X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

কারও ফাঁদে পা দেবেন না নির্বাচন কমিশন

মো. জাকির হোসেন
২৭ অক্টোবর ২০২২, ২০:২৩আপডেট : ২৭ অক্টোবর ২০২২, ২০:৫২

চিকিৎসা বিজ্ঞানে ক্যানসার, এইচআইভি, কোভিড-১৯-সহ কঠিন দুরারোগ্য ব্যাধি নিরাময়ের চিকিৎসা আবিষ্কৃত হলেও ডায়াবেটিস নিরাময়ের চিকিৎসা আজ অবধি অধরাই রয়ে গেছে। বাংলাদেশের রাজনীতির অসুখও ডায়াবেটিসের মতো অনিরাময়যোগ্য বলেই প্রতীয়মান হয়। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস যেমন কিডনি, হৃৎপিণ্ড, চোখ, দাঁতসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ধ্বংসে নীরব ঘাতকের মতো কাজ করে, তেমনি আমাদের রাজনীতিতে জেঁকে বসা অনিরাময়যোগ্য অসুখ সমাজ, রাষ্ট্র ও এর অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান ও মূল্যবোধ ধ্বংসে ঘাতকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। বিশেষ খাদ্যগ্রহণসহ নানা কারণে যেমন আক্রান্ত ব্যক্তির ডায়াবেটিসের মাত্রা ওঠানামা করে তেমনি আমাদের রাজনীতির অসুখের তীব্রতাও কম-বেশি হয়ে থাকে। রাজনীতির অসুখ এখন বাড়তির দিকে। রাজপথ, সভা-সমাবেশ নিয়ে নানা হুমকি-ধমকি চলছে বড় দুই দলের মধ্যে। রোগীর অসুখের মাত্রা অত্যধিক বেড়ে গেলে আত্মীয়-স্বজনকে হতাশ হয়ে বলতে শুনেছি ‘সময় শেষ হয়ে এসেছে’ কিংবা রোগীর অবস্থা আরও খারাপ হলে বলতে শুনেছি ‘আজকের দিন/রাত পার হয় কিনা’ এমন সব কথা। বিএনপি ও তার মিত্ররা সভা-সমাবেশে বলছেন ‘সরকার এই বছর পার হয় কিনা’।

রাজনীতিবিদদের সঙ্গে সুর মিলয়ে তাল দিচ্ছেন একশ্রেণির সুশীলও। রাজনীতিবিদদের চেয়েও ভয় এই সুশীলদের নিয়ে, যারা ওপরে সুশীল ভেতরে কুটিল। গত শতাব্দীর আশির দশকের শেষদিকে যখন বাইপোলার বা দ্বি-মেরুর পৃথিবীর সমাপ্তি ঘটে এবং একক মেরুর পৃথিবীর সূচনা ঘটে মূলত সে সময়ে সুশীল তথা এই সিভিল সোসাইটির পুনরুত্থান পরিলক্ষিত হয়। একদিকে সোভিয়েত রাশিয়ার পতন, আর অন্যদিকে একক কর্তৃত্বের যুক্তরাষ্ট্রের উত্থানের ফলে সবকিছু নতুনভাবে বিশ্লেষণ শুরু হয়। সামনে চলে আসে নতুন নতুন তাত্ত্বিকেরা। এরই ধারাবাহিকতায় আবির্ভূত হয় সুশীল সমাজের মতো ধারণাগুলো। মূলত ষাটের দশকের পর থেকেই একটা নতুন বৈশ্বিক মতবাদ আলোচনায় চলে আসে যার মূল সূত্র হলো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে রাষ্ট্রকে দুর্বল করে দেওয়া এবং রাষ্ট্র যে ব্যর্থ সেটি জনগণকে বোঝানো। এ মতবাদের বিস্তৃতি রাষ্ট্রকে কেন্দ্রীয় জায়গা থেকে সরিয়ে দেয় ও রাষ্ট্রের জায়গা দখল করে নেয় বাজার।

এ সময় ট্রেড ইউনিয়নের মতো বিভিন্ন সংঘের মধ্য দিয়ে সংগঠিত হতে থাকে মানুষ এবং সমাজে শক্তিশালী স্টেকহোল্ডারের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয় সুশীল সমাজ। কর্তৃত্বপরায়ণ ও স্বৈরতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলোর অত্যাচার আর নিপীড়নের প্রেক্ষাপটে সুশীল সমাজ ধারণাটি দ্রুত বিস্তার লাভ করেছিল। ’৮০ র দশকের সেই উত্তাল সময়ে সুশীল সমাজের মধ্য দিয়েই রাজনৈতিক দলগুলো কর্তৃত্বপরায়ণ রাষ্ট্রকে চ্যালেঞ্জ করে শান্তিপূর্ণ ও অহিংস প্রক্রিয়ায়। অনশন, প্রতিরোধ আন্দোলন, দিকনির্দেশনা, তথ্য আদান-প্রদানের নেটওয়ার্ক গড়ে তোলা, রিডিং ক্লাব, মতবিনিময়ের জন্য ফোরাম গঠন ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করে। শত কোটি জনতা একটি সুন্দর আগামীর সংগ্রামে সিভিল সোসাইটি খ্যাত সুশীল সমাজকে তাদের উৎসাহ, উদ্দীপনার আকর হিসেবে খুঁজে পায়। দুঃখজনক হলেও সত্য জনগণ কর্তৃত্বপরায়ণ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শেষে দেখতে পেলো সিভিল সোসাইটি প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির বিকল্প হওয়ার পরিবর্তে নিজেদের এনজিও হিসাবে উপস্থাপন করেছে। সিভিল সোসাইটি এখন দাতা রাষ্ট্র ও ফান্ড প্রদানকারী সংস্থাগুলোর এজেন্ট হিসাবে তাদের চাওয়া-পাওয়া পূরণে নিয়োজিত। একটা সময় ছিল যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে ও পরে সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন সুশীল সমাজের সদস্যরা।

নব্বইয়ের দশকে স্বৈরশাসন হটিয়ে দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনার লড়াইয়েও রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি সুশীল সমাজের ভূমিকা ছিল। কিন্তু যে সুশীল সমাজ আমরা দেখতে পাই তা পথ হারিয়ে ফেলেছে। দেশীয় নির্যাস থেকে গড়ে ওঠার পরিবর্তে বাইরের শক্তির ফরমায়েশি প্রকল্পের অংশ হিসেবে তার গ্ল্যামার হারিয়েছে। সুশীল সমাজের মোড়কে অর্থনৈতিকভাবে ধনী রাষ্ট্রসমূহ বাংলাদেশের মতো উন্নয়নকামী রাষ্ট্রে তাদের দুরভিসন্ধি পূরণ করার চেষ্টা করে যাচ্ছে আর সুশীলরা সেই বাজারি প্রচেষ্টায় কুশীলবের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। পশ্চিমা দুনিয়া নব্য উদারবাদিতার নামে সামাজিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে রাষ্ট্রের হাত যথাসম্ভব গুটিয়ে নেওয়ার প্রেসক্রিপশন বাস্তবায়ন করতে সিভিল সোসাইটিকে ব্যবহার করছে। তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে রাষ্ট্র ও সরকারের ভূমিকাকে ছোট করে আনা ও একই সাথে প্রচলিত প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতিবহির্ভূত সমাজের এক শ্রেণির প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ভূমিকাকে সামনে নিয়ে এসে বিরাজনীতিকরণের ধারাকে প্রমোট করা।

সরকার দোষ করলে সমালোচনা করতেই পারে, তাতে দোষের কিছু নাই। কিন্তু সমালোচনার নামে সুশীলরা যখন বাইরের শক্তির এজেন্ডা বাস্তবায়নে অরাজনৈতিক শক্তি কিংবা দুর্বল সরকার প্রতিষ্ঠায় নিজেদের উৎসর্গ করে তখন সমস্যা দেখা দেয়। আমাদের সিভিল সোসাইটির উল্লেখযোগ্য একটি অংশের বৈশিষ্ট্য হলো, কোনও দলের প্রতি অনুরাগ-বিরাগের আড়ালে নিরপেক্ষতার ভান করা, গবেষণা ও তথ্যনির্ভর ভবিষ্যৎ দিকনির্দেশনার চেয়ে আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়া, অপ্রচলিত ও অপ্রাসঙ্গিক তত্ত্বের কচকচানি ও সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য বাস্তবতাবিবর্জিত ও বিরাজনীতিকরণের পরামর্শ প্রদান। আমাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ২০০৭ সালে সামরিক বাহিনী সমর্থিত সরকারের প্রধান কুশীলব ছিল আমাদের সুশীল সমাজের একটি অংশ। এমন অসাংবিধানিক সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েই তারা ক্ষান্ত হয়নি, তাদের পক্ষে সভা-সেমিনার করেছে। পত্রিকায় কলাম লিখেছে। টেলিভিশন টকশোতে তাদের পক্ষে মুখে ফেনা তুলেছে। দেশের প্রধান দুই দলের দুই নেত্রীকে রাজনীতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখার ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলা তো সুশীলদেরই আবিষ্কার।

দুই নেত্রীকে আটক করে জেলে পাঠানোর ক্ষেত্রে সুশীলদের ভূমিকার কথা সুবিদিত। সুশীল সমাজের অনেকেই একে রাজনৈতিক সংকট সমাধানের একমাত্র উপায় বলে প্রচার-প্রচারণাও চালিয়েছেন। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট অচলাবস্থার সময় আমাদের সুশীলের একটি অংশ অসাংবিধানিক জুজুর ভয় দেখিয়েছে বারবার। আগামী জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে এখনও ১৪-১৫ মাস বাকি। কিন্তু আমাদের সুশীল সমাজ এরইমধ্যে কোমর বেঁধে নেমে পড়েছেন। নির্বাচন কমিশনকে কখনও তীব্র সমালোচনা করছেন, কখনও কমিশন সদস্যদের ধন্যবাদের বন্যায় ডুবিয়ে মারার উপক্রম করছেন, আবার কখনও কমিশনকে প্ররোচিত করছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে অস্বীকৃতি জানানোর জন্য। আমাদের সুশীলের একটি অংশ এখনও নির্দলীয়-তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে গণতন্ত্রের অপরিহার্য দাওয়াই মনে করে এর পক্ষে কলামে, টকশোতে বক্তব্য দিয়ে যাচ্ছেন।

দুই দশকেরও বেশি সময় ধরে সেবন করা তত্ত্বাবধায়ক দাওয়াই রাজনীতি ও গণতন্ত্রের রোগ নিরাময়ে কার্যকর দাওয়াই হয়ে উঠতে পেরেছে কি? নাকি এ দাওয়াইয়ের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় রাষ্ট্রের একটি অঙ্গ প্রায় বিকলাঙ্গ হতে বসেছিল? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সঙ্গে সর্বোচ্চ আদালতের বিচারপতিদের সম্পৃক্ত করায় বিচার বিভাগের বিকলাঙ্গতার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল।

তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংক্রান্ত সংবিধানের ত্রয়োদশ সংশোধনী অনুসারে নির্বাচিত সরকারের মেয়াদান্তে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য অবসরপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কিংবা আপিল বিভাগের বিচারপতির নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের বিধান ছিল। বড় রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের পছন্দের বিচারপতিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান করার এক ধ্বংসাত্মক প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছিল। এর ফলে প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল দেশের সর্বোচ্চ আদালতের বিচারিক চরিত্র পাল্টে একে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করার এক ভয়ানক প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়েছিল। দেশের উচ্চ আদালতকে রাজনৈতিকভাবে দখলের কলাকৌশল শুরু করে রাজনৈতিক দলগুলো। দখল-কৌশলের কয়েকটি চিত্র তুলে ধরছি। উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করার সুপ্রতিষ্ঠিত প্রথা ভঙ্গ করা হয়। প্রশ্নবিদ্ধ বিচারক নিয়োগ দেওয়া হয়। কেবল উচ্চ আদালতের বিচারকদের বয়স বাড়ানো হয়। আদালত অঙ্গনের পবিত্রতা নষ্ট করে রাজনৈতিক সভা-সমাবেশ, ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের মতো ধ্বংসাত্মক সংস্কৃতি শুরু হয়। এজলাসের দরজায় লাথি মারা হয়। এজলাসে বসে থাকা বিচারককে উদ্দেশ করে গালাগাল শুরু হয়।

আইনজীবীরা বিভক্ত হয়ে আইনের শাসনের চেয়ে দলীয় আদেশ-নির্দেশের প্রতি বেশি অনুরক্ত হয়ে পড়েন। উচ্চ আদালত প্রাঙ্গণ অসুস্থ রাজনীতির অবাধ বিচরণ ক্ষেত্রে পরিণত হয়। কেবল ক্ষমতার পালাবদলের গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে সুষ্ঠু নির্বাচনের নামে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে বিচারপতিদের সম্পৃক্ত করে দেশের সর্বোচ্চ আদালতকে ধ্বংস করে গণতন্ত্র টিকিয়ে রাখা যাবে কি? বিচারপতিদের বাদ দিলে অন্য কোনও প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে নিয়োগ করা যাবে, সে বিষয়ে কোনও ধারণা আছে কি? উভয় দলের কাছে গ্রহণযোগ্য এমন কোনও ব্যক্তি আছেন কি? ২০০৭ সালে প্রাতিষ্ঠানিক তত্ত্বাবধায়কের বদলে ব্যক্তি তত্ত্বাবধায়ক নিয়ে সৃষ্ট অচলাবস্থার ফলে কি পরিণতি হয়েছিল তা কি ভুলে গেছি? বিচার বিভাগীয় প্রাতিষ্ঠানিক তত্ত্বাবধায়কের বদলে আর কি প্রাতিষ্ঠানিক তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থা হতে পারে সে বিষয়ে কোনও কাঠামো উপস্থাপন না করে তত্ত্বাবধায়কের সরকারের পক্ষে বক্তব্য পাঠক-দর্শককে বিনোদন দেওয়া ছাড়া আর কী হতে পারে?

স্মরণ রাখতে হবে, সমাজের উপরতলার একটি অভিজাত অংশের লব্ধ প্রতিষ্ঠিত কিছু ব্যক্তি স্বঘোষিতভাবে যারা সুশীল সমাজ বলে দাবি করেন তাদের একটি বড় অংশ হলো সেসব ব্যক্তি, যারা তাদের জীবনের একটি দীর্ঘ সময়কাল রাজনৈতিক দলের কর্মকাণ্ডে, সরকারের সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনে, সরকারি কাজকর্মে, সরকারের উপদেষ্টারূপে অথবা পরামর্শদাতারূপে, রাষ্ট্রপরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ আসনে ইত্যাদি নানাবিধ কাজে যুক্ত থেকেছেন। এদের কেউ কেউ আন্তর্জাতিক এনজিও কর্মী, কেউ নিজেই গড়ে তুলেছেন এনজিও প্রজেক্ট, আবার কেউ মানবাধিকার কর্মী। সর্বসাধারণের কণ্ঠস্বর ও মুখপাত্র হওয়ার পরিবর্তে আমাদের সুশীল সমাজ এক ধরনের ঘেরাটোপে বন্দি সংরক্ষিত সমাজ হিসাবে গড়ে উঠেছে যেখানে প্রবেশাধিকার নেই সবার। সাধারণ মানুষের সঙ্গে সম্পর্কহীন আমাদের অভিজাত সুশীল সমাজ। প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বদৌলতে মানুষ জানতে পারেন সিভিল সোসাইটি নামে একটা কিছু বাংলাদেশে আছে। পত্রিকায় সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে বিবৃতি আসে, কিংবা বিভিন্ন চ্যানেলে বক্তৃতার ঝড় তোলে সুশীল সমাজ।

আমাদের সমাজে সুশীলের সংখ্যা কম নয়, কিন্তু এদের মধ্যে নিরপেক্ষ আছে খুব কম। সবাই নিরপেক্ষ পরিচয় দিয়ে যেকোনও দলের পক্ষ হয়ে কাজ করেন। সুশীল সমাজের লোকজনদের যে বাধ্যতামূলক নিরপেক্ষ হতেই হবে এমনটা নয়। তাদের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক মতাদর্শ থাকতেই পারে। কিন্তু সাধারণ জাতীয় ইস্যুতে বা জাতীয় স্বার্থের বিষয়গুলোতে তাদের অবশ্যই দলীয় গণ্ডির বাইরে এসে কার্যকর ভূমিকা বা দায়িত্ব পালন করা উচিত। এখন যারা দেশের তথাকথিত সুশীল সমাজের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তারা প্রায় অনেকেই কোনও না কোনও আমলে সুবিধাভোগী, সে কারণে তাদের ব্যক্তিগত ইমেজও প্রশ্নবিদ্ধ।

বিভিন্ন সুবিধা পেতে তারা নিজেরাই দেশের প্রধান দুটি রাজনৈতিক দল কিংবা তাদের মতবাদের সঙ্গে মিশে গেছেন। ফলে মত প্রকাশ করতে গিয়ে তাদের দলীয় মনোভাব প্রকাশ পেয়ে যায়। গত নির্বাচনের আগে সুশীল পরিচয়ধারী এক ব্যক্তিকে পাওয়া গেলো এক গোপন সভায় যেখানে নির্বাচনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল নিয়ে সরকারবিরোধী মোর্চা গঠনের লক্ষ্যে  চা-চক্রের আয়োজন করা হয়েছিল। আমাদের রাজনীতি ও গণতন্ত্রকে আরও পরিশীলিত করার জন্য সুশীলদের যতটুকু সুশীল হওয়ার দরকার ছিল, তা হতে পেরেছেন কি?

