X
বুধবার, ১৫ মে ২০২৪
৩১ বৈশাখ ১৪৩১

‘অভিযুক্ত রাষ্ট্র’ কীভাবে করে গণপিটুনির বিচার?

ডা. জাহেদ উর রহমান
২৬ জুলাই ২০১৯, ১৭:৩৭আপডেট : ২৬ জুলাই ২০১৯, ১৭:৪০

ডা. জাহেদ উর রহমান এই যে জনগণের হাতে গণপিটুনিতে মানুষের মৃত্যু হচ্ছে আর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হচ্ছে—দুটোকে একই পাল্লায় মাপা যায়? ফেসবুকে অনেকেই, এমনকি অনেক কলামিস্টও দুটোকে এক করে দেখার চেষ্টা করছেন। আমরা কি বুঝতে পারছি, এটাও যে রাষ্ট্রের জন্য কতটা ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়ায়?
পরবর্তী আলোচনায় যাওয়ার আগে একটা সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ–তাদের জন্য এই লেখা নয়, যারা প্রতিটি বিচার-বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের পর সরকারি বাহিনীগুলোর ‘ভোররাতে অস্ত্র উদ্ধারের জন্য আসামিকে নিয়ে.../ আসামিরা অপরাধের জন্য সংগঠিত হচ্ছে এই খবর পেয়ে...’ এই বয়ানগুলোকে বিশ্বাস করেন।  এই লেখা তাদের জন্য, যারা নিশ্চতভাবেই জানেন, ২০০১ সালের বিএনপি নেতৃত্বাধীন ৪ দলীয় জোট সরকারের সময় থেকেই রাষ্ট্রীয় বাহিনী কিছু মানুষকে নানা তকমা লাগিয়ে স্রেফ ঠাণ্ডা মাথায় খুন করেছে, এখনও করছে।
যতদূর মনে পড়ে পিটিয়ে মারার বিরুদ্ধে আমরা অসাধারণ সোচ্চার আচরণ করেছিলাম বছর আটেক আগে।  ঢাকার আমিনবাজারে শবে বরাতের রাতে ছয় ছাত্রকে ডাকাত সন্দেহে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছিল। গত বেশ কয়েকদিন থেকে ছেলে ধরা আতঙ্কে সারাদেশে পিটিয়ে মানুষ মারার বিরুদ্ধে আবার আমরা বেশ সোচ্চার আচরণ করছি।  তখন যে কারণে আমরা এতটা সোচ্চার হয়েছিলাম, একই রকম কারণ এখন আবার তৈরি হয়েছে। এর কারণ বোঝা যাবে গণপিটুনিতে হত্যা নিয়ে ২২ জুলাই দেশের শীর্ষস্থানীয় একটি পত্রিকার শিরোনাম দেখলে– ‘গণপিটুনির শিকার প্রায় সবাই নিরীহ’।

আমিনবাজারের ঘটনায় ছয়জন ছাত্রকে পিটিয়ে মারায় আমাদের বিবেককে স্পর্শ করেছিল, কারণ ওই ছয়জন ডাকাত ছিল না।  চোর-ডাকাত, পকেটমার পিটিয়ে মারার ঘটনা আমাদের সমাজে দীর্ঘকাল থেকে ঘটে, ওসব নিয়ে আমরা কিছু বলিও না। আমরা অনেকে এটাকে অপরাধ কমানোর খুব ভালো একটা সমাধান বলে মনেও করি। গত সাড়ে ৮ বছরে ৮২৬ জনকে পিটিয়ে হত্যা করার রেকর্ড নানা পত্রপত্রিকায় পাওয়া গেছে।

এই যে কয়দিন আগেও ব্যাগের মধ্যে শিশুর কাটা মাথাসহ পাওয়া ব্যক্তিটিকে যখন পিটিয়ে মেরে ফেলা হলো, তখন সেটা নিয়ে আমরা কোনোরকম কথা বলিনি।  অনেকে নিশ্চয়ই উল্লসিত হয়েছি, এরকম পরপর কাণ্ড করা মানুষটাকে মেরে ফেলায়। সেখানে থাকতে পারলে আমরা অনেকেই হয়তো হাঁক লাগাতাম সেই ‘পুণ্যের’ অংশীদার হতে। আমরা কথা বলছি, সমালোচনা করছি, আক্ষেপ করছি, সোচ্চার হচ্ছি একজন নারী অথবা একজন প্রতিবন্ধী বাবা যখন সন্তানকে দেখতে এসে কিংবা একজন নিরপরাধ মানুষ গণপিটুনির শিকার হয়ে মারা যেতে দেখে।  

