X
বৃহস্পতিবার, ১৮ এপ্রিল ২০২৪
৫ বৈশাখ ১৪৩১

একজন কথোয়াল এবং ব্যক্তি ও সমাজের যৌথ নকশিকাঁথা

গৌতম গুহ রায়
২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৪:৪০আপডেট : ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২০, ১৫:৫৩

গৌতম গুহ রায় গল্প বা উপন্যাস তো আসলে সময়ের আখ্যান,কিন্তু সেই ‘সময়’ নিরালম্ব নয়, তার উপস্থাপনায়, অর্থাৎ গ্রহিতার পুনর্বিন্যাসে সময়ের চরিত্রও নির্ধারিত হয়ে যায়। গ্রহিতা বা আখ্যানের পাঠক যদি সৃষ্টিশীল পুনর্নির্মাণে দক্ষ না হন, তবে তাঁর সময়বোধ ভ্রান্তি আচ্ছন্ন হতে বাধ্য। পার্থক্যে চিহ্নায়িত আমাদের এই সময়,এই সমাজ। আধুনিকোত্তর সময়ে মুখ ও মুখোশের প্রতীতি যখন অসম্ভব হয়ে পড়ছে, আকরণগত বিন্যাসের দ্বন্দ্বে মুছে যাচ্ছে মানব-পরিস্থিতির যাবতীয় আদি বোধ ও ধারণা, তখন একজন আখ্যানকারকে দায়িত্ব নিয়ে সামাজিক বিন্যাসের বয়ান, পুনর্বয়ান ঘটাতে হয় তাঁর সৃজনের মধ্য দিয়ে। পাঠক তাঁর পাঠান্তে সেই আখ্যানের অংশ হয়ে যান, এখানেই আখ্যানকারের সাফল্য মূল্যায়িত হয়। গল্প বা আখ্যান পাঠের শেষে পাঠক বাধ্য হবেন তাঁর নিজের মতো গন্তব্যে যেতে,লেখক নয়, পাঠকই কাহিনির আসল রূপকার। কাজী আনিস আহমেদের গল্প পাঠের পর আমি এই সিদ্ধান্তেই পৌঁছে যাই যে গল্প আসলে কাহিনির বিন্যাস ও পাঠককে নিছক বিনোদন দান করা নয়, পাঠককে তাঁর কল্পনাকে শাণ দেয়া,বিস্তার করানোও কথোয়ালের কাজ,তাই একে কাহিনির পরিবেশন নয়, একটি টেক্সটের বয়ান বলা যুক্তিসংগত। গল্প-উপন্যাসের একটা বড় কাজ পাঠকের ভালো লাগা, সেটা সমকালের পাঠক হতেই হবে,এমন কোনো দিব্যি কেউ দেয়নি,কিন্তু একদিন সে পাঠকের ভালো লাগার টেক্সট হবে, এটাই কাম্য, পাঠকের কাছে তাকে একদিন পৌঁছাতে হবে। আমরা মানি যে কবিতার প্রধান কাজ বাস্তবকে নির্বাস্তব করে তোলা,আর কথাসাহিত্যের চিরকালীন কাজ নির্বাস্তবকে বাস্তব করে তোলা,অনেক চোখে দেখা ঘটনা মিলে এলোমেলো যে জানা, যাকে একটু সোজা করে অভিজ্ঞতা ভাবা হয়,সেটাকে একটিমাত্র পরিসরে এনে বাঁধা। কাজী আনিস সেই কাজটি করেছেন, সুচারুভাবে। তাঁর অভিজ্ঞতার কেন্দ্রে ঢাকা শহর, কিন্তু বিস্তারে গোটা বাংলাদেশ, এর গ্রাম, এর গঞ্জ, এর দ্বিধাগ্রস্ত মানুষেরা। কেন্দ্রে যে শহর, তার নানা আলো-আন্ধকারের শেড নিয়ে অবয়ব পায় আনিসের কাহিনি। আমার পাঠ অভিজ্ঞতায় যে দুটো বই, তার অন্যতম ‘গুডনাইট মি. কিসিঞ্জার ও অন্যান্য গল্প’ এবং ‘চল্লিশ কদম’ আমাকে প্রলুব্ধ করেছে তাঁকে নিয়ে কিছু কথা বলার জন্য। এত নিরাসক্তভাবে আখ্যানের নির্মাণ, যেখানে ভরা থাকে বাংলাদেশের মুক্তির যুদ্ধ থেকে শুরু করে ব্যক্তিমানুষের ব্যক্তিগত সম্পর্কের নানা খাঁজ ও দ্বন্দ্ব।

