X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

স্প্যানিশ ফ্লু থেকে ডেঙ্গু এবং কোভিড-১৯

আতিক আহসান
১১ মার্চ ২০২০, ১৬:৩৯আপডেট : ১১ মার্চ ২০২০, ১৬:৪১

আতিক আহসান বর্তমান কোভিড-১৯ এর মতো সারা পৃথিবীতে আগেও একবার এক ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জা ছড়িয়ে পড়েছিল। ১৯১৮ সালে ছড়িয়ে পড়া সেই ইনফ্লুয়েঞ্জার নাম ছিল ‘স্প্যানিশ ফ্লু’। সারা পৃথিবীতে তখন মানুষের সংখ্যা ছিল আনুমানিক ১৯০-২০০ কোটির মতো, এরমধ্যে ধারণা করা হয় ৫০ কোটি বা প্রতি ৪ জনের একজন স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হয়েছিল। এই ৫০ কোটির মধ্যে ৫ কোটি মানুষ মারা যায়।
যদিও বিষয়টি অনেক কাল আগের কথা, তখন কম্পিউটারের  প্রচলন ছিল না, কম্পিউটারের এত জটিল জটিল সব ইকুয়েশন করার ক্ষমতা ছিল না। ছিল না এত উন্নতমানের ল্যাবরেটরি, ডাক্তার, ওষুধ, টেস্ট কিট কিংবা বিজ্ঞানী, না ছিল ইন্টারনেট। এমনকি সেই সময় ঠিক কত মানুষ স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হলো বা মারা গেলো তা অনেকটা অনুমানের ওপর ভিত্তি করেই বলা হয়ে থাকে, কারণ তখন সব দেশের পরিসংখ্যান বা এমআইএস এত গোছানো ছিল না। 
বর্তমান পৃথিবী সেই সময় থেকে অনেক এগিয়েছে। পৃথিবীর জনসংখ্যা কত, কতজন কোন রোগে আক্রান্ত হলো, এমনকি নতুন ভাইরাসের জিনম কোড কী, তাও আমরা তিন দিনের মধ্যে সারা পৃথিবীর যেখানেই থাকি, তা চাইলে জানাতে পারি। সুতরাং আমরা ১৯১৮ সালের মতো ওই পরিস্থিতিতে পড়বো না সত্যি, তবে একই সঙ্গে ১৯১৮ সালে যে বস্তু ছিল না, তা হচ্ছে গতি। গতি একদিকে যেমন আমাদের অনেক সুবিধা করে দিয়েছে, একই সঙ্গে এর বাই প্রোডাক্ট হিসেবে অনেক অসুবিধা নিয়ে এসেছে। ১৯১৮ সালে কেউ যদি লন্ডন যেতে চাইতো, তাকে মাসের পর মাস জাহাজ চড়ে যেতে হতো, হজে যেতে হলে হেঁটে, উটের পিঠে করে ২/৩ মাসের যাত্রা করতে হতো। কিন্তু এখন বিমানে চড়ে ১১ ঘণ্টায় আমরা লন্ডন যেতে পারি, আর ৬ ঘণ্টায় সৌদি আরব যেতে পারি। শুধু লন্ডন বা মক্কা না, পৃথিবীর যেকোনও প্রান্ত থেকেই যেকোনও স্থানে এখন ২৪ ঘণ্টায় পৌঁছানো সম্ভব হয়। প্রতি ঘণ্টায় ১ হাজার কি.মি. অতিক্রম করার সুযোগ না থাকার পরও ১৯১৮ সালে ৫০ কোটি মানুষ স্প্যানিশ ফ্লুতে আক্রান্ত হওয়া যেমন অদ্ভুতুড়ে বিষয় ছিল, এখন পৃথিবীব্যাপী ব্যাপক বিমান যোগাযোগের সময়ে ৭৭০ কোটি মানুষকে কোভিড-১৯ এর মতো সংক্রামক রোগ থেকে দূরে থাকাটাও এক অদ্ভুতুড়ে বিষয়। 

