X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

খুলনার নির্বাচন কী বার্তা দিলো

আনিস আলমগীর
২২ মে ২০১৮, ১৩:৪৪আপডেট : ২২ মে ২০১৮, ১৬:০১

আনিস আলমগীর গত ১৫ মে ২০১৮ খুলনা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয়ে গেল। নির্বাচন শতাংশে নির্ঝঞ্ঝাট হয়নি। অবশ্য পর্যবেক্ষকরা বলছেন, গণ্ডগোলের মাত্রা ফলাফল উল্টানোর মতো ছিল না। তৃতীয় বিশ্বের প্রত্যেক দেশে, বিশেষ করে স্থানীয় নির্বাচনে, অনুরূপ কিছু ঝামেলা নির্বাচনের দিন হয়েই থাকে। খুলনার নির্বাচনও ব্যতিক্রম ছিল না।
প্রতিদ্বন্দ্বী উভয় প্রার্থী- আওয়ামী লীগের তালুকদার আবদুল খালেক আর বিএনপির নজরুল ইসলাম মঞ্জু শক্তিশালী প্রার্থী ছিলেন। উভয়ের নির্বাচনি প্রচারও ছিল জমজমাট। চোখ ধাঁধানো প্রচারণায় স্থির করা কঠিন ছিল কে জিতবেন নির্বাচনে। আবার অনেককে বলতে শুনেছি খুলনা শহর বিএনপির তালুক। বিএনপিকে হারানো মুশকিল হবে।
চিরদিন কোনও এলাকা কারও তালুক থাকে না। ১৯৭০ সালের আগে এই তালুকের আদি তালুকদার ছিলেন খানে সবুর খান। সত্তরের জাতীয় নির্বাচনে বাঘ মার্কায় নির্বাচন করে তিনি নৌকার প্রার্থীর কাছে হেরেছিলেন। আসলে নির্বাচনে জয়-পরাজয় পরিবেশ পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে নৌকার জোয়ার এতই বেগবান ছিল যে খড়কুড়োর মতো অন্য প্রার্থীরা ভেসে গিয়েছিলেন। পিডিপি প্রধান নুরুল আমিন আর চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় ছাড়া ওই নির্বাচনে আর কেউ জিতেনি। অবশিষ্ট ১৬২ আসনে আওয়ামী লীগ প্রার্থীরাই জিতে ছিলেন।

খুলনার নির্বাচন তো জাতীয় নির্বাচন ছিল না। এটি আঞ্চলিক সিটি করপোরেশন নির্বাচন। সুতরাং এখানে জাতীয় নির্বাচনের কথা বলছি কেন? এখন নির্বাচন হচ্ছে দলীয় প্রতীকের ভিত্তিতে। নৌকা মানেই আওয়ামী লীগ, ধানের শীষ মানেই বিএনপি। জনপ্রিয় দল, জনপ্রিয় মার্কা। তাই এ নির্বাচন আঞ্চলিক পর্যায়ের হলেও জাতীয় পর্যায়ের আমেজ এখানে বিনষ্ট হয়নি। জাতীয় পর্যায়ের নির্বাচনের কথা সে জন্যই আসছে। উভয় দল জাতীয় নির্বাচনের চেয়েও শক্ত হাতে কেসিসি নির্বাচন হ্যান্ডেল করেছে।

আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যে মেয়র প্রার্থী নিয়ে কোনও অন্তর্কলহ ছিল না। কর্মীরা স্ব-স্ব প্ল্যাটফর্মে ঐক্যবদ্ধ ছিল। তাহলে এখানে জয় পরাজয়ের ডিসাইডিং ফ্যাক্টর কী ছিল? জাতীয় পর্যায়ের ইস্যুগুলোকেই কি ভোটাররা বিবেচনায় নিয়েছিলেন? বিএনপি তাদের চেয়ারপারসন কারাবন্দি নেত্রী খালেদা জিয়ার মুক্তি চেয়েছে, তারেক জিয়ার মামলাকে মিথ্যা মামলা বলে প্রচার করেছে। আবার আওয়ামী লীগ উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার কথা বলেছে। তাহলে জাতীয় পর্যায়ের ইস্যু বাকি থাকলো কী! সুতরাং এখন আমরা ধরে নিতে পারি যে খুলনা নির্বাচনে জাতীয় ও আঞ্চলিক দুই ইস্যুকে মাথায় রেখে ভোটাররা ভোট দিয়েছে।

