X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

খোলা চিঠি সুন্দরের কাছে

আহসান কবির
১৮ মার্চ ২০১৬, ১৬:৫৯আপডেট : ১৮ মার্চ ২০১৬, ১৭:১১

আহসান কবির শ্রদ্ধেয় ড. আতিউর রহমান,
আপনাকে সালাম। আপনার কাছে লেখা চিঠিটার শিরোনামটা ধার (এটাকে হয়তো বলা যেত হ্যাক। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক হ্যাক-এর জায়গা থেকে সরে এসে এখন বলছে চুরি!) করেছি কথা সাহিত্যিক আনিসুল হকের কাছ থেকে। ‘খোলা চিঠি সুন্দরের কাছে’ আনিসুল হকের প্রথম কবিতার বইয়ের নাম। আপনাকে জানার পর থেকেই আপনাকে সুন্দর মনে হতো, এখনও হচ্ছে। পদত্যাগ বাংলাদেশের রাজনীতির ঐতিহ্য নয়, পদ আঁকড়ে রাখাই ঐতিহ্য। আপনি সুন্দর বলে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন, যদিও আপনার কাছ থেকে আমি এটা ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসেই আশা করেছিলাম। দুর্জনেরা আপনার পদত্যাগের পর বলে বেড়াচ্ছেন, আপনি নাকি পদত্যাগ করতে চাননি! প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সরকারের বিবিধ চাপের কাছে শেষমেষ আপনি নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছেন।
শ্রদ্ধেয়, আপনাকে জানার পর থেকে আমি ক্রমাগত আপনার ওপর মুগ্ধ হয়েছি। আমার চোখে ভেসে উঠেছে সেই দিঘলী গ্রামের হাটের দৃশ্য। আপনি দাঁড়িয়ে আছেন। ক্যাডেট কলেজের ভর্তি পরীক্ষায় আপনি প্রথম হয়েছেন। জামালপুরের সেই গ্রামের হাট থেকে মানুষের ভালোবাসা আর দোয়ার টাকায় আপনি মির্জাপুর ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হতে পেরেছিলেন। মেধাবী সাধারণ একজন মানুষ, এরপর ক্রমাগত আপনি অসাধারণ হয়ে উঠেছেন। আপনার ক্লাসটিচার আপনার নাম বদলে দিয়েছিলেন। আতাউর থেকে আপনি হয়ে যান আতিউর। এরপর থেকে আপনাকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি। চোখ ধাঁধানো রেজাল্ট ছিল আপনার, ক্যাডেট কলেজে কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে! আপনি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষাতে মেধা তালিকায় পঞ্চম ও নবম হয়েছিলেন। আপনি সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের সদস্য, জনতা ব্যাংক পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন, এরচেয়েও অনেক গুরুত্ব পূর্ণপদে আপনি আসীন হয়েছিলেন। আপনি যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্ণর হন তখন মনে হয়েছিল এই পদে সম্ভবত শুধু আপনাকে কিংবা সাহিত্যিক লুৎফর রহমান সরকারকেই মানায়!

আপনাকে রবীন্দ্রপ্রেমী হিসেবেও সুন্দর লাগতো; মানাতোও দারুন! নোবেল বিজয়ের পর প্রাপ্ত টাকা রবীন্দ্রনাথ রেখেছিলেন এক কৃষি ব্যাংকে। ঘটনাটা আপনার কাছে সুন্দর লেগেছিল। এ কারণে কিনা জানি না, আপনি মাত্র দশ টাকা দিয়ে কৃষকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে পারার ব্যবস্থা করেছিলেন। জানি না সেই ছোট্ট আপনার দিকে তাকিয়ে থাকা সে দিনের সেই হাটবারের  স্বপ্নবান মাটির মানুষগুলোর মুখ তখন আপনার মনে পড়ছিল কি না! আপনি বাচ্চাদের জন্য স্কুল ব্যাংকিং আর ব্যাংকের চাকরির নিয়োগ পরীক্ষায় বিসিএসের চেয়েও স্বচ্ছ পদ্ধতি অবলম্বন করতে চেয়েছিলেন। সেই আপনাকে যখন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে পদত্যাগ করতে হলো, তখন কিছু প্রশ্ন জেগেছে মনে। জানি না, এই প্রশ্নের উত্তর কখনও দেশবাসী জানতে পারবে কি না!

এক. একজন সেনাপতি কখনও তার যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে চলে যায় না। আপনি কেন বিদেশ গিয়েছিলেন? কারও-কারও কাছে এটাই একটা বিরাট প্রশ্ন! না কি একা একাই কোনও এক অজানা শত্রুর সঙ্গে বোঝাপড়া করতে গিয়েছিলেন? আবার আপনি আপনার বক্তব্যে বলছেন, আপনি প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীকে জানিয়ে গিয়েছিলেন! এত বড় একটা অঘটনের পরেও বিদেশভ্রমণে গিয়ে নিজেকে আপনার ক্লান্ত মনে হয়নি? অপরাধ বোধ জন্মায়নি? নাকি চেষ্টা করেছিলেন মেয়াদের শেষদিন পর্যন্ত গভর্নর হিসেবে টিকে থাকতে?

