X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

টিআরপি নিয়োগ: আইনজীবীদের আপত্তির কারণ কী?

মোহাম্মদ সিরাজ উদ্দিন
১৭ জানুয়ারি ২০২৪, ২০:৩২আপডেট : ১৭ জানুয়ারি ২০২৪, ২০:৩২

ট্যাক্স রিটার্ন প্রস্তুতকারীদের সংক্ষেপে টিআরপি বলে। এখানে টিআরপি একটি পদবিকে বোঝানো হয়েছে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের ট্যাক্স রিটার্ন প্রস্তুতকারী প্রফেশনে যারা থাকেন তাদের টিআরপি নামে সম্বোধন করা হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের আইন ও বিধিতে সম্প্রতি এই টিআরপি বা ট্যাক্স রিটার্ন প্রস্তুতকারী শব্দটি একটি আলোচিত বিষয়।

টিআরপি’র ইতিহাস:  দুনিয়ার সব দেশের নাগরিকদের ট্যাক্স দেওয়ার বিধান নেই। এখন পর্যন্ত ১০টি দেশের নাগরিকদের ট্যাক্স দিতে হয় না। এছাড়া অন্যান্য প্রায় দেশেরই নাগরিকদের নানাভাবে নানা নিয়মে ট্যাক্স দেওয়ার বিধান রয়েছে। ট্যাক্স দেওয়া উন্নত রাষ্ট্রগুলোর রাজস্ব বিভাগ করদাতাদের সেবা নিশ্চিত করার জন্য আয়কর পেশাজীবীর পাশাপাশি রিটার্ন প্রস্তুতকারী বা করদাতাদের সহায়তাকারী নিয়োগের উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু এতে সফলতার চিত্র খুব একটা দেখা যায়নি। দুই-একটি দেশের উদাহরণ নিচে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

ক) যুক্তরাষ্ট্রে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব পরিষেবা (আইআরএস) নিয়ন্ত্রণের একটি বিশেষ কর্মসূচি ছিল ট্যাক্স রিটার্ন প্রিপারার ইনিশিয়েটিভ। ২০১০ সালে আইআরএস এই কর্মসূচি ব্যাপক হারে শুরু করার পরিকল্পনা করে।

২০১১ সালে রেজিস্টার টিআরপি সংযুক্ত করে অভ্যন্তরীণ রেভিনিউতে সহায়ক হিসেবে এর পরীক্ষামূলক ব্যবহার শুরু করে। পরবর্তী সময়ে টিআরপিগণের যোগ্যতা ও সেবার মান নিয়ে নানান সীমাবদ্ধতার অভিযোগ আসতে শুরু করে। এতে টিআরপিতে সংযুক্ত ব্যক্তিদের প্রশিক্ষণ প্রদান ও বার্ষিক মূল্যায়ন পরীক্ষা গ্রহণের একটি নীতি’র বিতর্কে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব পরিষেবার (আইআরএস) সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই বিষয়ে একটি মামলায়, ১৮ জানুয়ারি ২০১৩ সালের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কলম্বিয়ার জেলা আদালতের বিচারক জেমস ই. বোসবার্গের একটি আদেশের মাধ্যমে টিআরপি প্রোগ্রামটি স্থগিত হয়ে যায়। আইআরএস পক্ষ থেকে এই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছিল। আইআরএস টিআরপি’র যোগ্যতা নির্ধারণে, তাদের পদবি ও শিক্ষাগত যোগ্যতা ও সেবা নিশ্চিতকরণ, কার্যক্রমের পরিধির বর্ণনায় যথার্থতা নিরূপণ ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির যোগ্যতা নির্ধারণে যুক্তিযুক্ত কারণ আদালতে উপস্থাপন করতে ব্যর্থ হওয়ায় ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইউএস কোর্ট অব আপিল ফর দ্য ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়া সার্কিটের কর্তৃক নিম্ন কোর্টের আদেশ বহাল রাখে। যার ফলে স্থায়ীভাবে টিআরপি কার্যক্রম বাতিল হয়ে যায়।