তাহলে অ্যান্টি ইনকামবেন্সি ফ্যাক্টর এখানে কাজ করলো না কেন? এটাই দেখার বিষয়। সম্ভবত জাতির উপলব্ধি শক্তিশালী হয়েছে। চিলে কান নিয়ে গেছে বললে এখন আর দৌড়াবে না। হাত দিয়ে দেখবে মাথার সঙ্গে কান আছে কিনা। কোনও দলকে ভোট দিলে মসজিদে উলুধ্বনি হবে- এমন অবাস্তব আবেগের কথা রাজনীতিকে, নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে পারবে না। এই উপলব্ধি যতই শক্তিশালী হবে ততই রাজনীতিতে বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটবে, ভোটাধিকার প্রয়োগের পরিপক্বতা আসবে। গণতন্ত্র মানেই ৫ বছর পর পর সরকার পরিবর্তন নয়। আমাদের ভোটারদের বাস্তব জ্ঞান শক্তিশালী হোক সেটাই আমরা কামনা করি।

আমাদের দেশের রাজনীতিবিদরা নানা পঙ্কিলতায় নিমজ্জিত থাকে। কোনটা তার সৎ চিন্তা আর কোনটা রাজনৈতিক চাতুরি- তার মধ্যে পার্থক্য নির্ণয় করা সাধারণ মানুষের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়ে। আমাদের দেশের বর্তমান রাজনীতি নিয়ে আমরা যে ক্লান্ত তার জন্য জরিপ চালানোর দরকার পড়ে না, যেখানে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বার্থ সুবিধা আদায়ের প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত। এখানে সুশীলরাও নিরঙ্কুশ সত্যচর্চায় দ্বিধান্বিত।

কোনও এক পত্রিকা বলেছে, কেসিসির নির্বাচনে দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়া শিশু ভোট দিয়েছে। একথা আবার দেখলাম কলামিস্টরাও তাদের কলামে লিখছেন। সত্য ঘটনা হচ্ছে একটি শিশু বাবার সঙ্গে ভোটকেন্দ্রে গিয়েছে। আর প্রিসাইডিং অফিসার জানতে চেয়েছে, তুমি কেন এসেছ? সে জবাব দিয়েছে চাচুকে ভোট দিতে এসেছি। তার বাবাকে কালি লাগানোর সময় শিশুটিকেও আঙুলে কালি লাগিয়ে দিয়েছিল। আর রটে গেলো দুই বছরের শিশু ভোট দিয়েছে।

সবাইকে সত্যের মাপকাঠি রেখে কথা বলা উচিত। এসব অপপ্রচার রাজনীতির সংস্কৃতিকে স্থূল করে তুলছে। গণমাধ্যম কোনও কিছুকে ধ্বংস করতে সময় লাগে না। সুতরাং গণমাধ্যমেরও সচেতন হওয়া উচিত। একটি অভিন্ন কল্যাণের জন্য আমাদের রাজনীতির ক্ষেত্রটি প্রস্তুত করা দরকার। এখানে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা থাকতে হবে।

কেসিসির নির্বাচন থেকে বুঝলাম মানুষ এখন আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে উন্নয়ন চায়। রূপপুর আণবিক কেন্দ্র স্থাপন, যার থেকে আপাতত বিদ্যুৎ উৎপাদন হবে; নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণ, মহাকাশে স্যাটেলাইট প্রেরণ, পটুয়াখালীর পায়রায় তৃতীয় সমুদ্রবন্দর স্থাপন, কর্ণফুলী নদীতে ট্যানেল নির্মাণ, পায়রা-মাতারবাড়ি-বাঁশখালী ও রামপালে তাপবিদুৎকেন্দ্র স্থাপন- ইত্যাদি প্রকল্পগুলোর কাজ জাতিকে আত্মপ্রত্যয়ী করে তুলেছে। যারা এসব কাজ করছে তাদের প্রতি আঞ্চলিক ও জাতীয় পর্যায়ে দৃঢ় সমর্থন জ্ঞাপনে একটা মনোভাব মানুষের মধ্যে জেগেছে।

পূর্বে মেয়র থাকাকালে তালুকদার আবদুল খালেকের কাজ এবং তার দলের জাতীয় পর্যায়ে উন্নয়নের ধারার কারণে খালেক ৬৫ হাজার ভোটের বিপুল ব্যবধানে কেসিসির মেয়র নির্বাচিত হয়েছেন। ইতিবাচক ও গঠনমূলক চিন্তা আধুনিক সমাজ-সভ্যতার সন্তাপ ও সংকট থেকে পরিত্রাণের একমাত্র উপায়। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের ছোট একটা দেশ, ১৬ কোটি মানুষের বসবাস। যেকোনও অপরিণত চিন্তা জাতির জন্য সংকট সৃষ্টি করবে।

বিএনপি কেসিসি মেয়র নির্বাচনে শক্তিশালী ভূমিকায় ছিল। একটা নির্বাচনে হার-জিত থাকবেই। তাদের প্রার্থী হেরেছেন। এ হারা অগৌরবের ছিল না। কেসিসির প্রতিষ্ঠার পর থেকে তারা ২০ বছর ক্ষমতায় ছিল। তৈবুর রহমান ১৫ বছর এবং বিগত মেয়র মনি ৫ বছর ক্ষমতায় ছিলেন। খালেক বা আওয়ামী লীগ ছিল মাত্র ৫ বছর। খালেকের ৫ বছরে যে উন্নয়ন হয়েছে তাকে মনিরের চেয়ে উত্তম বিবেচনা করেছেন খুলনাবাসী।

সম্ভবত মানুষের উন্নয়নের প্রশ্নে খালেককে আবার কামনা করেছেন এবং বিপুল ভোটে জয়ী করেছেন। তিনি একবার প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। রামপাল থেকে পাঁচবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন। অভিজ্ঞ লোক। সততার সঙ্গে কাজ করলে তিনি খুলনার প্রচুর উন্নয়ন করতে পারবেন। সরকারি দলের প্রবীণ লোক। তার জন্য উন্নয়নের টাকা পয়সা বরাদ্দ নেওয়া কঠিন কিছু নয়।

বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া জেলখানায়। তাদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান লন্ডনে, তারও ১৭ বছরের জেল হয়েছে। এখন লন্ডনে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়ে বসবাস করছেন। সুতরাং বলাই যায় বিএনপির এখন দুর্দিন। তারা খুলনা-গাজীপুর উভয় স্থানে প্রার্থী দিয়েছে। গাজীপুরের প্রার্থীও শক্তিশালী। হার জিতের কথা বিবেচনা না করে তাদের উচিত হবে সব নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা। তাহলেই দলটি চাঙ্গা থাকবে, টিকে থাকবে। নয়তো আরও বিপর্যয়ের সামনে পড়বে। মানুষ মনে করেন, আওয়ামী লীগের প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপি। মানুষের ধারণা থেকে এই সত্যটি রহিত হয়ে গেলে বিএনপির অবলুপ্তি নিশ্চিত।

লেখক: সাংবাদিক

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
কেএনএফ’র বিরুদ্ধে যৌথ বাহিনীর অভিযানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ
কেএনএফ’র বিরুদ্ধে যৌথ বাহিনীর অভিযানে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ
পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়গুলো পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে: পরিবেশমন্ত্রী
পরিবেশ সংরক্ষণের বিষয়গুলো পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করা হচ্ছে: পরিবেশমন্ত্রী
পটকা-আতশবাজি তৈরি করা ঘরটি উড়ে গেলো বিস্ফোরণে, মা-মেয়েসহ আহত ৪
পটকা-আতশবাজি তৈরি করা ঘরটি উড়ে গেলো বিস্ফোরণে, মা-মেয়েসহ আহত ৪
আবাহনীর ১০ ক্রিকেটার চট্টগ্রামে, একাদশ গঠন নিয়ে বিপাকে সুজন
আবাহনীর ১০ ক্রিকেটার চট্টগ্রামে, একাদশ গঠন নিয়ে বিপাকে সুজন
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