কাজী আনিস আহমেদের প্রথম গল্প ‘চল্লিশ কদম’-এর শুরুটাই বেশ চমকে দেয়ার মতো। কবরে শায়িত মানুষটি, যার জীবিত অস্তিত্ব নেই, আবার আছেও, তার বয়ানে লেখা। মূল গল্পটি ইংরেজিতে লেখা, ‘দ্য ফোর্টি স্টেপস’। এর অনুবাদ করেছেন মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়। গল্পটি যখন পড়া শুরু করি, খুব ছোটবেলায় পড়া হ্যারল্ড রবিন্সের ‘আ স্টোন ফর ড্যানি ফিসার’-এর কথা মনে হচ্ছিল, ড্যানি কবরে শায়িত, তার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে একটি একটি করে উপলক্ষ্য রাখা হচ্ছিল। কিন্তু কিছুক্ষণের এই ভ্রান্তি কেটে যায়, এটি একদম ভিন্ন স্বাদের, স্বতন্ত্র স্বাদের আখ্যান। শুরুটাই টেনে নিয়ে যায়, ‘আগের সন্ধ্যাতেই মারা যাওয়ার পর শিকদার সাহেব এখন মাটির ছয় ফুট তলায় শুয়ে আছেন। মারা যে গেছেন সে সম্বন্ধে নিজে তিনি খুব একটা নিশ্চিত ছিলেন না বটে, তবে যারা তাঁকে কবর দিয়েছিল তারা অবশ্য পুরোপুরি নিঃসন্দেহই ছিল। সাদা কাফনে আপাদমস্তক ঢাকা, সেখানে শুয়ে শুয়ে এখন আর তাঁর মুনকার আর নাকির এই দুই ফেরেশতার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কিছুই করার নেই।’ এরপর কাহিনি এগিয়ে যায়, শিকদার সাহেবের বয়ানে, তার মৃত্যু-পূর্ব মুহূর্তের ঘটনা থেকে ক্রমশ পিছিয়ে যাওয়া। কৌশলী বয়ানের কারণে পাঠক বাস্তব আর বাস্তবোত্তর বর্ণনার মাঝে ঢুকে পড়েন। শিকদারের শেষ গোসল আর জানাজা ইয়াকুব মোল্লার বিশেষ তত্ত্বাবধানে হচ্ছিল। ‘জংধরা কোদাল দিয়ে তারা চটপট একটা গর্ত খুঁড়ে নিয়েছিল, যখন পাশেই শুয়ে শুয়ে তিনি গা থেকে মৃদু ঝিম ধরানো কর্পূরের গন্ধ ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন। তাদেরই কেউ কেউ গর্তের মাপমতো বাঁশের খুঁটি নিয়েছিল, আর অন্যরা তাঁকে গর্তে নামানোর তোড়জোড় করছিল। তাঁর চোখ দুটি যদি খোলা থাকত তো তিনি নিশ্চয়ই দেখতে পেতেন মাথার ওপরের আকাশের চৌকো চিলিতেটা একটু একটু করে বাঁশের খুঁটিতে ঢাকা পড়ে গেল ...।’ এর মাঝেও শিকদারের মনে ধন্দ আসে, সত্যিই কি তিনি মারা গেছেন, নাকি এ এক দুঃস্বপ্ন, তার বিবিসাহেবা তার ঘুম ভাঙিয়ে তাকে যেকোনো মুহূর্তে জাগিয়ে দেবেন, তাকে বলবেন যে তিনি সারা রাত ধরে এক খোয়াব দেখছিলেন। তার মনে জিজ্ঞাসা আসে, ‘সত্যিই কি কারও খোয়াবের মধ্যে অনুভ‚তির এমন জীবন্তরূপ বা চিন্তন আর এমন সচ্ছল প্রাঞ্জলতা সম্ভব?’ এই সূচনা পর্বেই কথাকার আরও দুটো সূত্র রেখে দেন, যা কাহিনির অন্তিম পর্বের সঙ্গেও জুড়ে আছে। একটি দাফন বা কবর ও বিবির প্রতি ভালোবাসার আকুতি। একটিমাত্র ষাট পৃষ্ঠার উপন্যাসের মধ্যে অনেকগুলো ভাঁজ রেখেছেন, বেশ কয়েকটি কম্পবিন্দু রেখেছেন কথোয়াল। একজন শিল্পীর পরিণতি, যে চিত্রকর হিসেবে প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন তিনি শেষ পর্যন্ত একজন কাঠের কাজের ব্যবসাদার হয়ে উঠলেন। জামশেদপুরের এক অজগাঁ থেকে দন্তচিকিৎসক হওয়ার বাসনা নিয়ে যেই ছাত্রটি ঢাকা নগরে গেলেন, তিনি হেকিম হয়ে ফিরলেন। কিন্তু এর মাঝেই তাঁর পরিচয় ঘটল এক সাদা চামড়ার ললিতকলা শিক্ষার্থীর সঙ্গে। এই ডসন ক্রমে আখ্যানটির একটি প্রধান চরিত্র হয়ে ওঠেন। এই ‘চল্লিশ কদম’-এর একটি প্রধান বিন্দু মন্দির-মসজিদ নিয়ে বিরোধ। আনিস সাহেব সাহসিকতার সঙ্গে তাঁর যুক্তিবাদী মন ও মানবতার পাঠ থেকে এই ঘটনাটিকে এনেছেন, যেটা তিনি না এনে অন্য কোনো গল্প বলেও ডসনকে জামশেদপুরে রেখে দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি সচেতনভাবেই এই বিতর্কিত ঘটনার বয়ান এনেছেন। ডসন চিত্রকর হওয়ার স্বপ্নে রণভঙ্গ দিয়ে ইংল্যান্ডের এক প্রত্নতাত্ত্বিক দলে কাজ জুটিয়ে নেন। প্রত্নতাত্ত্বিক গবেষণা ও খননের কাজে সেই সংস্থাটি জামশেদপুর এলে সেই দলের সদস্য হয়ে ডসনও চলে আসেন। কিন্তু এখানেই আখ্যানের বাঁক আসে। জামশেদপুরের চিহ্নিত জায়গাগুলোর প্রত্নতাত্ত্বিক সার্ভের ফাঁকে তারা প্রান্তের মসজিদটিও দেখতে যায়। ‘মসজিদের পশ্চিম দিকের পাঁচটি সবচেয়ে পুরনো থাম একেবারেই জীর্ণ দশায় গিয়ে পৌঁছেছে, তাদের সংস্কার বা মেরামতি হয়নি, যেমন হয়েছে ওই মসজিদের বাকি অংশের। আড়চোখে সন্তর্পণে তাকিয়ে, প্রত্নতাত্ত্বিকরা দেখতে পেয়েছে থামের লাল বেলেপাথরের গায়ে নর্তকীদের মূর্তির ভগ্নাংশ।...তাদের মনে কোনো সন্দেহই নেই যে এই মসজিদটি একদিন একটা মন্দির ছিল।’ এরপর স্বাভাবিকভাবেই কানাঘুষো ও দাঙ্গার আগুন ছড়িয়ে যায় এলাকায়। প্রত্নতাত্ত্বিক দল পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়, কিন্তু ডসনকে তারা ফেলে যায়, মারাত্মক ওলাউঠায় (কলেরা) শয্যাশায়ী সে। তখন তার একদিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে, উদ্ধারকর্তা হিসেবে দায়িত্ব নেন শিকদার সাহেব। এখানেই আর একটি ‘বাঁক’। চিকিৎসা পরিষেবাকে আরও ভালো করার জন্য শিকদার ঢাকায় যান। বাড়িতে ডসন ও এক অথর্ব দাই। ইংরেজি ভাষা ও আদব-কায়দা শেখানোর কারণে ও সুযোগে শিকদারের বিবির সঙ্গে ডসনের যে ঘনিষ্ঠতা হয়, তার পরিণতিই আখ্যানটির ক্লাইমেক্স। এখানে পাঠক রবি ঠাকুরের ‘গোরা’র ছায়া খুঁজতে পারেন, কিন্তু এখানে আনিস সাহেব গুরুত্ব দিয়েছেন ব্যক্তিমানুষের সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্কের নিবিড়তাকে। তিনি ‘সোনালি চুলের নবজাতক’কে আড়াল করেই রেখেছেন, কিন্তু তার জন্মরহস্য আখ্যানের কেন্দ্রে রেখেছেন, রহস্য প্রতীক হিসেবে রেখেছেন বাচ্চার কান্নাকে। ‘বাচ্চা কি মরাই জন্মেছিল? নাকি জন্মাবার পরেই মারা যায়?’ ‘মরা জন্মাবে কী করে? দাইবুড়ি বলে সে নাকি এক বাচ্চার কান্না শুনেছিল।’ ... ‘আর বাচ্চার কবরটা? দেখোনি ওদের উঠোনে তাল গাছের তলায় জমিটা কেমন ঢিবির মতো উঁচু হয়ে আছে।’ এখানেই একজন লেখকের মুনশিয়ানা। এই মুনশিয়ানায় নাতিদীর্ঘ উপন্যাসটিতে ‘যৌন কলঙ্কের’ রগরগে দাগ লাগেনি। মূল্যবোধের নিগরে বাঁধা সমাজের কাছে যা দুষ্কাম, তা ব্যক্তি সম্পর্কের সুগন্ধে ছাড়পত্র পেয়ে যায় মানবিক আখ্যানের। কেউ পরিষ্কার করে বলতে পারছে না বাচ্চাটা মৃত না জীবিত, গোর দেয়া হয়েছে কি হয়নি। কিন্তু ডসন ও সোনালি চুলের কথায় গল্পের পেছনের গল্পটা পাঠক পড়ে নিতে পারছেন।

কাজী আনিস আহমেদ ‘জামশেদপুরের সব কাহনেরই দুটো ভাষ্য থাকে। একটা ছড়ায় মুখে মুখে, আরেকটা বয়ে নিয়ে যায় চিমনির ধোঁয়া।... চিমনির ধোঁয়ার ভাষ্য জানায়: হ্যাঁ হ্যাঁ, দাইবুড়ি এক বাচ্চার কান্নার আওয়াজ শুনেছিল।...কে বলতে পারে উঠোনের ওই জমিনের ঢিবির তলায় সত্যি সত্যি কী আছে? ওই কবরটা কি নেহাতই লোকের ধারণাকে ভুল পথে চালনার জন্য? কোনো কিছু গোপন করার চেষ্টা, যাতে শিকদারের বাচ্চা সম্বন্ধে কোনো দিনও কেউ আর কোনো কথা জিজ্ঞাসা করতে না পারে?...’ এভাবে উপন্যাসের রহস্যজালকে বিস্তার করেন আনিস সাহেব, কিন্তু সমাধানের সিদ্ধান্ত ছেড়ে দেন পাঠকের কোর্টে। ‘চল্লিশ কদম’-এর শেষটা নিখুঁত, ছোটগল্পের মতো, ‘ডসন যখন গোরস্তানে পৌঁছল ততক্ষণে তারা শিকদার সাহেবের লাশটা কবরের মধ্যে নামাতে শুরু করেছে। ডসন দেখতে পেল তার দোস্তের শরীরটা সেলাই না করা সাদা ধবধবে একটা কাপড়ে মোড়া, তাঁর বুকের সাদা চুল ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে, ঠিক মুখটায় কাফনটা একটু কুঁচকে নড়ে গিয়েছে। নাকের বাঁশিতে তুলো গোঁজা...লহমার জন্য ডসনের মনে হলো সে যেন দেখতে পাচ্ছে তুলোর সুতো একটু নড়ে উঠেছে, যেন শিকদার সাহেবের শ্বাসপ্রশ্বাস পড়ছে।...বেহুঁশ দশায় আচ্ছন্ন পড়ে থাকা শিকদার সাহেবকে কিনা বিষণ্ন ও ভক্তি গদগদ জামশেদপুরীরা কবর দিয়ে দিয়েছে। তাদের ভুল তারা অবশ্য কোনো দিনই জানতে পারবে না। কিন্তু শিকদার সাহেব, হুঁশ ফিরে আসার পর কয়েক লহমার জন্য সন্দেহ করে বসবেন যে ভয়ানক একটা ভুল করে ফেলা হয়েছে।’

