X
মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪
১০ বৈশাখ ১৪৩১

তথ্য প্রযুক্তির উন্নয়ন এবং নারীর সমতায়ন

ফারজানা মাহমুদ
১৬ মার্চ ২০২২, ১৭:৫৩আপডেট : ১৬ মার্চ ২০২২, ১৭:৫৩
ফারজানা মাহমুদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালে জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) সদস্য পদ লাভ করে। ১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধু জাতিসংঘের ২৯তম অধিবেশনে ‘প্রযুক্তি’ ‘মনুষ্য’ ‘মর্যাদাপূর্ণ জীবন’ ও ‘সমাজের সুষম বণ্টনের’ ওপর জোর মতামত দেন। আর্থ-সামাজিক জরিপ, আবহাওয়ার তথ্য আদান-প্রদানে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু বেতবুনিয়ায় স্যাটেলাইটের আর্থ-স্টেশন উদ্বোধন করেন। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৮ সালে জননেত্রী শেখ হাসিনা দেশকে একটি সুখী, সমৃদ্ধ ও জ্ঞানভিত্তিক ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের ঘোষণা দেন। ঘোষণায় বলা হয়, ২০২১ সালে স্বাধীনতার ৫০ বছরে দেশ পরিণত হবে ডিজিটাল বাংলাদেশে। বঙ্গবন্ধু কন্যার দেওয়া প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়িত হয়েছে।

দেশে বর্তমানে মোবাইল সংযোগের সংখ্যা ১৮ কোটির অধিক। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছে প্রায় ১৩ কোটি। ই-গভর্নমেন্ট কার্যক্রমে প্রচলিত সেবা প্রদানের পদ্ধতির ডিজিটালাইজেশন করা হয়েছে। ডিজিটাল পরিষেবাগুলোর কয়েকটি উদাহরণ হলো– শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির জন্য নিবন্ধন, পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ, বিদেশে চাকরির জন্য নিবন্ধন, জন্মনিবন্ধন, অফিসিয়াল ফরম সংগ্রহ, অনলাইনে ট্যাক্স রিটার্ন জমা দেওয়া, অনলাইন টেন্ডারিং ইত্যাদি। অনলাইন ব্যাংকিং সিস্টেম দেশের আর্থিক কার্যক্রমকে গতিশীল করেছে। থানায় অভিযোগ দায়েরের জন্য এসএমএস পরিষেবা, ইউটিলিটি পরিষেবার জন্য অনলাইন বিল পেমেন্ট, এবং ই-পাসপোর্ট, টেলিমেডিসিন সেবা, প্রশাসনিক কার্যক্রমের জন্য ভিডিও কনফারেন্সিং ই-পরিষেবার উদাহরণ। বিচার বিভাগের কাজ ত্বরান্বিত করতে, জাতীয় হেল্পলাইনগুলোয় সেবা দিতে এবং বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীর টিকাদান নিশ্চিতেও ডিজিটাল পদ্ধতির প্রয়োগ হচ্ছে। প্রায় পাঁচ হাজার ইউনিয়ন ইনফরমেশন সার্ভিস সেন্টার স্থাপন, মোবাইল মানি অর্ডার এবং পোস্টাল ক্যাশ কার্ডের প্রবর্তন সাম্প্রতিক অতীতের উল্লেখযোগ্য অর্জন। ইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্র, জেলা তথ্য সেল, জাতীয় তথ্য সেলও বৈপ্লবিক সংযোজন।

মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় মহিলা সংস্থা নারীদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণের জন্য জেলাভিত্তিক প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। এই সংস্থা ‘তথ্য আপা’ নামে একটি ডিজিটাল ডাটাবেস তৈরি করেছে। এখন আইসিটি ক্লাস মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজে একটি বাধ্যতামূলক বিষয়। লকডাউনে শিক্ষার্থীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম যেন থেমে না যায় সে জন্য প্রাথমিক, মাধ্যমিক, মাদরাসা ও কারিগরি পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের জন্য ডিজিটাল কনটেন্ট তৈরি করা হয়েছে এবং অনলাইনে শ্রেণি কার্যক্রম চলেছে করোনার সময়ে। বর্তমানে প্রায় ২৫ শতাংশ নারী আইসিটি সেক্টরে পড়াশোনা করছেন।

সারা দেশে প্রায় ৬ লাখ ৫০ হাজার ফ্রিল্যান্সার রয়েছে। মাত্র কয়েক বছরে ১০ হাজার ৫০০ নারী উদ্যোক্তা তৈরি হয়েছে। আইসিটি বিভাগের এলআইসিটি প্রকল্প থেকে, মাস্টার ক্লাসে অংশগ্রহণ করে প্রান্তিক গ্রামীণ নারীরা ডিজিটাল বিপণন এবং উৎপাদন থেকে শুরু করে বিক্রয় পর্যন্ত একটি ব্যবসায়িক মডেল তৈরি সম্পর্কে ধারণা লাভ করেছে। দেশে ৮ হাজার শেখ রাসেল ডিজিটাল কম্পিউটার ল্যাব স্থাপন করা হয়েছে। শতবর্ষ স্বপ্ন আশা প্রকল্পের মাধ্যমে ১০০ কোটি টাকা দিয়ে ৫০টি স্টার্টআপ প্রদান করা হয়েছে, এতে ন্যূনতম ৩০ শতাংশ নারী উদ্যোক্তা অন্তর্ভুক্ত রাখার অঙ্গীকার করা হয়েছে।

বর্তমানে আইসিটি খাতে রফতানি ব্যয় ১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অনলাইন শ্রমশক্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। ২০১৭ সালে শুরু হওয়া সাউথ-সাউথ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে সোমালিয়া, নেপাল, ভুটান, মালদ্বীপ, ফিজি, ফিলিপাইন ও প্যারাগুয়ের সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে এসডিজি, ওপেন গভর্নমেন্ট ডাটা চেঞ্জ ল্যাবসহ বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান এবং সেবা বা সিস্টেম আদান-প্রদান করা হচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে নানা উদ্যোগ ও কার্যক্রম সফলভাবে সম্পন্ন করার স্বীকৃতিস্বরূপ বাংলাদেশ অর্জন করেছে জাতিসংঘের সাউথ-সাউথ কো-অপারেশন অ্যান্ড ভিশনারি অ্যাওয়ার্ড, আইসিটি সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট অ্যাওয়ার্ড, ওয়ার্ল্ড সামিট অন দ্য ইনফরমেশন সোসাইটি (ডব্লিউএসআইএস) উইটসা, অ্যাসোসিও অ্যাওয়ার্ডসহ অসংখ্য আন্তর্জাতিক পুরস্কার।

বিগত একযুগে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নসহ শিক্ষা, শ্রমশক্তিতে অংশগ্রহণ এবং মজুরির মতো ক্ষেত্রগুলোতে লিঙ্গবৈষম্য দূর করার ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক অগ্রগতি হয়েছে। তবে, ডিজিটাল প্রযুক্তি ব্যবহারে সুযোগ লাভের ক্ষেত্রে লিঙ্গ ব্যবধান এখনও বেশি। যদিও নারী আমাদের জনসংখ্যার অর্ধেক, আইসিটি সেক্টরে তাদের অংশগ্রহণ এখনও সন্তোষজনক নয়। দেশে ৮৬ শতাংশ পুরুষের কাছে মোবাইল ফোন রয়েছে যেখানে শুধু ৬১ শতাংশ নারী মোবাইল ফোনের মালিক। ৪০ শতাংশ পুরুষের তুলনায় ৩১ শতাংশ প্রযুক্তি-অক্ষম নারীদের ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে।  তবে অধিকাংশ পুরুষ মনে করে একজন নারীকে প্রযুক্তি ব্যবহার করার জন্য শিক্ষিত হতে হবে, যা পুরুষদের জন্য প্রয়োজনীয় নয়। এর পেছনের কারণ হলো গ্রামীণ সমাজে নারীর প্রতি ধারণা, পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব ও সংস্কৃতি।

বিআইজিডি জরিপ অনুসারে বাংলাদেশে ১৪-১৬ বছর বয়সী ১/৪ অংশ গ্রামীণ ছেলেরা স্মার্টফোন ব্যবহার করে, তবে মাত্র ৮ শতাংশ মেয়েরা এই সুবিধা পায়। এই ব্যবধান বয়সের সঙ্গে বাড়তে থাকে, এটি পুরুষ এবং নারীদের মধ্যে আর্থ-সামাজিক বৈষম্যকে আরও বাড়িয়ে তুলতে পারে। অবাধ গতিশীলতার কারণে, পুরুষ যখন প্রয়োজন তখন মোবাইল ডাটা কিনতে পারে। কিন্তু মেয়েরা সর্বক্ষেত্রে তা পারে না, এর পেছনেও রয়েছে পুরুষ ও নারীর প্রতি সামাজিক নিয়মের প্রভাব। ছেলেদের অবাধে বাইরে চলাফেরা করতে দেওয়া হয় কিন্তু মেয়েদের অবাধ চলাফেরা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।

প্রযুক্তি ব্যবহারের সুবিধায় লিঙ্গ বিভাজন উচ্চ আয়ের পরিবারগুলোতে দৃশ্যমান নয়; ছেলে এবং মেয়ে উভয়েরই নিজস্ব স্মার্টফোন এবং সার্বক্ষণিক ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে। আবার অবিবাহিত নারীদের তুলনায় বিবাহিত নারীরা ইন্টারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে অনুকূল অবস্থানে রয়েছে। অবিবাহিত নারীদের ফোন ব্যবহার করার অনুমতি নেই। মেয়েদের বিয়ের বাইরে সম্পর্কে জড়ানোর ভয় তাদের মোবাইল ফোন ব্যবহারে প্রতিবন্ধক। কিন্তু সবাইকে অবশ্যই উপলব্ধি করতে হবে যে এই অনুশাসনগুলো নারীদের শিক্ষা এবং কর্মসংস্থানে তাদের সম্ভাবনা অন্বেষণ করতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

বেসিস-এর সমীক্ষা অনুসারে আইসিটি সেক্টরে নারীর অংশগ্রহণ ১২ থেকে ১৩ শতাংশ, আর নারী উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে তা ২ বা ৩ শতাংশে নেমে আসে। প্রযুক্তি ব্যবহারে সক্ষম নারীদের মাত্র ৩ শতাংশ কম্পিউটার ব্যবহার করেন, যেখানে পুরুষদের মধ্যে এই হার ১১ শতাংশ। কর্মক্ষেত্রে নারীর ক্রমবর্ধমান অংশগ্রহণের পরও সমান অংশগ্রহণের দিক থেকে আইসিটি শিল্প অনেক পিছিয়ে রয়েছে। দেশের আইসিটি কোম্পানিগুলোর মাত্র ১ শতাংশ নারীদের নেতৃত্বে রয়েছে। উপরন্তু লিঙ্গ পক্ষপাত এবং কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগে পুরুষের আধিপত্য, পরিবেশগত এবং সামাজিক অনুশাসনগুলো আইটি সেক্টরে নারীদের অগ্রগতিকে অবরুদ্ধ করে চলেছে। ডিজিটাল অধিগম্যতা এবং দক্ষতার এই লিঙ্গভিত্তিক ব্যবধান ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে প্রতিবন্ধক।

যেহেতু সব সরকারি-বেসরকারি পরিষেবাকে ই-পরিষেবাতে রূপান্তরিত করা হচ্ছে, তাই নারী ও পুরুষ উভয়ের জন্য আইসিটি ব্যবহারের সুযোগ এবং দক্ষতা ক্রমশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে।

বিগত কয়েক বছরে বাংলাদেশের ই-কমার্স ব্যবসায় দ্রুত সম্প্রসারিত হয়েছে, বহু সংখ্যক ভোক্তা অনলাইনে জিনিসপত্র ক্রয় করছেন এবং এর সঙ্গে নারী উদ্যোক্তাদের সংখ্যাও বেড়েছে। নারীদের দ্বারা পরিচালিত অনলাইন ব্যবসার প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে, তাদের বিরুদ্ধে অনলাইন সহিংসতা উদ্বেগজনক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ইন্ডাস্ট্রিয়াল ডেভেলপমেন্ট লিজিং কোম্পানি অফ বাংলাদেশ লিমিটেডের মাসিক ব্যবসায়িক মূল্যায়ন (২০১৯) অনুসারে, ফেসবুকে ৩ লাখের বেশি বাংলাদেশি খুচরা বিক্রেতা রয়েছে, যাদের ৫০ শতাংশ নারী। এই মূল্যায়নে বলা হয়েছে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারকারীদের ৭৯ শতাংশের বেশি কখনও না কখনও অনলাইনে হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হয়েছেন, যার মধ্যে নারী প্রায় ৫৩ শতাংশ।

