X
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪
২৩ বৈশাখ ১৪৩১

বাঁশখালীর কান্না: ‘খুব জুলুমে আছি, খুব নির্যাতনে আছি’

গোলাম মোর্তোজা
২৫ মে ২০১৬, ১৫:৫০আপডেট : ২৫ মে ২০১৬, ১৬:১৭

গোলাম মোর্তোজা আমরা গণমাধ্যম কর্মীরা রাজনীতিবিদসহ দেশ পরিচালনাকারীদের সমালোচনা করি এই বলে যে, তারা হাতির মতো জঙ্গলে মুখ লুকিয়ে ভাবে- কেউ দেখছে না।
গণমাধ্যমের ওপরও এমন দায় কি কখনও কখনও পড়ে না? হয়তো পড়ে। কেউই তো শতভাগ শুদ্ধ নয়। দোষ-ত্রুটি সবারই থাকে। অথবা এত ঘটনা-দুর্ঘটনার দেশে গণমাধ্যম সব বিষয় সব সময় সমান গুরুত্ব দিয়ে তুলে ধরতে পারে না। তারপরও আমাদের মতো দেশে গণমাধ্যমের ওপর মানুষের বিশাল আস্থা, প্রত্যাশা। তা যে একেবারে পূরণ করতে পারছে না, তেমন নয়। অনেক রকমের প্রতিকূলতার মাঝেও গণমাধ্যম তার দায়িত্ব পালন করছে। দেশে বিবেক বিক্রি করে দেওয়া গণমাধ্যম কর্মী-নেতা যেমন আছে, তেমনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দায়িত্ব পালন করা সংবাদকর্মীও আছেন। কোন দিকে সংখ্যা বেশি, সেই বিতর্কে না গিয়ে চট্টগ্রামের বাঁশখালীর মানুষের আন্দোলন প্রসঙ্গে কিছু কথা বলতে চাইছি। সেখানে কী ঘটছে আর গণমাধ্যমের সংবাদে কিভাবে কতটা প্রতিফলিত হচ্ছে, সে বিষয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা।
১. চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে এস আলম গ্রুপ ১৩২০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করবে। এলাকাবাসী যা চায় না। এলাকার মানুষ কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র বিরোধী আন্দোলন করছেন। আন্দোলনকে দমন করার জন্যে এস আলম গ্রুপের ক্যাডার বাহিনী এবং পুলিশ বাহিনী গুলি চালিয়ে ৪ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করলো। আহত হলো শতাধিক। ঘটনাটি গত ৪ এপ্রিলের।
গুলি চালানোর মতো উত্তপ্ত পরিস্থিতি সেখানে বিরাজ করছে, সেদিনের ঢাকার কোনও গণমাধ্যমে তার প্রতিফলন ছিল না। ঢাকার পরেই চট্টগ্রামে দেশের পত্রিকা-টেলিভিশনগুলোর ব্যুরো অফিস আছে। আছেন সংবাদকর্মী, লোকজন।
কিন্তু প্রায় কোনও ভিডিও ফুটেজ নেই, ছবি নেই। কারণ কী? প্রশ্নটি খুব স্বাভাবিকভাবেই সামনে আসে। উত্তর পাওয়া গেল, পরিস্থিতি এমন হতে পারে, কেউ ধারণা করতে পারেননি। যাইহোক সেদিনের অনলাইনে, টেলিভিশন সংবাদে এবং ছাপা পত্রিকায় সংবাদটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান পেল। তার পরের দিন থেকে সংবাদটি গুরুত্ব হারাতে শুরু করলো। এস আলম গ্রুপের বিজ্ঞাপন গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে নিল। আস্তে আস্তে বাঁশখালীর মানুষের কথা, উধাও হয়ে গেল টেলিভিশন-পত্রিকা থেকে।

আরও পড়তে পারেন: যেভাবে জামায়াত নিষিদ্ধ করতে চায় সরকার

২. বাঁশখালীর গন্ডামারা এলাকায় প্রায় ৫০ হাজার মানুষের বাস। লবণ চাষ তাদের অন্যতম জীবিকা। কৃষি কাজও আছে। তাদের উচ্ছেদ করে বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে চায় এস আলম গ্রুপ। বাঁশখালী, গন্ডামারার এই ৫০ হাজার মানুষ গত ৪ এপ্রিলের পর থেকে অবরুদ্ধ অবস্থায় জীবনযাপন করছেন।

বিপুলসংখ্যক পুলিশ বাহিনী পুরো এলাকা অবরুদ্ধ করে রেখেছে। গ্রামের সব প্রবেশ পথে পাহারা বসিয়েছে পুলিশ। গ্রামের কোনও মানুষ বের হতে পারছেন না।

অথচ টেলিভিশন-পত্রিকায় কোনও সংবাদ নেই। গত ২১ মে ঘূর্ণিঝড় ‘রোয়ানু’র কারণে এই এলাকায় ৭ নম্বর বিপদ সংকেত ছিল। এত বড় বিপদের সময়েও গ্রামের মানুষের পাশে কেউ দাঁড়ায়নি। পুলিশি পাহারা এবং ধরপাকড়ের মধ্যে ৭ নম্বর বিপদ সঙ্কেত নিয়ে তারা গ্রামে অবস্থান করেছেন।

