X
মঙ্গলবার, ০৭ মে ২০২৪
২৪ বৈশাখ ১৪৩১

উত্তরের ভোটের হাওয়া কি লাগবে ঢাকায়

মোস্তফা হোসেইন
৩০ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৩:০৭আপডেট : ৩০ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৭:২৮

মোস্তফা হোসেইন গত ৪ ডিসেম্বর ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মেয়র পদ শূন্য ঘোষণা করা হয়েছে। পরবর্তী ৯০ দিনের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হবে মেয়র পদে উপ-নির্বাচন। এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে ঢাকা উত্তরের ১৮টি ও দক্ষিণের ১৮টি ওয়ার্ডের সাধারণ নির্বাচনও। ঢাকা উত্তরের সাবেক মেয়র আনিসুল হককে যুক্ত হওয়া ১৮ ওয়ার্ডবাসী ভোট দেওয়ার সুযোগ পায়নি। উপ-নির্বাচন হলে নতুন মেয়রকে তাই আনিসুল হকের চেয়ে ১৮ ওয়ার্ডের বেশি ভোটারের ভোটসহ নির্বাচনি বৈতরণী পাড়ি দিতে হবে।
ইতোমধ্যে রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচন অনুষ্ঠানকে অনেকেই ডিএনসিসি নির্বাচনের প্রাক্কালে ওয়ার্মআপ হিসেবে গণ্য করতে শুরু করেছে। ভোটারদের মধ্যে মোটামুটি উৎসাহ তৈরি হচ্ছে, ভোটপ্রিয় মানুষ বলে। একইসঙ্গে মানুষের মধ্যে সন্দেহও দেখা দিতে শুরু করেছে, আদৌ কি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচন বর্তমান সরকার আমলে অনুষ্ঠিত হবে?
দুটি বড় দলের দৌড়ঝাঁপ শুরু হয়েছে এটা দেখার পরও কেবল মনে হচ্ছে, কোথায় যেন একটা দেওয়াল তৈরি হচ্ছে। সময়মতো সেই দেওয়ালটা দৃশ্যমান হবে। এটা অনুমান নির্ভর হলেও অনুমানের পেছনে কারণও কিছু থাকে। সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া যাক।

১৯৯৪ সালে সিটি করপোরেশন নির্বাচন চালু হয়। প্রথমবার মেয়র নির্বাচনে সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হন আওয়ামী লীগের মোহাম্মদ হানিফ। ১৯৯৯ সালে মেয়র হানিফের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা। দ্বিতীয়বার নির্বাচন হওয়ার কথা সিটি করপোরেশন মেয়র পদে। সীমান্ত সংক্রান্ত জটিলতা দেখা দিলো নির্বাচনের প্রাক্কালে। সুতরাং নির্বাচনের জন্য ঢাকা সিটি করপোরেশনকে অপেক্ষা করতে হলো আরও কয়েকবছর। যতদূর মনে আসে সীমানা সংক্রান্ত মামলাটি হয়েছিল নির্বাচন ঘনিয়ে আসার পর। সমীকরণটা অন্যদিকে চলে গেলো। নির্বাচন যখন বাধ্যবাদকতায় পরিণত হয়েছে, নির্বাচন অনুষ্ঠান যখন প্রায় নিশ্চিত, সেই অবস্থায় মামলার সুবাদে নির্বাচন হলো না।
এরপর নির্বাচন হয় ২০০২ সালে। জাতীয়তাবাদী দল তখন ক্ষমতায়। সাদেক হোসেন খোকা সিটি করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হলেন। ২০০৭ সালে মেয়রের মেয়াদ শেষ। স্বাভাবিক কারণেই নির্বাচন হওয়ার কথা। কিন্তু নির্বাচন হলো না। প্রথম কারণ দেশে অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি। দ্বিতীয়ত, আগের মতোই মামলা, মোকাদ্দমা। হাইকোর্টে মামলা ঝুলছিল আরও একটি। ফলে নির্বাচন আর হলো না। তারপরও বেশ কিছু সময় চলে যায় নির্বাচন ছাড়া। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচন মাধ্যমে ক্ষমতায় আসে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। ২০১১ সালের ৩০ নভেম্বর গঠিত হয় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন। আর নতুন আইন অনুযায়ী সিটি করপোরেশনে প্রশাসক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় সরকারি কর্মকর্তাকে। ২০১২ সালের ২৪ মে সিটি করপোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পরও নির্বাচন হলো না। সেই আগের মতোই ঘটনা। আদালতের নির্দেশনা। সর্বশেষ ২০১৫ সালে দু’টি সিটি করপোরেশনে অনুষ্ঠিত হয় সাধারণ নির্বাচন। ৪ লাখ ৮০ হাজার ভোট পেয়ে ঢাকা উত্তরের মেয়র নির্বাচিত হলেন আনিসুল হক। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী হলেন বিএনপি’র তাবিথ আউয়াল। আর তিনি পেলেন ৩ লাখ ২৫ হাজার ভোট।
ঢাকা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের সঙ্গে মামলা যেন ছায়ার মতো লেপ্টে আছে। হয়তো ভাবতে পারেন, এর সঙ্গে আগামী নির্বাচনের কী সম্পর্ক? এমনটা বলব না–আগের ধারাবাহিকতা হিসেবেই মামলা হবে?
হিসাবটা অন্যখানে। ঢাকা সিটি করপোরেশন আগের চেয়ে বড় হয়েছে। উত্তর ও দক্ষিণে যুক্ত হয়েছে ১৮টি করে ওয়ার্ড। ফলে ঢাকা উত্তরের ওয়ার্ড সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৭২টিতে। উপ-নির্বাচনের মেয়রকে এই ৭২টি ওয়ার্ডের ভোটারদের কাছে যেতে হবে। স্থানীয় সরকার আইনের ৩৪ অনুচ্ছেদে নির্বাচন কখন অনুষ্ঠিত হবে, তা বলা আছে। কিন্তু সিটি করপোরেশনের সঙ্গে নতুন করে ওয়ার্ড যুক্ত হলে সেই ওয়ার্ডের নির্বাচনের বিষয় কিছু বলা নেই। সুতরাং নতুন যুক্ত হওয়া ওয়ার্ডগুলো থেকে নির্বাচিত কাউন্সিলরদের অবস্থা কী হবে, তা স্পষ্ট নয়। তারা তো নতুন করে নির্বাচিত হবেন। সেই কাউন্সিলররা আড়াই বছর মেয়াদের জন্য হবেন কোন যুক্তিতে? অন্যদিকে আড়াই বছর পর যখন সিটি করপোরেশনের আবার নির্বাচন হবে, তখন ওই ওয়ার্ডগুলোর ভোটাররা কি মেয়র নির্বাচনে ভোট দিতে পারবেন না? এমন নানা প্রশ্ন আসতেই পারে।

