X
বুধবার, ০১ মে ২০২৪
১৮ বৈশাখ ১৪৩১

সাফল্যের চেয়ে মধুর কোনও প্রতিশোধ নেই

প্রভাষ আমিন
০৫ মে ২০২৩, ১৯:০১আপডেট : ০৫ মে ২০২৩, ১৯:০১

পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকলেও অসুস্থতার কারণে আনুষ্ঠানিক উদ্বোধনটা দেখতে হয়েছিল টেলিভিশনের পর্দায়। তারপর অনেকবার যাবো যাবো করেও আর পদ্মা সেতু পাড়ি দেওয়া হয়নি। তবে বাংলাদেশের প্রথম ও একমাত্র এক্সপ্রেসওয়ে ধরে বেশ কয়েকবার মাওয়া পর্যন্ত গিয়েছি। দেখেছি পদ্মা সেতু। কিন্তু আমি প্রমত্তা পদ্মার বুকে নিছক সেতু দেখি না, স্বপ্নের বাস্তবায়ন দেখি, বাংলাদেশের সক্ষমতার-আত্মমর্যাদার সংযোগ দেখি। নির্মাণকাজের উদ্বোধন অনুষ্ঠান দেখে ফিরে বাংলা ট্রিবিউনে আমি লিখেছিলাম, ‘পদ্মা সেতু: শেখ হাসিনার গোঁয়ার্তুমির প্রতীক’। শিরোনাম নিয়ে অনেকেই আপত্তি করেছিলেন। কিন্তু আমি এখনও বিশ্বাস করি, শেখ হাসিনার মধ্যে দেশপ্রেমের গোঁয়ার্তুমি না থাকলে পদ্মা সেতু বানানো সম্ভব হতো না।  

পদ্মা সেতু বানানোর কথা ছিল উন্নয়ন সহযোগীদের ঋণের টাকায়। সবচেয়ে বেশি, ১২০ কোটি ডলার দেওয়ার কথা ছিল বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন সহযোগী বিশ্বব্যাংকের। এছাড়া ছিল জাইকা, এডিবির অর্থায়নের আশ্বাস। কিন্তু পদ্মা সেতু প্রকল্পে কোনও টাকা ছাড় হওয়ার আগেই দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগ এনে বিশ্বব্যাংক সরে দাঁড়ায়। তাদের দেখাদেখি সরে দাঁড়ায় জাইকা এবং এডিবি। পরে দুর্নীতি দমন কমিশন ও কানাডার আদালত- কোথাও দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়নি। বড় বড় উন্নয়ন সহযোগীরা সরে যাওয়ায় অনেকেই ভেবেছিলেন পদ্মা সেতু আর হচ্ছে না। এমনকি তখনকার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিতও পদ্মা সেতু বানানো সম্ভব নয় বলেই ধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু একজনের মনে ছিল ভিন্ন ভাবনা। তিনি শেখ হাসিনা। যার বুক ভরা সাহস। যে সাহসের উৎস দেশপ্রেম। বিশ্বব্যাংককে চটানো ঠিক হবে না, দলের অনেকের এমন ভাবনার বাইরে গিয়ে শেখ হাসিনা ঘোষণা করেন, পদ্মা সেতু বানানো হবে নিজেদের টাকায়।