‘ফেরেশতারাও আসবে কি না, সে সম্বন্ধে তাঁর গভীর সন্দেহ আছে। শুধু যেটা তিনি নিশ্চয় করে জানতে পারবেন, সেটা হলো কাঠের ওই পাদুকা জোড়া ক-কদম যায়। কাঠের জুতোর তলির খটখট তিনি শুনতে পাচ্ছেন, ধীরে ধীরে দূরে চলে যাচ্ছে, তবে তা তাঁকে গুনে গুনে হিসাব করা থেকে কিন্তু আটকাতে পারেনি; ছত্রিশ, সাঁইত্রিশ...।’ এখানে পাঠক মনে করতে পারেন, ডসন স্থায়ীভাবে জামশেদপুরী হওয়ার সময় রবারের জুতো বাদ দিয়ে কাঠের সাবেকি খড়ম পরা ধরেছিল। উপন্যাসের শুরুতে সেই খড়মের কথা শিকদারের বয়ানে উঠে এসেছিল, ‘...ভেজা মাটির ওপর রবারের জুতোর চাপা আওয়াজগুলো থেকেই শিকদার সাহেব ধরে নিতে পারছিলেন যে, তাঁর জন্য যারা শোক প্রকাশ করতে এসেছিল, এখন তারা কবর থেকে হেঁটে চলে যাচ্ছে। রবারের জুতোর মিছিল থেকে খটখট আওয়াজ উঠছিল। একমাত্র খড়ম জোড়ার। শিকদার সাহেব মন দিয়ে সেই খড়মের আওয়াজ শুনতে লাগল...।’ পদক্ষেপ, খড়ম আখ্যানটিকে নিয়ে গেল এক ভিন্ন বয়ানের স্তরে। পাঠক যেখান থেকে তার মতো করে রস-রহস্য-তৃপ্তি কল্পনার আস্বাদন করতে পারবেন।

কাজী আনিসের কাহিনিগুলোর নিবিড় পাঠান্তে লক্ষ করা যাবে যে কালের গভীরতর মাত্রা আবিষ্কার করার প্রক্রিয়ায় তাঁর আখ্যানগুলো অনেকাংশে প্রচলিত সীমানা পেরিয়ে আমাদের প্রাত্যহিকতার সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে। আসলে সার্থক উপন্যাস বা আখ্যান বাচনে চিহ্নায়ক খচিত কবিতার মতো হয়ে যায়, যেখানে নিবিড় সখ্য আমাদের জীবনভাষ্য। পাঠককে লক্ষ করতে হবে আখ্যানের যাত্রাপথ স্থবির কোনো ভাবাদর্শের প্রতি অন্ধ আনুগত্যের পরিণতিতে ‘সহস্র শৈবালদামে’ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে কি না। আনিস সাহেবের এখানেই সাফল্য, তিনি তাঁর নির্মাণকে কোনো প্রাণহীন আদর্শ বা ধর্মীয় আচরণ, বিশ্বাসের সংবেদনহীন ধাতব দড়িতে বেঁধে রাখেননি। প্রেম, দেশবোধ, ধর্মচিন্তা  ইত্যাদি যাবতীয় ব্যাপারেই তিনি নির্মোহ থেকে বাস্তবের, মানবিকতার পাঠকে গুরুত্ব দিয়েছেন। তিনি ব্যক্তিজীবনে নানা স্তরের মানুষের সঙ্গে মিশেছেন, শিক্ষার কারণে, ব্যবসার কারণে, সামাজিক কারণে, মানুষকে দেখার এই বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতাকে তিনি তাঁর লেখায় প্রয়োগ করেছেন। আমরা তাই তাঁর গল্পে প্লট, বিষয়ের বৈচিত্র্য দেখি। তাঁর আখ্যানগুলোর কেন্দ্রে তাঁর ঢাকা শহর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভ‚মিকায় থাকে। কোনো শহর বা গঞ্জ শুধু তার বাইরের চাকচিক্য নিয়ে থাকে না, সেখানকার মানুষগুলোর ব্যর্থতা, স্বপ্ন, সাফল্য, বিষাদ, সংযুক্তি ও বিচ্ছিন্নতা মিশে যে গ্রাম নগর, তাই আসল চেহারা তার। ঢাকা শহরের ও তাকে কেন্দ্র করে যে বৃহত্তর পরিমণ্ডল, তার ব্যর্থতা সাফল্য আনন্দ বিষাদের আখ্যান তাঁর গল্প সংকলন ‘গুডনাইট মি. কিসিঞ্জার ও অন্যান্য গল্প’।

