X
সোমবার, ২৩ জুন ২০২৫
৯ আষাঢ় ১৪৩২
বিশ শতকের ইতালির গল্প

শতক হতে ষোলো, একুশ, আটাশ, সাঁইত্রিশ ।। জর্জিও ম্যাঙ্গানেলি

অনুবাদ : মাহীন হক
০২ এপ্রিল ২০২৪, ১৪:৩৩আপডেট : ০২ এপ্রিল ২০২৪, ১৪:৩৩

ষোলো

পরনে লিনেনের স্যুট, লোফার জুতা আর ছোট মোজা থাকা লোকটা ঘড়ির দিকে তাকায়। আটটা বাজতে দুই মিনিট বাকি। সে ঘরে, বসে আছে, খানিক অস্বস্তিতে, একখানা খাড়া ও কঠিন চেয়ারের শেষ কোনায়। সে একা। দুই মিনিটের মধ্যে—এতক্ষণে তা নব্বই সেকেন্ডও হবে না—তার শুরু করতে হবে। সত্যি সত্যিই প্রস্তুত হওয়ার জন্য সে একটু আগেই উঠে গিয়েছিল। খুবই সাবধানে মুখ ধুলো সে, মনোযোগ সহকারে প্রস্রাব করে নিল, ধৈর্যের সহিত খালি হলো, সতর্কভাবে দাড়িগোঁফ কামালো। জাঙিয়াটাও নতুন, এর আগে কক্ষনো পরা হয়নি, এবং গায়ের স্যুটটা এই সকালের জন্যই মাপ নিয়ে বানানো হয়েছিল আরও এক বছর আগে। পুরো এই এক বছরে তার সাহস হয়নি। প্রায়ই সে ভোরে ঘুম থেকে উঠে যেত—সাধারণত, তার ওপর, লোকটা ভোরেই ওঠে—কিন্তু যে মুহূর্তে সব প্রস্তুতি সারা হয়ে যেত, চেয়ারে বসত সে, ঠিক তখনই সাহস হারিয়ে ফেলত। কিন্তু এখন সে শুরু করতে যাচ্ছে। আটটা বাজতে আর পঞ্চাশ সেকেন্ড বাকি। সত্যি বলতে গেলে, শুরু করতেই হবে এমন কিছুই নেই। আরেক দিক দিয়ে দেখলে, সে সবকিছুর শুরুয়াতের মুখে দাঁড়িয়ে আছে। সে যাই হোক, এমন কিছুই নেই যা তাকে ‘করতে হবে’। তাকে স্রেফ আটটা থেকে নয়টা অবধি পৌঁছতে হবে। আর কিছুই না : কেবল একটা ঘণ্টার বিস্তার পার হয়ে যেতে হবে, যা সে এর আগে অসংখ্যবার করেছে, কিন্তু এবার তাকে পার করতে হবে সরল ও বিশুদ্ধ সময়, আর কিছুই না। আটটা বেজে ইতোমধ্যে পার হয়ে গেছে, এক মিনিটের একটুখানি বেশি। সে শান্ত আছে, তবু শরীরে হালকা এক কাঁপুনি জমে আসে তার। সপ্তম মিনিটে তার হৃদকম্পন ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। দশম মিনিটে তার কণ্ঠ আটকে আসে, আর তার বুক আতঙ্কের প্রান্তে দাঁড়িয়ে ধুকপুক করতে থাকে। পনেরো মিনিট আসতে আসতে তার গোটা শরীর ঘামে ভিজে আসে, প্রায় তাৎক্ষণিকভাবে; তারও তিন মিনিট পরে তার মুখের থুতু শুকিয়ে যায়, ঠোঁট বিবর্ণ হয়ে আসে। ২১ মিনিটে তার দাঁতগুলো ঠকঠক করতে শুরু করে, যেন বা তারা হাসছে; অক্ষিগোলক প্রসারিত হয়ে আসে, চোখের পালকের স্পন্দন থেমে যায়। গুহ্যদ্বার প্রসারিত হয়ে যায়, সমস্ত শরীরের লোম দাঁড়িয়ে যায়, নিথর শিহরণে সে ঠায় বসে থাকে। তারপর আচানক, তার হৃদস্পন্দন ঝিমিয়ে পড়ে, দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসে। পঁচিশ মিনিটে, একটা প্রচণ্ড কাঁপুনি তাকে বিশ সেকেন্ড ধরে ঝাঁকাতে থাকে; আর এই কাঁপুনি থামার পর তার মধ্যচ্ছদা নড়তে শুরু করে, ও একসময় তার হৃৎপিণ্ডটাকে জাপটে ধরে। অশ্রু ঝরে, যদিও সে কাঁদে না। একটা প্রচণ্ড হুংকারে তার কানে তালা লেগে যায়। লিনেন স্যুট পরিহিত ভদ্রলোকটা চাচ্ছেন সবকিছু বুঝিয়ে বলতে, কিন্তু আটাশতম মিনিট তার কপালে প্রচণ্ড একটা আঘাত হানে, আর সে চেয়ার থেকে পড়ে যায়, এবং টু-আওয়াজ না করে জমিনে পতনমাত্র সে গুঁড়ি গুঁড়ি হয়ে মিলিয়ে যায়।

