X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পদ্মার ইলিশকে টেক্কা দেওয়ার চ্যালেঞ্জ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের

রঞ্জন বসু, দিল্লি
০৮ ডিসেম্বর ২০২২, ১২:৩১আপডেট : ০৮ ডিসেম্বর ২০২২, ১৯:৫৮

সপ্তাহ দুয়েক আগে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় কথাগুলো বলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বলছিলেন, ‘প্রতিবছর উৎসবের মরশুমে তার রাজ্যবাসীকে যে পদ্মার ইলিশের ভরসায় তাকিয়ে থাকতে হয়, সেদিন এবার অতীত হতে চলেছে।’ পশ্চিমবঙ্গেও প্রচুর পরিমাণে সুস্বাদু ইলিশ পাওয়া যাবে বলে সেদিন প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেদিন বলেন, ‘আমাদের রাজ্যে কোলাঘাট কিংবা ডায়মন্ড হারবারেও এখন ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ আসছে। ওপারের ইলিশের ভরসায় আর আমাদের বসে থাকতে হবে না। ডায়মন্ড হারবারে আমরা তো একটি ইলিশ গবেষণা কেন্দ্রও স্থাপন করেছি, তারা দারুণ কাজ করছে।’

খোকা ইলিশ (যাকে বাংলাদেশে জাটকা বলা হয়) ধরা বন্ধ করতে সচেতনতা বাড়াতেও জোর দেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছিলেন তিনি।

রাজ্য বিধানসভায় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই বক্তব্যের পরেই শুরু হয়েছে জোর বিতর্ক, পশ্চিমবঙ্গর পক্ষে কি আদৌ পদ্মার ইলিশকে টেক্কা দেওয়া সম্ভব? যদি গঙ্গা বা হুগলী নদীতে ইলিশের উৎপাদন (প্রোডাকশন) বাড়ানো যায়, তা কি স্বাদে-গন্ধে কখনও পদ্মার ইলিশের তুলনীয় হতে পারবে?

এই প্রশ্নটা নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের ভেতরেও বিশেষজ্ঞ বা ইলিশপ্রেমীদের মধ্যে দেখা যাচ্ছে নানা রকম অভিমত।

কলকাতায় সুপরিচিত ইলিশ গবেষক ও বিজ্ঞানী অসীম কুমার নাথ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পদ্মার ইলিশের কেন এত নামডাক, সেটা আগে আমাদের বুঝতে হবে। ইলিশ যখন বঙ্গোপসাগর থেকে পদ্মায় ঢোকে, তখন প্রথমে মেঘনার এসচুয়ারি দিয়ে ঢুকে পুরো মেঘনা পাড়ি দিয়ে তারপর পদ্মায় আসে। আর মিঠা পানিতে এতটা সময় থাকার জন্যই স্বাদে-গন্ধে অনন্য হয়ে ওঠে সেই ইলিশ।’

তিনি বলেন, ‘সমুদ্রে ইলিশের শরীরে যে ফ্যাট বা লিপিড জমা হয়, নদীতে সাঁতরানোর সময় সেই লিপিড ভেঙেই ইলিশের শরীরে তৈরি হয় পলিআনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড বা ‘পুফা’। ওমেগা থ্রি, ওমেগা সিক্স বা লিনোলেনিক অ্যাসিডের মতো এসব পুফা কিন্তু ইলিশের স্বাদ পাল্টে দেয়। সমুদ্রে ধরা ইলিশের চেয়ে তাই চাঁদপুর বা হার্ডিঞ্জ ব্রিজে ধরা ইলিশ খেতে অনেক বেশি ভালো!’

‘এখন প্রশ্ন হলো, পশ্চিমবঙ্গে সেই মানের ইলিশ পাওয়া সম্ভব কি না? আমার উত্তর হলো, হ্যাঁ সম্ভব, যদি আপনি ইলিশটাকে সেই পরিমাণ দৌড় করাতে পারেন। একই তো বঙ্গোপসাগর থেকে গঙ্গায় আসছে, কিন্তু মোহনার কাছাকাছি না ধরে আপনি যদি সেটা কয়েক শ মাইল উজানে মুর্শিদাবাদে গিয়ে ধরতে পারেন, তাহলে সেই একই স্বাদ না পাওয়ার কোনও কারণ নেই। সুতরাং পদ্মার ইলিশের স্বাদ পেতে হলে গঙ্গাতেও ইলিশকে অনেকটা ‘রান’ করাতে হবে। তবেই মিলবে সেই স্বাদ আর গন্ধ’, বলছিলেন অধ্যাপক অসীম কুমার নাথ।

পদ্মার ইলিশকে টেক্কা দেওয়ার চ্যালেঞ্জ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের

কোলাঘাটের কাছে রূপনারায়ণ নদীতে বা হুগলীর বলাগড়ে গঙ্গাতেও বেশ ভালো পরিমাণে ইলিশ ধরা পড়ে, কিন্তু সেগুলো মোহনা থেকে বড়জোর দুই শ মাইলের ভেতরে। কাজেই পদ্মার ইলিশের স্বাদ তাতে আশা করা উচিত নয় বলেই বিশেষজ্ঞদের অভিমত।

ইলিশ বিশেষজ্ঞ সুতীর্থ চ্যাটার্জি আবার মনে করিয়ে দিচ্ছেন, ফারাক্কা বাঁধ হওয়ার আগে ইলিশ একসময় পাওয়া যেত গঙ্গার মোহনা থেকে প্রায় হাজার মাইল উজানে উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদেও। ‘নেহরু পরিবারের বাসভবন আনন্দ ভবনে মতিলাল নেহরু এলাহাবাদের গঙ্গায় ধরা ইলিশ বাজার করে আনতেন বলে জানা যায়, স্বাদে-গন্ধে যা ছিল অতুলনীয়!,’ জানাচ্ছেন তিনি।