আসলে সবার দোষ দিয়ে লাভ নেই। আগে আমাদের মানসিকতাটাই ছিল পরনির্ভর, বিদেশনির্ভর। ছেলেবেলা থেকেই আমরা দেখে আসছি, বাংলাদেশ বিদেশি সাহায্যনির্ভর। খাদ্যসহ সবকিছু আমদানিনির্ভর। দাতা সংস্থা ও পশ্চিমা দেশগুলোকে আমরা হুজুর হুজুর করে চলতাম। আগে আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় বাংলাদেশ মানেই ছিল ঝড়-ঝঞ্ঝা-জলোচ্ছ্বাস, দারিদ্র্য-মঙ্গা। কিন্তু শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে বদলে দিয়েছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন শক্তিশালী। আমদানির বদলে খাদ্য আমরা রফতানি করি। তৈরি পোশাক, রেমিট্যান্স, ইদানীং তথ্যপ্রযুক্তিও হয়ে উঠছে আমাদের অর্থনীতির প্রাণ। দারিদ্র্য কমেছে, মঙ্গা শব্দটিই এখন ডিকশনারিতে ঠাঁই নিয়েছে। বাংলাদেশ এখন নিম্ন-মধ্যম আয়ের দেশ। দারুণ চমক দেখিয়েছে বিভিন্ন সামাজিক সূচকে। মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু, স্যানিটেশন-নানা সূচকে রীতিমতো উদাহরণ মানা হয় বাংলাদেশকে।

এত অগ্রগতির পরও আমাদের মাইন্ডসেটে পরনির্ভরতা রয়েই গিয়েছিল। মার্কিন রাষ্ট্রদূত বা ব্রিটিশ হাইকমিশনার আমাদের রাজনীতির নিয়ন্ত্রক হয়ে ওঠেন কখনও কখনও। কিছু হলেই আমরা বিদেশিদের কাছে ধরনা দেই, বিচার দেই। বিশ্বব্যাংক সরে যাওয়ার পর যখন সবাই হাল ছেড়ে দিয়েছেন, তখন শেখ হাসিনা নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু করার ঘোষণা দিয়ে আসলে আমাদের সেই মানসিকতায় প্রচণ্ড আঘাত করেন। আমরাও যে পারি সেটা বুঝিয়ে দিলেন। আসলে জমানা অনেক আগেই বদলে গেছে। আমি টের পাইনি। শেখ হাসিনা এক লহমায় আমাদের মানসিকভাবেও স্বাবলম্বী করে দিয়েছেন। নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু বানিয়ে আমরা আমাদের সক্ষমতারও প্রমাণ দিয়েছি। অনেক সময় টাকা থাকলেও অনেক কিছু করা যায় না, মানসিকতা আটকে রাখে। পদ্মা সেতু আমাদের সেই পরাধীনতার, ভৃত্য মানসিকতার অর্গল থেকে মুক্তি দিয়েছে। বিশ্বের সবাই দেখেছে, বিশ্বব্যাংকের মুখের ওপর ‘না’ করে দিয়ে পদ্মা সেতুর মতো প্রকল্প আমরা বাস্তবায়ন করতে পারছি। বাংলাদেশ মানে এখন ঝড়-ঝঞ্ঝা-জলোচ্ছ্বাস-দারিদ্র্য-মঙ্গা নয়। বাংলাদেশ এখন সম্ভাবনার নাম। ভবিষ্যতে বাংলাদেশের ইতিহাসে পদ্মা সেতুর আগে এবং পরে- এইভাবে ভাগ হবে। পদ্মা সেতুর পরের বাংলাদেশ সম্ভাবনার, সক্ষমতার দাপুটে বাংলাদেশ। শেখ হাসিনা বুঝিয়ে দিয়েছেন, সাহস থাকলে, সক্ষমতা থাকলে, দেশপ্রেম থাকলে বিশ্বব্যাংক হোক আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সবার চোখে চোখ রেখে কথা বলা যায়।

