X
বুধবার, ২৮ মে ২০২৫
১৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২

‘পদ্মা সেতু’, ‘নির্মাণ ব্যয়’ এবং বিএনপির অপপ্রচার

মোহাম্মদ এ. আরাফাত
১৮ জুন ২০২২, ১৪:৫০আপডেট : ১৮ জুন ২০২২, ২১:০৫

সেতু বিভাগের আয়-ব্যয়ের হিসাবে দেখা যায়, মূল সেতুতে খরচ হয়েছে ১২ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা। ভূমি অধিগ্রহণ ও নদী শাসনসহ অন্যান্য সব কিছু নিয়ে পুরো প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। অথচ তারেক রহমান বলেছেন– পদ্মা সেতু প্রকল্পে নাকি ব্যয় হয়েছে ৫০ হাজার কোটি টাকা। ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বিভিন্ন সময়ে বলেছেন, পদ্মা সেতু প্রকল্পে ব্যয় হয়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা। আমি যদি প্রশ্ন করি, এই ৪০-৫০ হাজার কোটি টাকার হিসাব তারা কোথায় পেলেন? বিএনপির চুনোপুঁটিগুলোও তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে একই রকম অপপ্রচার করেছে। এখানে পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে বিএনপি নেতারা মিথ্যা অপপ্রচার করছে। মিথ্যা অপপ্রচারের মাধ্যমে মানুষকে বিভ্রান্ত করাই তাদের কাজ। বিএনপি নিজেরা যেহেতু অতীতে বিভিন্ন সময়ে সরকারে থাকা অবস্থায় কোনও কাজ করতে পারেনি, তাই মিথ্যার আশ্রয় নেওয়া ছাড়া আর উপায় কি?

পদ্মা সেতুর খরচ কেন বাড়লো?

১. প্রাথমিক পরিকল্পনায় সেতুটি ছিল একতলা। পরবর্তীতে সেতুর নকশা পরিবর্তন করে রেললাইন সংযুক্ত করে সেতুটিকে দোতলা করা হয়।

২. প্রাথমিক পরিকল্পনায় সেতুর দৈর্ঘ্য ধরা হয়েছিল ৫.৫৮ কিলোমিটার, যা পরে বেড়ে দাঁড়ায় ৬.১৫ কিলোমিটার। অর্থাৎ পানির উপরিভাগের সেতুর দৈর্ঘ্য ০.৫৭ কিলোমিটার বেড়ে যায়। কিন্তু পানির বাইরেও ভায়াডাক্টসহ সেতুর কিছু অংশ আছে, এটি সংযোগ সড়ক নয়, সেতুরই অংশ। পানির বাইরে ভায়াডাক্টসহ সেতুর দৈর্ঘ্য ৩.৬৯ কিলোমিটার। পানির অংশ এবং পানির বাইরের অংশসহ পুরো সেতুর দৈর্ঘ্য ৯.৮৪ কিলোমিটার। পানির ওপরের অংশে মূল সেতুতে ০.৫৭ কিলোমিটার বেড়ে যাওয়ায়, পানির বাইরের অংশসহ পুরো সেতুর দৈর্ঘ্য আসলে ১ কিলোমিটারের বেশি বেড়ে যায়।

৩. প্রাথমিক পরিকল্পনায় সেতুর ৪১টি স্প্যানের মধ্যে ৩টি স্প্যান একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় রাখার ব্যবস্থা ছিল, (Navigation) জাহাজ চলাচলের জন্য। পরবর্তী সময়ে সংশোধিত বাজেটে ৪১টি স্প্যানেরই উচ্চতা বাড়িয়ে দেওয়া হয়।

৪. প্রাথমিক পরিকল্পনায় ভূমি অধিগ্রহণের আনুমানিক পরিকল্পনা ছিল ২ হাজার ৭৭৭ একর জমি, যা পরে বাস্তবে গিয়ে দাঁড়ায় ৬ হাজার ৬৫৫ একর। অর্থাৎ আড়াই থেকে তিনগুণ বেড়ে যায় এবং জনস্বার্থে ভূমি অধিগ্রহণ বাবদ ক্ষতিপূরণের পরিমাণও তিনগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়।