একুশ

প্রতি সকালের জেগে ওঠার পর—অনিচ্ছাসত্ত্বেও এ জেগে ওঠা, যাকে হয়তো আলসেমিও বলা চলে—এই ভদ্রলোক চটজলদি গোটা দুনিয়ার একটা ছক কষে নেয়। কিছুকাল আগেই সে টের পেয়ে গেছে যে প্রত্যেকবার তার ঘুম ভাঙে মহাবিশ্বের ভিন্ন ভিন্ন বিন্দুতে, যদিও পৃথিবী, অর্থাৎ যে গোলকটাতে সে বাস করে, বাহ্যিকভাবে সেটা বিলকুল বদলায় না। বাচ্চাকালে সে মোটামুটি নিশ্চিত ছিল যে মহাশূন্য দিয়ে যাবার পথে পৃথিবী মাঝে মাঝে নরকের খুব ধার ঘেঁষে কিংবা এমনকি নরকের মধ্যদিয়েও চলে যায়, কিন্তু স্বর্গের মধ্যদিয়ে যাওয়ার অনুমতি তার নেই, কেননা সে অভিজ্ঞতার পর দুনিয়াবি সকল ঘটনাক্রমকে অসম্ভব, অহেতুক ও অর্থহীন মনে হবে। সুতরাং, যেভাবেই হোক স্বর্গ ও পৃথিবীকে আলাদা থাকতে হবে, যেন স্রষ্টার অমোঘ ও বোধাতীত পরিকল্পনায় কোনো আঘাত না আসে। এমনকি এখনও—যদিও এখন সে একজন প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষ ও তার নিজেরই একটা গাড়ি আছে—তবু ছোটবেলার সেই ধারণাটার কিছু অংশ তার মধ্যে রয়ে গেছে। এতদিনে অবশ্য সে ধারণাটার ওপর থেকে ধর্মীয় আবরণটা সরিয়ে নিয়েছে, এবং তার প্রশ্নটা এখন আরও রূপকার্থে এবং খানিকটা বিচ্ছিন্ন : সে জানে যে যখন সে ঘুমায় তখনও গোটা পৃথিবী ছুটছে—যেমনটা স্বপ্নে দেখা যায়—এবং প্রতি সকালে পৃথিবীর সবগুলো গুটি আবার বোর্ডে সাজানো হয়ে যায়, তারা কোনো খেলার অংশ হোক বা না হোক।