হয়তো স্থানীয় সরকার ( সিটি করপোরেশন) আইনের ৫-এর ৩ উপধারা বলে নির্বাচন হয়ে যেতে পারে। এই উপনির্বাচনে যদি ১৮টি ওয়ার্ডকে বাদ দিয়েও অনুষ্ঠিত হয় তাতেও মেয়র পদে নির্বাচন অবৈধ হবে না। কারণ ৭৫ ভাগ ওয়ার্ডে নির্বাচন হয়ে যাবে। কিংবা অন্য কোনও আইন বলেও হয়তো নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব হতে পারে। সুতরাং অনেকেই মনে করতে পারেন, নির্বাচন অনুষ্ঠানে কোনও বাধা নেই। কিংবা অনুষ্ঠান হবেই।

কিন্তু রাজনৈতিক কিছু সমীকরণ বলে উল্টোকথা। এক্ষেত্রে রংপুরকে ‘টেস্ট-কেইস’ হিসেবে আনা যায়। রংপুর সিটি করপোরেশনের নির্বাচনকে অনেকেই হয়তো মিলাতে চাইবেন না। তারপরও নির্বাচনি হিসাব নিকাষের ক্ষেত্রে তাকে বাদও দেওয়া যাবে না। বিএনপি’র বিষয় দিয়ে শুরু করা যাক। বিএনপি’র প্রার্থী রংপুরে আগের চেয়ে অনেক ভোট বেশি পেয়েছেন। তিনি এবার পেয়েছেন ৩৫ হাজার ১৩৫ ভোট। আগের নির্বাচনে বিএনপির প্রার্থী কাওসার জাহান পেয়েছিলেন ২১ হাজারের কিছু বেশি ভোট। সেই হিসাবে তিনি ১৪ হাজার ভোট বেশি পেয়েছেন। এটাকে কি বিএনপি’র অগ্রগতি বলা যাবে? যতদূর মনে আসে আগেরবার বিএনপির প্রার্থী নির্বাচনকালে একসময় নির্বাচন বর্জন করেছিলেন। তার মানে, নির্বাচন বর্জন না করলে তিনি আরও ভোট পেতেন। অন্যদিকে রংপুরে ১৫ হাজার ‘অবাঙালি’ ভোট রয়েছে। নতুন মাত্রায় জামায়াতের ভোট যুক্ত হয়েছে তাদের কৌশলগত কারণে। সেখানেও ৪০ হাজার ভোট বলে আগেই দাবি করা হয়েছে। আর জামায়াতের ওপর নির্ভরশীলতার বিষয়টি বিএনপি নেতা জয়নুল আবেদীন ফারুক রংপুরে প্রকাশও করে ফেলেছেন প্রকারান্তরে। এই বাড়তি ভোট থেকে বাড়তি প্রাপ্তি কিন্তু বিএনপি’র ক্ষেত্রে ঘটেনি। সুতরাং কিছুটা চিন্তায় তো ঢাকার বিএনপিকে পড়তেই হবে। অন্তত যেভাবে নেগেটিভ ভোটের রমরমা চিন্তা করা হচ্ছে বিএনপির ক্ষেত্রে সেটা হচ্ছে না। অর্থাৎ ভোটাররা এখন হিসাবনিকাশ করতে শুরু করেছে।
অন্যদিকে ঢাকার হিসাব করতে গিয়ে তারা আনিসুল হকের আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার সঙ্গে যুক্ত করছে আওয়ামী লীগের নিজস্ব ভোট। সেক্ষেত্রে আতিকুল ইসলাম যদি আওয়ামী লীগের প্রার্থী হন কিংবা তার মতো কোনও ক্লিন প্রার্থী যদি উত্তরে ভোট প্রত্যাশী হয় তাহলে মোকাবিলা করার অবস্থাটা কেমন তাদের।