বাংলাদেশের ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনের খরচের সঙ্গে চীন বা ভারতের তুলনা একমাত্র কোনও অজ্ঞই করবে। চীনে ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনের কোনও খরচ নেই। তাছাড়া চীনে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে বাস করে ১৫৩ জন মানুষ। ভারতে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে বাস করে ৪৬৪ জন মানুষ আর বাংলাদেশে প্রতি বর্গ কিলোমিটারে বাস করে ১ হাজার ২৬৫ জন মানুষ। বাংলাদেশের জনসংখ্যার ঘনত্ব ভারতের থেকেও তিনগুণ বেশি, স্বাভাবিকভাবেই এখানে ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসনের খরচ অনেক বেশি হয়।

৫.  প্রাথমিক পরিকল্পনায় ফেরিঘাট স্থানান্তরের ব্যয় ধরা ছিল না, যা পরে সংশোধিত বাজেটে ধরা হয়।

৬.  প্রাথমিক পরিকল্পনায় নিরাপত্তার জন্য সেনাবাহিনীর safety team নিয়োগ ও নৌযান সংগ্রহের বিষয়টি ছিল না, যা পরে সংশোধিত বাজেটে ধরা হয়।

৭. দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রের কারণে প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ দেরি হয়ে যায় এবং এর ফলে ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য ৬৮.৬৫ থেকে ধাপে ধাপে ৮৪.৮০ হয়ে যায়। করোনাকালেও দুই বছর সেতু নির্মাণের অগ্রগতি কিছুটা ব্যাহত হয়। ডলারের বিনিময় মূল্য ২৪ শতাংশ বেড়ে যায়। এছাড়াও আন্তর্জাতিক বাজারের বিভিন্ন পণ্য সামগ্রীর মূল্যও বৃদ্ধি পায়।

৮. বুয়েটের অধ্যাপক ড. সাইফুল আমিন বলেছেন, পদ্মার তলায় মাটির বিশেষ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্য কিছু কিছু জায়গায় পাইল ড্রাইভ করতে গিয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী হ্যামার দিয়ে ড্রাইভ করেও ১২০ মিটারের থেকে বেশি ড্রাইভ করা সম্ভব হয়নি। সেক্ষেত্রে প্রকৌশলীদের নকশায় পরিবর্তন করে পাইলের সংখ্যা বাড়াতে হয়েছে।

৯. ২০০৭ সালের প্রাথমিক পরিকল্পনায় বিদ্যুৎ, গ্যাস ও ফাইবার অপটিক্যাল কেবল সংযুক্ত করা ছিল না, যা পরবর্তী সময়ে সংযুক্ত করা হয়েছে।

সবচেয়ে বড় কথা, ২০১১ সালে প্রথম সংশোধিত (DPP) বাজেটেই পদ্মা সেতুর ব্যয় ৩০০ কোটি ডলারে বর্ধিত করা হয়। বিশ্বব্যাংক তখনও পদ্মা সেতু প্রকল্পের সঙ্গেই ছিল। ৩০০ কোটি ডলারের মধ্যে বিশ্বব্যাংকের ১২০ কোটি ডলার দেওয়ার কথা ছিল। বিশ্বব্যাংক প্রকল্পের সঙ্গে থাকলে জবাবদিহি এবং স্বচ্ছতা থাকে বলে যারা দাবি করছে, তাহলে তারা এখন কী বলবেন? বিশ্বব্যাংকের অধীনেই তো (২০১১ সালে) পদ্মা সেতুর বাজেট প্রথম সংশোধিত হয় এবং প্রকল্প খরচ ৩০০ কোটি ডলার তথা ২০ হাজার ৫০০ কোটি টাকা করা হয়। এই ৩০০ কোটি ডলারই পরবর্তী সময়ে ডলারের বিপরীতে ৮৪.৮০ টাকা বিনিময় হারে হিসাব করলে ২৫ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা হয়ে যায়।

