X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা শেখ ফজলুল হক মনি’র স্মৃতিকথা

ড. জেবউননেছা
১০ নভেম্বর ২০২১, ১৫:২২আপডেট : ১০ নভেম্বর ২০২১, ১৬:৪৪

ড. জেবউননেছা ক্ষণজন্মা কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তাঁর ‘রানার’ কবিতায় লিখেছিলেন-

শপথের চিঠি নিয়ে চলো আজ
       ভীরুতা পিছনে ফেলে –
পৌঁছে দাও এ নতুন খবর,
       অগ্রগতির ‘মেলে’,
দেখা দেবে বুঝি প্রভাত এখুনি –
       নেই, দেরি নেই আর,
ছুটে চলো, ছুটে চলো আরো বেগে
       দুর্দম, হে রানার॥

কবি সুকান্তের ‘রানার’রা এমন করেই খবর পৌঁছে দেওয়ার জন্যই পৃথিবীতে আসেন এবং চলে যান। এমনই এক রানার পৃথিবীতে এসেছিলেন। যিনি ষাট দশকের একজন উদীয়মান গল্পকার এবং  তৎকালীন সময়ে ‘বৃত্ত’ নামক একটি উপন্যাস প্রকাশ করেন। তিনি প্রবন্ধ লেখার পাশাপাশি ‘অবাহ্নিতা’ শিরোনামে একটি গল্প লিখেন, যেটি পরবর্তীতে টেলিফিল্ম হিসেবে চিত্রায়িত হয়েছে। তাঁর লেখা ছয়টি গল্প নিয়ে প্রকাশিত গল্পগ্রন্থের নাম ‘গীতা রায়’।  নিজের লেখা ঠিক আছে কিনা, তা জানার জন্য গল্প, উপন্যাস লিখে তাঁর সরাসরি শিক্ষক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক, বাংলা একাডেমির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলামের কাছে যেতেন। যিনি ছিলেন ভীষণ পড়ুয়া। যিনি ঘুমাতে যেতেন হাতে একটি বই নিয়ে। ঘুম থেকে উঠে চোখ মেলেই জাতীয় দৈনিকগুলো পড়া ছিল তাঁর নিয়মিত কাজ। যিনি জীবনের শেষ দিন পড়েছিলেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওপর লেখা একটি বিখ্যাত দলিল ‘লাস্ট ব্যাটেল’। রাতের শেষ প্রহর পর্যন্ত বইটি তিনি পড়েছেন। লেখক হিসেবে তাঁর জীবনের শুরুটা গল্প দিয়ে হলেও তিনি ছিলেন আপাদমস্তক একজন প্রাবন্ধিক। যার সাংবাদিকতায় হাতেখড়ি হয়েছিল ১৯৬৩ সালে মরহুম তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার তত্ত্বাবধানে।

প্রাণবন্ত এবং গুণী এই মানুষটি সুন্দর এই পৃথিবীতে আসেন গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ায় ১৯৩৯ সালে ৪ ডিসেম্বর। গোপালগঞ্জের গিমাডাঙ্গা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক, ঢাকা নবকুমার ইনস্টিটিউট থেকে মাধ্যমিক এবং ১৯৫৮ সালে জগন্নাথ কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক সম্পন্ন করেন। অতঃপর ১৯৬০ সালে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজ থেকে স্নাতক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। কারাগারে থাকাবস্থায় ড. আলীম আল রাজী আইন কলেজ থেকে এলএলবি সম্পন্ন করেন। তিনি তাঁর মাতামহীর (বঙ্গবন্ধুর মাতা) কাছ থেকে শিশুকালে শিখেছিলেন পরনিন্দা করতে হয় না। তাঁর লেখা ০৭.০৬.১৯৭৪ইং ‘পরনিন্দা করিওনা’ শীর্ষক শিরোনাম প্রবন্ধে তা-ই দেখা যায়। তবে তিনি নিন্দুক না হলেও ছিলেন একজন বিশ্লেষক, দক্ষ আলোচক এবং একজন তুখোড় ছাত্রনেতা। তিনি ১৯৬০ থেকে ১৯৬৩ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬২ সালে হামিদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করার জন্য ছয় মাস কারাভোগ করেন। ১৯৬৪ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠানে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর মোনায়েম খানের হাত থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদপত্র গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানান এবং সরকারের গণবিরোধী শিক্ষানীতির বিরোধীতে সমাবর্তন বর্জন আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করেন। এই আন্দোলন সফল হলেও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার এমএ ডিগ্রি প্রত্যাহার করে। পরে তার পরিবার মামলা করে মামলায় জয়লাভ করেন এবং ডিগ্রি ফিরে পান।

