X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

সৌদি-ইরান বিরোধ কবে থামবে

আনিস আলমগীর
০৮ অক্টোবর ২০১৯, ১৫:১১আপডেট : ০৮ অক্টোবর ২০১৯, ১৫:১৪

আনিস আলমগীর সৌদি আরব এবং ইরান দু’টি বৃহত্তম মুসলিম দেশ। উভয় রাষ্ট্র আন্তর্জাতিক এবং মুসলিম উম্মাহর রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মর্যাদাশালী রাষ্ট্র। মক্কা শরিফ ও মদিনা শরিফের অবস্থানের কারণে সৌদি আরব মুসলমানদের কাছে বিশেষ মর্যাদা পেয়ে আসছে। সৌদি আরবের লোকসংখ্যা কম হলেও বিশাল ভূখণ্ডের অধিকারী। তবে সমগ্র অঞ্চল প্রায় মরুভূমি। সৌদির ২০ লাখ বর্গকিলোমিটার আয়তন, লোকসংখ্যা মাত্র তিন কোটি ২০ লাখ। ইরানের আয়তন প্রায় সাড়ে ১৬ লাখ বর্গকিলোমিটার, লোকসংখ্যা ৮ কোটি মাত্র। উভয় দেশে সম্পদের ঈর্ষণীয় প্রাচুর্য রয়েছে। বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ তেলের মজুত সৌদি আরবে, আর বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ গ্যাসের মজুত ইরানে। আবার তেল-গ্যাস উভয় সম্পদের ক্ষেত্রেও দেশ দুটি বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর কাতারে আছে।
১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লব হওয়ার পর সম্রাট রেজা শাহ পাহলভীর পতন হয়। ইরান বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন কোম শহরের ইসলামী পণ্ডিতেরা। মূল নেতা ছিলেন আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি। তিনি ইরান সম্রাটের কোপানলে পড়ে ১৫ বছর ধরে ইরাক ও ফ্রান্সে নির্বাসনে ছিলেন। ফ্রান্স থেকেই তিনি ইরানের ইসলামি বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। কোমের আয়াতুল্লাহরা সবাই রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে। সুতরাং পাহলভী সম্রাট রেজা শাহ পাহলভীর পতনের পর থেকে ইরানের সঙ্গে সৌদি আরবের সুসম্পর্ক ছিল না। এখনো নেই।

ইসলাম ধর্ম অনুসারীদের মূল দুটি ধারা হচ্ছে—শিয়া ও সুন্নি। ইরানের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক শিয়া আর সৌদি আরবের সংখ্যাগরিষ্ঠ লোক সুন্নি। উভয় দেশে যে সংখ্যালঘু শিয়া ও সুন্নি নেই, তাও নয়। সৌদি আরবে ১৫ থেকে ২০ শতাংশ মানুষ শিয়া আর ইরানে সুন্নির সংখ্যাও ১০ শতাংশ। ইরানের পার্লামেন্ট বা মজলিসে ফেরকাগতভাবে প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা আছে। এমনকি ইরানে কিছু ইহুদিও বসবাস করে এবং তাদেরও মজলিসে প্রতিনিধিত্ব আছে। শাসনতন্ত্র প্রণয়নের সময় কোমের মাওলানারা এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। মুসলিম বিশ্বের ইতিহাসে এটি বিরল ঘটনা।