Johns Hopkins CSSE পোর্টালের তথ্যমতে, ৩১ ডিসেম্বর, ২০১৯ থেকে আজ ৮ মার্চ, ২০২০ বিকাল পর্যন্ত বাংলাদেশসহ মোট ১০৭টি দেশ বা এলাকা করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। আজ পর্যন্ত মোট আক্রান্তের সংখ্যা ১০৭,৩৫৩ জন, এর মধ্যে মৃত্যুবরণ করেছেন ৩,৬৪৬ জন। অর্থাৎ কোভিড-১৯ এ এখন পর্যন্ত মৃত্যুহার শতকরা ৩.৪০% জন।

কোভিড-১৯ নিয়ে কেন সারা বিশ্বে এত তোলপাড় শুরু হলো, সেটা অনেকে সমালোচনামূলক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখে থাকেন। তাদের যুক্তি, অন্যান্য সিজনাল ফ্লুতেও তো বছরে হাজার হাজার মানুষ মারা যায়, সেটা নিয়ে তো এত মিডিয়া কভারেজ হয় না। কথা সত্য, সিডিসির তথ্যমতে ২০১৭-২০১৮ সালে আমেরিকায় সিজনাল ফ্লুতে মৃতের সংখ্যা ছিল ১২,০০০-৬১,০০০ এর মধ্যে এবং আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৯৩ লাখ থেকে ৪.৫ কোটির মধ্যে। সেই হিসেবে মৃত্যুহার দাঁড়ায় শতকরা হিসেবে ০.১৩%-০.১৪% এর মতো। পার্থক্যটা সিজনাল ফ্লু থেকে কোভিড-১৯ এর ঠিক এইখানেই।

তবে এর মধ্যে আশার কথা হচ্ছে চীনে ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২০ পর্যন্ত ৪৪,৬৭২ জন রোগীর তথ্য বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে যে শতকরা ৮১ ভাগের হালকা উপসর্গ দেখা গেছে এবং ১ ভাগের কোনও উপসর্গই দেখা যায়নি। (সুতরাং আমাদেরও এই ৮২% নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই)। কিন্তু বাকি ১৮% এর মধ্যে ৫% এর জটিলতা দেখা যায় এবং এই জটিলতা বয়স্ক এবং যারা আগে থেকেই ফুসফুস, কিডনি, হৃৎপিণ্ড এবং ডায়াবেটিস রোগে ভুগছেন তাদের মধ্যে বেশি। সুতরাং আমরা জানি কারা সব থেকে ঝুঁকিপূর্ণ এবং এই দলকে সুরক্ষিত রাখায় এই মুহূর্তে করণীয়। 

এখন সম্পূরক প্রশ্ন যেটি আসে, তা হলো আমরা কীভাবে সেটি করতে পারি। প্রথমত, আমাদের জানতে হবে, তারা কেন সব থেকে ঝুঁকিপূর্ণ, এর উত্তর হলো তাদের শরীরে আগে থেকে অন্য রোগ থাকার কারণে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম। এই কারণে তাদের অন্যদের থেকে আপাতত নিরাপদ দূরত্বে রাখার ব্যবস্থা করতে পারলে সব থেকে ভালো হয়। তবে আমাদের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশে এটা কতটুকু সম্ভব, সেটা প্রশ্ন সাপেক্ষ। তবে সবাই ভালোভাবে হাত ধোয়া, হাঁচি-কাশি দেওয়ার সময় যেন আশেপাশে ছড়িয়ে না পড়ে সেদিকে লক্ষ রাখা, যেখানে সেখানে থুতু-কফ না ফেলা এগুলো আমরা এরমধ্যে সবাই জেনে গেছি, সেগুলো মেনে চলতে হবে। 

সর্বোপরি যে প্রেক্ষাপটে লেখাটা শুরু করা তা হচ্ছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের গতি এবং প্রযুক্তি যেমন দ্রুত পাল্টাচ্ছে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আমাদেরও প্রস্তুতি গ্রহণ করতে হবে। নতুন নতুন সংক্রামক ব্যাধির সঙ্গে পেরে উঠতে আমাদেরও তাদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে প্রতিরোধ বা নিয়ন্ত্রণের সরঞ্জাম তৈরি করে নিতে হবে। 

সামনে এপ্রিল মাস আসছে, তবে তার আগেই বৃষ্টির কারণে হয়তো দেশে ডেঙ্গু শুরু হয়ে যেতে পারে। এখন প্রযুক্তি, ইন্টারনেট, কম্পিউটারের সহায়তায় রিয়েল টাইমে কোন রোগের প্রাদুর্ভাব কোথায়, কোন ক্লাস্টারে বেশি, সেগুলো অনেক সহজেই মনিটরিং করা সম্ভব। যত দ্রুত ক্লাস্টার শনাক্ত করা সম্ভব হয়, তত ছোট পরিসরে রোগীদের কোয়ারেন্টাইন করে রাখতে পারলে বাকিরা নিরাপদে থাকেন। চীন, ইরান কিংবা ইতালি তাদের দেশের একটা বড় অংশকে কোয়ারেন্টাইনে নিতে বাধ্য হয়েছে, কারণ তারা শুরুতে রোগী শনাক্ত করতে ব্যর্থ হয়েছিল এবং তারপর ক্লাস্টারগুলোও চিহ্নিত করতে দেরি করে। এই সমস্যা সমাধান হতে পারে একটা কার্যকরী ডিজিটাল এপিডেমিওলোজিক্যাল সার্ভেইল্যান্স সিস্টেম।  

বলে রাখা ভালো, মশার ঘনত্ব পরিমাপ করার সার্ভেইল্যান্স সিস্টেম থেকে এপিডেমিওলোজিক্যাল সার্ভেইল্যান্স সিস্টেমের পার্থক্য হচ্ছে এর কেন্দ্রে থাকে মানুষ, আর ভেক্টর কন্ট্রোল সার্ভেইল্যান্স সিস্টেমের কেন্দ্রে থাকে মশা।  এপিডেমিওলোজিক্যাল সার্ভেইল্যান্স সিস্টেম দিয়ে প্রায় রিয়েল টাইমে রোগীর অবস্থান শনাক্ত করা যায় এবং অন্যদের নিরাপদে রাখা যায়। 

এই ডিজিটাল এপিডেমিওলোজিক্যাল সার্ভেইল্যান্স সিস্টেম করলে সরকারি/বেসরকারি অনেক প্রতিষ্ঠানকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। সেটি তৈরি করা হয়তো খুব সহজ না, কিন্তু অসম্ভবও না। সময়ের এবং গতির সঙ্গে তাল মেলাতে হলে আমাদের সেটি তৈরি করা ছাড়া অন্য রাস্তাটি আছে, তা হচ্ছে শুধু অসহায় হয়ে যা হচ্ছে তা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখা। আমরা নিশ্চয় এমন পরিস্থিতিতে আসলে হাত পা গুটিয়ে বসে না থেকে, বরং পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে সমস্যা মোকাবিলা করতে চাই।         

লেখক: মেডিক্যাল অ্যানথ্রোপলজিস্ট

 

/এসএএস/এমএমজে/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
দিনাজপুরে একসঙ্গে ২০ হাজার কণ্ঠে গীতা পাঠ
দিনাজপুরে একসঙ্গে ২০ হাজার কণ্ঠে গীতা পাঠ
জেসি অনভিজ্ঞ বলেই আপত্তি ছিল মোহামেডান-প্রাইম ব্যাংকের
জেসি অনভিজ্ঞ বলেই আপত্তি ছিল মোহামেডান-প্রাইম ব্যাংকের
যাত্রাবাড়ীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
যাত্রাবাড়ীতে সড়ক দুর্ঘটনায় মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
শেখ জামালের জন্মদিন আজ
শেখ জামালের জন্মদিন আজ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