প্রথম আলো-প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের ২০২০ জরিপে এসেছে, ভুয়া আইডি খোলার মাধ্যমে হয়রানির শিকার হয়েছেন ২৪ শতাংশ নারী। অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগত ছবি, তথ্য, ভিডিও প্রচারের শিকার হয়েছেন ৩৪ শতাংশ, যাদের  মধ্যে নারী ১৮ শতাংশ। অনলাইনে সহিংসতার কারণে মানসিক চাপের মধ্যে পড়া ব্যক্তিদের ৪৭ শতাংশ নারী। ৩২ শতাংশের বেশি নারী জানিয়েছেন, এসব হয়রানি তাঁদের স্বাধীনভাবে চলাচল ও মতপ্রকাশে বাধা তৈরি করছে।  নিরাপত্তাহীনতা তৈরি হয়েছে বলে জানিয়েছেন ২৫ শতাংশ নারী। সামাজিকভাবে হেয় ও বিব্রত হয়েছেন ১৭ শতাংশ নারী, এ ছাড়া ২৪ শতাংশ আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভুগেছেন, ১৯ শতাংশ নিপীড়িত হচ্ছেন—এমন অনুভব করেছেন বলে জানিয়েছেন। ১৪ শতাংশের বেশি হয়রানি ও সহিংসতার শিকার হয়ে অনলাইন ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার বন্ধ করে দিয়েছেন। প্রথম আলো–প্ল্যান ইন্টারন্যাশনালের জরিপে এসেছে, অনলাইনে হয়রানি বা সহিংসতার শিকার হলে কীভাবে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত, সে সম্পর্কে জানেন না প্রায় ৪০ শতাংশের বেশি নারী।

২০২০ সালে বিশ্বের ১৯৪টি দেশের সাইবার নিরাপত্তায় গৃহীত আইনি ব্যবস্থা, প্রযুক্তিগত দক্ষতা, সাংগঠনিক ব্যবস্থা, সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং পারস্পরিক সহযোগিতার ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা সূচকে বাংলাদেশ আইটিইউ-তে ৫৩তম স্থানে ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও ২০২০ সালেই বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন, পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন ও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ আইনে সাইবার অপরাধসংক্রান্ত ৬ হাজার ৯৯টি মামলা হয়েছে, যার অধিকাংশই নারীরা করেছেন। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আওতাধীন মামলাগুলোর প্রায় ৩৫ শতাংশই নারীদের দায়ের করা। সাইবার অপব্যবহার জনিত অপরাধের খুব কম শতাংশই রিপোর্ট করা হয়। অনেক নারী জানেন না কোথায় যেতে হবে সাহায্যের জন্য। পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিটে এই ধরনের অপরাধের বিরুদ্ধে রিপোর্ট করা যায়। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগের অধীনে অভিযোগ ও পরামর্শের জন্য দুটি কলসেন্টার রয়েছে, যেসব অভিযোগকারী আইনি ব্যবস্থা নিতে চান না, কিন্তু  প্রযুক্তিগত সহায়তা চান এখানে তাঁদের সহায়তা করা হয়। দীর্ঘ আইনি প্রক্রিয়া, অর্থাভাবে অনেক ভুক্তভোগী আইনি সহায়তা নেন না। আবার কম বয়সী নারীদের পরিবার সমাজে আরও হেনস্তা হওয়ার ভয়ে ঘটনাগুলো চেপে যায় এবং ভুক্তভোগীকে শাসন করার মধ্য দিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে চায়।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান উপলব্ধি করেছিলেন যে জাতীয় উন্নয়নের জন্য নারীর ক্ষমতায়ন জরুরি। তাই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্র ও জনজীবনের সব পর্যায়ে নারীদের সম অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয় ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে রাষ্ট্রের বিশেষ বিধান প্রণয়নের ক্ষমতার সংযোজন করা হয় (অনুচ্ছেদ ২৮) । আবার ১০ নম্বর অনুচ্ছেদে ন্যায়ানুগ সমাজ গঠনের অঙ্গীকার করা হয়েছে। সর্বোপরি ১৯ নম্বর অনুচ্ছেদে সুনাগরিকদের মধ্যে সুযোগের সমতা, সমাজের সুষম বণ্টন এবং সামাজিক অর্থনৈতিক অসাম্য বিলোপের প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়। জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা আইসিটি খাতে নারীর ক্ষমতায়ন ও সমতায়নে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। রূপকল্প ২০২১-এর মাধ্যমে সরকার নারী উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করেছে। ন্যাশনাল ইনফরমেশন অ্যান্ড কমিউনিকেশন টেকনোলজি (আইসিটি) পলিসি ২০১৫ লিঙ্গ সমতার ওপর জোর দিয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের জন্য দেশ লিঙ্গ সমতা ও নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করার নানা কৌশল গৃহীত ও বাস্তবায়িত হয়েছে।

প্রযুক্তিগত অগ্রগতি নারীদের ফ্রিল্যান্স এবং ঘরে বসে কাজ করতে সক্ষম করে, একই সঙ্গে পরিবার এবং ক্যারিয়ার পরিচালনা করার সুযোগ দিয়ে ব্যবসায় এবং সমাজের শ্রেণিবিন্যাসের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করতে পারে। আইটি সেক্টর বিপুল সংখ্যক বৈচিত্র্যময় এবং সৃজনশীল কাজের ক্ষেত্র তৈরি করে, যা নারীদের অর্থ উপার্জন করতে এবং পরিবারকে সমর্থন করতে, আরও স্বাধীন হতে সুযোগ তৈরি করে। তবে এর জন্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য কমিয়ে সামাজিক সমতা নিশ্চিত করা এবং নারী-পুরুষের ডিজিটাল বিভাজন এবং এ  সংক্রান্ত আদর্শিক বাধাসমূহ মোকাবিলা জরুরি। স্কুলে থাকাকালীন সময় থেকেই নারীদের প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ প্রদানের পাশাপাশি উদ্যোক্তা হিসেবে আত্মপ্রকাশের সুযোগ তৈরি করা প্রয়োজন।

লিঙ্গ সমতা শুধু একটি মৌলিক মানবাধিকার নয়, এটি একটি সমৃদ্ধ, আধুনিক অর্থনীতির মূল, যা টেকসই এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করে। প্রযুক্তিগত রূপান্তরে অংশগ্রহণ নারীর অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং বৃহত্তর লিঙ্গ সমতা অর্জনে অবদান রাখতে পারে। শ্রমবাজারে লিঙ্গ সমতা বৃদ্ধি, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বাড়ানো এবং আরও টেকসই অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল বিশ্ব গড়ে তোলার জন্য নীতিমালা প্রণয়নের পাশাপাশি সবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের প্রয়োজনও আছে। প্রযুক্তিতে নারীর নিরাপদ প্রবেশাধিকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনলাইনে হয়রানির শিকার নারীকে আইনি সহায়তা নিতে ভুক্তভোগীদের উদ্বুদ্ধ  করতে আইনের প্রচার ও দ্রুত প্রয়োগ জরুরি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অনলাইনে কিশোরী ও নারীর নিরাপত্তা বিষয়ক ধারা সংযোজনেরও প্রয়োজন আছে। ডিজিটাল মাধ্যমে নারীবিদ্বেষী প্রচারণা চালানো হলে কিংবা কোনও নারীর প্রতি সহিংসতা বা অপরাধমূলক মন্তব্য করলে সেই মন্তব্যকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আওতায় আনতে হবে। নারীর প্রতি ঘৃণাবাচক প্রচারণাকে বাকস্বাধীনতা নয় বরং অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে। সর্বোপরি পারিবারিক জীবনে নারীর মর্যাদা ও সম্পত্তিতে নারীর সম-অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশ এখন স্বপ্ন নয়, সত্যি, তবে এই ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল যেন প্রতিটি নারী সমানভাবে উপভোগ করতে পারে তার জন্যে সামাজিক ও পারিবারিক পরিমণ্ডলে নারীর সমতায়ন জরুরি।

লেখক: ব্যারিস্টার; গবেষক ও অ্যাকটিভিস্ট
 
 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
গরমে রাস্তায় পানি ছিটানোর সুপারিশ সংসদীয় কমিটির
গরমে রাস্তায় পানি ছিটানোর সুপারিশ সংসদীয় কমিটির
মাটি কাটার সময় বেরিয়ে এলো রাইফেল, গ্রেনেড ও মর্টারশেল
মাটি কাটার সময় বেরিয়ে এলো রাইফেল, গ্রেনেড ও মর্টারশেল
২৩ মিনিটে জামালকে তিন গোল দিয়ে সেমিফাইনালে পুলিশ
২৩ মিনিটে জামালকে তিন গোল দিয়ে সেমিফাইনালে পুলিশ
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