বিএনপি’র সম্ভাব্য প্রার্থী হিসেবে যার নাম শোনা যাচ্ছে, পানামা কেলেঙ্কারির সূত্রে তার নামে আগেই মিডিয়ায় এসেছে। সেক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতার খেলাটা কেমন হবে, তা নিশ্চয়ই ভাবিয়ে দেয় তাদের। তাদেরই ভাবনায় আসতে পারে, গত নির্বাচনের মতো শাসক দল যদি তাদের ভাষায় কারচুপি কিংবা অবৈধ পথে বিজয়ের পথ বেছে নেয়, তা প্রতিহত করার ক্ষমতাও তাদের নেই। এই পরিস্থিতিতে আসন্ন সাধারণ নির্বাচনে কী প্রভাব ফেলবে, তাও ভাবতে হচ্ছে। সুতরাং এমনটা বলার সুযোগ নেই, বিএনপি একান্তভাবেই নির্বাচনকে স্বাগত জানাচ্ছে।

এবার আসা যাক আওয়ামী লীগের ক্ষেত্রে। রংপুরে আওয়ামী লীগের প্রার্থী শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছেন। তিনি আগের চেয়ে অর্ধেক ভোট পেয়েছেন। বলা হচ্ছে, ওই প্রার্থীর জনবিচ্ছিন্নতা ও এলাকার কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন না হওয়ায় এই পরাজয়। এই যুক্তি কি জনপ্রিয়তা হ্রাসের জন্য যথেষ্ট? এককভাবে প্রার্থীর অযোগ্যতাই কি তাকে পরাজিত করেছে? তারা নিশ্চয়ই অবগত আছে, ভোটারদের কাছে তাদের আগের মতো গ্রহণযোগ্যতা নেই। সুতরাং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়ে তারা কি জাতীয় নির্বাচনকে ঝুঁকিতে ফেলতে চাইবে?

এটাতো অত্যন্ত স্বাভাবিক, রাজধানীর নির্বাচন জাতীয় নির্বাচনে অবশ্যই কিছু হলেও প্রভাব ফেলবে। সেই ঝুঁকি কি আওয়ামী লীগ নেবে?

যদি দু’টি বড় দলই দ্বিধায় থাকে, তাহলে নির্বাচন চাইবে না, এটাই স্বাভাবিক। তারা কেউ নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা দেওয়ার মতো বোকামো করবে না এটাও স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে অস্ত্র হিসেবে আসতে পারে মামলা। যা আমরা ইতোপূর্বে দেখেছি। তবে দল দু’টির একটিও নির্বাচন নিয়ে যে মামলায় যাবে না, সেটাও ঠিক। যেকোনও নাগরিকই এই মামলার বাদি হতে পারবেন? আর কিভাবে সেটা হবে, তাও অনুমান করলেই বোঝা যায়। সুতরাং আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নির্বাচনি প্রস্তুতি নিচ্ছে, এমন সংবাদ রটার পরও সন্দেহ থেকেই যায়– উত্তরের ভোটের হাওয়া লাগবে তো ঢাকায়?

লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।

/এসএএস/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
এ বছর পুলিৎজার পেলো ৩ সংবাদমাধ্যম
এ বছর পুলিৎজার পেলো ৩ সংবাদমাধ্যম
মনজিল হত্যা: সৎমা-ভাইসহ ৬ জনের যুক্তিতর্ক অব্যাহত
মনজিল হত্যা: সৎমা-ভাইসহ ৬ জনের যুক্তিতর্ক অব্যাহত
আসছে ব্যয় কমানোর বাজেট
আসছে ব্যয় কমানোর বাজেট
টস হেরে ব্যাট করছে বাংলাদেশ
টস হেরে ব্যাট করছে বাংলাদেশ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