এই পালাবদলের মানেটা ঠিক কী তা বোঝার কোনো দাবি সে করে না, সে শুধু জানে যে সময়তে সে টের পায় এক বিশাল শূন্যতার উপস্থিতি, উত্তুঙ্গ চূড়ার টান, অথবা কখনো, সুদীর্ঘ প্রান্তর যেখানে সে গড়াগড়ি খেতে চায়—কখনো কখনো নিজেকে সে দেখতে পায় একটা বর্তুল মহাজাগতিক সত্তা হিসেবে—শুধু ঘুরছে আর ঘুরছে। আরও কিছু মুহূর্ত আছে, ঘাসেদের বিভ্রান্ত প্রতীতির, অথবা খানিকটা উদ্দীপনা ও অস্বস্তির সহিত গুটিকয় সূর্যের দ্বারা ফোখ ঝলসে যাওয়ার, যেসব সূর্য সবসময় খুব একটা বন্ধুবৎসল নয়। আবার অন্য কখনো, সে স্পষ্ট শুনতে পায় ঢেউয়ের শব্দ, যারা আসে ঝড় কিংবা প্রশান্তি থেকে; আর কখনো কখনো নির্মমভাবে তাকে মনে করিয়ে দেওয়া হয় পৃথিবীতে তার অবস্থান : যেমন, যখন কোনো নিষ্ঠুর ও নিবিষ্ট চোয়াল তাকে ঘাড় ধরে নিয়ে যায়, যেমনটা তার ক্লান্ত ও অসহায় পূর্বপুরুষেরা অতীতে অগণিতবার ধরা পড়েছে কোনো অদেখা জানোয়ারের দাঁতের মাঝখানে। কিছুদিন আগেই সে জেনেছে যে কেউ কোনোদিন নিজের ঘরে ঘুম থেকে ওঠে না : সে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে যে ঘর বলতে কিছু নেই, যে দেয়াল ও পর্দা হলো নিছক মায়া, একটা ভণ্ডামি; সে জানে সে শূন্যতার ওপর ঝুলে আছে; যে আর প্রত্যেকের মতো সেও দুনিয়ার কেন্দ্রবিন্দু, যেখান থেকে অসীমসংখ্যক অসীমতা বিচ্ছুরিত হয়। সে জানে এই বিভীষিকাকার সামনে টিকে থাকা তার পক্ষে সম্ভব না, আর এমনকি এই মহাশূন্যতা কিংবা নরক, এসবও নিছক কিছু উদ্ভাবন, তাকে বাঁচানোর জন্য।

আটাশ 

ভোরের মেঘেদের উদ্ভট ও অর্থহীন নকশা দেখে উত্তেজিত হয়ে সম্রাট হাজির হলেন কর্নওয়ালে। কিন্তু যাত্রাপথ ছিল এতটাই বন্ধুর, দুঃসহ ও কষ্টসাধ্য, যে পৌঁছতে পৌঁছতে তিনি কোনখান থেকে রওনা করেছিলেন সেটাই প্রায় ভুলে যেতে বসলেন। তিনজন সহচর ও একজন ভৃত্যকে সাথে নিয়ে তিনি বের হয়েছিলেন। বিদ্যুৎচমকে শিউরে ওঠা এক রাতে সম্রাটের সাথে মরিয়া এক আলোচনার পর, প্রথম সহচরটা এক বেদের সাথে পালিয়ে যায়। দ্বিতীয় সহচর মহামারির প্রেমে পড়ে যায়, আর মৃত্যুর মুখে পড়ে দ্রুত ক্ষয়ে যেতে থাকা গ্রামটা ছেড়ে আসার ব্যাপারে কারও কোনো কথাই সে শুনল না। তৃতীয়জন পরবর্তী সম্রাটের সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়ে তাকে হত্যা করার চেষ্টা করে। ফলে আমাদের সম্রাট বাধ্য হন তাকে