খ) ভারতে টিআরপি: ভারতের অর্থ মন্ত্রণালয় (রাজস্ব বিভাগ) (সেন্ট্রাল বোর্ড অব ডাইরেক্ট ট্যাক্সেস), ২৮ নভেম্বর ২০০৬ সালে ২০৩৯ নং এসও’র মাধ্যমে টিআরপি নিয়োগ, এর যোগ্যতা ও কার্যপরিধি বর্ণনা করে একটি বিধিমালা প্রণয়নের ঘোষণা দেয়। উক্ত বিধিতে টিআরপি’র জন্য আবেদনকারীর শিক্ষাগত যোগ্যতার জন্য ন্যূনতম মান নির্ধারণ করা হয়েছিল। যেমন, ব্যবসায় শিক্ষায়, ব্যবস্থাপনা, অর্থনীতি বা আইন বা গণিত বা পরিসংখ্যান বিষয়ে স্বীকৃত ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রিধারী যেকোনও ব্যক্তি ট্যাক্স রিটার্ন প্রস্তুতকারী হিসাবে কাজ করার যোগ্য হবেন।

কিন্তু প্রশ্ন দেখা দেয় টিআরপি’র ফি নির্ধারণ ও এই পেশার কাজে সময় নিয়ে। সারা বছর এই পেশার তেমন কাজ থাকে না। শুধু ট্যাক্স মৌসুমে টিআরপিগণ করদাতাদের সেবা দেবে এবং নির্ধারিত ফি নেবেন। এতে অব্যাহতভাবে পেশাগতভাবে টিআরপি সনদধারীরা টিকে থাকতে পারছেন না। তাদের ন্যূনতম ফি দেওয়ার যে বিধান রয়েছে তাতে ও পেশাদার টিআরপি তৈরি করতে ভারতের রাজস্ব বিভাগ কোনও উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করতে পারেনি। ফলে ভারতের রাজস্ব বিভাগের টিআরপি স্কিমটিও তেমন অবদান রাখতে পারছে না।

বাংলাদেশে টিআরপি উদ্যোগ: জাতীয় রাজস্ব বোর্ড মে, ২০২৩-এ একটি বিধিমালা (এসআরও নং ১৬৮/ আইন/ আয়কর/ ২০২৩, ২৩ মে, ২০২৩) প্রকাশ করে। তখন থেকে বাংলাদেশে প্রথম টিআরপি আলোচনায় আসে। এই আলোচনাই শুধু আলোচনাতে থাকেনি, ব্যাপক হারে এর বিপক্ষে মতামত প্রকাশ করেছে আইনজীবী সমাজ ও বৃহৎ কর আইনজীবী সংগঠন, ঢাকা ট্যাক্সেস বার অ্যাসোসিয়েশনসহ দেশের প্রায় ৬৫ কর আইনজীবী সমিতি। শুধু তাই নয়, নানা মহল থেকে এনবিআরকে এই বিষয়ে অগ্রসর না হওয়ার পরামর্শও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এনবিআর’র পক্ষ থেকে এই বিষয়ে তেমন সাড়া পাওয়া যায়নি। এনবিআর ১৪ ডিসেম্বর চূড়ান্তভাবে টিআরপি নিয়োগের সার্কুলার ইস্যু করে।

টিআরপি নিয়ে বিতর্ক কেন?

এই বিষয়ে বলার আগে এই কলামের ওপরে যুক্তরাষ্ট্র এবং ভারতের টিআরপি’র পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, আমাদের টিআরপি নিয়োগ বিধিমালায় সীমাবদ্ধতা রয়েছে।

যেমন:

ক) যেখানে ভারত সুনির্দিষ্ট ও গুরুত্বপূর্ণ কতিপয় বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রিধারীদের টিআরপি সনদ প্রদানের বিষয়ে ঠিক করে দিয়ে কাঙ্ক্ষিত সেবা নিশ্চিত করতে পারেনি, সেখানে আমাদের টিআরপি নিয়োগে জেনারেল/সব বিষয়ে এ ডিগ্রিধারীদের সুযোগ থাকায় এদের যোগ্যতার ঘাটতি থাকবে এবং সেবার মান নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হবে।

খ) ফি নির্ধারণ সঠিক পর্যালোচনার ঘাটতি আছে। যার কারণে টিআরপিগণ কাজে আগ্রহী হবে না, ফলে কাঙ্ক্ষিত উদ্দেশ্য অর্জনে ব্যাহত হতে পারে।

গ) টিআরপিদের তদারকি সংস্থা নির্বাচন বিষয়টি স্পষ্ট নয়; কারণ দেশের সব জেলা/ উপজেলা পর্যায়ে এমন প্রতিষ্ঠান পাওয়া সহজ হবে না। এতে সেবার মান ব্যাহত হতে পারে।