সমাজের মধ্যে ঘটে যাওয়া খুব বড় কোনও নৃশংসতা, বীভৎসতা অনেক সময়ই সেগুলো নিয়ে নতুন করে মূল্যায়ন করার সুযোগ করে দেয়। সেসব নৃশংসতা, বীভৎসতা থেকে বেরিয়ে আসার পথ দেখায়।  নৃশংস গণপিটুনির সাম্প্রতিক ঘটনাগুলো আমাদের সমাজে নিচের প্রশ্নগুলো অনিবার্যভাবেই তুলে দিতে পারতো –

একজন চোর, ডাকাত বা ছিনতাইকারী যদি হাতেনাতে ধরাও পড়ে তাকে কি পিটিয়ে মেরে ফেলা যায়? ডাকাতি বা ছিনতাইয়ের শাস্তি কি মৃত্যুদণ্ড? এমনকি যে অপরাধের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড (যেমন হত্যা) সেই অপরাধীকেও কি পিটিয়ে মেরে ফেলা জায়েজ? মেরে না ফেলে ভয়ঙ্কর পিটুনি দিয়ে মারাত্মকভাবে আহত করা যাবে? একজন অপরাধী, সে যত ভয়ঙ্করই হোক না কেন, সে কি এই রাষ্ট্রের নাগরিক নয়? তার কি রাষ্ট্রের কাছে ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার নেই? অপরাধীর কি মানবাধিকার নেই? যারা গণপিটুনি দিয়ে মানুষকে হত্যা করে বা আহত করে, তাদের কি আইনের আওতায় আনা হবে না? তাদের কি কোনও শাস্তি এই রাষ্ট্র দেবে না? 

আরও প্রশ্ন আসতে পারতো–কেন এই সমাজে এরকম ঘটনা ঘটে? এর পেছনে আমাদের সমাজ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার দায় কতটা? একটা রাষ্ট্রের বিচার ব্যবস্থা মানুষের হাতে কতটা অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেলে, মানুষ বিচার বিভাগের ওপর কতটা আস্থাহীন হলে এমন ঘটনা ঘটতে পারে? মানুষের মধ্যে নানা বিষয়ের অবদমন এখন কতটা প্রকট হয়েছে এবং কীভাবে সেটা মানুষকে এই ধরনের নৈরাজ্যের মুখে ঠেলে দেয়? 

ওঠা উচিত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নও– যে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রীয় বাহিনী নিজে বিনা বিচারে মানুষ হত্যা করে, সেই রাষ্ট্রে মানুষেরও কি এমন কাজ করার জন্য আগের চেয়ে অনেক বেশি উৎসাহিত হওয়ার কথা না?

এই দেশে এখন প্রতিদিন গড়ে ১ জনের বেশি মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছে। গত বছর হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে সাড়ে চারশ’র মতো আর এই বছর গত ছয় মাসে বিচার বহির্ভূত হত্যাকান্ডের সংখ্যা ২০০। 

একটা রাষ্ট্রে অপরাধ থাকবে। একটা রাষ্ট্রে যে কেউ চাইলে যে কাউকে খুন করে ফেলার চেষ্টা করতে পারে। আপন প্রাণের তোয়াক্কা না করলে অনেক ক্ষেত্রেই যে কাউকে খুন করায় সফল হওয়া যেতেই পারে। এই তো সেদিন আদালতে বিচারকের খাস কামরায় গিয়ে বিচারকের উপস্থিতিতে একজন আসামিকে খুন করেছে আরেক জন।

জনগণের পরস্পরের সঙ্গে পরস্পরের অধিকার রক্ষার কোনও চুক্তি নেই। তেমনটা যদি থাকতোও, সেটা ভঙ্গ হলে কী হবে, সেটা নির্ধারণ ও নিশ্চিত করার জন্য মাঝে খুব শক্তিশালী কোনও সংস্থা না থাকলে সেটা হতো অর্থহীন।  এজন্যই মানুষ সমাজবদ্ধ হয়েছে এবং ধীরে ধীরে রাষ্ট্রব্যবস্থা তৈরি করেছে।  নিজেদের বহু স্বাধীনতা ছেড়ে দিয়ে, শেষ বিচারে নিপীড়ক বল প্রয়োগকারী রাষ্ট্র তৈরি করার মাধ্যমে মানুষ আসলে চেয়েছিল রাষ্ট্র একটা এজেন্সি হিসেবে কাজ করে সমাজের শৃঙ্খলা এবং ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করবে। 