ইরান আর সৌদি আরবের সম্পর্ক এখন খুবই খারাপ। ২০১৬ সাল থেকে কূটনৈতিক সম্পর্ক পর্যন্ত নেই দুই দেশের মধ্যে। ধর্মীয় ফেরকার বাইরে দুই দেশের সম্পর্কের তিক্ততার মধ্যে আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তার, আমেরিকা ও ইসরায়েলের সঙ্গে সৌদিদের দহরম মহরমও অন্যতম। ১৯৮০ থেকে ’৮৮ সাল পর্যন্ত দীর্ঘ আট বছর সাদ্দাম হোসেনের কাঁধে বন্দুক রেখে সৌদি আরব-আমেরিকা ইরানের বিরুদ্ধে যুদ্ধও করেছে। সৌদি আরব ইরাককে অর্থ দিয়েছে, আর আমেরিকা অস্ত্র দিয়েছে সেই যুদ্ধে। মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব দেশ ছিল ইরানের বিরুদ্ধে। তারপরও ইরানকে পরাস্ত করা যায়নি। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় ইরান যুদ্ধবিরতি মেনে নিয়েছিল।

সৌদি আরব-ইরানের তিক্ত সম্পর্কের সাম্প্রতিক আরেকটি কারণ হচ্ছে ইয়েমেন। ইয়েমেন সৌদি আরবের দক্ষিণ প্রান্তে অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক জনপদ। কোরআন, বাইবেল এবং ওল্ড টেস্টামেন্টে ইয়েমেনের কথা উল্লেখ আছে বারবার। ইয়েমেনই ছিল রানি বিলকিসের রাজ্য। বাদশা সোলায়মান জেরুজালেম থেকে আকাশপথে সাবা এসেছিলেন, রানি বিলকিসের সঙ্গে দেখা করার জন্য।

ইয়েমেনের সঙ্গে ইরানের কোনও স্থল সীমানা নেই। ইয়েমেনের উত্তরে সৌদি আরব, দক্ষিণে এডেন উপসাগর। পূর্বে ওমান আর পশ্চিমে লোহিত সাগর। আয়তন ৫ লাখ ২৭ হাজার ৯৬৮ বর্গকিলোমিটার। লোকসংখ্যা দুই কোটি ৮০ লাখ। এখানে শিয়া-সুন্নি প্রায় সমান। সেখানকার হুথি বিদ্রোহীরা যাইডি শিয়া। হুথিরা শিয়া হলেও সুন্নিদের সঙ্গে তাদের মতপার্থক্য ইরানি শিয়াদের মতো ব্যাপক নয়। ইয়েমেনের রাজধানী সানা। এডেন হচ্ছে বড় সামুদ্রিক বন্দর। লোহিত সাগর এবং এডেন উপসাগরের সংযোগস্থলে অবস্থানের কারণে প্রাচীনকাল থেকে এই বন্দরের গুরুত্ব খুবই বেশি।

২০১১ সালে আরব-বসন্তের সময় ইয়েমেনেও বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল। তখন ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট আলী আবদুল্লাহ সালেহ বিক্ষোভের তোড়ে পদত্যাগ করেন। তার ডেপুটি আবদারাবুহ মানসুর হাদির কাছে তাকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে বাধ্য করা হয়। ২০১২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাইস প্রেসিডেন্ট মানসুর হাদি ইয়েমেনের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট হাদিকে অনেক সংকটের মুখোমুখি হতে হয়। আল কায়েদার হামলা, দক্ষিণে বিছিন্নতাবাতী আন্দোলন, সালেহের প্রতি অনেক সামরিক কর্মকর্তার আনুগত্য। এর বাইরে দুর্নীতি, বেকারত্ব আর খাদ্য সংকট। আর নতুন প্রেসিডেন্টের দুর্বলতার সুযোগে ইয়েমেনের যাইডি শিয়া মুসলিম নেতৃত্বের হুথি আন্দোলনের কর্মীরা সাডা প্রদেশ এবং আশেপাশের এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। এ সময় অনেক সুন্নিও তাদের সমর্থন জোগায়। এরপর বিদ্রোহীরা সানা অঞ্চলেরও নিয়ন্ত্রণও নিয়ে নেয়।