মৃত্যুদণ্ডের আসামি গণ্য করতে, এবং নিজের কেনি আঙুল দিয়ে তার গলা কাটার অভিনয় করেন; তারপর দুজনেই হেসে একে অপরের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নেয়। শেষমেশ ভৃত্যটাই সম্রাটের সাথে থেকে গেল। দুজনেই ছিল নীরব, বিষণ্ন দুজন মানুষ; দুজনেই জানত যে তারা এমন এক লক্ষ্যের পিছনে ছুটছে যা অসম্ভব না হলেও অহেতুক; এবং তাদের দুজনেরই প্রচণ্ড অস্পষ্ট কিছু আধিবিদ্যক ধারণা ছিল, এবং যখনই তারা কোনো মন্দির, গির্জা বা মঠের সামনে এসে পৌঁছত, তারা কখনোই তার ভিতরে প্রবেশ করত না, কেননা উভয়েই নিশ্চিত ছিল, যদিও ভিন্ন ভিন্ন কারণে, সে এসব জায়গায় পাওয়া যাবে কেবল মিথ্যা, অনিশ্চয়তা ও ভ্রান্তি। কর্নওয়ালে পৌঁছানোর পর সম্রাট নিজের অস্বস্তি লুকালেন না : ভাষাটা তিনি জানতেন না, তিনি বুঝছিলেন না তাকে কী করতে হবে, তার মুদ্রাগুলো খুব সতর্কভাবে খুঁটিয়ে দেখছিল উৎসুক গ্রামবাসীরা। প্রাসাদে চিঠি পাঠাতে চেয়েছিলেন তিনি, কিন্তু ঠিকানা মনে পড়ছিল না। সম্রাটই একমাত্র ব্যক্তি যিনি নিজের ঠিকানা ভুলে যেতে পারেন, এমনকি ভুলে যাওয়াই তার কর্তব্য। ভৃত্যের এমন কোনো সমস্যা হলো না : অগোছাল এই সম্রাটের সাথে থাকাটাই ছিল তার জন্য নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার একমাত্র উপায়। সময়ের সাথে সাথে কর্নওয়াল বণিক ও পর্যটন বাজারের দিকে এগোল। এবং ওহায়ো, সমরখন্দের এক ইতিহাসের প্রফেসর সম্রাটের অবস্থান চিহ্নিত করেন : ততদিনে তিনি পানশালায় বসে বসে দিন কাটাচ্ছেন, আর ফাইফরমাশ খাটছে তার মিতভাষী ভৃত্য। সম্রাট যে কর্নওয়ালে আছেন সে খবর খুব দ্রুত ছড়িয়ে গেল, এবং যদিও কেউই জানত একটা সম্রাট আসলে কী চিজ, অথবা দুনিয়ার কোন প্রান্তের তিনি, তবু কর্নওয়ালের স্থানীয়রা এতে বেশ খুশিই হলেন। বিনামূল্যে তাকে মদ দেওয়া হলো। তার একটা মুদ্রা নিয়ে সে গ্রামের কুলচিহ্নের বর্মের মধ্যে রাখা হলো। তার ভৃত্যকেও একটা সম্মানিত পদবি দেওয়া হলো। আর সম্রাট, যিনি এতদিনে সেখানকার স্থানীয় ভাষা কিছুটা রপ্ত করে নিয়েছে, তার বিয়ে ঠিক হয়ে রয়েছে এক বিষণ্ন যোদ্ধার রূপসী কন্যার সাথে। সম্রাটের হাতে এখন একটা ঘড়ি আছে এবং রোজ তিনি আপেলের পাই খান; সবাই বলাবলি করছে যে আগামী নির্বাচনে তিনি উদারপন্থিদের পক্ষ থেকে প্রার্থী হবেন; এবং সম্মানের সাথে হারবেন।