১৯৬৫ সালে তিনি পাকিস্তান নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হন এবং দেড় বছর কারাভোগ করেন। ১৯৬৬ সালের ৭ জুন সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে ঐতিহাসিক শ্রমিক ধর্মঘট এবং ছয় দফা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে তাঁর বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করা হয়। বিভিন্ন অভিযোগে তার বিরুদ্ধে আটটি মামলা দায়ের করা হয়। তিনি তাঁর প্রবন্ধ ‘ছেষট্টির সাত জুন: প্রস্তুতি পর্ব’ শিরোনামে শেষ লাইনে লিখেছেন, ‘এদিকে  জেলখানা থেকে বঙ্গবন্ধু জানতে চেয়েছেন হরতালের প্রস্তুতি কতদূর, কী হলো সেটা সম্পর্কে। গভীর রাতে পেছনের দেয়াল টপকিয়ে ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধুর বাসায় গেলাম। মামিকে বিস্তারিত সবকিছু জানিয়ে বললাম, রাতের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর নিকট খবর পৌঁছে দেওয়ার জন্য। হরতাল হবেই’। এই এতটুকুতেই বোঝা যায় তিনি কতটা দৃঢ়চেতা মানুষ ছিলেন।

দীর্ঘদিন  কারাভোগ করে ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলনের সময় কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেন। তিনি ১৯৭০ সালের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য ছিলেন। স্বাধীনতার পূর্বে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী পরিষদ’, যেটি ‘নিউক্লিয়াস’ নামে পরিচিত ছিল, সেই পরিষদের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। ১৯৭১ সালে মে মাসের দিকে এই পরিষদ বাংলাদেশ লিবারেশন ফ্রন্ট ‘মুজিব বাহিনী’ নামে ভারতের দেরাদুনের তান্দুয়া নামক পাহাড়ি  স্থানে চারটি সেক্টরে গঠিত হয়। তিনি পূর্বাঞ্চলের যৌথ কমান্ডার ছিলেন। মাঝে মাঝে তিনি হেলিকপ্টারে মেজর জেনারেল সুজন সিং উবান, পিভিএসএম, এভিএসএম-সহ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র পরিদর্শনে আসতেন। এই প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ১৬টি ব্যাচে ১০,০০০ মুক্তিযোদ্ধা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। ‘মুজিব বাহিনী’ নামটি নামকরণের ব্যাপারে জেনারেল উবান প্রথম প্রস্তাব করেন। তিনি মুজিববাহিনীর চার নেতার নাম দিয়েছিলেন ‘অবিচ্ছেদ্য চার’। মেজর জেনারেল উবানের স্মৃতিচারণে দেখা যায়, ‘প্রচণ্ড আত্মশক্তিতে বলীয়ান এই মানুষটি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় প্রায় অসুস্থ থাকতেন। কিন্তু কাজ করা বন্ধ করতেন না। অদম্য সাহসের অধিকারী এই লোকটি পার্বত্য চট্টগ্রামের সবচেয়ে প্রতিবন্ধকতাপূর্ণ ভূমিতে প্রকৃত যুদ্ধের সময় আমার সঙ্গে ছিলেন। মনির সঙ্গে সাক্ষাতে আমি বুঝেছিলাম তিনি প্রশংসনীয় গুণের অধিকারী অমিত আত্মত্যাগের মনোভাবসম্পন্ন। তাদের কেন্দ্রে প্রশিক্ষিত এক ছোট সুদর্শন বালকের ওপর অসহ্য নির্যাতন হয়েছিল। ঢাকার পতনের পর শেখ ফজলুল হক মনি তাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, তিনি মুজিব বাহিনীর একটি অসুস্থ বালককে হেলিকপ্টারে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা নিয়ে যেতে পারেন কিনা। পরে উবান যখন ঢাকায় আসেন, তখন দেখেন শেখ মনি কম বয়সী ছেলেকে সাথে নিয়ে তার আকাশযানের দিকে আসছেন। তিনি বুঝতে দেরি করলেন না, এই সেই ছেলে যাকে শেখ মনি ঢাকায় পাঠিয়ে সুস্থ করে তুলেছেন। এই হলো শেখ মনি, যার ধ্যানে-জ্ঞানে ছিল মনুষ্যত্ববোধ’।

ষাট দশকে পল্টনে আওয়ামী লীগের অফিসের নিচতলায় ছিল সাপ্তাহিক ‘বাংলার বাণী’র অফিস। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ‘বাংলার বাণী’ পত্রিকার বিষয়ে বলেন, ‘সাপ্তাহিক বাংলার বাণী’ (বঙ্গবন্ধু) নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করলেন। সেগুনবাগিচায় একটি জায়গা নিয়ে একটি ট্রেডেল মেশিন বসানো হলো। সেখান থেকে ‘বাংলার বাণী’ পত্রিকা প্রকাশিত হতো। মনি ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় পড়তেন। তাকেই কাগজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল’। এতে বোঝা যায়, বঙ্গবন্ধু সঠিক মানুষটিকে চিনতে ভুল করেননি।  ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তাঁর সম্পাদনায়  সাপ্তাহিক ‘বাংলার বাণী’ পত্রিকা দৈনিক পত্রিকায় রূপান্তরিত হয়। অস্থায়ী দফতর ছিল তেজগাঁয় পাসবান প্রিন্টিং। পরে পত্রিকার অফিস  ৮১, মতিঝিলে দোতলায় ছিল। ধীরে ধীরে শেখ মনি একজন শক্তিশালী প্রাবন্ধিক হিসেবে সুখ্যাতি লাভ করেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে কনভেনশনে ‘বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। একই সময়ে তিনি তেজগাঁও আঞ্চলিক শ্রমিক লীগের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। ১৯৭৩ সালের ২৩ আগস্ট তিনি বিনোদন সাপ্তাহিক ‘সিনেমা’ পত্রিকা প্রতিষ্ঠিত করেন। ১৯৭৪ সালের ৭ জুন তাঁর সম্পাদনায় ইংরেজি  দৈনিক ‘বাংলাদেশ টাইমস’ প্রকাশ করেন। তাঁর ইচ্ছা ছিল পশ্চিমবঙ্গের ‘দেশ’ পত্রিকার মতো একটি উন্নত ম্যাগাজিন প্রকাশ করার। দৈনিক পত্রিকায় তার একটি বিশেষ প্রতিবেদন রঙিন অক্ষরে প্রকাশ হওয়ার ঘটনা বাংলাদেশে প্রথম তিনিই করেছিলেন। জার্মান থেকে পত্রিকা প্রকাশের জন্য গজ অফসেট প্রিন্টিং মেশিন আমদানির সব ব্যবস্থা করেছিল ‘দৈনিক পাকিস্তান’ এবং ‘দৈনিক বাংলা’। এরপর ‘বাংলার বাণী’ই ছিল বড় ও আধুনিক প্রকাশনা ব্যবস্থা। তিনি পত্রিকার খুঁটিনাটি প্রেস, ফটোগ্রাফ, মেকআপ এবং কম্পোজ প্রভৃতির ব্যাপারে বিস্তারিত জ্ঞান রাখতেন। ‘দৈনিক ইত্তেফাক’ ও ‘পিপলস’-এ নিয়মিত প্রবন্ধ লিখতেন। পত্রিকার প্রতি ভালোবাসা এতটাই ছিল যে রাত দুইটা, তিনটায় পত্রিকার প্রথম ছাপা কপি হাতে নিয়ে বাসায় ফিরতেন। পরের দিন দশটা এগারোটার মধ্যে অফিসে চলে যেতেন। তিনি ভীষণ জ্ঞানপিপাসু এবং বইপাঠক ছিলেন। এ বিষয়ে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বীর মুক্তিযোদ্ধা হাসানুল হক ইনু এমপি বলেন, মনি ভাই অত্যন্ত ব্যক্তিত্বসম্পন্ন, নম্রভাষী এবং পড়ুয়া  মানুষ ছিলেন। আমি বুয়েটে পড়তাম বলে তিনি আমাকে স্নেহ করতেন’।