তাহলে অপপ্রচারকারীরা কেন প্রশ্ন করছে ১০ হাজার কোটি টাকার বাজেট কীভাবে বেড়ে গেলো? তাদের কি প্রশ্ন করা উচিত নয়, ২৫ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা থেকে মোট ব্যয় কত বেড়েছে? যেখানে বিশ্বব্যাংক থাকা অবস্থাতেই পদ্মা সেতুর বাজেট আর ১০ হাজার কোটি টাকা থাকেনি, বেড়ে ২৫ হাজার ৪৪০ কোটি টাকা হয়ে গিয়েছিল, সেখানে ১০ হাজার কোটি টাকার বাজেটের সঙ্গে এই তুলনা করার চালাকির উদ্দেশ্যটা কী? পদ্মা সেতু প্রকল্পে মোট ব্যয় হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিশ্বব্যাংককে পদ্মা সেতু প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়ার পর থেকে মোট বাজেটে খরচ বেড়েছে ৪ হাজার ৭৫৩ কোটি টাকা। সেই খরচ বাড়ার কারণগুলো আমি ইতোমধ্যে উল্লেখ করেছি।

বিশ্বব্যাংক ইউনূস-হিলারির ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে পদ্মা সেতুতে দুর্নীতির মিথ্যা অভিযোগ এনেছিল। পরে তা কানাডার আদালতে খারিজ হয়ে যায়। কানাডার আদালত কোনও প্রমাণ না পেয়ে দুর্নীতির সেই মিথ্যা অভিযোগকে ‘ট্র্যাশ’ বা ‘আবর্জনা’ বলে উল্লেখ করে। এই রায় আসার পর বিশ্বব্যাংক বিব্রত হয়েছে এবং প্রশ্নবিদ্ধও হয়েছিল।

সম্প্রতি বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, যেভাবে পদ্মা সেতু প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হয়েছে এবং যে ধরনের নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া গেছে তাতে বলার কোনও সুযোগ নেই যে এই প্রকল্পে দুর্নীতি হয়েছে।

ভূপেন হাজারিকা সেতুর খরচের সঙ্গে তুলনা:

১. ভূপেন হাজারিকা সেতু একতলা, অন্যদিকে পদ্মা সেতু দোতলা।

২. ভূপেন হাজারিকা সেতুর প্রস্থ ১৩ মিটার, অন্যদিকে পদ্মা সেতুর প্রস্থ ১৮.১০ মিটার।

৩. ভূপেন হাজারিকা সেতুর পাইল লোড ক্ষমতা ৬০ টনের কিছু বেশি, অন্যদিকে পদ্মা সেতুর পাইল লোড ক্ষমতা ৮ হাজার ২০০ টন।

৪. ভূপেন হাজারিকা সেতুর ওজন নেওয়ার ক্ষমতা ৬০ টন, অন্যদিকে পদ্মা সেতুর ওজন নেওয়ার ক্ষমতা ১০ হাজার টন।

৫. ভূপেন হাজারিকা সেতুর পিলারের ওজন ১২০ টন, অন্যদিকে পদ্মা সেতুর পিলারের ওজন ৫০ হাজার টন।

দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, পাইল লোড ক্ষমতা, পিলারের ওজন, সেতু ওজন নেওয়ার ক্ষমতা– এগুলো সবকিছু হিসাব করলে পদ্মা সেতু ভূপেন হাজারিকা সেতুর থেকে ১৩৩ গুণ ভারী এবং শক্তিশালী একটি সেতু। সেই হিসেবে পদ্মা সেতু নির্মাণের ব্যয় হওয়া উচিত ছিল ভূপেন হাজারিকা সেতু নির্মাণ ব্যয়ের থেকে ১৩৩ গুণ বেশি। কিন্তু তা হয়নি, কারণ এই হিসাবগুলো সাধারণ ঐকিক নিয়মে হয় না।