সাঁইত্রিশ

যে মহিলার জন্য সে অপেক্ষা করছিল সে অ্যাপয়েনমেন্টটাতে আসেনি। সে, যেনতেন—যে লোকটা নিজের বয়সের তুলনায় বেশিই জোয়ান সেজে এসেছে—সে তেমন একটা গায়ে মাখল না। আলবৎ, তার একটুও গায়ে লাগেনি। সে যদি আরেকটু খেয়াল করত, তাহলে সে স্বীকার করত যে হালকা কিন্তু কিন্তু নিশ্চিত একটা অস্বস্তি তাকে চেপে ধরছিল। নারীটি দেখা করতে কেন আসেনি সে ব্যাপারে সে বেশকিছু তত্ত্বটত্ত্ব বানিয়ে নিতে পারে। নিজের মনের মধ্যে এসব কারণ সাজাতে থাকাকালেও সে সেই জায়গাটা থেকে চলে যায় না, বরং হালকা করে এক কোণে সরে দাঁড়ায়, যেন বা সেটা একটা গুহা যেখানে মেয়েটার একটা অংশ, কিংবা সমস্তটাই ঢাকা পড়ে আছে। হয়তো ও ভুলে গেছে। যেহেতু নিজেকে সে একজন অগুরুত্বপূর্ণ লোক বলে ভাবতেই পছন্দ করে, ফলে এই অনুমানটা তার পছন্দ হয়। মেয়েটাও তাহলে ধরে ফেলেছে যে একজন ফালতু মানুষ, তার সাথে দেখা হওয়াটা পুরোপুরি আকস্মিক, ফলে তাকে মনে রাখার একমাত্র উপায়ই হলো ভুলে যাওয়া। হয়তো খামখেয়ালিতেই সিদ্ধান্তটা নিয়েছিল ও—অথবা হয়তো বেশ বিরক্তির সাথেই—যেহেতু মেয়েটা একটু স্বেচ্ছাচারী ধরনের। সে ক্ষেত্রে এই সাক্ষাৎটা ওর কাছে বেহুদা মনে হয়েছিল, একটা তুচ্ছ অহেতুকতা, নিশ্চয়ই মনের কোনো টান ছিল না, অথচ জীবন থেকে, কিংবা অন্তত জীবনের কয়েকটা দিন থেকে পুরোপুরি বাদ দিয়েও দেওয়া যাচ্ছিল না। হয়তো সময়টা ভুল করে ফেলেছিল, আর ঠিক এই মুহূর্তে সে টের পায়, লোকটা নিজেই, যে সময়ের ব্যাপারে সে নিজেও নিশ্চিত না। কিন্তু এই উপলব্ধি তাকে বিচলিত করতে পারে না : সময়টা অনিশ্চিত হওয়াই তার কাছে স্বাভাবিক বলে মনে হয়, কেননা নিজেকে সে একজন না-আসা নারীর সাথে দেখা করার চিরন্তন ওয়াদায় আবদ্ধ একজন মানুষ হিসেবে দেখে। নাকি জায়গাটা নির্ধারণেই কোনো গুবলেট হয়েছে? সে হাসে। তার মানে কি দাঁড়ায় নিজেকে সে মেরামত করে নিচ্ছে, লুকিয়ে পড়েছে গোপন কোনো ডেরায়, এবং তার অনুপস্থিতির আদত মানে হলো ভয়, পলায়ন কিংবা এমনকি একটা খেলা, অথবা তলব? নাকি তাদের দেখা করার কথা ছিল আসলে সবখানে, সুতরাং দুজনের কেউই অপরজনকে ফেলে রাখেনি, সময়েও না স্থানেও না? সুতরাং তাকে উপসংহার টানতে হলো যে দেখা করার নির্ধারিত সময়ের মান রাখা তো হয়েছেই, সেইসাথে তা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পালন করা হয়েছে। তার মৃদু স্বস্তির অনুভূতি ততক্ষণে আনন্দের পুলকে পরিণত হতে শুরু করেছে। সে সিদ্ধান্ত নেয়, যে তাদের দেখা হওয়াটা ততক্ষণে এতটাই সম্পূর্ণরূপে ঘটে গেছে যে এখন আর নিজেকে তার এর চেয়ে শুদ্ধতর কিংবা মহত্তর কিছু দেওয়ার নেই। চট করে সে দেখা করার জন্য নির্ধারিত জায়গাটার দিকে পিঠ ফিরিয়ে কোমলভাবে বিদায় জানায় সে নারীটিকে যার সাথে দেখা করার জন্য সে প্রস্তুতি নিচ্ছে। 