রাজনৈতিক দলের প্রতি অনুরাগ-বিরাগ, দূরদর্শিতার অভাব, গবেষণা ও তথ্যের চেয়ে অনুমান ও আবেগনির্ভর পরামর্শ সুশীলদের সুশীল হয়ে ওঠার পথে বড় বাধা হিসাবে কাজ করেছে। আমাদের রাজনীতি যতই অশোভন হোক তাকে শোভন করার পরিবর্তে নির্বাচন কমিশনকে নির্বাচন অনুষ্ঠানে অস্বীকৃতি জানাতে প্ররোচিত করা তথা অসাংবিধানিক শক্তিকে স্বাগত জানানো সুশীল সমাজের কাজ নয়।

বিচারিক ক্যুর মাধ্যমে সরকার উৎখাত কিংবা রাজনৈতিক সংকট এবং সহিংসতার অজুহাতে বিরাজনীতিকরণের ধারা প্রচলন কিংবা রাজনৈতিক কোন্দল এবং দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশে রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সুশীলদের রাষ্ট্র পরিচালনায় যুক্ত করা কোনও কিছুই সুশীলের ধারণার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সুশীল সমাজের একটি অংশ আবারও দেশে-বিদেশে তৎপর হয়েছে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, সুশাসন, উন্নয়নের কথা বলে ওয়ান ইলেভেন স্টাইলে আগামী কয়েক বছর দেশকে রাজনীতিমুক্ত রাখতে। নির্বাচন কমিশনকে তাই সাবধান থাকতে হবে মুহুর্মুহু ধন্যবাদের বিরুদ্ধে।

নির্বাচন বন্ধ করে দেওয়া সাফল্য নয়, তাই ধন্যবাদ মাল্যভূষিত হয়ে আবেগতাড়িত হওয়ারও সুযোগ নেই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারভুক্ত নয়। সাংবিধানিক যে ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনের রয়েছে তা যথাযথ প্রয়োগ করে সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেওয়া কমিশনের প্রধান ও একমাত্র কাজ। প্রজাতন্ত্রের কোনও কর্মচারী কমিশনকে সহায়তা না করলে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক যেকোনও ব্যবস্থা এমনকি চাকরি থেকে অপসারণের ক্ষমতাও কমিশনের রয়েছে। কীভাবে সাংবিধানিক ক্ষমতা প্রয়োগ করবেন তা কেবল আপনারা নির্ধারণ করবেন। স্মরণ করিয়ে দেওয়া যেতে পারে, বেশ কয়েকজন প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও বিচারপতি লতিফুর রহমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হয়েও বিতর্কের ঊর্ধ্বে থাকতে পারেননি।

নির্বাচন কমিশনে যারা দায়িত্ব পালন করছেন তাদের সকলেরই রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ ও চ্যালেঞ্জিং দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতা রয়েছে। সাংবিধানিক ক্ষমতা ব্যবহার করে আপনাদের মেধা, বুদ্ধিমত্তা, অভিজ্ঞতা, সাহস ও বিচক্ষণতা দিয়ে একটি সুন্দর ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে সক্ষম হবেন এ বিশ্বাস আমাদের আছে। বিভ্রান্তি কিংবা পরিকল্পিত ফাঁদে পা দিয়ে কোনও সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি কিংবা বিতর্কের জন্ম দেওয়া থেকে হুঁশিয়ার থাকবেন। মহাকাল মানব জীবনের সমগ্র সোনালি ফসল গ্রহণ করলেও একটি ভুল পদক্ষেপ সব অর্জনকে মুহূর্তেই ধুলোয় মিশিয়ে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রীয় জীবনে বিপর্যয় ডেকে আনে বৈকি।

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

ই-মেইল: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