বুয়েটের অধ্যাপক ড. শামসুল হক বলেছেন, “সেতু নির্মাণের যত সরঞ্জাম প্রয়োজন, আমরা তার সবকিছু বিদেশ থেকে আমদানি করি। কাজেই অন্য দেশের সেতু নির্মাণের খরচের সাথে হুবহু তুলনা করা যায় না এবং খরচ কম-বেশি হয় নদীশাসনের ওপর ভিত্তি করে।”

খালেদা জিয়ার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন নিয়ে ফখরুলের মিথ্যাচার:

প্রকৃতপক্ষে ১৯৯৮ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপানের সহযোগিতায় সম্ভাব্যতা যাচাই ও সমীক্ষা করিয়ে ২০০১ সালের ৪ জুলাই, মাওয়া-জাজিরা প্রান্তে পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরে ২০০১ সালে অক্টোবরে ক্ষমতায় এসে বিএনপি মাওয়া-জাজিরা প্রান্তে সেতু নির্মাণ বাতিল করে।

বিএনপি নতুনভাবে সমীক্ষা করায় পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া প্রান্তে সেতু নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাই করে। কিন্তু পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া প্রান্তে সেতু নির্মাণ সম্ভব ছিল না বলে সমীক্ষায় বলা হয় এবং মাওয়া-জাজিরা প্রান্তেই সেতু নির্মাণের সুপারিশ করা হয়।

বিএনপি সরকার পরে এই সেতু প্রকল্প নিয়ে আর এগোয়নি। খালেদা জিয়া পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর কখনোই স্থাপন করেননি। বাংলাদেশের কোনও গণমাধ্যম অনুসন্ধান করে কোথাও খালেদা জিয়ার ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের কোনও চিহ্নই খুঁজে পায়নি।

সম্প্রতি ফেসবুকের ফ্যাক্ট চেকার ওয়চ-ডগ ‘FactWatch’ পরিষ্কার বলে দিয়েছে, ফখরুলের পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের দাবিটি মিথ্যা এবং বানোয়াট।

মজার ব্যাপার হলো, খালেদা জিয়া পদ্মা সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছে এমন বানোয়াট দাবির কিছু দিন আগেই ফখরুল বলেছিল পদ্মা সেতু সম্পূর্ণ ‘অপ্রয়োজনীয়’, যা একেবারেই উল্টো কথা। ফখরুলকে প্রশ্ন করা উচিত, অপ্রয়োজনীয় জিনিস নির্মাণের উদ্যোগ খালেদা জিয়া কেন নেবে? আসল সত্যটা হলো, বাংলাদেশের অগ্রগতির জন্য যা দরকার তার সবকিছুই এদের কাছে অপ্রয়োজনীয়।

এই তো হলো বিএনপির রাজনীতি! মিথ্যা, অপপ্রচার এবং গুজবনির্ভর এই দলটি দেশের মানুষকে প্রতিনিয়ত বিভ্রান্ত করেই যাচ্ছে।

লেখক: চেয়ারম্যান, সুচিন্তা ফাউন্ডেশন

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের খোঁজ নিতে হাসপাতালে ডিএমপির প্রতিনিধিদল
জুলাই অভ্যুত্থানে আহতদের খোঁজ নিতে হাসপাতালে ডিএমপির প্রতিনিধিদল
২০৩১ সাল পর্যন্ত ইয়ামাল বার্সেলোনার
২০৩১ সাল পর্যন্ত ইয়ামাল বার্সেলোনার
জামায়াত নেতা এটিএম আজহারের খালাসের প্রতিবাদে বিক্ষোভ
জামায়াত নেতা এটিএম আজহারের খালাসের প্রতিবাদে বিক্ষোভ
পান্তের সেঞ্চুরি ছাপিয়ে দারুণ জয়ে প্রথম কোয়ালিফায়ারে বেঙ্গালুরু
পান্তের সেঞ্চুরি ছাপিয়ে দারুণ জয়ে প্রথম কোয়ালিফায়ারে বেঙ্গালুরু
সর্বশেষসর্বাধিক