জর্জিও ম্যাঙ্গানেলি (১৯২২-১৯৯০)

ম্যাঙ্গানেলি প্রথাবদ্ধ বয়ান ও বাস্তববাদকে ঘৃণা করতেন। ১৯৬৩ সালে পালের্মোতে প্রতিষ্ঠিত ‘গ্রুপ্পো ৬৩’ নামক নব্য আঁভা-গার্দ সাহিত্য আন্দোলনের সাথে তিনি যুক্ত ছিলেন। বুদ্ধিজীবিতার রীতিবদ্ধ বয়ান ও কার্লো কাসোলার মতো লেখকদের যুদ্ধপরবর্তী দর্শনের বিরুদ্ধে গিয়ে এ দলটি মনোযোগ দিয়েছিল জোরালো সাহিত্যগুণ ও নিরীক্ষামূলক লেখার দিকে। ম্যাঙ্গানেলির জন্ম মিলানে। মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ১৯৪৪ সালে পার্টিজান যুদ্ধে যোগ দেন। এক বছরের মধ্যেই তিনি ধরা পড়েন ও মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন, কিন্তু শেষে রাইফেল দিয়ে মারার পর তার জল্লাদ তাকে ছেড়ে দেন। সাহিত্যজগতে পদার্পণ করেন হেনরি জেমসের ‘কনফিডেন্স’ গ্রন্থটি অনুবাদের মাধ্যমে। এছাড়াও তিনি অনুবাদ করেছেন টি এস এলিয়ট, এডগার অ্যালান পো ও ডব্লিউ বি ইয়েটসের লেখা। বেশকিছু প্রকাশনা সংস্থার সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছেন এবং রোমের সাপিয়েঞ্জা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবেও নিয়োজিত ছিলেন, কিন্তু খুব শিগগিরই সে জগৎ থেকে তার মন উঠে আসে। ঘুরতে খুব ভালোবাসতেন এবং ভারতের ব্যাপারে লিখেছেনও বিস্তর। বহু বছর ইয়ুংয়ের পদ্ধতিতে মনোবিশ্লেষণ করেছেন। মায়ের সাথে খুব জঘন্য সম্পর্ক ছিল তার, এবং লেখার মধ্যেও বিভিন্ন মিথিক আদিরূপ জায়গা করে নিয়েছে। নিজের মনোবিশ্লেষণের নোটগুলো থেকেই নিজের প্রথম বই, হিলারোট্র‍্যাজেডিয়া লেখার প্রেরণা পান। বইটা ভাষার দিক দিয়ে বেশ অলংকারবহুল, সোজাসাপটা এক স্বগতোক্তি। বইটা তার মায়ের মৃত্যুর পর প্রকাশিত হয়, যখন তার নিজের বয়স চল্লিশের বেশি। শতক (ইংরেজিতে প্রকাশিত হয় সেঞ্চুরিয়া : ওয়ান হানড্রেড ওরোবোরিক নভেলস নামে) বইটি ১৯৭৯ সালে ভিয়ারেজ্জিও পুরস্কার পায়। বইটিতে একশটি অত্যন্ত ছোট্ট কিন্তু অন্তর্দাহপূর্ণ ও মর্মভেদী স্থান পেয়েছে। বোকাচ্চিওর ডেকামেরনেও একই পরিমাণ লেখা ঠাঁই পেয়েছে। প্রতিটি গল্প বেশ দুর্বোধ্য ও নির্মম, যেন কোনো চূড়ার প্রান্তে টানটান ঝুলছে। প্রতিটি অংশের স্বাদ খুব ধীরেসুস্থে নিতে হবে, তাদের জটিল প্রকৃতির কারণে সবগুলো একবারে গিলে ফেলা সমীচীন হবে না। এখানে তার কিছু গল্পের নজির রাখা গেল, যেগুলো বহন করে পরিশুদ্ধ পরিমিতিবোধ, নিরীক্ষণবোধের ও তার আঙ্গিকের পরিচয়, যা একই সঙ্গে সুবিন্যস্ত ও দুঃসাহসী।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
জাতীয় ঈদগাহে ঈদের প্রধান জামাত অনুষ্ঠিত
অপ্রাপ্তির মধ্যেও ঈদের আনন্দ খোঁজেন তারা
ঈদে পর্যটক বরণে প্রস্তুত চট্টগ্রামের বিনোদনকেন্দ্রগুলো
সর্বশেষ খবর
এটা শুধু সিনেমা নয়, দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র: শাকিব খান
এটা শুধু সিনেমা নয়, দেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র: শাকিব খান
বেনাপোল কাস্টমস হাউজে কর্মকর্তাদের ফের ‘কলমবিরতি’
বেনাপোল কাস্টমস হাউজে কর্মকর্তাদের ফের ‘কলমবিরতি’
বিশ্বব্যাপী মার্কিন নাগরিকদের জন্য নিরাপত্তা সতর্কতা জারি
বিশ্বব্যাপী মার্কিন নাগরিকদের জন্য নিরাপত্তা সতর্কতা জারি
আজও শ্রম ভবনে অবরুদ্ধ কারখানা মালিক, আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা
আজও শ্রম ভবনে অবরুদ্ধ কারখানা মালিক, আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা
সর্বাধিক পঠিত
ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র সরবরাহে প্রস্তুত একাধিক দেশ: রাশিয়া
ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র সরবরাহে প্রস্তুত একাধিক দেশ: রাশিয়া
কর ফাঁকি: মৌসুমী-ফারিয়া-সাবিলা নূরসহ ২৫ তারকার ব্যাংক হিসাব জব্দ
কর ফাঁকি: মৌসুমী-ফারিয়া-সাবিলা নূরসহ ২৫ তারকার ব্যাংক হিসাব জব্দ
আমরণ অনশনের হুঁশিয়ারি আন্দোলনকারীদের, বৈঠক করবেন আসিফ নজরুল
আমরণ অনশনের হুঁশিয়ারি আন্দোলনকারীদের, বৈঠক করবেন আসিফ নজরুল
এক্সিম ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত এমডি আখতার হোসেনের পদত্যাগ
এক্সিম ব্যাংকের ভারপ্রাপ্ত এমডি আখতার হোসেনের পদত্যাগ
লালমনিরহাটে মহানবীকে কটূক্তির অভিযোগে সেলুনের কর্মী বাবা-ছেলে আটক
লালমনিরহাটে মহানবীকে কটূক্তির অভিযোগে সেলুনের কর্মী বাবা-ছেলে আটক