তিনিই প্রথম সম্মেলনের পরিবর্তে বার্ষিক সম্মেলনকে ‘কংগ্রেস’, দলের সভাপতি পদের পরিবর্তে চেয়ারম্যান এবং সহ-সভাপতি পদের পরিবর্তে প্রেসিডিয়াম সদস্য পদ প্রবর্তন করেছিলেন। ১৯৭৩ সালে আওয়ামী যুবলীগের প্রথম সম্মেলনে ভারতীয় কংগ্রেসের সভাপতি যুবনেতা প্রিয় রঞ্জনদাস মুন্সী  শেখ মনির ১৯৭৩ সালে বার্লিনে দশম বিশ্ব যুব সম্মেলনে শেখ মনি প্রদত্ত ইংরেজি ভাষায় রাখা বক্তব্যের ভূয়সী প্রশংসা করেন। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘ দিবসে শেখ মনির বক্তব্যের প্রশংসা করেন জাতিসংঘ বাংলাদেশ কমিটির সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আহম্মদ হোসেন।

১৯৭১-এ মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষণ শেষে ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক প্রদত্ত নৈশভোজে বাংলাদেশের যুব নেতাদের বক্তৃতা পর্বে সভাপতির ভাষণ দিয়েছিলেন প্রায় দুই ঘণ্টা। মৃত্যুর আগের দিন জেলা পর্যায়ের সম্পাদকবৃন্দের প্রশিক্ষণ কর্মসূচিতে মূল বক্তা হিসেবে চমৎকার বক্তব্য প্রদান করেছিলেন তিনি। ‘বাংলার বাণী’ সাংবাদিক কর্মচারীদের যৌথ সভায় তিনি বলেছিলেন, ‘বাংলার বাণী আমার সন্তানের চাইতেও বেশি প্রিয়। একে বাঁচিয়ে রাখতে পারলে আপনারা যেমন লাভবান হবেন, তেমনি লাভবান হবে দেশ’।

ব্যক্তি শেখ ফজলুল হক মনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন ১৯৬৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক কৃষক নেতা শহীদ আব্দুর রব সেরনিয়াবাত এবং বঙ্গবন্ধুর সেজো বোন আমেনা বেগমের দ্বিতীয় সন্তান শহীদ বেগম সামসুননেছা আরজু সেরনিয়াবাতের সঙ্গে। আপাদমস্তক পেশাদার এই মানুষটি ব্যক্তিজীবনের সঙ্গে পেশাগত ব্যস্ততা মিলিয়ে ফেলতেন না। তাই তো ১৯৭০ সালে তিনি সংবাদ সম্মেলনে পাকিস্তান সফরে যান এবং সে সময় তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র অধ্যাপক ড. শেখ ফজলে শামস পরশ (চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ) ১৯৭০ সালের ২ জুলাই জন্মগ্রহণ করেন। অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী এবং দুধের শিশু রেখে দেশমাতৃকার ডাকে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন তিনি।