সাহিত্য আষ্টেপৃষ্ঠে সমাজস্পর্শ দ্বারা অনুলিপ্ত। যে সকল লেখক সমাজের গা বাঁচিয়ে, তাকে এড়িয়ে, সাহিত্য সৃষ্টির চেষ্টা করেন এবং ওই চেষ্টায় নিয়োজিত থাকাকালে এই আত্মপ্রসাদে মগ্ন থাকেন যে, তাঁরা যা রচনা করছেন, তা বিশুদ্ধ আনন্দের লীলাজাত সৌন্দর্যকমল, তাঁদের সেই সৃষ্টির জন্য সমাজের প্রকৃত চেহারা কী, তা জানেন না। জীবিকার সূত্রে, আত্মীয়তা বন্ধনের সূত্রে, রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি আনুগত্যের সূত্রে, আরও নানা সূত্রে লেখক তাঁর জন্মকাল থেকে মৃত্যুকাল পর্যন্ত আক্ষরিক অর্থে সমাজের হাতে ধরা হয়ে বাস করেন। এই মৌলিক সত্যটিকে অস্বীকার করার অর্থ সমাজকে না বোঝা, নিজেকেও না বোঝা। আত্মপরিচয়ের অভাব থেকেই বেশির ভাগ কল্পিত বা অবাস্তব নির্মাণের উদ্ভব। কাজী আনিস আহমেদ এই জায়গাটায় সৎ থেকে তাঁর নির্মাণের কাজ করেছেন। অবাস্তব কষ্ট কল্পনায়, অভিজ্ঞতার বাইরের কোনো অলীক জগৎ তিনি রচনা করেননি। তাঁর গল্পগুলো যেন আমাদের চারপাশের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো, আমরা তার ‘রিপিট অ্যাকশান’ পড়ছি, আর সেই ঘটনাগুলোর ‘আখ্যানের পেছনের আখ্যানের’ রস নিচ্ছি। সত্তরের দশকের দেশ যখন মুক্তির আকাক্সক্ষায় তৈরি হচ্ছে, সেই ক্রান্তিকালের ঢাকা শহরের ‘সব হারিয়ে যাওয়ার স্রোতে’ এক পাঞ্জাবি মেয়ে চামেলির সঙ্গে কথক গালিবের প্রেম ও প্রেম হারানোর গল্প। ঢাকার হারানো কৈশোরের গল্প ‘আয়েশাকে হারিয়ে’ আমাদের সামনে এনে দেয় সেই সমাজের ছবি, যেখানে সে একটি নানা শাখা-প্রশাখাবিশিষ্ট জটিল প্রতিষ্ঠান, ব্যক্তির প্রেম, আকাক্সক্ষা সেখানে আলাদাভাবে গুরুত্বহীন। অথচ এই সমাজকে এড়াতে চাইলেই এড়ানো যায় না। আমরা যখন ভাবছি সামাজের থেকে বিমুক্ত হয়ে শুধু নিজের কল্পনা ও মননের জোরে সাহিত্য সৃষ্টি করছি, হয়তো দেখব তখনো আমরা কোনো না কোনোভাবে সমাজের সঙ্গে সংযুক্ত থেকেই এই কাজ করছি। আনিস সাহেবের অন্যান্য গল্প সেই সমাজসন্নিহিত বয়ান। তাঁর ‘এলিফ্যান্ট রোড’ যেমন এক নিরীহ কেরানির চোখে দেখা জীবনের রূঢ় বাস্তব চেহারা, এখানে সমাজের বাস্তবতা ব্যক্তির থেকে মুখ্য হয়ে ওঠে পাঠকের কাছে। এমনই ‘ফেরার বছর’, আরও তীব্রভাবে নাগরিক জীবনের ব্যক্তি ও ব্যক্তির মাঝের শূন্য অবস্থাকে চিহ্নিত করেছেন কথাকার। আনিস আহমেদের বড় গল্প ‘আমার শত্রুরা’য় দেখি বৈভব আক্রান্ত ঢাকার ছবি, যেখানে ‘শাহবাজ সাহেব তার পুরোটা সকাল এবং অফিসেরও অর্ধেকটা সময় ধরে শুধু অনুপুঙ্খ নির্দেশনা দিয়েছেন রাতের আয়োজনটা কেমন কীভাবে হবে সে বিষয়ে। ফুল, ফুল! তিনি চাইলেন ব্যাংকক থেকে প্লেনে করে আনা তাজা অর্কিড।... আমরা এক অনক্ষত্রের মতো সাদা আলোকবিন্দু চাই যা বাগানের চেহারাটি শিকল জ্যামিতিক ভাঁজ ও বঙ্কিমতায় স্পষ্ট করে তুলবে।...’ এই গল্পের শেষে যেন লেখকের সামনে অবস্রিত ঢাকা শহর, যেখানে এই বৈভবখচিত নগর নেই, পুনর্জন্ম নিচ্ছে এক নতুন নাগরিক বয়ান। ‘...এই হারানো শহরের উদাহরণটি তার জন্য আজ এক বড় রকম সান্ত¡নার উৎস। কিছুই স্থায়ী নয়।...লোহায় পাথরে নির্মিত শহরও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। তারপরও মানুষ বানিয়ে যাচ্ছে শহর, বানিয়ে যাচ্ছে সাম্রাজ্য। পত্তন করছে নতুন জমি, নতুন বসতি। মানুষের গড়া শহর ধূলিসাৎ হয়ে যায়, এমনকি সেই শহরের গৌরবের ধবধবা কাহিনিগুলোও চুরমার হয়ে যায় বলেই কীর্তির মহত্ত¡ অস্বীকারের সুযোগ নেই। কেবল শূন্যতাটুকু হলেও টিকে থাকে।’ এভাবেই কাজী আনিস আহমেদের গল্প আসলে জীবনকে বোঝা ও বোঝানোর আখ্যান, মানুষের সঙ্গে ‘অপর’-এর সম্পর্ক সমীকরণের আখ্যান।

অন্য কথা

কথাকার আনিস সাহেবকে এই আলোচনার শেষ অংশে ভিন্ন একটি কারণে অভিনন্দন জানাই। সে তাঁর সাহিত্যজগতের সম্মিলনের মন্ত্র উচ্চারণের স্বপ্নের জন্য। আমার বাবা একটি কথা বলতেন, অর্থ অনেকেরই থাকে, কিন্তু মন সবার থাকে না, স্বপ্ন সবার থাকে কিন্তু তার অভিমুখ সমাজমুখী কি না, সেটাই বড় কথা। সাহিত্যের যে আন্তর্জাতিক আসর ঢাকা শহরে ফি বছর আয়োজিত হয়, তার তুলন এই তল্লাটে নেই। আন্তরিকতায় ও আয়োজনের নিখুঁত কুশলতায় অনন্য। কবিতা, গল্প, নাটকের সাংস্কৃতিক আয়ুধে সামাজিক অবক্ষয়কে রুখে দেয়ার এই প্রচেষ্টা অভিনন্দনযোগ্য। খুব কাছে থেকে দেখা মানুষটির আন্তরিক উষ্ণতা এই সাফল্যের অন্যতম ‘ইন্সটিংট’, সেলাম কাজী সাহেব।

লেখক: কবি ও অনুবাদক

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
সয়াবিন তেলের দাম পুনর্নির্ধারণ করলো সরকার
ইইউ দেশগুলোকে ইউক্রেনে ক্ষেপণাস্ত্র-বিধ্বংসী অস্ত্র পাঠাতে হবে: বোরেল
ইইউ দেশগুলোকে ইউক্রেনে ক্ষেপণাস্ত্র-বিধ্বংসী অস্ত্র পাঠাতে হবে: বোরেল
কানের সমান্তরাল তিন বিভাগে কোন কোন দেশের ছবি
কান উৎসব ২০২৪কানের সমান্তরাল তিন বিভাগে কোন কোন দেশের ছবি
বিএনপির কারণে ভিন্ন কৌশল নেওয়ার কথা জানালো আ.লীগ
উপজেলা নির্বাচনবিএনপির কারণে ভিন্ন কৌশল নেওয়ার কথা জানালো আ.লীগ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