দুই. ব্যাংক কবিতার মতো নয়। রবীন্দ্রনাথ যে কৃষি ব্যাংকে টাকা রেখেছিলেন, সেটাই এক সময়ে দুস্থ প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। আপনি যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর তখন সোনালী ব্যাংকে (২০১২ সালে) আড়াই হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে। প্রায় একই সময়ে হলমার্ক কেলেঙ্কারির ঘটনা ঘটে এবং তিন হাজার ছয়শত কোটি টাকা লোপাট হয়। বেসিক ব্যাংকে চার হাজার কোটি টাকার কেলেঙ্কারির ঘটনা দেশময় তোলপাড় তোলে। ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতেও জনতা ব্যাংকে ২৫১ কোটি টাকার দুর্নীতি ধরা পরে। আপনার কি মনে হয় না আপনার আরও কঠোর হওয়া উচিত ছিল? তবে আপনার দুর্ভাগ্য এই যে চার হাজার কোটি টাকা কেলেঙ্কারির পর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, চার হাজার কোটি টাকা এমন বেশি কিছু না! কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে আশি কোটি টাকা লোপাটের ঘটনায় তিনি খুব বেশি সমালোচনা মুখর হয়ে উঠেছেন!

তিন. ২৬ জানুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে (?) প্রথম হামলে পড়েছিল হ্যাকার, চোর অথবা লোপাটকারীরা। শ্রদ্ধেয় আতিউর রহমান আপনি কি সেটা জানতে পারেননি? ৫ ফেব্রুয়ারি রাত সাড়ে বারটায় বাংলাদেশ ব্যাংকের সুইফটের (সুইফট হচ্ছে ব্যাংকের আর্থিক লেনদেনের বার্তা আদান প্রদানকারী আন্তর্জাতিক একটা নেটওয়ার্ক ব্যবস্থা) বার্তা ব্যবহার করে ৩৫টি অর্থ স্থানান্তরের অ্যাডভাইস পাঠানো হয়েছিল অ্যামেরিকার ফেডারেল ব্যাংক অব নিউইয়র্কে (এই ব্যাংকে বাংলাদেশের মতো অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও বড়-বড় প্রতিষ্ঠান তাদের রিজার্ভ বা সঞ্চয় জমা রাখে। এই টাকা দিয়ে বিদেশি ঋণ শোধ, কেনাকাটার দাম পরিশোধ, এলসির টাকা পরিশোধসহ আরও অনেক কিছুর লেনদেন হয়ে থাকে) ৩৫টির ভেতর ৫টি বার্তা বা পরামর্শ কার্যকর হয়ে গেলে ১০ কোটি ১০ লাখ ডলার বা ৮০৮ কোটি টাকা চলে যায় ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কাতে। আপনি কি জানতেন না এসব? জানলে কখন সেটা জানতে পারেন? জানার সঙ্গে সঙ্গে আপনি সেটা অর্থমন্ত্রী বা প্রধানমন্ত্রীকে জানাননি কেন? যদি প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েও থাকেন তাহলে তার নির্দেশনা কী ছিল? ৫ ফেব্রুয়ারির পর ২৩ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের সভা হয়েছে। তখন এই প্রসঙ্গ তোলা হয়নি কেন? ২৯ ফেব্রুয়ারি ও ১ মার্চ অডিট বোর্ডের সভা হয়েছে। তখনও প্রসঙ্গটা চেপে রাখা হয়েছিল কার স্বার্থে? শ্রদ্ধেয় ড. আতিউর রহমান আমরা কি এসব কখনও জানতে পারব না? নাকি অনেক ব্যর্থতার পরেও আপনি কারও নির্দেশ মানতে গিয়ে বলির পাঁঠা হয়েছেন?

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
ইউক্রেনের অন্তত ৭টি প্যাট্রিয়ট সিস্টেম প্রয়োজন: ন্যাটোকে জেলেনস্কি
ইউক্রেনের অন্তত ৭টি প্যাট্রিয়ট সিস্টেম প্রয়োজন: ন্যাটোকে জেলেনস্কি
শিশু হাসপাতালে তিন দিনের ব্যবধানে দুবার আগুন!
শিশু হাসপাতালে তিন দিনের ব্যবধানে দুবার আগুন!
ব্যাংককে চীনের দাবাড়ুকে হারালেন মনন
ব্যাংককে চীনের দাবাড়ুকে হারালেন মনন
ব্যয়বহুল প্রযুক্তি আর ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের এখনই সময়
এনার্জি মাস্টার প্ল্যান সংশোধনের দাবিব্যয়বহুল প্রযুক্তি আর ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের এখনই সময়
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