একজন শেখ মনি তিনি ছিলেন স্পষ্টভাষী এবং নিজ গুণে গুণান্বিত একজন মানুষ। ছিলেন সংস্কৃতি সচেতন। তিনি উত্তম-সুচিত্রার সিনেমা দেখতেন নিয়মিত। পুলিশ তা অবগত হয়ে ঢাকার গুলিস্তান থেকে একবার তাকে গ্রেফতার করে। বাইরে থেকে যতটা কঠিন মনে হতো, আসলে তিনি ছিলেন কোমল হৃদয়ের মানুষ। তিনি তেজগাঁও এলাকার সাধারণ শ্রমিকদের খোঁজ-খবর রাখতেন এবং তাদের সমস্যা সমাধানে নিজ হাতে দায়িত্ব পালন করতেন। তাঁর বাবা শেখ নুরুল হক একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন। মা আছিয়া বেগম বঙ্গবন্ধুর মেজো বোন। তারা ছিলেন তিন ভাই তিন বোন। বঙ্গবন্ধু শেখ মনিকে রাজনৈতিক দত্তক হিসেবে বোনের কাছে আবদার করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর অনুরোধ বোন ফেলতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু যে খাঁটি জহুরি ছিলেন, তা ইতিহাসের বাঁকে এসে প্রমাণিত হয়েছে। একজন শেখ মনি বঙ্গবন্ধুর বোনের ছেলে হয়েও তিনি কখনোই ক্ষমতার অপব্যবহার করেননি। তাঁর কোন লেখায় বঙ্গবন্ধুকে তিনি ‘মামা’ বলে সম্বোধন করেননি। তাঁর প্রতিটি লেখায় ‘বঙ্গবন্ধু’ নামটিই চোখে পড়ে।

১ অক্টোবর, ১৯৭৩ সালে তাঁর একটি কলামের একপর্যায়ে বলেছেন, ‘বাংলাদেশে প্রকাশিত আর পাঁচটি সংবাদপত্র যেসব সুবিধা লাভ করেছে, স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম মুখপত্র হয়েও আমরা তার চাইতে কম সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা গ্রহণ করেছি।’ নিজ দায়িত্বে কতটা স্বচ্ছ এবং জবাবদিহি হলে এমন মাথা উঁচু করে বলতে পারেন। ‘বাংলার বাণী’ পত্রিকা অফিসে দেশি-বিদেশি বহু মানুষ আসতেন যেতেন। তদবিরের জন্য এলে তাকে বলার সাহস পেতেন না। এক্ষেত্রে মেজর জেনারেল উবান বলেন, উচ্চ সংস্কৃতিবান মানুষটি কথা কম বলতেন। তাঁর হাসি বের হয়ে আসতো একদম সরাসরি হৃদয়ের ভেতর থেকে এবং সে হাসি ছিল সংক্রামক। তাঁকে হাসতে দেখে আমার ভালো লাগতো। মুক্তির পরে আমি দেখেছি তিনি পত্রিকার কাজে এত নিবিষ্ট ছিলেন যে আমাকে তিনি খুব কম সময়ই দিতে পারতেন এবং আমি বারবার তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করতে চেষ্টা করার পর তিনি শুধু একবার ‘হ্যালো’ বলার জন্য হাজির হতেন।’ রাজনীতি আর দেশকে নিয়ে নিমগ্ন থাকায় দুই সন্তান তার স্নেহ সান্নিধ্য পেয়েছেন অল্প সময়। তাঁর বড় ছেলের স্মৃতিচারণে দেখা যায়, বাবার মৃত্যুর পর যখন তারা সব ধরনের যানবাহনে চড়ে বর্ডার পার হচ্ছিলেন তখন তিনি কান্নাকাটি করছিলেন, এমনকি ছোট ভাই তাপসও তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন, ‘আর একটু পথ, এই তো চলে আসছি। তখনও তারা জানেন না বাবা-মা নেই। কারণ, তাদের বলা হয়েছিল বাবা-মা আহত হয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশে আছেন। তিনি লিখেছেন, ‘আমি যেন বাবা মাকে চাইতে চাইতে আর না পাইতে পাইতে অতিষ্ঠ’। এ বিষয়ে ছোট পুত্র শেখ ফজলে নূর তাপস তাঁর বাবাকে নিয়ে বলেন, ‘আমার বাবা-মায়ের স্মৃতি বলতে শুধু মেঝেতে পড়ে থাকা নিথর রক্তাক্ত দুটি লাশ। এ ছাড়া আমি আর কিছুই মনে করতে পারি না’।

৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৫-এ তিনি লিখেছেন, ‘আমাদের নিজস্ব জ্ঞানচর্চার জন্য মাতৃভাষারই অনুশীলন ও প্রচলন করতে হবে’। স্পষ্টভাষী প্রাবন্ধিক ১ অক্টোবর, ১৯৭৩ সালে লিখেছেন, শেখ মনিরা জীবন বাজি রেখে মোনায়েমের কারাগারে অশেষ নির্যাতন আর ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছে। স্বাধীন বাংলাদেশে ভুঁইফোঁড় হিসেবে তাদের আবির্ভাব ঘটেনি।’

আপাদমস্তক শেখ মনিকে নিয়ে এত অল্প পরিসরে লিখে শেষ করা ভীষণ কঠিন। তাও শেষ করতেই হয়। শেষ করবো তারই গল্পগ্রন্থ গীতারায়ের কয়েকটি সংলাপ নিয়ে, ‘বুক শেলফ থেকে ‘সঞ্চয়িতা’ খানা টেনে নিলাম। নিমগ্ন হয়ে আমি কবিতা পড়ছিলাম- ‘এই বাসা ছাড়া পাখি ধায় আলো অন্ধকারে/কোন পার হতে কোন পারে/ধ্বনিয়া উঠিছে শূন্য নিখিলের পাখার ও গানে/হেথা নয়, অন্য কোথাও, অন্য কোথা অন্য কোন খানে’।

হ্যাঁ, তিনি চলে গেছেন পরপারে, রেখে গিয়েছেন তাঁর কর্ম। সেই কর্মই সাক্ষ্য দেবে তার অস্তিত্বের। তাঁর প্রতিভা মিলে যায় তাঁর নামের অর্থের সাথে। ‘ফজলুল’ শব্দের অর্থ ‘শ্রেষ্ঠত্ব’ এবং ‘হক’ শব্দের অর্থ হলো ‘আল্লাহর দয়াপ্রাপ্ত’। আসলেই তাঁর লেখায় শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ পাওয়া যায়। আর তিনি আল্লাহর দয়াপ্রাপ্ত বলে তাঁর মধ্যে বিশেষ ধরনের ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের বৈশিষ্ট্য দেখা যায়। তিনি ‘বাংলার বাণী’ পত্রিকায় ‘দূরবীনে দূরদর্শী’ শিরোনামে জাতীয় আন্তর্জাতিক বিষয়ে লিখতেন। উক্ত পত্রিকায় প্রকাশিত ৬৪টি নিবন্ধ থেকে বোঝা যায়, তিনি ছিলেন নীতি-আদর্শের দিক থেকে একজন আপসহীন মানুষ এবং ভীষণ দূরদর্শীসম্পন্ন। ১৮ ডিসেম্বর, ১৯৭২-এ প্রকাশিত তাঁর নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘খোদা না করে, বঙ্গবন্ধুকে যদি হারাই। তাহলে বাংলার এই সাড়ে সাত কোটি দুঃখী মানুষের ভাগ্যে কি আছে! সুতরাং জাতীয় স্বার্থেই তার জীবনের জন্য যে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়েছে, তার চাইতে শতগুণ কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা করার দরকার ছিল।’ কতটুকু দূরদর্শী হলে একজন মানুষ এমন ভবিষ্যদ্বাণী করতে পারেন। তিনি বর্তমানে দাঁড়িয়ে ভবিষ্যৎ কল্পনা করতে পারতেন। আর একটি প্রবন্ধে ১৮ ডিসেম্বর, ১৯৭২ সালে তিনি লিখেছিলেন, ‘আজও বাংলাদেশের বুকে একশ্রেণির লোক আমাদের অর্জিত স্বাধীনতার চারাগাছটিকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। আজও বাংলাদেশের বুকে বসে তথাকথিত পাকিস্তানের অনুচররা মুসলিম বাংলা গঠনের স্বপ্ন দেখে।’ তাঁর এই সংশয় সত্যি হয়েছিল।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়। একই দিনে বিপথগামী সেনা সদস্যের বুলেটে ৩৫ বছরে প্রাণ হারান শেখ ফজলুল হক মনি। তবে শেখ মনিরা হারান না, রানার হয়ে বেঁচে থাকেন ইতিহাসের পাতায়। প্রাচীর রোমান সাম্রাজ্যের শাসনকর্তা জুলিয়াস সিজারের একটি ইতিহাস খ্যাত উক্তি রয়েছে—‘এলাম, দেখলাম, জয় করলাম’। মাত্র ৩৬ বছর বয়সে তিনি গল্প, প্রবন্ধ লিখেছেন। দেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ করেছেন। একজন দক্ষ রাজনীতিবিদ হিসেবে প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা শেখ ফজলুল হক মনির প্রতি শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।

