাদেশে মুসলিম-আগমন কাহিনী আলোচনায় না আনাটাই সঙ্গত) বিশেষ করে এদেশে মুসলিম লীগ গঠিত হওয়ার পর থেকে হিন্দুদের আক্রান্ত হওয়াটা এক ধরনের নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথম দিকে দু’পক্ষ দাঙ্গায় অংশ নিলেও ক্রমশ বাংলাদেশে হিন্দুরা শক্তি হারাতে শুরু করে, সংখ্যাগুরুর দাপটতো আছেই সেই সঙ্গে রাষ্ট্র যখন নির্দিষ্ট কোনও ধর্মবিশ্বাসের পাশে ঢাল হয়ে দাঁড়িয়ে সংখ্যালঘুকে আশ্রয়হীন করে তোলে তখন সে রাষ্ট্রের নিয়তির সঙ্গে সঙ্গে সংখ্যালঘুও বাস্তুচ্যুত হতে শুরু করে। বাংলাদেশে যেটি হয়েছে।

মুসলিম লীগ বাংলাদেশ থেকে রাজনৈতিক দল হিসেবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ঠিকই কিন্তু তাদের মনস্তত্ব, আচার-আচরণ ও রাজনীতিকে এদেশে অত্যন্ত সুচতুর ভাবে ছড়িয়ে রেখে যেতে সক্ষম হয়েছে। শক্তি দিয়ে ‘পরিচয়’ (আইডেনটিটি) নির্ধারণের এই প্রক্রিয়াটি প্রাচীন এবং সভ্যতা একে বিষবৎ ত্যাগ করেছে ঠিকই কিন্তু এই উপমহাদেশে এই শক্তি দিয়ে নিজেদের অস্তিত্বকে জানান দেওয়ার রীতিটি এখনও রূঢ় বাস্তবতা, যার অভিঘাত প্রতিনিয়ত আমাদের প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে, যেমন গতরাতে হয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। প্রশ্ন তোলা যেতে পারে যে, গত কয়েকদিন ধরেই ঘোষণা দেওয়া হচ্ছিলো এলাকায় যে, শুক্রবার জুম্মার নামাজের পরে হিন্দু এলাকায় আক্রমণ করা হবে, কারণ এক হিন্দু যুবক কাবা শরীফের অবমাননা করেছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই এই হুমকি দেওয়া হচ্ছিলো, প্রশাসন বিষয়টি আমলে যে আনেনি তাতো কালকের ঘটনাই প্রমাণ করে। যদিও হামলার ঘটনা শুক্রবার ঘটেনি, ঘটেছে রবিবার। এদেশে যখন সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুক বন্ধ করে দেওয়ার কথা বলা হয় তখন আমরাই তার প্রতিবাদ করি কারণ তাতে আমাদের বাক স্বাধীনতা ক্ষুণ্ন হয়। কিন্তু সদ্য-অতীতে যখন সাঈদীকে চাঁদে পাঠিয়ে দেশব্যাপী তাণ্ডব সৃষ্টি করা হয়েছিল কিংবা তারপর রামুকাণ্ডসহ আরও যে সব ঘটনা ফেসবুকে উত্তেজনা ছড়িয়ে ঘটানো হয়েছে তার দায় ও দায়িত্ব কি আমরা প্রতিবাদকারীরা কেউ নিয়েছি বা নেই? না নেই না। তার দায়-দায়িত্ব ও ভুক্তভোগী হলো কেবলমাত্র আক্রান্ত ব্যক্তি, তার বাইরে আক্রমণকারীরা এদেশে বীরের জাতি, গাজী কিংবা জিহাদি। এ প্রশ্ন কি করার সময় আসেনি যে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারেও আসলে প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে যেমন প্রস্তুতির প্রয়োজন রয়েছে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ক্ষেত্রেও? এর কোনোটিতেই স্বেচ্ছাচারিতা বা শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে নিজেদের ‘আইডেনটিটি’ জাহিরের কোনও সুযোগ সভ্যতা দেয় না?