৩. বাঁশখালীর মানুষের আন্দোলনের নেতা মো. লিয়াকত আলী। সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান। এলাকার জনপ্রিয় মানুষ। পুলিশ গ্রাম ঘেরাও করে রেখেছে। গ্রামের ভেতরে মানুষ অবস্থান নিয়ে প্রতিরোধ তৈরি করে আছে। এস আলম গ্রুপ এবং পুলিশের প্রধান টার্গেট এখন লিয়াকত আলী। তিনি বিএনপি, তিনি জামায়াত নানা পরিচয়ে পরিচিতি করা হচ্ছে। লিয়াকতের প্রতি গ্রামের মানুষের আস্থায় ঘাটতি হচ্ছে না। পুলিশ  হন্যে হয়ে খুঁজছে লিয়াকতকে। গত ১৬ মে ২৬ প্লাটুন পুলিশ গিয়েছিল লিয়াকতকে গ্রেফতার করতে। নেতৃত্বে ছিল দুইজন এসপি। গ্রামের মানুষের ভালোবাসার এবং প্রতিরোধে পুলিশ গ্রেফতার করতে পারেনি লিয়াকতকে। গ্রেফতার করেছে লিয়াকতের পিতা ৭০ বছরের বৃদ্ধ অসুস্থ রোগীকে।

আরও পড়তে পারেন: অসহিষ্ণুতার প্রতি সহিষ্ণু সমাজ?

লিয়াকত আত্মগোপনে আছেন। আত্মগোপনে থাকা লিয়াকতের একটি দীর্ঘ সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছে ‘সাপ্তাহিক’-এর বর্তমান সংখ্যায়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাংবাদিক আনিস রায়হান। সাক্ষাৎকারে লিয়াকত বলেছেন, ‘৭ নম্বর বিপদ সংকেত মাথায় নিয়েও গ্রামের মানুষ সেখানেই অবস্থান করতে বাধ্য হয়েছেন। এই এলাকায় প্রায় ৫০ হাজার মানুষ আছেন। তাদের প্রায় ১০ কোটি টাকার লবণের ক্ষতি হয়েছে ঘূর্ণিঝড়ে। প্রায় দু’সপ্তাহ যাবত পুলিশ এলাকায় অভিযান চালাচ্ছে। ফলে মানুষ লবণ বিক্রি করতে পারেনি। ঝড় বৃষ্টি ও জলোচ্ছ্বাসের ফলে সেই লবণ ধুয়ে চলে গেল। আমরা ভাই খুব জুলুমে আছি, খুব নির্যাতনের মধ্যে আছি।’
লিয়াকতদের এই আর্তনাদ নগরের মানুষকে বিচলিত করে না ।

৪. বাঁশখালী তো বাংলাদেশেরই একটি অংশ। তারা তো বাংলাদেশেরই মানুষ। উন্নয়ন, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সবই হয়তো দরকার আছে। তা কি মানুষকে জুলুম করে, মানুষ হত্যা করে? বেঁচে থাকার, প্রতিবাদ করার অধিকার কি বাঁশখালীর মানুষগুলোর নেই? শত শত পুলিশ দিয়ে দিনের পর দিন অবরুদ্ধ করে রাখতে হবে তাদের? একজন লিয়াকত আলী দরিদ্র মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের নেতা। বিএনপি-আওয়ামী লীগের নেতারা বিক্রি হয়ে গেছেন। মেরুদণ্ড সোজা করে দাঁড়িয়ে আছেন লিয়াকত। টাকা দিয়ে তাকে কেনা যায়নি। প্রথমবার গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। পারবে না, তা নয়। লিয়াকত গ্রেফতার হতে পারেন। ক্রসফায়ারে নিহত হতে পারেন। অবরুদ্ধ করে, নির্যাতন করে গ্রামবাসীকে হয়তো বিতাড়িতও করা যাবে। গণমাধ্যম তার কিছুই জানবে না, দেখবে না, প্রকাশও করবে না?

গরিব মানুষের পাশে কেউ থাকবে না!

লেখক: সম্পাদক, সপ্তাহিক

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
প্রথম ধাপে ৭ শতাংশ কোটিপতি প্রার্থী
উপজেলা নির্বাচনপ্রথম ধাপে ৭ শতাংশ কোটিপতি প্রার্থী
আপাতত মেনশন নয়, আপিল বিভাগে সিরিয়াল অনুযায়ী চলবে মামলার শুনানি
আপাতত মেনশন নয়, আপিল বিভাগে সিরিয়াল অনুযায়ী চলবে মামলার শুনানি
ধূসর ছবির ঝকঝকে প্রিন্ট!
ধূসর ছবির ঝকঝকে প্রিন্ট!
এবার যুক্তরাষ্ট্রের সুপার গ্র্যান্ডমাস্টারের সঙ্গে ড্র করে ফাহাদের চমক
এবার যুক্তরাষ্ট্রের সুপার গ্র্যান্ডমাস্টারের সঙ্গে ড্র করে ফাহাদের চমক
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