তথ্যসূত্র:

১.         ফকির আব্দুর রাজ্জাক এবং বিমল কর সম্পাদিত, দেশ সমাজ রাজনীতি: শেখ মনির ভাবনা, আগামী প্রকাশনী, ২০১১ইং।

২.         ফকির আব্দুর রাজ্জাক এবং বিমল কর সম্পাদিত, দূরবীণে দূরদর্শী, আগামী প্রকাশনী, ২০১১ ইং।

৩.         গীতারায়, শেখ ফজলুল হক মনি, নওরোজ কিতাবিস্তান, ১৯৭২ইং ।

৪.         শেখ ফজলুল হক মনি, এক অনন্য রাজনীতির প্রতিকৃতি, ফকির আব্দুর রাজ্জাক, আগামী প্রকাশনী, ২০১০ইং।

৫.         ফ্যান্টমস অব চিটাগং: দি ফিফথ আর্মি ইন বাংলাদেশ, মেজর জেনারেল (অব.) এস এস উবান, অনুবাদ, ঘাস ফুল নদী, ২০১৪ইং

৬.         ‘সাপ্তাহিক ‘বাংলার বাণী’ পত্রিকা প্রকাশ করতেন: প্রধানমন্ত্রী’, চ্যানেল আই অনলাইন, ১ অক্টোবর, ২০২০ইং।

৭.         শেখ ফজলুল হক মনি: রাজনৈতিক যুগসন্ধিক্ষণের প্রতিকৃতি, বাংলা নিউজ২৪।

৮.         নির্বাসনের দিনগুলো, শেখ ফজলে শামস পরশ, চেতনায় বঙ্গবন্ধু, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ, ২০২১ইং

৯.         ১৫ আগস্ট, কালরাত্রির সেই দুঃসহ স্মৃতি, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ, ২০২১ইং

১০.       বাংলা একাডেমির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক ড. রফিকুল ইসলামের সাক্ষাৎকার, ০১.০৯.২০২১ইং

১১.       হাসানুল হক ইনু, এমপির সাক্ষাৎকার, ০৫.০৯.২০২১ইং

১২.       ‘ভয়াল সেই রাতের বর্ণনা দিলেন শেখ ফজলে নূর তাপস’, নিউজ২৪, ১৫.০৮.২০১৮ইং

১৩.      শেখ ফজলুল হক মনির মেজো বোন শেখ রেবা রহমানের সাক্ষাৎকার, ০৮.০৯.২০২১ইং

১৪.       শেখ ফজলুল হক মনির খালাতো বোন হুরুন্নেসা এবং শিউলি সেরনিয়াবাতের সাক্ষাৎকার, ০১.০৯.২০২১ইং

লেখক: অধ্যাপক, লোকপ্রশাসন বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

                                                                                                                                                                                                                                                                       

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে ‘বড় পরিবর্তন’ দেখছে না যুক্তরাষ্ট্র
বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতিতে ‘বড় পরিবর্তন’ দেখছে না যুক্তরাষ্ট্র
পদে থেকেই ইউপি চেয়ারম্যানরা উপজেলা নির্বাচন করতে পারবেন
পদে থেকেই ইউপি চেয়ারম্যানরা উপজেলা নির্বাচন করতে পারবেন
জীবনানন্দ পুরস্কার পেলেন জাহিদ হায়দার ও মোস্তফা তারিকুল আহসান
জীবনানন্দ পুরস্কার পেলেন জাহিদ হায়দার ও মোস্তফা তারিকুল আহসান
শাকিবের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের জায়গা অন্যরকম: চঞ্চল
শাকিবের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্কের জায়গা অন্যরকম: চঞ্চল
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