জানি অনেকেই এই বক্তব্যে আহত হবেন, বিশেষ করে গণতন্ত্র, ফেসবুক ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন তোলায়। কিন্তু কেউ কি একবারও ভেবেছি যে, আমরা এসবের বিবেকবান-ব্যবহারের যোগ্য কি না? এদেশে হিন্দু নির্যাতনের ঘটনা যেমন ঐতিহাসিক তেমনই উগ্র জাতীয়তাবাদী চিন্তা-চেতনাও আমাদের মজ্জাগত। আমরা এর থেকে কেউই মুক্ত নই। আমরা ধর্ম দিয়ে জাতীয়তা নির্ধারণ করে এখন এমনভাবে বগল বাজাতে শুরু করেছি যে, এদেশে আর কোনও ধর্মের মানুষকে আমরা মানুষই মনে করছি না। কিন্তু যে মুহূর্তে আমরা এদেশের বাইরে পা রাখছি, আরেকটি সংখ্যাগুরু রাষ্ট্রে গিয়ে সংখ্যালঘু হয়ে পড়ছি তখনই আমরা খানিকটা হলেও বুঝতে পারছি যে, সংখ্যালঘু হওয়ার যন্ত্রণা কত। কিন্তু সেও বিদেশেই কেবল, দেশে ফিরেই আমরা আবার হয়ে যাচ্ছি অত্যন্ত শক্তিশালী সংখ্যাগুরু, ক্ষেত্র বিশেষে বিদেশে আমরা মানিয়ে-মেনে চললেও এদেশে এসে কিন্তু ঠিকই পাশের বাড়ির হিন্দুদের ধর্মাচরণ নিয়ে প্রশ্ন তুলছি, আজানের সময় পুজা করা যাবে না, উলু দেওয়া যাবে না ইত্যাদি সব নির্দেশনা জারি করছি বা এসব নির্দেশনা মেনে নিয়ে নিজের মতো করে জীবনযাপন করছি। এই যেমন কালকে ক্রিকেট দলের বিজয়কে আমরা উদযাপন করছি জাতীয়ভাবে ঠিকই কিন্তু আমাদের ভেতর ক’জন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হিন্দু নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে চিন্তা করছি? হ্যাঁ, কেউ যে একেবারেই করছেন না তা নয়, ফেসবুকের পাতাতেই দেখছি অনেকে গতকালকের ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন, ক্রিকেট জয়ের আনন্দ এতে সম্পূর্ণ ম্লান হয়ে গিয়েছে বলে মানছেন, কিন্তু তারা যে নিজেরাই সংখ্যালঘু এই সত্যতো আমরা অস্বীকার করতে পারছি না কেউই, পারছি কি? সবচেয়ে বড় কথা হলো, এইসব ভয়ঙ্কর ঘটনাবলীতে রাষ্ট্রকে কেন আমরা কোথাও দেখতে পাই না, সে প্রশ্ন সম্মিলিত ভাবেই আমরা তুলতে ব্যর্থ হচ্ছি। রাষ্ট্র চরিত্রও এদেশে সংখ্যাগুরুর মতোই উগ্র ও একচোখা, রাষ্ট্রও ধর্মীয় সংখ্যালঘুকে ‘সংখ্যালঘু’ হিসেবেই দেখে এবং সুযোগ পেলেই এদেশের সংখ্যাগুরুর মুসলমানের মতো মারমুখী হয়ে ওঠে সংখ্যালঘুর ওপর।

বহুবার বলেছি যে, পাকিস্তান থেকে এই ধর্মীয় উগ্রবাদ সংক্রান্ত শিক্ষা আমাদের গ্রহণ করা উচিত, একটি দেশ কিভাবে ধর্মের কারণে, ধর্মের দ্বারা এবং ধর্মীয়ভাবে ধ্বংস হয়ে যায়, পাকিস্তান তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ। কিন্তু কে শোনে কার কথা? পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে এসে আবার পাকিস্তানে প্রত্যাবর্তনই এদেশের নিয়তি, সেকথা আর নতুন করে প্রমাণ করার কিছুই নেই। আগেই বলেছি, মুসলিম লীগ নামে ধ্বংস হয়েছে ঠিক কিন্তু এর চেয়ে বাস্তব ও জ্যান্ত রাজনীতি এদেশে আর কোনও রাজনৈতিক দলই করে না, এ নিয়ে আর বেশি কিছু বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।

লেখক: কলামিস্ট

আরও খবর: ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ১০ মন্দিরে হামলা, আহত শতাধিক, বিজিবি মোতায়েন

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
নারায়ণগঞ্জে চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলার অভিযোগ, আহত ৩
নারায়ণগঞ্জে চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলার অভিযোগ, আহত ৩
সুন্দরবনে আগুন ছড়ানো রুখতে দেওয়া হয়েছে বেরিকেট
সুন্দরবনে আগুন ছড়ানো রুখতে দেওয়া হয়েছে বেরিকেট
এই ৬ বীজ নিয়মিত খেলে সুস্থ থাকতে পারবেন দীর্ঘদিন
এই ৬ বীজ নিয়মিত খেলে সুস্থ থাকতে পারবেন দীর্ঘদিন
লখনউকে বড় হারের লজ্জা দিয়ে শীর্ষে কলকাতা
লখনউকে বড় হারের লজ্জা দিয়ে শীর্ষে কলকাতা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