তাই রাষ্ট্রীয় বাহিনী যখন তার হাতে চলে আসা কোনও অভিযুক্ত অপরাধীকে বিনাবিচারে হত্যা করে ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের নামে, তখন মানুষকে নিরাপত্তা এবং ন্যায়বিচার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া রাষ্ট্র নিজেই হয়ে ওঠে এক ভয়ঙ্কর অপরাধী। আমি আমার নিরাপত্তা ও ন্যায় বিচারের দায়িত্ব যে রাষ্ট্রের কাছে দিয়েছিলাম, সেই রাষ্ট্র কোনোভাবেই আমাকে বিনা বিচারে মেরে ফেলতে পারে না, আমি যত বীভৎস অপরাধীই হই না কেন। 

কাউকে বিনা বিচারে খুন করে ফেলা কিন্তু আদৌ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ না, এটা বরং ক্ষমতার ক্ষয়িষ্ণুতার লক্ষণ। আমাদের ‘নির্বোধ’ সরকারগুলোও এই বাস্তবতা বোঝে না। একটা দেশে যে কেউ চাইলে আরেক জনকে খুন করে ফেলতে পারে। রাষ্ট্রের ক্ষমতা আসলে বিচার করতে পারার ক্ষমতা, যে ক্ষমতা রাষ্ট্রের অন্য কারও হাতে নেই। তাই রাষ্ট্র যখন তার বিচারের ক্ষমতা প্রয়োগ করে এবং সেটার মাধ্যমে যদি কাউকে এমনকি আইনি মৃত্যুদণ্ডের মাধ্যমে হত্যাও করে, সেটা রাষ্ট্রকে আরো শক্তিশালী করে।  ঠিক এই যুক্তিতেই বিচারবহির্ভূতভাবে মানুষকে খুন করে রাষ্ট্র আদতে তাকে একটা প্রতিষ্ঠান হিসেবে থাকার যোগ্যতাকে নষ্ট করে, রাষ্ট্র তখন রাস্তার এক খুনি পাণ্ডা ‘নয়ন বন্ডে’ পরিণত হয়।

 এটা একটুও বাড়িয়ে বলা হবে না যদি বলা হয়—তথাকথিত ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধের ব্যবহার করা প্রতিটা বুলেট আদতে রাষ্ট্রের মূল কাঠামোতে গিয়ে বিদ্ধ হয় এবং সেটিকে দুর্বল করে করে রাষ্ট্র ব্যবস্থাকেই ভেঙে দেয়। 

কোনও সন্দেহ নেই পিটিয়ে মানুষ মেরে ফেলা এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার। এর বিরুদ্ধে সোচ্চার হতেই হবে। এবং সেই সোচ্চার হওয়া মানে শুধু গণপিটুনিতে অংশ নেওয়া মানুষদের বিচারের আওতায় আনা না, এর গভীর সামাজিক, মনোবৈজ্ঞানিক কারণ খুঁজে বের করে সেটার সমাধান করা। এভাবে সমাধান না করে কিছু মানুষকে বিচারের আওতায় এনে এই অপরাধ থেকে মুক্ত হতে পারবো বলে যারা ভাবছি, তারা ‘মব/ক্রাউড সাইকোলজি’ নিয়ে ন্যূনতম ধারণাও রাখি না।

আর এই পরিস্থিতিকে সামলানোর জন্য সবার আগে দরকার রাষ্ট্র নিজেকে প্রস্তুত করা। গণপিটুনি বন্ধের পাশাপাশি এর চেয়ে হাজার গুণ বড় অপরাধ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করে মানুষের ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার নিশ্চিত করে তারপর জনগণকে ‘নসিহত’ এবং বিচার করতে আসা উচিত।

লেখক: সদস্য, স্টিয়ারিং কমিটি, জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট ও সদস্য, কেন্দ্রীয় কমিটি, নাগরিক ঐক্য

 

/এমএনএইচ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
‌‘এখনও ঘুমালে মনে হয় জলদস্যুরা এই বুঝি গুলি করলো’
এমভি আবদুল্লাহর চিফ অফিসার‌‘এখনও ঘুমালে মনে হয় জলদস্যুরা এই বুঝি গুলি করলো’
‘দলীয় সাংবাদিক’ ও সাংবাদিকতায় অনাস্থা
‘দলীয় সাংবাদিক’ ও সাংবাদিকতায় অনাস্থা
‘আমাদের ছাড়াতে এয়ারক্রাফটের মাধ্যমে মুক্তিপণ দেওয়া হয়েছিল’
‘আমাদের ছাড়াতে এয়ারক্রাফটের মাধ্যমে মুক্তিপণ দেওয়া হয়েছিল’
লিগ্যাল এইড পরিচালনায় অসামঞ্জস্য তুলে ধরলেন প্রধান বিচারপতি
লিগ্যাল এইড পরিচালনায় অসামঞ্জস্য তুলে ধরলেন প্রধান বিচারপতি
সর্বশেষসর্বাধিক