কিন্তু ফারাক্কায় বাঁধ দেওয়ার পর ভারতে ইলিশের আর উজান বেয়ে অতটা দৌড় দেওয়ার রাস্তাই নেই। তাই পদ্মার সঙ্গে তার টেক্কা দেওয়াও কঠিন।

বিধানসভায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর একটা কথাও মেনে নিয়েছেন, বাংলাদেশে ইলিশ উৎপাদনে বিরাট সাফল্য পেয়েছে জাটকা ধরা বন্ধ করেই। কিন্তু বাস্তবতা বলছে, পশ্চিমবঙ্গ সে কাজে চূড়ান্ত ব্যর্থ। তাই রাজ্যে ইলিশের উৎপাদনও তেমন বাড়ছে না। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য বলছেন, ‘এখানে শুধু আইন করে কিছু হবে না। মানুষকে আগে সচেতন হতে হবে।’

বিজ্ঞানী অসীম কুমার নাথ মনে করেন, ‘আইনও তো দরকার। বাংলাদেশ জালের নেটের সাইজ বেঁধে দিয়েছে ১১০ মিলিমিটার, যাতে ছোট ইলিশ তা গলে বেরিয়ে যেতে পারে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে আপনি যদি ফানেলের মতো দেখতে বেহুন্দি জাল, ৪০ মিমির নেট জাল ব্যবহার চালিয়ে যান, তাহলে কীভাবে প্রোডাকশন বাড়বে? পাশাপাশি ভিজিল্যান্স বা কড়াকড়িও অনেক বাড়াতে হবে, জেলেরা যখন খোকা ইলিশ ধরা বন্ধ রাখবেন, তাদের বাংলাদেশের মতো বিনা পয়সায় চালডালের ব্যবস্থা করতে হবে।’

তবে পশ্চিমবঙ্গে উৎপাদন যতই বাড়ুক, সে রাজ্যের ইলিশ কখনোই পদ্মা-মধুমতীর ইলিশের মতো হবে না বলে ওই রাজ্যেও অনেকেই বিশ্বাস করেন।  

লেখক-গবেষক দিগেন বর্মন তার ‘ইলিশ পুরাণ’ বইটি লেখার সময় কলকাতায় বহু ইলিশপ্রেমী শিল্পী-সাহিত্যিকের সঙ্গে কথা বলেছিলেন, অনেক নথিপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করেছিলেন।

তিনি বলেন, ‘কলকাতা বিশারদ রাধাপ্রসাদ (শাঁটুল) গুপ্ত বা লেখক কমলকুমার মজুমদারের স্থির বিশ্বাস ছিল গঙ্গাতেই আসলে শ্রেষ্ঠ ইলিশ হয়, যদিও তা সংখ্যায় কম। আর ভালো জিনিস আসলে পরিমাণে কমই তৈরি হয়, তা কে না জানে!’

প্রয়াত সাহিত্যিক বুদ্ধদেব গুহ কিংবা ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ সিনেমার অভিনেত্রী রূপা গঙ্গোপাধ্যায় আবার পদ্মার ইলিশের ‘ডাই হার্ড ফ্যান’– তারা মানতেন না (বা মানেন না) তার তুলনীয় কোনও ইলিশ আর কোথাও ধরা যেতে পারে।

লেখিকা কল্যাণী দত্ত তার স্মৃতিকথায় আবার কলকাতার বাগবাজার ঘাটে ধরা ইলিশের প্রবল সুখ্যাতি করেছেন। তার মতে, ‘ওর চেয়ে খাসা জিনিস ভূভারতে আর কোথাও হতেই পারে না।’

ফলে ইলিশের জন্য ‘ওপারের ওপর আর নির্ভর করতে হবে না’– এ কথা বলে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়আসলে বাঙালির পুরনো একটি বিতর্ককেই উসকে দিয়েছেন। পদ্মার টেক্কা দিতে পারুক বা না পারুক, ইলিশের লালন-পালনে নতুন করে চাপে পড়েছে ভারতের গঙ্গা!

/এনএআর/
সম্পর্কিত
ভারতে দ্বিতীয় দফায় ভোটপ্রচণ্ড গরমেও ভোটকেন্দ্রে ভোটার, ভোটদানের হার ৬১ শতাংশ
জিম্মি মুক্তির বিষয়ে আন্তরিক হলেও গাজায় আগে যুদ্ধবিরতি চায় হামাস
গাজার ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কারে ১৪ বছর লাগতে পারে: জাতিসংঘ
সর্বশেষ খবর
মেলা থেকে অস্ত্রের মুখে দুই নারীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ
মেলা থেকে অস্ত্রের মুখে দুই নারীকে তুলে নিয়ে ধর্ষণ
তীব্র গরমে সিল্কসিটি ট্রেনে আগুন
তীব্র গরমে সিল্কসিটি ট্রেনে আগুন
দ্বিতীয় বিয়ে করায় স্বামীর অঙ্গহানি করলেন স্ত্রী
দ্বিতীয় বিয়ে করায় স্বামীর অঙ্গহানি করলেন স্ত্রী
প্রচণ্ড গরমেও ভোটকেন্দ্রে ভোটার, ভোটদানের হার ৬১ শতাংশ
ভারতে দ্বিতীয় দফায় ভোটপ্রচণ্ড গরমেও ভোটকেন্দ্রে ভোটার, ভোটদানের হার ৬১ শতাংশ
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি