X
বুধবার, ০১ মে ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

কেমন হতে পারে আগামীর রাজনীতি?

মোস্তফা হোসেইন
২৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৫:৩৮আপডেট : ২৬ ডিসেম্বর ২০২৩, ১৭:৩৫

বাংলাদেশে সাংবিধানিকভাবে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা নিশ্চিত করা আছে। গণতান্ত্রিক উপায়ে রাজনীতি করার অঙ্গীকারও প্রতিটি রাজনৈতিক দলের। কম-বেশি বিতর্ক থাকার পরও বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক পথেই এগিয়ে যাচ্ছে। অন্তত বাংলাদেশে কোনও অরাজনৈতিক শক্তি ক্ষমতায় আসার তেমন কোনও সম্ভাবনা নেই। রাজনীতি রাজনৈতিক দলগুলোর মাধ্যমেই পরিচালিত হচ্ছে এটাও বাস্তবতা। প্রশ্ন হচ্ছে, অদূর ভবিষ্যতে এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার গতি-প্রকৃতি কী হতে পারে?

২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪-এর সাধারণ নির্বাচন বিশ্লেষণ করলে এর কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া যেতে পারে। এবারের মতো ২০১৪ সালে বাংলাদেশের বৃহত্তম বিরোধী দল বিএনপি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছে না। ২০১৮ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেও রাজনীতিতে মার খায় বিএনপি। ২০২৪ সালের নির্বাচনে ২০১৪ সালের মতোই বর্জন করছে তারা। সামান্য পার্থক্য হচ্ছে, তখন তারা নির্বাচন প্রতিরোধের ডাক দিয়েছিল, এবার বর্জনের ডাক দিয়েছে।

বিএনপির নির্বাচন বর্জনের পরিণতি কী? এটা কি বিএনপির রাজনীতি বর্জনের দিকে যাবে নাকি রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতিকে অন্যদিকে প্রবাহিত করবে? এমন প্রসঙ্গ আসতেই পারে।

আওয়ামী লীগ ২০০৮-এ ক্ষমতায় এসে একদিকে রাষ্ট্র পরিচালনা, অন্যদিকে রাজনীতি পরিচালনায় একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় সক্ষম হয়। তাদের গণতান্ত্রিক কর্মকাণ্ড নিয়ে ১০১টা প্রশ্ন করা যায়।

গত ১৫ বছর ধরে রাজপথে গণমাধ্যমে অসংখ্য প্রশ্নের মুখোমুখি আওয়ামী লীগকে মোকাবিলা করতে হয়েছে। প্রশ্ন করার ক্ষমতা অর্জনের বিষয়টিও যে গণতান্ত্রিক সেই বিষয়টি ইতোমধ্যে প্রমাণ হয়ে গেছে। শাসন ব্যবস্থা, দলীয় নেতাকর্মীদের দুর্নীতির মতো অসংখ্য ঘটনা জনসম্মুখে তুলে ধরার কাজটি সব বিরোধী দলই অনায়াসে করতে পারছে। সুতরাং গণতান্ত্রিক পরিবেশ তথা মত প্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে নেই।

প্রশ্ন আসতে পারে, আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের নেতাকর্মীদের বিরোধীদের মতে দমন চালানোর বিষয়টি। কিন্তু বিরোধীরা তারপরও বলার সুযোগ পাচ্ছে। মিছিল মিটিং এবং গণমাধ্যমে বক্তব্য উপস্থাপনের সুযোগ পাচ্ছে। তারপরও বড় বিরোধী দলটি গণতন্ত্রহীন পরিবেশের অভিযোগ করে কীভাবে? তাদের এই অভিযোগ যে জনপ্রিয়তা পায়নি, তাও তাদের আন্দোলনে জনসমর্থন না পাওয়ায় প্রমাণ হয়ে যায়।

রাজনীতি কৌশলের খেলা। সেই খেলায় আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয়ে ১৫ বছর ধরে ক্ষমতায় টিকে আছে- এটা বাস্তবতা। এই দলকে যে যেভাবেই গালি দিক, যত সমালোচনাই করুক এটাই সত্য।