ঘ) বিধি মোতাবেক টিআরপি সনদধারীগণ শুধু রিটার্ন প্রস্তুতকারী হিসেবে কাজ করবে। মানে তারা মৌসুমি সেবাদাতা হিসেবে কাজ করবে, শুধু ট্যাক্স রিটার্ন জমার সময়ে (২-৩ মাস), অবশিষ্ট সময়ে (৯-১০) মাস তাদের কাজ থাকবে না। ফলে পেশাদারি সেবা দিতে যেরূপ অভিজ্ঞ হওয়ার কথা সেরূপ অভিজ্ঞতা অর্জন করবে না।

ঙ) পেশাদার হিসেবে সারা বছর কাজ না থাকায় এখানে অপেশাদার কাজে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে, ফলে রাজস্ব বিভাগ প্রশ্নের মুখে পড়বে।

দেশের সব ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের করযোগ্য নাগরিকদের করনেটে আনার জন্য এবং রাজস্ব বৃদ্ধিতে টিআরপি’র বিকল্প হিসেবে যে সুপারিশগুলো এনবিআর বিবেচনায় নিতে পারে:

­­১. উপজেলা/জেলা পর্যায়ে কমপক্ষে ৫/১০ জন আইনজীবীর সনদ প্রদানের ব্যবস্থা করা;

২. জেলা/উপজেলাভিত্তিক ট্যাক্স বার অনুমোদন দেওয়া এবং আইনজীবীদের পেশাগত দায়িত্ব পালনে সহায়তা করা;

৩. সরাসরি করদাতা বৃদ্ধিতে কর আইনজীবীদের সম্পৃক্ত করা; এতে বাস্তব অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে ব্যাপক হারে করদাতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হতে পারে;

৪. কর-আইনজীবীদের বিভিন্ন অঞ্চল ও এলাকায় ভাগ করে করদাতার সেবা নিশ্চিত করার দায়িত্ব প্রদান করা যেতে পারে;

৫. কর-আইনজীবীদের নিয়ন্ত্রণ ও পেশাগত আচরণবিধি পরিপালন করার জন্য ট্যাক্স কাউন্সিল গঠন করা;

৬. কর-আইনজীবীদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান;

৭. কর-আইনজীবীদের নতুন করদাতা তৈরি ও কর আদায়ের জন্য কমিশন প্রদান করা যেতে পারে;

৮. সনদ প্রাপ্তদের আবশ্যিকভাবে পেশায় নিয়োজিত থাকার শর্ত দেওয়া; নতুবা সনদ বাতিল করার শর্ত দেওয়া; একইভাবে ইতোপূর্বে যারা সনদ নিয়েছেন; কিন্তু পেশায় নেই, তাদের সনদ বাতিল করা।

আমাদের আরও সময় নিয়ে এই বিষয়ে অগ্রসর হওয়া দরকার। কারণ, একটা পদ্ধতি চালু করতে রাষ্ট্রের ব্যাপক আর্থিক ব্যয়ের সম্পর্ক থাকে। পরবর্তীতে দেখা যায়, কিছু লোকের স্বার্থ শেষ, উদ্যোগও তেমন কাজে আসে না, রাষ্ট্র আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অনুরূপ কোনও সিদ্ধান্ত রাজস্ব বিভাগের অনন্ত যাওয়া উচিত না। কারণ, রাজস্ব আদায় যেখানে বারবার নিম্নমুখী সূচক বিদ্যমান, সেখানে আর্থিক ব্যয়ের সম্পর্কিত বিষয়গুলো সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হওয়া দরকার।

লেখক: আয়কর আইনজীবী

[email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও মার্কিন থিঙ্কট্যাংকের প্রশংসা
শেখ হাসিনার নেতৃত্ব ও মার্কিন থিঙ্কট্যাংকের প্রশংসা
শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘনে জরিমানার পরিমাণ বাড়ছে: আইনমন্ত্রী
শ্রমিক অধিকার লঙ্ঘনে জরিমানার পরিমাণ বাড়ছে: আইনমন্ত্রী
চুয়াডাঙ্গাকে টপকে মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড গড়লো যশোর
চুয়াডাঙ্গাকে টপকে মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রার রেকর্ড গড়লো যশোর
দুই ম্যাচ হাতে রেখেই চ্যাম্পিয়ন আবাহনী 
ঢাকা প্রিমিয়ার লিগদুই ম্যাচ হাতে রেখেই চ্যাম্পিয়ন আবাহনী 
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