X
বুধবার, ০১ মে ২০২৪
১৮ বৈশাখ ১৪৩১

তরুণরা নেই, নেতৃত্ব যাবে কার হাতে

মোস্তফা হোসেইন
২৬ আগস্ট ২০২৩, ১৯:৩০আপডেট : ২৬ আগস্ট ২০২৩, ১৯:৩৭

আন্দোলনে তরুণদের কম দেখতে পাচ্ছেন বিএনপি সাধারণ সম্পাদক মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। অন্যদিকে বিএনপির আন্দোলনের সঙ্গে জনগণ নেই, এমন কথা বলেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। দুই নেতার বক্তব্য একসঙ্গে জোড়া দিলে পাওয়া যায়– আন্দোলন আছে, তবে সেই আন্দোলনে তরুণরা প্রায় নেই বললেই চলে এবং জনগণও নেই।

মির্জা ফখরুল ইসলাম সম্প্রতি তরুণদের নেতৃত্বে গঠিত গণঅধিকার পরিষদের সভায় অতিথি হিসেবে বলেছেন, পাকিস্তান আমলে যে কোনও অনাচার, অন্যায়ের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি অগ্রণী ভূমিকা রেখেছে ছাত্ররা। দুর্ভাগ্য আজ, সেই তরুণ ও ছাত্রদের দেখতে পাচ্ছেন না তিনি।

তরুণরা আন্দোলনে আসছে না কেন? স্পষ্টত প্রমাণ হলো– তরুণরা রাজনীতিবিমুখ এখন। তাদের রাজনীতিবিমুখ হওয়াটা দেশের জন্য শুভ নয়। এই মুহূর্তে প্রবীণরা রাজনৈতিক দলগুলো পরিচালনা করছে। রাজনীতিতেও তারাই প্রতিনিধিত্ব করছেন। আগামীটা তরুণদের। সেই তরুণরা যদি এই সময় রাজনীতি থেকে দূরে সরে থাকে তাহলে আগামী কর্ণধার হবে কারা? ভবিষ্যতের পথ বন্ধ করে দেওয়ার এই ব্যর্থতার দায় রাজনীতিবিদদেরই নিতে হবে। ভাবতে হবে কেন আজকে তরুণরা রাজনীতিতে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে। তরুণদের আকৃষ্ট করার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর ভূমিকা কী?

মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর পাকিস্তান আমলে তরুণদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার প্রসঙ্গ এনেছেন। এই তথ্যটি ঐতিহাসিকভাবে সত্য। প্রশ্ন হচ্ছে, এই মুহূর্তে কি বাংলাদেশে অন্যায় দুর্নীতি নেই? অবশ্যই আছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে মাত্রাটা একটু বেশিই। তারপরও তরুণরা এগিয়ে আসছে না কেন?

বছর কয়েক আগে একটি জরিপের কথা বলা যায়। ওই জরিপে দেখা গেছে ৫৪ শতাংশ তরুণ মনে করেছিলো দেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতি সন্তোষজনক। মূলত হরতাল-ধর্মঘটের মতো নেতিবাচক দিকগুলোর অনুপস্থিতির কারণেই যে তাদের এই মানসিকতা সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। অন্যদিকে সেই জরিপ অনুযায়ী অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিয়েও তরুণদের অর্ধেকের বেশি সন্তুষ্ট। জরিপ চালানো হয়েছিলো ২০১৯ সালে। সুতরাং এটাকে ভিত্তি ধরে মন্তব্য করাটা হয়তো এই মুহূর্তে অনেকেই সঠিক নাও মনে করতে পারেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এই দুটি কারণেই মানুষ ক্ষুব্ধ হয় বেশি। এই মুহূর্তে দ্রব্যমূল্য সাধারণ মানুষকে তটস্থ করে দিলেও তরুণরা প্রতিবাদী হচ্ছে না, এটাও বাস্তবতা। তাহলে কি ধরে নিতে হবে, দ্রব্যমূল্য ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাওয়াটাকে তারা সহজেই মেনে নিয়েছে? নাকি সরকারি দলের বক্তব্য অনুযায়ী বিশ্বঅর্থনৈতিক টালমাটাল অবস্থায় বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য বেড়ে যাওয়া স্বাভাবিক, এই যুক্তিকে তারা যথার্থ মনে করেছে।

তরুণদের প্রবণতা হচ্ছে রাজনীতি থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেওয়া। গুটিয়ে নিচ্ছে এমন সংখ্যাও মনে হয় অন্তত দুই তৃতীয়াংশের কম হওয়ার কথা নয়। কিন্তু তারা কি শুধুই লেখাপড়া কিংবা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত। এখানে স্পষ্ট হয়ে যায়, তাদের অধিকাংশই তেমনটি নন। আজকের তরুণদের বড় একটি অংশ ধর্ম সম্পর্কে অধিক আগ্রহী। সাংস্কৃতিক জগত থেকেও তারা নিজেদের গুটিয়ে রাখছে। তার মানে হচ্ছে-তরুণরা রাজনীতি ও সাংস্কৃতিক জগতকেও পছন্দের তালিকায় রাখছে না। আরও স্পষ্ট করে বলতে গেলে-এই তরুণদের একটি বড় অংশ অর্থনৈতিক সুবিধা অর্জনকে বড় করে দেখছে। অর্থের পেছনে তাদের যতটা ভাবতে দেখা যায়, বাকিগুলোতে ঠিক ততটাই অনীহা প্রকাশ করতে দেখা যায়।

এই অর্থ প্রাপ্তির আকাঙ্ক্ষা এতটা প্রকট যে, যারা রাজনীতিতে আসছেন তারাও অর্থকেই প্রাধান্য দিচ্ছেন। রাজনৈতিক আদর্শ বড় নয়, যে দল ক্ষমতায় আছে কিংবা যে দলটি হয়তো ক্ষমতায় আসার সম্ভাবনা আছে সেই দলটিকেই এই অংশের তরুণরা নিজেদের দল হিসেবে মনে করছে। শুধু তাই নয় আগের মতো তরুণদের শুধু দলীয় স্বার্থে নিজের শ্রম দেওয়াটাকেও তারা ভাবছে না। অর্থাৎ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অর্থপ্রাপ্তির বিষয়টিও তারা ভাবছে।

এক্ষেত্রে মির্জা ফখরুল ইসলামের বক্তব্য অনুযায়ী পাকিস্তান আমলের দৃষ্টান্ত দেওয়া যেতে পারে। সেই উদাহরণটি এই নিবন্ধকারের অভিজ্ঞতার আলোকে উপস্থাপন করা যায়। আমরা ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে ছাত্রকর্মী হিসেবে মাইলের পর মাইল হেঁটেছি, রাতে টিনের চুঙ্গা নিয়ে গ্রামে গ্রামে বেরিয়ে পড়েছি। একমাত্র খাবার ছাড়া দল কিংবা প্রার্থীর কাছ থেকে কিছু পাওয়া যেতো না। তাও আবার অধিকাংশ সময়ই বাবা মায়ের কাছ থেকে টাকা নিয়ে খরচ করতে হয়েছে। এটা শুধু নির্দিষ্ট কর্মীর জন্য নয়, মোটামুটি সবার জন্যই প্রযোজ্য ছিল। কিন্তু আজকে কোনও রাজনৈতিক কর্মী এভাবে নিজের খেয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে যোগ দেয় কিনা সন্দেহ আছে। তাদের মধ্যে বোধ তৈরি হয়েছে, দল তার নয়, নগদ যা পাওয়া যায় সেটাই তার লাভ। এই প্রবনতাকে বল যায়-ভাড়াটে কর্মী হিসেবে।

তাহলে অর্থ দাঁড়ালো রাজনীতি এখন অর্থমুখী। যে তরুণটি মানবসেবার কথা ভাবে, সে এমন রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হবে না এটাই স্বাভাবিক। একইসঙ্গে রাজনৈতিক দল ও তাদের আদর্শের বিষয়টিও তাদের কাছে বিবেচ্য। এই মুহূর্তে সরকারে থাকা এবং সরকারের মুখোমুখি থাকা দলগুলোর সক্ষমতা, দক্ষতা এবং তাদের লক্ষ্য আদর্শ সম্পর্কে সম্যক ধারণা আছে তাদের। দুটি দলই ঘুরে ফিরে ক্ষমতা ভোগ করেছে। দুটিই সরকার পরিচালনা ও বিরোধী দলে কাজ করেছে। যদি এমন বলা হয় যে,তাদের কর্মকাণ্ড এবং ইতিহাসই তরুণদের কাছে টানতে পারছে না, বোধ করি খুব বেশি বলা হবে না।

রাজনীতিবিমুখ তরুণদের একটি অংশ হয়তো ধর্মীয় কাজে যুক্ত হচ্ছে একটি অংশ ধর্মীয় নামের রাজনীতিতে যুক্ত হচ্ছে। আচার-আচরণে ধর্মীয় ভাব প্রতিটি মানুষেরই কমবেশি থাকে। কিন্তু ধর্মের নামে যেসব সংগঠন রাজনীতি করছে তাদের অতীত বর্তমান বিশ্লেষণ করলে কতটা ধর্মীয় তাও প্রশ্নাতীত নয়। তারপরও কম হলেও একটি অংশ সেদিকেও ঝুঁকছে। এই প্রবণতার পেছনে প্রচলিত রাজনৈতিক সংস্কৃতির দীনতাই মূল দায়ী বলে মনে করা যায়।

প্রচলিত রাজনীতিতে মেধার মূল্যায়ণ না হওয়াটাও তরুণদের মধ্যে রাজনীতির প্রতি আকর্ষণ হারানোর বড় একটা কারণ। একসময় ছাত্ররাজনীতিতে মেধাবীরা নেতৃত্ব দিতেন। গত শতকের সত্তরের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত ছাত্র রাজনীতিতে নেতৃত্ব দিতেন সাধারণত মেধাবী শিক্ষার্থীরা। আজকে যেসব প্রবীণ রাজনীতিবিদ আছেন, তাদের প্রায় সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী শিক্ষার্থী হিসেবে তাদের ছাত্রজীবনেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন। কিন্তু আজকে ছাত্র রাজনীতি কিংবা মূল রাজনীতিতেও মেধার বিষয়টি উপেক্ষিত। যে কারণেও মেধাবীরা বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে সরকারি চাকরি পাওয়ার স্বপ্ন দেখেন। তারা এও দেখছেন একজন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী রাষ্ট্র পরিচালনায় কর্মকর্তাদের ওপর প্রায় সর্বাংশে নির্ভরশীল। তারা দেখছেন অনেকক্ষেত্রে রাজনীতিবিদদেরও পরিচালনা করেন প্রশাসনের লোকজন। সঙ্গত কারণেই তরুণরা সেই সুযোগটা নিতেই উৎসাহ বোধ করেন।

তরুণদের রাজনীতির প্রতি আগ্রহী করতে হলে, রাজনীতিকে গণমুখী,কল্যাণকামী করার বিকল্প নেই। যা এই মুহূর্তে একটু কঠিন বৈকি। আরও সহজভাবে বলতে গেলে কোনো দলের নেতারা যদি অমেধাবী হন,তাহলে কর্মী কিংবা সমর্থকদের বিষয়টি ভিন্নতর হওয়ার কথা নয়। সব দলই যে এমন তা বলা যাবে না। কিন্তু পরোক্ষভাবে হলেও মেধা উপেক্ষিত রাজনীতিতে। সুতরাং তরুণ ও মেধাবীরা আস্তে আস্তে দূরে সরে যাচ্ছে রাজনীতি থেকে। এই প্রবণতা পরিবর্তন হওয়া জরুরি বলে মনে করি।

লেখক: সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক।

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সরকারের সব উন্নয়ন-অগ্রগতি শ্রমিকদের মাধ্যমেই: হানিফ
সরকারের সব উন্নয়ন-অগ্রগতি শ্রমিকদের মাধ্যমেই: হানিফ
হংকংয়ে টানা ১০ হাজার বজ্রাঘাত
হংকংয়ে টানা ১০ হাজার বজ্রাঘাত
বিরোধ উপাচার্যের সঙ্গে শিক্ষকদের: আমরা কেন হল ছাড়বো, প্রশ্ন শিক্ষার্থীদের
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ও হল বন্ধের প্রতিবাদবিরোধ উপাচার্যের সঙ্গে শিক্ষকদের: আমরা কেন হল ছাড়বো, প্রশ্ন শিক্ষার্থীদের
প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের সময় পেছালো
প্রধানমন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের সময় পেছালো
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