X
শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪
৭ বৈশাখ ১৪৩১

মমতা, গোলাম আলী ও শিবসেনা

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী
২১ জানুয়ারি ২০১৬, ১১:৪৫আপডেট : ২৪ জানুয়ারি ২০১৬, ১১:৩৯

বখতিয়ার উদ্দীন চৌধুরী গত পঁচিশ বছর ধরে কলাম লিখছি। রাজনীতি, ধর্মনীতি, অর্থনীতি নিয়ে বহু বিষয় নিয়ে লিখেছি। সবখানেই বিবাদ। আজ গান নিয়ে কলাম লিখব। জানতাম গানের কোনও জাত নেই, ধর্ম নেই, গান কোনও সীমান্তও মানে না। এখন দেখছি গানের জাত না থাকলেও, গানওয়ালাদের জাত আছে।
১৯৩০ সালে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়ে ছিলেন। অক্সফোর্ড হচ্ছে জগতের অভিজাত পণ্ডিতদের একেবারে মুখ্যতম কৌলিন্য পীঠ। অক্সফোর্ডে রবীন্দ্রনাথ যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তা ভারতের কোনও ধর্ম-দর্শন রাজনীতি কিছুই নয়- বাউল গান ও তার মানবধর্মকে নিয়েই তিনি বক্তৃতা দিয়েছিলেন। সারা বক্তৃতাব্যাপী তিনি হাসন রাজার গানের উদ্বৃতি দিয়েছিলেন বার বার।
রবীন্দ্রনাথ জমিদারের পুত্র, মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর তার পিতা, তার পিতামহ ছিলেন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন ভারতে রেলগাড়ির প্রবর্তন করেন তখন প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর কোম্পানিকে টাকা ধার দিয়েছিলেন। বিরাট জমিদারির মালিক ছিলেন তিনি। উত্তরাধিকার সূত্রে সব কিছু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পেয়েছিলেন পরবর্তী সময়ে। কুষ্টিয়া জেলার শিলাইদহে ঠাকুরদের জমিদারির কুঠিবাড়ি ছিল। পাবনা জেলার শাহাদাতপুরে ও ঠাকুরদের কুঠিবাড়ি আছে যেখানে বাংলাদেশর সরকার রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করার কথা ঘোষণা দিয়েছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন তাদের জমিদারি দেখাশোনা করার জন্য শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে আসতেন তখন কুষ্টিয়ার বাউল সম্রাট লালন জীবিত। লালনের ঘর ছিল শিলাইদহের অনতিদূরে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লালনকে অবসরে তাদের কুঠিবাড়িতে ডেকে এনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলাপ আলোচনা করতেন, গান শুনতেন। একতারা নিয়ে লালন কুঠিবাড়িতে পা রাখলেই নাকি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উতলা হয়ে উঠতেন। বিশ্ব ভারতীর উপাচার্য ক্ষিতিমোহন সেন শাস্ত্রী তার কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘লীলা’ বক্তৃতায় বলেছেন- বাউল সম্রাট লালনের শিষ্য ছিলেন রবীন্দ্রনাথ।
রবীন্দ্রনাথ তার গীতিকবিতা এবং নোবেল প্রাইজের জন্য লালনের কাছে ঋণী। বাউল গান আর গজল একই আঙ্গিকের । সুফিবাদীরা উভয় গানের ভক্ত। ১৯১৩ সালে যখন রবীন্দ্রনাথ নোবেল প্রাইজ পেলেন তখন বিশ্বের সকল প্রান্ত থেকে ‘তুমি পূর্ণ’ ‘তোমার পূর্ণতার স্বীকৃতি’ ইত্যাদি বলে হাজার হাজার বার্তা আসলো তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বললেন, ‘সকলে বলে পূর্ণ আমি, আমিতো অপূর্ণ তোমা বিহনে’। এটা ছিল তার সীমাবদ্ধ হৃদয়ে অসীমকে পাওয়ার আকুল বাসনা। বাউল করিম যখন বলেন, ‘আমি সরাবি চলেছি পথে সরে দাঁড়াও যত সুফিগণ, লাগিলে গন্ধ হইবে মন্দ- মলিন হবেরে তোর সুফি ত্বন’। করিমের এ সরাব বাস্তবের কোনও সরাব নয়। এটা তার প্রেমের সরাব। এ বাউলের কাছে জাত নেই, ধর্ম নেই, কোনও সীমানা নেই। সে ব্যাকুল হয়ে ঘুরছে তার অভিষ্টের সন্ধানে।
গত ১২ জানুয়ারি কলকাতা নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে এসেছিলেন ওস্তাদ গোলাম আলী খাঁন। ইনডোর স্টোডিয়ামের ভেতরে কোনও জায়গা ছিল না। বাইরে দাঁড়িয়ে লক্ষ লক্ষ লোক জায়েন্ট স্ক্রিনে গোলাম আলীর গজল শুনেছিলো। ইনডোর স্টেডিয়াম থেকে রাজভবন পর্যন্ত নাকি লোক আর লোক। গত নভেম্বর মাসে বোম্বের গজল প্রিয় লোকেরা বোম্বেতে ওস্তাদ গোলাম আলীকে একটা গজল-সন্ধ্যায় অংশ গ্রহণের জন্য দাওয়াত দিয়েছিলো। গজল-সন্ধ্যার আয়োজন যখন প্রায় সম্পন্ন হয়েছিলো তখন শিবসেনা ও আরএসএস ঘোষণা দিলো যে বোম্বেতে গোলাম আলীর কোনও গজল-সন্ধ্যা হতে পারবে না। মহারাষ্ট্রে এখন শিবসেনা ও বিজেপির সরকার। শেষ পর্যন্ত গোলাম আলীর গজলের আসর আর বসল না। কারণ গোলাম আলী মুসলমান আর তার বাড়ি পাকিস্তান। এর আগে তারা বলিউডের শ্রেষ্ঠ তারকা নায়ক আমির খান এবং শাহরুখ খানকে নিয়েও অনেক গণ্ডগোল করেছিলো। তাদেরও অপরাধ ছিল তারা মুসলমান।

ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের বাড়ি বাংলাদেশের ব্রাক্ষণবাড়ীয়ায় কিন্তু ভারতীয়রা এক সময় তাকে বাংলাদেশে আসতে দেয়নি। আদর করে সম্মান দিয়ে তাকে ভারতে রেখে দিয়েছিলো কারণ ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান ভারত ছেড়ে আসলে ভারতের সংস্কৃতিক জগতের ক্ষতি হবে। এখন কি এক পশু শক্তির অভ্যূদয় হলো ভারতে। অবশ্য অতি সম্প্রতি ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় অশুভ চক্র পুড়িয়ে দিয়েছে ওস্তাদ আলাউদ্দিন খানের স্মৃতি চিহ্নগুলো।

আগ্রায় আর সিকান্দারায় আকবরের সময়ে যখন মিয়া তানসেনের গানের আসর বসতো তখন নাকি হাজার হাজার লোকের সমাগম হতো রাজপ্রাসাদে। রাজা তাদের নাকি বাধা দিতেন না। একটা কথা এখনও প্রচলিত আছে মিয়া তানসেনের গানে নাকি যমুনার নিম্ন স্রোত উজানে বইতো।

গত ১২ জানুয়ারিতে ওস্তাদ গোলাম আলী খান আসলেন কলকাতায়। নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে গজল গাইলেন মন ভরে। কলকাতায় এখন তৃণমূল কংগ্রেস এর সরকার। মমতা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় মুখ্যমন্ত্রী। তিনিই সহযোগিতা করেছেন এই গজল সন্ধ্যার। তিনি এ অনুষ্ঠানটির উদ্বোধনও করলেন। পশ্চিম বাংলার বিজেপি বলছে এটা নাকি ভোটের গজল। মমতা তার উদ্বোধনী ভাষণে বলেছেন, ‘শিল্পীর দেশ নেই, সীমানা নেই। তারা সবকালের সব মানুষের আত্মীয়’। ওস্তাদ গোলাম আলী খান বললেন, ‘বাংলা যেভাবে আমাকে সম্মান দেখালো, যেভাবে আমাকে বুকে জড়িয়ে নিলো- তাতে আমি অভিভূত’।

মমতা কয়দিন পরে তার রাজ্যে ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ হবেন। এখন তার সতর্কতার সঙ্গে পা ফেলা দরকার। কোনও পদক্ষেপে কোনও গোষ্ঠী অসন্তুষ্ট হয়। কিন্তু তা বিবেচনায় না এনে মমতা ভারতের অসাম্প্রদায়িক চরিত্রের পক্ষে অবস্থান নিয়ে এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব সম্পাদন করেছেন। এ থেকে মহারাষ্ট্রের রাজ্য সরকারের শিক্ষা নেওয়ার তৌফিক হয় কিনা জানি না। আমরা এ বাংলার মানুষও মমতার এ উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করি।

ওস্তাদ গোলাম আলী খান ১২ জানুয়ারি কলকাতার নেতাজি ইনডোর স্টেডিয়ামে লাখো শ্রোতার  উদ্দেশে মন ভরে গজল পেশ করলেন। তিনি নাকি যখন ‘মেরে মনজিল কাহা, মেরে ঠিকানা কাহা, সিরফ এক বার মোলাকাত দে দো’- এ গজলটা পেশ করেছিলেন তখন নাকি স্রোতারা  অঝোরে কেঁদেছিলেন। এমতো সাধু কথার গান করার একটা লোককে উগ্রবাদীরা বোম্বেতে গান করতে দিলো না। যা হোক মমতা উগ্রবাদীদের একটা শিক্ষা দিলেন।

ভারত বহু জাতির দেশ, এক অভিন্ন সত্ত্বায় বিরাজমান ছিল বহু শতাব্দি। নানা ঐতিহাসিক কারণে ভারত বিভক্ত হয়েছে সত্য কিন্তু তার সাংস্কৃতিক মনন এখনও অভিভাজ্য।

লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলাম লেখক

[email protected]

 

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
হাজারীবাগে নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে শ্রমিকের মৃত্যু
হাজারীবাগে নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে শ্রমিকের মৃত্যু
ব্রাজিলিয়ান মিগেলের গোলে কষ্টে জিতলো কিংস
ব্রাজিলিয়ান মিগেলের গোলে কষ্টে জিতলো কিংস
তীব্র গরমে সুপার লিগে দুই দিন করে বিরতি
ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগতীব্র গরমে সুপার লিগে দুই দিন করে বিরতি
ড্রিমলাইনারের কারিগরি বিষয়ে বোয়িংয়ের সঙ্গে কথা বলতে বিমানকে মন্ত্রীর নির্দেশ
ড্রিমলাইনারের কারিগরি বিষয়ে বোয়িংয়ের সঙ্গে কথা বলতে বিমানকে মন্ত্রীর নির্দেশ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