দীর্ঘ সময় ক্ষমতায় থাকার পর এবং কার্যকর বিরোধী দল না থাকায় সঙ্গত কারণেই আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের শক্তি-সামর্থ্য তাদের কোনও কোনও ক্ষেত্রে আধিপত্যবাদী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। যার পরিণতি প্রশাসনিক পর্যায়েও পড়েছে। ২০২৪ সালের নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ না করায় আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক মাঠে প্রতিদ্বন্দ্বীহীন খেলোয়াড়ে পরিণত হয়েছে। অস্বাভাবিক কিছু না ঘটলে আওয়ামী লীগই যে আবারও ক্ষমতায় আসছে এটা প্রায় নিশ্চিত।

এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের আগামী রাজনীতির গতিপ্রকৃতি অনুমান করা যায়। নিরঙ্কুশ ক্ষমতার যেসব অশুভ দিক আছে, সে থেকে বাংলাদেশের রাজনীতিমুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা কমে গেছে। এর জন্য শাসক দলের যেমন ভূমিকা আছে এর দায় থেকে বাকি দলগুলোও মুক্ত নয়। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলতে পারেন, রাজনীতির খেলায় কেউ যদি হেরে যায় সেই হারের দায় বিজিত দলের ওপর পড়বে কেন? সবাই তো জয়ের জন্যই মাঠে নামেন। প্রতিপক্ষ যদি খেলায় ভুল করে তার দায় তো তাকেই বহন করতে হবে।

এই হার যখন ধারাবাহিক হতে থাকে তখন রাজনীতিতে শূন্যতা তৈরি হতে পারে। যা গণতন্ত্রের জন্য দেশের জন্য শতভাগ শুভ না হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি। এর জন্য বিএনপি এবং আওয়ামী লীগকে এককভাবে দোষ দেওয়া ঠিক হবে না। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি ছাড়াও আরও শতাধিক দল রয়েছে। তাদের অবস্থাটা কী?

সরকারি জোটে থাকা ১২টি রাজনৈতিক (১৪ দলীয় জোট হিসেবে পরিচিত) দলের সাংগঠনিক শক্তি নিয়ে কথা বলা যায়। ২০১৪ এবং ২০১৮ নির্বাচনে তারা আওয়ামী লীগের সহানুভূতিতে নির্বাচিত হয়েছিলেন।

২০২৪-এর নির্বাচনেও তারা সেদিকেই হাঁটছে। লক্ষণীয়, গত নির্বাচনগুলোর সময় আওয়ামী লীগের সমর্থন পাওয়ার জন্য তাদের যেমন আকুতি ছিল এবার তার চেয়ে অনেক বেশি। তারপরও জোট সদস্য দলগুলো থেকে মাত্র ৭ জন নৌকা প্রতীক ব্যবহার করার সুযোগ পেয়েছেন। আগের বারের তুলনায় তা ৯টি আসনে কম। আওয়ামী লীগ ছাড় না দেওয়ায় জোটের শরিকরা কেউ কেউ নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকেই নিজেদের গুটিয়ে নিয়েছে।

এখানে আওয়ামী লীগের বক্তব্য ছিল স্পষ্ট। নির্বাচনে জিতে আসার মতো জনপ্রিয়তা না থাকলে কাউকে আসন ছেড়ে দেবে না। এটা আওয়ামী লীগের নির্বাচনি নীতিমালার অন্তর্ভুক্ত। নৌকার বাইরে গিয়ে যারা নির্বাচন করছেন, নির্বাচনে জয়-পরাজয়ের মাধ্যমে প্রকৃত অবস্থা বোঝা যাবে। তবে আশা জাগানিয়া কোনও আলামত দেখা যাচ্ছে না এটাও বাস্তবতা।

১৪ দলীয় জোটের শরিক দলগুলোর এই অবস্থার কোনও কারণ আছে কী? ১৫ বছরের বড় একটি সময় মন্ত্রিত্বও পেয়েছিলেন তাদের কেউ কেউ। ধরা গেলো মন্ত্রিত্ব চালানোর কারণে তারা সংগঠনের দিকে নজর দিতে পারেননি। কিন্তু একাদশ সংসদে ১৪ দলীয় জোটের শরিকদের কোনও মন্ত্রী বানানো হয়নি। এমপি হিসেবে তাদের হাতে ছিল বিশাল সুযোগ এবং সময়ও। তারা কি তাদের দলকে সংগঠিত করতে পেরেছিলেন? বাস্তবতা হচ্ছে, শরিক দলগুলোর একটিও সাংগঠনিক দিক থেকে শক্তিশালী হতে পারেনি।

তাদের যে সুযোগ ছিল তা যদি তারা সঠিকভাবে কাজে লাগাতেন তাহলে আওয়ামী লীগের প্রতিপক্ষ হিসেবে তারা আগামীতে নিজেদের দাঁড় করাতে পারতেন। তারা যে ব্যর্থতা স্বীকার করেছেন- আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিট না পাওয়া থেকে প্রমাণ হয়ে যায়। সুতরাং আগামীতে বাংলাদেশে বিরোধী দলবিহীন রাজনীতি চলার জন্য এই দলগুলোর দায়মুক্ত হওয়ার সুযোগ থাকে না।  

কোনও অঘটন না ঘটলে এটা বলা যায়, দেশ পরিচালনার ভার আবারও আওয়ামী লীগের ওপরই বর্তাবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের মানুষ এই ধারাবাহিকতাকে স্বাগত জানাবেন। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা যারা কামনা করেন তারাও খুশি হবেন। কিন্তু শক্তিশালী বিরোধী দলের প্রয়োজনীয়তার কথা যারা স্বীকার করেন তাদের এক্ষেত্রে খুশি হওয়ার কোনও কারণ নেই।

জাতীয় পার্টি ‘সরকারি সহানুভূতি’ নিয়ে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, তাদের ২৬টি আসন ছেড়ে দিয়েছে আওয়ামী লীগ। কিন্তু অধিকাংশ আসনে আবার স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতারা। সুতরাং এই ২৬ আসনেরও সব কটাতে যে জাতীয় পার্টি জয়ী হবে তারও গ্যারান্টি নেই। তারপরও তাদের অবস্থান অন্যদের তুলনায় কিছুটা ভালো। তাদের যদি আগামীতে প্রকৃত বিরোধী দলের ভূমিকায় দেখা যায়, তাহলে সেই শূন্যতা কিছুটা হলেও পূরণ হবে।

জাতীয় পার্টিও তাদের সাংগঠনিক শক্তি বাড়াতে পারেনি গত সময়। এর জন্য এই দলটিকে বিএনপির অনুকরণে ক্ষমতায় থেকে সৃষ্ট দল হিসেবে মনে করা হলেও, তারা গত ১৫ বছরে অনেক সুযোগ পেয়েছিল সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য। কিন্তু তাদের সময় গেছে দেবর-ভাবির বিবাদ নিয়ে। ফলে ক্ষয়ে যাওয়া শক্তি নিয়েই তারা নির্বাচনি মাঠে নেমেছে।

জাতীয় পার্টিও যদি আগামীতে প্রকৃত বিরোধী দলের ভূমিকায় রাজনীতি করে এবং তাদের সঙ্গে যদি ১৪ দলীয় জোটভুক্ত দলগুলো একজোট হতে পারে তাহলেও কিছুটা শূন্যতা পূরণ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

বিএনপিকে আরেকটি নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে, সংসদীয় বিরোধী দল কিংবা সরকার গঠনের যোগ্যতা অর্জনের জন্য। এই সময়টায় গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে একটি বড় শক্তির অনুপস্থিতি থেকে যাবে।

লেখক: মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক গবেষক

 
/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মন্ত্রী-এমপি’র আত্মীয়দের নিয়ে আ.লীগ কী ‘ইউটার্ন’ নিচ্ছে!
উপজেলা নির্বাচনমন্ত্রী-এমপি’র আত্মীয়দের নিয়ে আ.লীগ কী ‘ইউটার্ন’ নিচ্ছে!
‘মানুষের কত ফ্রেন্ড, কাউকে পাশে পাইলে আমার এমন মৃত্যু হইতো না’
‘মানুষের কত ফ্রেন্ড, কাউকে পাশে পাইলে আমার এমন মৃত্যু হইতো না’
বরগুনায় দুই সাংবাদিকসহ পাঁচ জনের বিরুদ্ধে সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা
বরগুনায় দুই সাংবাদিকসহ পাঁচ জনের বিরুদ্ধে সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলা
ভিনিসিয়ুসের জোড়ায় প্রথম লেগে বায়ার্নকে জিততে দেয়নি রিয়াল
চ্যাম্পিয়নস লিগ, সেমিফাইনালভিনিসিয়ুসের জোড়ায় প্রথম লেগে বায়ার্নকে জিততে দেয়নি রিয়াল
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