পদ্মা সেতু বানানোর পথে বাধা শুধু বিশ্বব্যাংক ছিল না। দেশি-বিদেশি নানা মহলের ষড়যন্ত্রও ছিল। সাধারণত শুনি বিশিষ্ট ব্যক্তিরা আন্তর্জাতিক মহলে নিজেদের প্রভাব খাটান দেশের স্বার্থে। কিন্তু বাংলাদেশ দুর্ভাগা। বাংলাদেশের বিশিষ্টজনেরা পদ্মা সেতু যাতে না হয় সেজন্য আন্তর্জাতিক মহলে তদবির করেছেন, প্রভাব বিস্তার করেছেন। এমনকি নির্মাণকাজ শুরুর পরও ষড়যন্ত্র থামেনি। তিনবারের সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া বলেছিলেন, ‘পদ্মা সেতুর স্বপ্ন দেখাচ্ছে সরকার। কিন্তু পদ্মা সেতু আওয়ামী লীগের আমলে হবে না। এ সেতু জোড়াতালি দিয়ে বানানো হচ্ছে। এ সেতুতে কেউ উঠবেন না।’ কিন্তু তাঁর কথা কেউ শোনেনি। বিএনপি সমর্থকরাও এখন মনের আনন্দে পদ্মা সেতুতে উঠছেন।

যারা ভেবেছিলেন, বিশ্বব্যাংককে পাত্তা না দিয়ে নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু বানালে তারা গোস্বা করবে, বাংলাদেশের সঙ্গে আর থাকবে না, তারা ভুল ভেবেছিলেন। আসলে পাত্তা পেতে হলে নিজেদের সক্ষম করে তুলতে হয়। বিশ্বব্যাংক নিজেদের প্রয়োজনেই বাংলাদেশের পাশে ছিল, আছে এবং থাকবে। পদ্মা সেতু নিয়ে সৃষ্ট টানাপড়েন বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে কোনও নেতিবাচক প্রভাব ফেলেনি। বরং সম্পর্ক আরও উষ্ণ হয়েছে। কতটা উষ্ণ হয়েছে, তার প্রমাণ আপনারা দেখেছেন গত সপ্তাহে। বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সম্পর্কের ৫০ বছর উদযাপিত হয়েছে নানা আয়োজনে, ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের সদর দফতরে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ডেভিড ম্যালপাসের উপস্থিতিতে ২৪ হাজার কোটি টাকার ঋণচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এসব আয়োজনে বাংলাদেশের উৎসাহব্যঞ্জক যাত্রায় বিশ্বব্যাংক সঙ্গে থাকবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আর বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট বলেছেন, জনগণের অদম্য শক্তি, সহনশীলতা ও সমৃদ্ধ দেশ গড়ার জাতীয় ইচ্ছাশক্তির কারণে বাংলাদেশের অসাধারণ যাত্রা সম্ভব হয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের ৫০ বছর উদযাপনের আয়োজনের একপর্যায়ে শেখ হাসিনা বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের হাতে স্যাটেলাইট থেকে তোলা পদ্মা সেতুর একটি বাঁধাই করা ছবি তুলে দেন। অনেকে এটাকে মধুর প্রতিশোধ হিসেবে দেখছেন। আসলেই সাফল্যের চেয়ে বড় কোনও প্রতিশোধ হয় না। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের হাতে পদ্মা সেতুর ছবি তুলে দেওয়া আসলে বদলে যাওয়া বাংলাদেশেরই প্রতীকী ছবি।

লেখক: হেড অব নিউজ, এটিএন নিউজ

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
১০ বছরের শিশুও জানে ‘দিনে কাজ ১২ ঘণ্টার’
১০ বছরের শিশুও জানে ‘দিনে কাজ ১২ ঘণ্টার’
ধর্ষণের পর শিশুকে হত্যা, জড়িতদের গ্রেফতারে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম
ধর্ষণের পর শিশুকে হত্যা, জড়িতদের গ্রেফতারে ২৪ ঘণ্টার আলটিমেটাম
খালেদা জিয়াকে আজ আবার হাসপাতালে নেওয়া হবে
খালেদা জিয়াকে আজ আবার হাসপাতালে নেওয়া হবে
বেড়েছে রাবার উৎপাদন, আয় এক কোটি ১৭ লাখ টাকা
হলদিয়া রাবার বাগানবেড়েছে রাবার উৎপাদন, আয় এক কোটি ১৭ লাখ টাকা
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