২০১৫ সালের জানুয়ারিতে হাদি পদত্যাগে বাধ্য হন। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট সালেহের সমর্থক এবং হুথিরা মিলে তাকে গৃহবন্দি করে। হাদি পালিয়ে এডেন চলে যান এবং হুথিদের ক্ষমতাগ্রহণকে অমান্য করে এডেনকে রাজধানী ঘোষণা করেন। হুথি আর নিরাপত্তা বাহিনীগুলো সাবেক প্রেসিডেন্ট সালেহের প্রতি অনুগত। এরপর তারা পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার চেষ্টা করে। তাদের পেছনে ইরান সমর্থন জুগিয়ে যাচ্ছে বলে ধারণা করা হয়। ২৫ মার্চ ২০১৫ গৃহযুদ্ধ শুরু হলে আর টিকতে না পেরে হাদি সৌদি আরবে পালিয়ে যান। হাদিকে ইয়েমেনে পুনরায় ক্ষমতায় আনতে সৌদি আরব আর অন্য আটটি সুন্নি দেশ একজোট হয়ে ইয়েমেনে অভিযান শুরু করে। এই জোটকে লজিস্টিক আর ইন্টেলিজেন্স সহায়তা করে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য আর ফ্রান্স।

২০১৫ সাল থেকে সৌদি বাহিনী বারবার ইয়েমেনের আকাশপথে, স্থলপথে আক্রমণ করে এবং কোনও জাহাজ যেন বন্দরে ভিড়তে না পারে তার প্রতি দৃষ্টি রাখে। তাতে ইয়েমেনে আকাল লেগে আছে। হাজার হাজার ইয়েমেনি শিশু পুষ্টিহীনতায় ভুগছে এবং মারা যাচ্ছে। বিশ্বের মানবতাবাদী সংগঠনগুলো সৌদি আররকে বন্দরে বোম্বিং না করার আহ্বান রেখেছে। তাতে কোনও ফল হচ্ছে না। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত আর আমেরিকা এখন জোট বেঁধে হুথিদের মোকাবিলা করছে, তবুও হুথিদের নিঃশেষ করা যাচ্ছে না। সৌদি আরব ও আমেরিকার অভিযোগ—হুথিদের সমরাস্ত্র সরবরাহ করছে ইরান।

হুথিরা ড্রোন হামলা করে গত সপ্তাহে সৌদির এক তেলক্ষেত্রের প্রচুর ক্ষতি সাধন করেছে। এখন সৌদির তেল উত্তোলন অর্ধেকে নেমে এসেছে। সৌদি আরব বলেছে, হামলা ইরান করেছে। ইরান তা অস্বীকার করেছে। আসলে এত সুনিপুণ আক্রমণ হুথিদের দ্বারা সম্ভব হলো কীভাবে? ২৮ সেপ্টেম্বর হুথিরা এসব কথার জবাব দিয়েছে। এবার আক্রমণ করেছে প্রচণ্ডভাবে, তাতে সৌদিরা নির্বাক হওয়ার কথা। হুথিরা বলেছে সৌদিরা ইয়েমেনে গণহত্যা বন্ধ না করলে তারা আরও ব্যাপক হামলা পরিচালনা করবে।

২৮ সেপ্টেম্বর হুথিরা সৌদি আরবের অভ্যন্তরে যে হামলা চালিয়েছে, তা তেলক্ষেত্র হামলার চেয়েও মারাত্মক। ইয়েমেনি বাহিনী এবং হুথিরা সৌদি বাহিনীকে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় যেতে প্ররোচিত করেছিল। অতঃপর সৌদি ভূখণ্ডে ইয়েমেনি বাহিনী এবং হুথিরা ঝটিকা আক্রমণ চালিয়ে সৌদি বাহিনীকে খুবই নাজুক পরিস্থিতির সম্মুখীন করেছিল। হুথিরা নাজরান শহর ও আশপাশের এলাকা ঘিরে ফেলেছিল। এ অভিযানে তারা প্রচুর সৌদি সৈন্য আটক করে এবং হাজার হাজার সামরিক যান ও অস্ত্র হুথিদের হস্তগত হয়।

এই অভিযানের আগে অনতিদূরে বিমানবন্দর ধ্বংস করে দিয়েছিল, যে কারণে সৌদি বিমান এই আক্রমণে সৈন্যবাহিনীকে সহযোগিতা দিতে আসতে পারেনি। এটি একটি মোড় পরিবর্তনকারী অভিযান। যুক্তরাষ্ট্রের বা সৌদি আরবের আর কোনও সুযোগ রইল না এটাতে ইরানের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলার। হুথিরা রিয়াদে কিং খালেদ বিমানবন্দরেও হামলা চালিয়েছিল।

সম্ভবত এসব হামলার কারণে সৌদি জোট ইয়েমেনের শক্তিকে আর খাটো করে দেখছে না। সৌদি ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান এখন প্রস্তাব করেছেন ইরানের সঙ্গে যুদ্ধ করার চেয়েও রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছানো উত্তম হবে। সৌদি আরব পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে ইরানের সঙ্গে মধ্যস্থতার প্রস্তাব দিয়েছিল। ইমরান খান মধ্যস্থতার ব্যাপারে সক্রিয় হয়েছেন। রাজকুমারের এই প্রস্তাবকে ইরান স্বাগত জানিয়েছে। সৌদিরা ইরানকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য ইসরায়েলের সঙ্গে দহরম-মহরম আরম্ভ করেছিল। তাদের সে প্রয়াসকে মুসলিম বিশ্ব ভালো চোখে দেখেনি।

সৌদি আরবের চিন্তা সম্ভবত তার সীমান্তবর্তী রাষ্ট্র ইয়েমেনে শিয়া মতাবলম্বীদের একটা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত থাকলে হয়তো তার অসুবিধা হতে পারে। সেজন্য তো ইয়েমেনে হাজার হাজার বোমা নিক্ষেপ করে নির্বিচারে নিরীহ মানুষ হত্যা করা সৌদির উচিত হয়নি। দীর্ঘদিন তাদের বন্দরে কোনও জাহাজ নোঙর করতে পারছে না। সৌদিদের বিমান আক্রমণের ভয়ে হাজার হাজার শিশু অপুষ্টিতে মরছে আর ইয়েমেনিরা মরছে অনাহারে। জাতিসংঘ বারবার হুঁশিয়ারি দিয়েছে ইয়েমেনের দুর্ভিক্ষ সম্পর্কে।

মুসলিম বিশ্ব সৌদি আরবকে ভ্যাটিকানের ভূমিকায় দেখতে চায়। সৌদি আরবের উচিত নিজেকে নিরপেক্ষ ভূমিকায় প্রতিষ্ঠা করা। তাদের মনে রাখা দরকার তারা হেরেমাইনের খাদেম। অমানবীয় যে কোনও কাজ তাদের জন্য অশোভনীয়। আমরা আশা করি সৌদি আরব আর ইরান রাজনৈতিক সমঝোতার জন্য সংলাপ শুরু করবে। বিরোধ থামিয়ে শান্তির পথে হাঁটবে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত।

[email protected]

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ফেরিঘাটে টেম্পুর ধাক্কায় কলেজশিক্ষার্থী নিহত
ফেরিঘাটে টেম্পুর ধাক্কায় কলেজশিক্ষার্থী নিহত
পাকিস্তানে উপ-প্রধানমন্ত্রী হলেন ইসহাক দার, পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ পিটিআইয়ের
পাকিস্তানে উপ-প্রধানমন্ত্রী হলেন ইসহাক দার, পরিবারতন্ত্রের অভিযোগ পিটিআইয়ের
দুই দফা অভিযানেও খোঁজ মেলেনি শিশুটির
দুই দফা অভিযানেও খোঁজ মেলেনি শিশুটির
ফুটপাত দখলকারীদের তালিকা চেয়েছেন হাইকোর্ট
ফুটপাত দখলকারীদের তালিকা চেয়েছেন হাইকোর্ট
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